প্রতিভা সরকার

মায়াজম
3

                                                                বক্ষমধু



১)
সাড় বাচ্চাটাকে দুহাতে বটের শেকড়ের নীচে কালো মাটির গর্তে নামিয়ে দেবার পরই পাগলির বুক টাটানি শুরু হল। টাটানি বলে টাটানি, সে টাটানি যার নিজের না হয়েছে সে বুঝবে না ! ফোঁঁড়ার মতো টনটন করছে দুই বুক, ক্রমে ফুলে উঠে যেন লোহার মতো শক্ত হয়ে গেল। আলতো করে আঙুল ছোঁয়ালেও মনে হয় ছুরির খোঁচা। পাগলির চোখের জল মরা বাচ্চার শোকে, না দুধ-জমা বুকের তাড়সে, সে নিজেই বুঝতে পারে না। শুধু কাঁদতে কাঁদতে মন্দিরের দিকে যায়। পুরোহিতকে সে যমের মতো ডরায়, কোনো বোধ না থাকলেও এটা জানে যে তার মন্দিরের দাওয়ায় ওঠা বারণ, কিন্তু দূরে কুয়োর পাশে মাটিতে বসে কেঁদে নিলে তো কারও কিছু বলার নেই। কাঁদতে কাঁদতেই চোখ রগড়ে দেখে নেড়ি কুকুরটার একটা গালুসগুলুস বাচ্চা অবাক মুখ তুলে তার কান্না দেখছে। এইটার মা আর একটা বাচ্চাকে নিয়ে হঠাৎ অন্তর্ধান করেছে। তিনদিন হল তার দেখা নেই। হয়ত আশেপাশের কেউ বিষ দিয়ে মেরেই ফেলেছে। এইটা কেমন করে বেঁচে আছে কে জানে। ছেই ছেই, যা: ধুসসস, পাগলি বাচ্চাটাকে তাড়ায়। ছোট ছোট মাটির ঢ্যালা ছোঁড়ে। কিন্তু সেটা সামনের দু পা মেলে বসেই থাকে, ঘাড় কাত করে মনোযোগের সঙ্গে তাকে দেখতে থাকে। তারও চোখের কোলে গড়িয়ে পড়া জল শুকিয়ে গেছে।
২)
দয়ানন্দকে দেখলে সমীহ করতে ইচ্ছে হবে, এমন সুপুরুষ সে। কালী মন্দিরের পুরোহিত বলে সুগৌর কপালের ওপর লম্বা সিঁদুরের রেখা, কমলা রঙের উত্তরীয়ে উর্ধাঙ্গ আবৃত, নীচে সাদা ধুতি। সে যখন মন্ত্রপাঠ করে, পঞ্চপ্রদীপের আলোর আভা পিছলোতে থাকে দেবীপ্রতিমার ত্রিনয়নে, তাকে মনে হয় তন্ত্রমন্ত্র সিদ্ধ এক অলৌকিক সত্তা, যে এই পৃথিবীর মানুষ নয়।
ঘোর জঙ্গলের ভেতর এই কালীমন্দিরের সেবায়েত দয়ানন্দ। সতীমায়ের কানের লতি এখানে প্রস্তরীভূত হয়ে আছে, তাই জঙ্গল, খারাপ রাস্তা, সব তুচ্ছ করে এখানে পুণ্যার্থীরা আসে, বিশেষ করে নির্দিষ্ট তিথিগুলিতে। তাদেরই পেছন পেছন খাবারের লোভে হয়ত পাগলিটা একদিন চলে এসেছিল। তার শরীরের অবস্থা দেখে দয়ানন্দ অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিল, আসন্নপ্রসবা, অসুস্থ এক তরুণী, রক্তশূণ্য বিকারহীন মুখ শুধু খাবার দেখলে চঞ্চল হয়ে ওঠে। নেহাত মানবতার খাতিরে থাকতে দেওয়া। শম্ভুকে বলাই ছিল, প্রসবের পরই যেন বাচ্চাশুদ্ধ ওকে যেন দূর করে দেওয়া হয়। গত রাতে খবর পাওয়া গেল পাশের জঙ্গলের মধ্যে মেয়েটা বাচ্চা বিইয়েছে, মরা বাচ্চা। কী করে নাড়ি ছিন্ন করেছে সে কেউ জানে না, কিন্তু প্রাচীন বটের শেকড়ের তলায় মাটি খুঁড়ে বাচ্চাটাকে পুঁতেও দিয়েছে। তার কাপড়ে শুকনো কালো কালো ছোপ দেখে ঘেন্নায় দয়ানন্দের অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসবার উপক্রম হয়। এটাকে একটা নতুন কাপড় আর কিছু খাবার দিয়ে আজই বিদায় করবি, তার ডানহাত শম্ভুর কানে সেবায়েতের ভারী গলার স্বর মন্দিরের প্রাচীন পেতলের ঘন্টার মতো গম্ভীর ও অব্যর্থ শোনায়।
৩)
শম্ভু কাঁঠাল গাছের মৌচাকটি ভাঙবে বলে গ্রাম থেকে লোক ডাকিয়ে এনেছিল। সে লাল গামছায় মাথা মুড়ে হাতে ধোঁয়া ওগড়ানো খড়ের আঁটি নিয়ে গাছে চড়তে চড়তে শম্ভুকে বলল, পাগলিটারে ওইখান থিকা যাইতে কন। নাইলে এঁয়াদের কামড়ে মারা পইড়বে।
