এস্কেলেটর
-
খুব হালকা ঘড়ঘড় শব্দ করে এস্কেলেটরটা ক্রমাগত চলছিল। এই চলমান কালো রঙের তীক্ষ্ণ সিঁড়িগুলো দেখলে সুপ্রিয়ার মাথা কেমন ঝিমঝিম করে। দুহাতে দুটো বড় ব্যাগ, কাঁধে ঝোলানো বড় পার্স, বেশ কয়েকবার সাহস করে এগিয়ে পা রাখতে রাখতেও ভয়ে পিছিয়ে গেলো সে। এস্কেলেটর থেকে হওয়া অনেক দুর্ঘটনার কথা শুনে শুনে ভয়টা আরও মনে চেপে বসে আছে।
এই শপিং মলটা নতুন। বেশ ঝকঝকে, বিশাল। প্রথম বার এসেছে সুপ্রিয়া। সুদীপ্ত শপিং মলের গেটের কাছে নামিয়ে দিয়ে গেছে। ঘণ্টা দুয়েক বাদে আসবে তাকে নিতে। ততক্ষণে তাকে সেরে নিতে হবে কিছু পুজোর বাজার। গ্রাউন্ড ফ্লোরের একটি দোকানে কিছু ভালো শাড়ি পেয়ে গেলো। ঘড়ি দেখল সুপ্রিয়া বেশ অনেকটা সময় লেগে গেছে শাড়ি বাছতে, কিনতে। আর চল্লিশ মিনিটের মধ্যে বাকি কেনা কাটা শেষ করতে হবে। সুদীপ্ত ফোন করলেই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। ও অপেক্ষা করে না, বড্ড রাগারাগি করে। কয়েকটা ভালো কুর্তি, কিছু ইমিটেশন গয়না কিনবার ইচ্ছা ছিল সুপ্রিয়ার। শাড়ির দোকানের লোকটা বলল সেকেন্ড ফ্লোরে চলে যান। সেখানে দিবা’জ ব্র্যান্ডের সেল চলছে। ‘সেল’ কথাটা খুব টানে। তাই পা বাড়াল দোকানের দিকে। শাড়ির দোকানের সামনেই এস্কেলেটর। সেকেন্ড ফ্লোরে যাবার জন্য সিঁড়ি খুঁজছিল সুপ্রিয়া। কোথাও দেখতে পেলো না। একজন বলল সিঁড়ি একেবারে পিছনের দিকে, অনেকটা হাঁটতে হবে। সময় কম। এস্কেলেটরের হ্যান্ডেরেলে বেশ কয়েকবার হাত রেখে সরে গেলো সে। ভয় করছে। খানিক বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ।
জীবনে অনেকগুলি ভয় আজও কাটিয়ে উঠতে পারলো না সুপ্রিয়া। তার মধ্যে বিশেষ করে এই এস্কেলেটর, লিফট আর মেট্রো ট্রেন। লিফটে ঢুকলেই তার দম বন্ধ হয়ে আসে। মেট্রো ট্রেনে সে একা যাবার কথা ভাবলেই মনে হয় সে হারিয়েই যাবে। অনলাইন ব্যাঙ্কিং, এটি-এম থেকে পয়সা তোলা ইত্যাদি করতে সে কোনদিনই সাহস পায় না। আজকাল ছেলেও এই নিয়ে বেশ বকাবকি করে।
বয়স পঞ্চাশ ছুঁয়েছে। একসময়ের ছিপছিপে, টানটান ফর্সা শরীরে এখন প্রচুর মেদ, ত্বক জৌলুস-হীন, মাথার পাতলা চুল সাদায় কালোয়, গভীর আয়ত চোখ দুটোর নিচে কালিমা, চোখের কোণে দৃশ্যমান বলিরেখা সব মিলিয়ে সুপ্রিয়ার চেহারায় বয়স স্পষ্ট জানান দেয় অথচ মনের বয়স বাড়েনি। সেই ছোটোবেলার ভীতু, বোকা মেয়েটা মনের ভিতরে কোথাও আজও ঘাপটি মেরে বসে আছে। দীর্ঘ পঁচিশ বছরের তার বিবাহিত জীবন, ছেলে এখন চাকরি করছে তবুও সুদীপ্ত তাকে এখনও একলা ছাড়ে না। সারাটা জীবন মোমের পুতুলের মতোই রয়ে গেলো সে। এখনও কোথাও যেতে হলে হয় সুদীপ্ত যাবে অথবা ছেলে। চাকরি সূত্রে ছেলে অন্য শহরে তাই এখন সুদীপ্তই একমাত্র ভরসা।
মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে সুপ্রিয়া। নয়াদিল্লী কালীবাড়ির পুজো প্যান্ডেলে তাকে দেখে তার শাশুড়ি সুজাতা মিত্র একনজরে পছন্দ করেছিলেন। কলেজের থার্ড ইয়ারে তখন সুপ্রিয়া। মিত্ররা কলকাতার বনেদি পরিবার। সেই বনেদিপনার সেইসময় কিছু অবশিষ্ট না থাকলেও মেজাজ সবার সেইরকমই রয়ে গেছে। শ্বশুরমশাই উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরে। সুদীপ্ত অ্যাডভোকেট। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সুপ্রিয়া। সুপ্রিয়ার মা বাবা এই ধরণের সম্বন্ধ পেয়ে গদগদ হয়ে উঠেছিলেন। বিয়ে হয়ে গেলো ফাইনাল পরীক্ষার পরই । বিয়ের পর জোরবাগের প্রশস্ত সরকারি বাংলোয় উঠেছিল সুপ্রিয়া। রাশভারী শ্বশুরমশাই, ভারিক্কি চেহারার শাশুড়িকে প্রথম দিন থেকেই ভয় পেতে শুরু করেছিল সুপ্রিয়া। পড়াশোনা ছাড়া অনেক কিছু করার ছিল সুপ্রিয়ার, বিশেষত ক্লাসিকাল মিউজিক শেখার ইচ্ছে ছিল প্রবল । শাশুড়ি একদিন পরিষ্কার জানালেন এই বাড়ির মেয়েরা স্টেজে বসে গান গায় না। সুপ্রিয়া জেনে গেলো এই বাড়ির মেয়ে,বউদের অনেক কিছুই বারণ। তারা বাজারে দাঁড়িয়ে ফুচকা খায় না, বৃষ্টি এলে ছাদে উঠে ভেজে না, গলা ছেড়ে গান করে না, পাড়া বেরায় না, বেশি কথা বলে না, অযথা বাড়ি থেকে বের হয় না। এরপর ছেলে কোলে এলো। সংসার, সন্তান নিয়ে পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে গেলো সুপ্রিয়া। শ্বশুর, শাশুড়ি আজ আর নেই। তারাও নয়ডায় বাড়ি করে উঠে এসেছে বহু বছর হল। কিছু অদ্ভুত, অলিখিত নিয়ম তবুও এই পরিবারে রয়ে গেছে। এখনও মাঝে মাঝেই সুদীপ্তর চোখে, গলার শব্দে শাশুড়িকে দেখতে পায়, শুনতে পায় সুপ্রিয়া। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় তার। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।
সুপ্রিয়াকে এভাবে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটি কমবয়সী মেয়ে এগিয়ে এলো। হেসে বলল, ‘আন্টি সেকেন্ড ফ্লোরে যাবেন ? চলুন আমি নিয়ে যাচ্ছি।‘ সুপ্রিয়া ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘আরে না, না, আমি যাবো না, আমার খুব ভয় লাগে। আমি সিঁড়ি খুঁজে পাচ্ছি না।‘ মেয়েটি এবার ওর ভয় দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ল, ‘আন্টি আপনি আমার হাত ধরুন, কিচ্ছু ভয়ের নেই, আমি নিয়ে যাচ্ছি’। অনেক আপত্তি সত্ত্বেও মেয়েটির পীড়াপীড়িতে সাহস করে ওকে একহাতে জড়িয়ে অন্যহাতে এস্কেলেটরের হ্যান্ডরেল ধরে সিঁড়িতে পা রাখল সুপ্রিয়া। প্রথম দিকে একটু টালমাটাল হলেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওরা উপরের ফ্লোরে পৌঁছে গেলো। মেয়েটি তার পিঠে হাত বুলিয়ে হেসে বলল, ‘চলুন এবার আমরা নামবো, দেখবেন একটুও ভয় লাগবে না।‘
কুর্তি কেনার কথা মাথা থেকে একেবারেই বেরিয়ে গেল। মনের আনন্দে এবার সুপ্রিয়া বার বার একা অকারণেই এস্কেলেটরে উঠানামা করছিল। মেয়েটি চলে যেতে যেতে দূর থেকে ওকে দেখে হেসে বুড়ো আঙুল তুলে ‘থাম্বস আপ’ দেখাল। সুপ্রিয়া উজ্জ্বল মুখে একটু লাজুক হেসে অস্ফুট স্বরে বলল,’ থ্যাংক্যু।
অনেকগুলি কমবয়সী ছেলেমেয়ে দলবেঁধে হৈচৈ করে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে আসছিল। ওদের দেখে একটু দমে গেলো সুপ্রিয়া। রিসেপশনের মেয়েটি ভালো। সুপ্রিয়ার কথা ভালোভাবে শুনল, তারপর কাকে যেন ফোন করে কথা বলল। ফোন রেখে মৃদু হেসে বলল ‘সব ঠিক আছে, হয়ে যাবে, আপনি অফিসে চলে যান’। পাশেই ছোট্ট অফিস। একটি ছেলে কম্প্যুটারে কাজ করছিল। সে একটা অ্যাডমিশন ফর্মটা বার করে দিল। বাইরের বেঞ্চে বসে ফর্ম ভরছিল সুপ্রিয়া। আবেদনকারীর নামের জায়গায় গোটা গোটা করে লিখল ‘সুপ্রিয়া মিত্র’। বয়স লিখল ‘পঞ্চাশ’। তার কাছ থেকে ফর্মটা নিয়ে জমা করতে করতে ছেলেটি ওকে অবাক হয়ে দেখল।
দীপাবলির পর থেকে ক্লাস শুরু হবে। ত্রিবেণী সঙ্গীত ভবনের বাইরে ক্যাবের জন্য অপেক্ষা করছিল সুপ্রিয়া। ইদানীং মোবাইলে অনলাইন ক্যাব বুক করতে শিখেছে। বাইরে স্বচ্ছ নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। ভবনের চত্বরে শিউলি গাছটা থেকে ফুল ঝরে বসবার বেঞ্চ আর ঘাস সাদা হয়ে আছে। কয়েকটি ঝরা ফুল হাতে তুলে নিলো সুপ্রিয়া, ফুলের মৃদু সুঘ্রাণ নিতে নিতে মনের আনন্দে গেয়ে উঠল, ‘এই আকাশে, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ …
সুচিন্তিত মতামত দিন