কিন্তু কিছু বলার আগেই পাগলি কুয়োতলা থেকে এদিকে আসতে থাকে। সেও বোধহয় মধুসংগ্রহ করা দেখতে চায়। শম্ভুর চ্যাঁচামেচি গ্রাহ্য করে না সে, দুহাতে অঞ্জলি পেতে গাছের নীচে এসে দাঁড়ায়। যেন মধুর লোভে উলসে উঠেছে তার স্মৃতি। গাছের ওপরের লোকটির গামছা জড়ানো চোখদুটি তার ছেঁড়া ব্লাউজ ঠেলে ওঠা ভেজা বুকের বৃন্ত, ঝুঁকে পড়া কাঁধ, নোংরা অথচ কোমল মুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে থাকে। ওপর থেকে পাখির চোখে তার এইসব দেখার সুবিধে হচ্ছিল নিশ্চয়ই। তারপরই কোন রাগে কে জানে, পাগলিকে সরে যাবার সুযোগ না দিয়ে নিষ্ঠুরের মতো সে খড়ের গোছার ধোঁয়া নিয়ে যায় মৌচাকের একেবারে কাছে। সমুদ্রগর্জনের মতো গম্ভীর শব্দ ওঠে, অজস্র ডানাকে ছুটে আসতে দেখে পাগলিও ছুট লাগায়, কামড় খেতে খেতেই পুকুরের দিকে দৌড়ে যায়, যাবার আগে হাতে তুলে নেয় কুকুরের বাচ্চাটাকে। গলা জলে দাঁড়িয়ে মাথার ওপর একহাতে তুলে রাখে বাচ্চাটাকে। ওর শরীরের পশমে হুলগুলো আটকে যাবে, এটা যেন সে বিলক্ষণ জানে।
৪)
অনেকক্ষণ ধরে পাগলির কান্না আর বাচ্চাটার কুঁইকুঁই শুনে বিরক্ত দয়ানন্দ চাক ভাঙার লোকটিকে ধমকায়, এমন ক্যাং করিলেন বাহে! জগজ্জননী সবার মধ্যে বিরাজ করে, জানা নাই সেই কথা!
নিজের কানেই নিজের কথা কেমন যেন শোনায়। মেয়েটাকে আজই তো জঙ্গল পার করার কথা! পুকুর পাড়ে গিয়ে মেয়েটিকে বলে, উঠি আসেন মাও। ভয় না খান। দ্যান, দ্যান, উমরার হাতে মধু দ্যান, শম্ভু।
বালতিতে চাক নিংড়োতে নিংড়োতে এক টুকরো মেয়েটার হাতের ওপর চটকায় শম্ভু। মেয়েটা চেটে খায় গাঢ় সোনালী মধু, তর্জনীতে একটু মাখিয়ে দেয় কুকুরের বাচ্চার মুখে। ঐ চ্যাটচেটে খাবারে বাচ্চাটার খুব আপত্তি, সে কাঁইমাই করে, নামতে চায় পাগলির গা বেয়ে বেয়ে। বুক অব্দি নেমে কী সে শুকিয়ে থাকা দুধের গন্ধ পায়! মুখ ঘসে ঘসে কী যেন খুঁজতে থাকে। সঙ্গে সেই অবিশ্রান্ত কান্না কুঁইকুঁই।
পাগলির বোধহয় কাতুকুতু লাগে, হাসিতে ফেটে পড়তে পড়তে সে তালগাছের মতো তিন পুরুষের সামনেই বুক উদোম করে রক্তাভ বোঁটা গুঁজে দেবার চেষ্টা করে বাচ্চাটার মুখে। প্রথমে সেটি মুখ ফিরিয়ে নেবার জন্য আকুলিবিকুলি করে, তারপর প্রাণপণ চুষতে থাকে স্ফীত স্তনবৃন্ত। তার কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে তরল। দীর্ঘ অনাহারের পর অমৃতভান্ডের খোঁজ পেয়ে বাচ্চাটা আত্মহারা, অথচ খাদ্যসন্ধানে স্থির, শুধু পেছনে লেজটি খুশিতে নড়ে, তুর তুর তুর।
দয়ানন্দের মনে হয় সৃষ্টি রহস্যের একেবারে মূলে দেহরসের যে ভূমিকা, যে অলৌকিক মধু ক্ষরণে বিধৃত এই দুনিয়া, মন্দির নিবাসিনী জগজ্জননী দয়া করে তার সামনে আজ সেই রহস্যের যবনিকা ওঠালেন৷ তার দুই হাত আপনা থেকে নমস্কারের ভঙ্গিতে জুড়ে যায়। পাগলি সেদিকে ফিরেও দেখে না৷ অনেক দূর অবধি দেখা যায় তার অপসৃয়মান দেহরেখা। নিজের মৃত বাচ্চার শব-পোঁতা বটের ঝুড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় সেদিকেও ফিরে তাকায় না সে। কুকুর ছানাটিকে স্তন্যপানরত অবস্থায় আঁকড়ে ধরে খালি হাঁটতেই থাকে।
পেছনে বিস্ফারিত চোখে দাঁড়িয়ে থাকা তিন পুরুষই বোঝে, পাগলিকে জবরদস্তি বিদেয় করার দায় তাদের এইভাবেই ঘুচলো

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

  1. এ মায়া শংকরের মোহ-মুদ্গর নয়। এ রক্ত-মাংসের মায়া। কেউ এড়িয়ে থাকতে পারে না। যদি সে মানুষ হয়। চমৎকার নির্মাণ...

    উত্তরমুছুন
  2. চুপ হয়ে থাকতে হয় শুধু

    উত্তরমুছুন
  3. একে তো পরপর ছবির মতো এসে গেল এক একটা ফ্রেম। আবার সেই ফ্রেমের কলাকুশলীদের এমন ট্রেনিং দিয়েছেন যে ফাটিয়ে অভিনয় করলো। নাট্য নির্দেশককে প্রণাম।

    উত্তরমুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন