খেসারত
তারকের মুখের দিকে শিবানী চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। হাড়গিলে চেহারায় জেগে আছে কেবল
দুটো চোখ। মাথা জুড়ে বিশ্রী ঘা। এলোমেলো চুল কেটে চেহারাটা আরো ভয়ংকর হয়ে ফুটেছে।
ভেতরে ভেতরে গুমড়ে চলেছে।
-এত রেগে আছিস কেন? কী হল? -মাহাজন তোর সাথে ফস্টি লষ্টি
করে? তোর গায়ে হাত দেয়?
-কে কলো?
-সব্বাই, সব্বাই।
-আর না খেয়ে থাকলে এই সব্বাই,
সব্বাই খেতে দিতে আসে? বড় মরদ এসেচেন। যাদের প্যাটে খিদের জ্বালা তাদের অত শরীলের
কতা ভাবলে চলে না। নে গেল।
ঝিরিঝিরি চাঁদ আলো, পাতা ছাওয়া মাটির ঘরের দাওয়ায় খেলা
করে। পাশ ফিরে শোয় শিবানী। তারক বিনাতে থাকে, আমি বনে যাই আর তুই ওই শয়তানের ঘরে?
ক্যা? মেয়েটারে একা রেখে যাস? কী রে উত্তর দিসনা ক্যা? গায়ের উপর হাত পড়তেই ছিটকে
যায় জ্যোৎস্নার আলো। বনের ভিতর থেকে আঁউ আঁউ শব্দ ভেসে আসে।
-নিজের বদনটা ওই ভাঙা
আয়নায় দেখ, তারপর আসিস। শালার চামগাদর, গোলাপের মধু চাও! ভাগ। বিরাট তানপুরার মতো
পেছন নিয়ে তোশেকের অর্দ্ধেক জুড়ে শুয়ে থাকা বউটাকে, বাঘিনী বলেই মনে হয় তারকের।
নিজের মাথার ঘায়ে খানিক হাত বুলায়, মেয়েটাকে বুকের ভিতর জাপটে নিয়ে শুয়েছে বউ।
বাড়ির পাশ দিয়ে খসখস খসখস কিসের যেন আওয়াজ। ঘাড়ের খুব কাছে নিশ্বাস পড়ে। শক্ত হয়ে
ওঠে চোয়াল, মাথার নীচে ড্যাগারটা মুঠো করে ধরে। অনেকক্ষণ নিঃশ্বাস চেপে রাখে।
পায়েসের গন্ধে ভরে ওঠে ঘরের ভিতরটা। গর্ত খুঁড়ে ভিতরে ঢুকল নাকি? খানিক উশখুশ করে।
গন্ধটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। বনের ভিতর থেকে আঁউ আঁউ আওয়াজ আসে। কে জানে আজ কার
জীবন শেষ? ভোরের আলো ফুটে ওঠে অভ্যাসের গড়িমসি নিয়ে। নিজের ভিতর হাত বুলিয়ে নেয়
আজান শেখ। তার বছর আঠাশের একঘেয়ে বাউলি জীবনে কোনো টান নেই, সবটাই শূন্য। ওর বাবা
নৈঈম শেখ বছর পাঁচেক ধরে ওকে নিয়ে যায় সঙ্গে করে কোলকাতা। মধু বিক্রির ফন্দি ফিকির
শেখায়। সবটাই মাথার উপর দিয়ে যায়। ধরতে পারেনা আজান। আমলামেথি গ্রামে ওদের বাড়ির
অবস্থা সবচে ভালো। নৈঈম এ তল্লাটের মহাজন কেবল নয়, বেশির ভাগ জমির মালিকও। গত দশ
বছর ধরে পঞ্চায়েতের সদস্য। আজান ওর বাবাকে কোনোদিন বুঝতে পারেনা। বহুবার পঞ্চায়েত
প্রধান হবার জন্য প্রস্তাব এলেও সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছে নৈঈম। -আরে নাহ্ নাহ্ প্রধান
হইলেই ঝামেলা বাড়ব। মানসের কামের জইন্যি একটু ঝাড়া হাত পাও লাগে। তাছাড়া আমরা তো
বাউলি। বন ছাইড়া, বনবিবি ছাইড়্যা থাকতে পারুম না। আজানের মনে হয় এসব সত্যি নয়। বাবা
আসলে আড়ালে থেকে সব মুঠোয় পুড়তে চায়। পঞ্চায়েত প্রধান রবি মালো ওর বাবার কথায়
হাগেমোতে। এত টাকা তবু আজানকে বাউলি হতে হয়! -আব্বা, আমি বনে যাব ক্যান? একডা মুদি
দোকান কইরা দেন না। গেরামে তো মাত্র একডা রইসে। মেহেন্দি করা দাড়ির ভেতর দিয়ে পানে
ভেজা ঠোঁট দুটো আলগা হয়, ক্যান বনে যাতি তুমি ডরাও? ওরে মরদের বাইচ্চা। নদীর পাড়ে
রহমতের মাইয়ারে ধামসাইতে তুমার ডর লাগেনা, ভয় কেবল বনে? আজানের রক্ত ফুটে ওঠে। বছর
তিনেক আগের এক ঘটনা প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে ওর সব তেল বের করেও লোকটার শান্তি হয়নি। আর
রহমতের মেয়েটা যে পটাং করে মরে যাবে এই বা কে জানত? কাদা থেকে দাঁড় করিয়ে বলেছিল,
সুজা বাড়ি যা কাওরে কিছু কওনের দরকার নাই। মেয়েটা ল্যাছড়াতে ল্যাছড়াতে খানিক এগিয়েই
উল্টে পড়ল কাটা গাছের মতো। সন্ধ্যার নিভে যাওয়া আলোয় আজান দেখল বনবিবি স্বয়ং এসে
দাঁড়িয়েছে। তার চোখ জ্বলছে। মুখটা অনেকটা তারকের বউ শিবানীর মতো। রহমতের মেয়েকে কখন
বাঘে নিল কেউ টের পেল না। ওর মধু চাওয়া চোখ দুটো রাতের অন্ধকারে আজানের বুকের উপর
বসে থাকে। তার ছিন্নভিন্ন শরীর দেখতে সারা গ্রাম ভেঙে পড়েছিল। নৈঈম আজানের ডানকানে
মোচড় দিয়ে বলেছিল, যাওয়া তুমার লাগবই, নইলে সবার চকখে বিঁধবো। চলো। ছেঁড়াখোঁড়া শরীর
এক জায়গায় জড়ো করতে করতে আসমার মা পাগলের মতো কাঁদছে, বাবাটাও হ্যালহ্যাল করে
কাঁদছে। নৈঈম এগিয়ে যায়, আরে মিঞা পাগলের লাহান করো ক্যা? সব কি আর আমাগো হাতে আসে?
তবে মাইয়াডা মধু লোভী আছিল। পীরখালির জঙ্গল মধুতে মোড়া তয় বাঘেও। আমার বাড়িত কতদিন
গ্যেছে মধু চাতি। দিছি। এই তো আজানেও দিছে। তার পরেও হের হাউশ! কাইন্দো না। কী করবা
কাইন্দা? এই বলে আজানের খালাত ভাই সামসের আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের দিয়ে মরার টুকরো
কুড়িয়ে, পুলিশ দারোগা সামলে গোর দিয়ে দিল নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে। আজানের গা গুলিয়ে আসে
এসব ভাবলে। সেদিন চলে আসার আগে দেখেছিল শিবানী আর ওর বাবার চোখে চোখে কত কথা।
জঙ্গলের থেকে একসাথে অনেকগুলো বক হঠাৎ ডানা মেলে দেয়। সেইদিন থেকে আজান কেবল ভয়
পায়। মন্ত্র দিয়ে বন বাঁধা তাকে শিখিয়েছিল ঠাকুর্দা। ঠাকুর্দা বিলাল শেখ সেই
কোনকালে মাছ ধরতে এসে ঝড়ের মুখে পড়েছিল আর বাংলাদেশ ফেরেনি। সেও সুন্দরবন তবে দেশটা
আলাদা। এই আমলামেথিতেই নতুন বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। বুদ্ধি করে রেশন কার্ড আছে।
ওদের তো এখন ভোটার কার্ড আছে। মুসলমান এই গাঁয়ে আছে কয়েক ঘর। তবে বাউলি হয়ে
মৌয়ালদের সাথে বনে যেতে যেতেই বিলাল শেখ সম্পত্তি বাড়িয়েছিল। সবাই বলে ওই সময়
বিরিঞ্চিবারি নফরগঞ্জ এলাকায় ডাকাতি বেড়েছিল। তার পরপরই বিলালের ফুলে ফেঁপে ওঠা।
আজান বোঝে ওর রক্তে বিষ আছে। তাই গ্রামে সবাই সব বুঝলেও চুপ করে থাকে। কেউ কাছে
ঘেঁষে না। বেশ কদিন ধরেই ঘুষঘুষে জ্বরটা শ্রীনাথের পিছন ছাড়ছে না। জ্বরের ঘোরে
কেবলিই দেখতে পাচ্ছে একমাস আগের ঘটনাটা। বাঘটা বুকের উপর থাবা মারতেই মালতি লাফিয়ে
বাঘটার ঘাড়ে চড়ে বসবে এ সে ভাবতেও পারেনা। মা মা বলে হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে বাঘটার
কানের ভিতর কাঠি দিয়ে খোঁচাতে শুরু করে দিয়েছিল। বাঘ চিৎকার করে থাবা সরাতেই মালতি
কী করে টেনে হেঁচড়ে নৌকায় তুলেছিল তার আর মনে পড়েনা। শুধু মনে পড়েছিল বনবিবি বোধহয়
আসলে মালতিই। খুট করে শব্দ হতেই চোখ মেলল, একটা টিমটিমে আলো। নাক টানার আওয়াজ।
-মাহাজন লোক পাঠিয়েছে, বলছে রিপোটার অনেক টাকা দিয়েছে তাই কিছূটা গ্রামের উন্নতিতে
দিতে।
-শালা হারামখোর, ওর মুখে মুতি। এতগুলো টাকা বেড়িয়ে গেল হাসপাতালে তখন কোন
সুমুন্দির পো এসেছিল দেখতে? হারে হারামিটা মধুর গন্ধ পায় তাই না! দিবি না মালতি
একটা টাকাও।
-তুমি তো বলেই খালাস। কাল পঞ্চায়েতে গিয়েছিলাম, একশো দিনের কাজে তোমার
নামটা ঢোকাতে। আমাকে দেখে লুঙ্গির খুট হাতে পেঁচিয়ে এগিয়ে এসে বলল, বাঘের ঘাড়ে চেপি
বসে যে মাইয়াছাওয়াল, তারে কী এসব শাড়ি বেলাউজে মানায়? লাল বেলাউজ আর নীল শাড়ি লাগব।
ঠিক আছে আমি তোরে দেবো, আমার বাড়ি আসিস।
-কী এমন কথা বলল, তুই কিছু বললি না?
-সব
কথার উত্তর দেওয়া যায় না, যাক টাকা পাঠাতেই হবে। অন্তত মান ইজ্জতটা বাঁচে। সারা
গ্রাম হাতের মুঠোয় পুরে বহাল তবিয়েতে থাকে এই নৈঈম। শ্রীনাথ কাঁকড়া ধরে বেড়ায়।
খাঁড়ির ভিতর অবধি যায় না। পাড়ে পাড়েই। মালতিটার বাচ্চাকে দু বছর আগে ক্যানিং এর
বাবাসাহেব নিয়ে গেলেন। বললেন ছেলেটার মাথা খুব পড়ার খরচ চার্চ থেকেই দেবে। ছোট্ট
জায়গা ঘিরে স্কুলবাড়ি আর বাচ্চাদের থাকার জায়গা। লেখাপড়া করায়, গান শেখায় আঁকা
শেখায়। যীশুর ছবিটা দেখলেই বড় মায়া হয় আহা গো ওমন কষ্ট দিয়ে মারে? তাই নিয়েও এই
নৈঈম কম জল ঘোলা করেনি। রটিয়ে দিয়েছিল সে নাকি ছেলে বেচেছে। একবার যদি বাগে পাওয়া
যেত। দাঁত কিড়মিড় করে শ্রীনাথ। বাইরে পায়ের খসখস আওয়াজ। কে কে এই সময়? মালতি কুপি
নিয়ে দেখে। তারক, সজল, রবিউল এসেছে। অনেকক্ষণ গল্প গুজব করল ওরা। তারক অবশ্য উশখুশ
করছিল। ওর বাড়িটা গ্রামের একেবারে শেষে। জঙ্গলের কাছে। তারকের বউটার ভরন্ত যৌবন
দেখতেও সুন্দর। তার উপর ঢলানি। এই আগলা পাগলা চেহারায় কী করে যে সামলাবে ছেলেটা তাই
ভাবে শ্রীনাথ। দাওয়ায় ওর পাশে এসে বসে।
-কী রে এমন চুপ করে আছিস? চেহারার হাল এই
করে রেখেছিস ক্যা?
-বউটা আর থাকবে না। -নৈঈম! তারক কথা বলে না চুপ করে থাকে। বিড়ি
ধরায়। গন্ধটা শ্রীনাথ টেনে টেনে নেয়। মালতি দেখলেই খ্যাচাবে। তা হোক। শ্রীনাথ
তারকের গায়ে হাত রাখে। সজল, রবিউল কিছু বলে না। তারক ফিসফিস করে বলে, তোর ঘরে তো
শুনি অভাব ঘুচেছে। এত রাগিস না। পেটের জ্বালা বড়ো জ্বালারে।
-তুই আজ একমাস ঘরে শুয়ে
তোর বউ, মীন ধরে, লোকের কাছে ধার চায় ক্যা? মাহাজনের সামনে কাপড় তুললেই পারে।
শ্রীনাথ রাগ করে না, রবিউল ধমকে উঠলে তাকেও হাত দিয়ে আটকায়। খুব সন্তর্পনে বলে,
মালতির পোড়া আমের মতো খসটে পড়া চেহারা, মাহাজন হাগার দিকে তাকলেও ওকে দেখবে না। তুই
কি ভেবেছিস মালতি চেষ্টা করেনি? মাহাজন উল্টে টিভি রিপোটারের দেওয়া টাকার ভাগ
চেয়েছে বুঝলি? তাছাড়া লোকে বলে তোর ব উ মাহাজনের কিছু একটা রহস্য জানে। তাই ওর কথায়
নৈঈম ওঠেবসে। ফ্যালফ্যাল করে তিনজনেই তাকায়। শ্রীনাথ বুকটায় হাত বুলায়।
-শরীরের
চিন্তা তাদের মানায় যাদের টাকার চিন্তায় একমাত্র ছেলেকে অন্য জায়গায় পাঠাতে হয় না,
বুঝলি তারক? বাড়ি যা। আর শোন তোর এই ঘিয়ে ভাজা চেহারায় শিবানীকে ধরতে পারবি না।
তোকে দেখলে মনে বিষ জমে মধু না। সবাই চলে যেতেই মালতি ঝাঁপায়, কী আমি ছিনাল! এই
বললে তুমি? দক্ষিণ রায়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে এনে, এ কী পেলাম আমি? শ্রীনাথ শান্ত হয়ে
ঘরে ফেরে। বিনিয়ে বিনিয়ে অনেকক্ষণ প্রলাপ টানে মালতি। -দুখির মার সুর টেনে টেনে বলে
গেলরে মালতি, তোর বউ জানে বাঘে খুবলানো সোয়ামির জোর আর থাকবো না তাই নৈঈমের পুরুষ্ট
দাবনার পিছনে ছোঁক ছোঁক। যদিও পাত্তা পাইবোনা। শিবানীরে দ্যাখতে নাইকার মতো, তাকে
ছাইড়্যা তেঁতুলের খোলায় কে হাত বাড়ায়। এত কথা বলার পর হঠাৎ শ্রীনাথের খুব ঘুম পায়।
মনে হয় জ্বরটা আবার আসছে।
(২)
আজান প্রতি বৃহস্পতিবার বাবার সাথে কোলকাতা যায়। রবি,
সোম, মঙ্গল আর বুধ বনে। জুম্মাবারে শুধু চক্কর দেয় গ্রামে। শনিবার ঘুমায়। খুব ঘুম।
এবার বাবা ধরে বসল জুম্মাবারেই বনে যেতে হবে। শনিবার আবার কোলকাতা। অর্ডার এসেছে
এবার মোটা অঙ্কের। কী সব কোম্পানির নাকি কোলকাতায় খুব নামডাক। সুন্দরবনের খাঁটি মধু
বিক্রির হিড়িক বেড়েছে। কিন্তু সন্দেহ হয় আজানের, জুম্মাবারে বনে যাওয়া তাদের তো
নিষেধ। হিন্দুরা যায় অবশ্য। তা গ্রামে অন্য বাউলি তো কম নেই। কোলকাতা থেকে আসা
ইস্তক লোকটা ছনমন ছনমন করছে কিছু একটা ধান্দা আছে, চোখ লোভে চকচক করছে। সন্দেহ বাড়ল
খালাত ভাই সামসেরকে দেখে। নৈঈম ওকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দোর দিতেই কান পাতল আজান কিছু
শোনা গেল না। রাতে খেতে বসে সামসেরভাই চপরচপর আওয়াজে মুরগি চিবোতে চিবোতে বলল,
তোমার আম্মির বয়েস হইসে বাড়িত একটা মাইয়াছাওয়াল খুবই পোয়োজন। আজান উদাস হয়ে গেল।
-আজ্ঞে ভাই কিন্তু আমার নিকাহ ইচ্ছা জাগে না। মৃদু হাসে সামসের, দেখ আজান তোমার
জাগে না কিন্তু তুমার আব্বার বয়স অহনো আছে। পোসতুত হোও নতুন নিকা করনের লোক ঠিক
হইসে। আজান কিছু বোঝার আগেই সামসের বলে, অত ভাববার লাগবো না, কাল তুমার লগে আমিও
যাব বনে, জুম্মাবারে তুমারে বনে পাঠাতে খালু ডরায়, তাই আমি আর আমার দুই বন্ধু
বন্দুক নিয়া সাথে যাব।
-বন্দুক! আব্বায় দেহি কোনো নিয়ম মানতে চায় না! বাউলি আমরা
আমাগো বন্দুক নিয়া বনে ঢুকা হারাম।
-আরে রাখেক, জানে বাঁচা লাগে আগে। সামসের খেয়ে
উঠে ঘরের পিছনে খসখস শুনে এগিয়ে যায়। বেশ ঝাপটাঝাপটি আর মেয়ে মানুষের গর্জন। চাপা
অথচ স্পষ্ট। ভীত অথচ দৃঢ়।
-আপনাকে বলিনি আমি বেবুশ্যে কিছুতেই হবনা। বিয়ে করবেন তো
করুন। ওই চামগাদরকে ছেড়ে আসতে আমার কোনো মায়া নেই। শুধু আমার মেয়ে আমার কাছে থাকবে।
রাজি থাকেন তো গায়ে হাত লাগান নাহলে নয়। টানটান হয় সামসের। কার এত তেজ? এই কি
শিবানী? মাথা দেওয়াল ঘেঁষে একটু আগায় দেখে নৈঈম ভিখারীর মতো অনুনয় বিনয় করছে। আর
সেই মেয়েও ডানা ঝাপটাচ্ছে। কাহিল হয়ে পড়ল খালু। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বেশ তুই যা
চাস তাই হইব। তোর মুসলমান হতে সমস্যা নাই তো? মেয়েটা পিছন ঘুরিয়ে চলে যেতে যেতে
বলল, পেটে খাওয়ার থাকলে সব ধর্মই ভালো লাগে। নিঃশ্বাস আটকে দেবার মতো শরীর,
হ্যারিকেন নিয়ে সরে সরে গেল রাস্তা দিয়ে। নৈঈম হাঁফ ছেড়ে ঘুরতেই সামসেরকে দেখে একটু
থতমত খেয়ে বলল, কচি বয়েস তো তাই তেজটাও বেশি। বলে হে হে হেসে চলে যেতে নিল। সামসের
হাতটা ধরে নিয়ে বলল, এর বর তো মৌয়াল তারক না! -হ! -আপনেরে একডা কথা কই, আপনার
হরিণের সিং, বাঘছাল আর পথের কাঁটা সরিয়ে দিতি যদি পারি তালি কথা দেন খালারে রাখবেন
আর নিকা করবেন না! -মানে? -মানে এরে ঘরে আনলি খালারে লাথ মেরে তাড়াব, তারা চায়া
বিধবারে ভোগ করবেন, তখন পেটের জ্বালায় মাগ হতে বাধব না। -তুমার এতে সার্থ কী?
-খালার শান্তি আর আমার এক লাখ টাকা। আমার কথা না শুনলি সব পঞ্চায়েতের কানে যাবো। আর
একডা কথা কন তো, আপনি এরে এত সাহস দিসেন ক্যান? ঘটনাডা কী? নৈঈম চলে যাবার পথে
শয়তানের ছায়া দেখে। একটা সর্বনাশের মেঘ জমে উঠল ঈশানে। বনের ভিতর তিক্ষ্ণ আওয়াজ
ছিঁড়ে দিল রাতের নিস্তব্ধতা। তারক অশ্রদ্ধার ভাতে জীবনের ঝাঁঝ ঢেলে নিল। কাসুন্দী
আর চুনোমাছের চচ্চড়ি খেয়ে শিবানীর দিকে চেয়ে বলল, কাল বনে যাব আজ একটু ভালো করে কথা
তো বলতে পারিস। না ফিরি যদি। চমকে ওঠে শিবানী। অলুক্ষণে কথার শব্দ ওর সহ্য হয় না।
বেঁচে থাকা মানুষকে যতটা ঠাসা যায় মরে গেলে সে সুখ নেই। তখন ভয় হয়, মায়া হয়। মুখ
নাড়িয়ে বলল, অত সুখ আমার আছে? ঘেয়ো চামগাদরের বউ হয়ে আদপেটা খেয়ে শুধু খেটে যেতে
হবে। পরনের শাড়ি নেই, একটা ঝুটো গয়না পজন্ত নেই। থু থু এর নাম জীবন? লোকের কাছে
চেয়ে চিন্তে দুটো তেল আনতে হয়, জল ছেঁচে মাছ আনতে হয়। আর এই যে চেটেচেটে কাসুন্দী
গেলা হচ্ছে সেই বা কোত থেকে আসে? তারক থালা ছেড়ে উঠতে গেলে রেরে করে ওঠে শিবানী,
খবরদার, ভাত ফেলে উঠলে আজ ঘরেই মেরে রাখব। তারকের মনে হয় যেন বনবিবি দাঁড়িয়ে আছে।
দুই চোখ জ্বলছে। মনে মনে প্রণাম ঠুকে দেয় মা গো কাল বাঁচিয়ে এনো। বনের ভিতর কে যেন
হাউহাউহাউহাউ করে ডাক দেয়। গায়ে কাঁটা দেয় শিবানীর। পাশ ফিরে আবছা আলোয় লোকটাকে
দেখে। তারক নাকি ওর প্রেত বোঝা যায়না। বনের ভিতর তিনহাতের ভিতরও কাউকে বোঝা যায় না।
দুটো নৌকায় এসেছে যে কজন তার ভিতর বাউলি কেবল আজান। মৌয়ালের দলের সঙ্গে মিশে চলেছে।
তরিবৎ করে মন্ত্র পড়ে। আগুপিছু কাঠির আগা ছোঁয়ায়। তারকের মনে হয় ছেলেটা বাপের মতো
শয়তান না। একটা মানুষ মানুষ ভাব আছে কিন্তু সঙ্গে আসা সামসের, ধনা, পিন্টু আর
মঈদুলকে তারকের শয়তানের ছায়া বলে মনে হয়। বনবাঁধা শেষ হলে মধুর কাজে লেগে যায় ওরা
সবাই। তারকের চোখ বারবার আজানের দিকে চলে যাচ্ছিল। দুটো চাক নামিয়ে ও একটু এগিয়ে
গেল, আজানের কাছে যেতেই চমকে উঠল। কাঁধে হাত রেখে তারক বলল, কী হয়েছে তোর মন কোথায়?
-তারক আজ অঘটন ঘটব, সাবধান যা। -এ আবার কী কথা? -এই বনবান্ধা আসলে কী সত্যি? তুই ক
সেই যে মনিরুল রে দক্ষিণ রায় নিল আমিই তো বন বান্ধছিলাম। আমার বাপ ঠাকুরদায় বন
বান্ধছে যহন তহন কি মানসেরে নেয় নাই! গা শিউরে ওঠে তারকের, কী বলিস রে। আজান বনের
দিকে দৃষ্টি রেখে বলে, আর যদি এইসব সত্যি হয় তালি আব্বায় বন্দুক পাঠায়সে ক্যা? ওই
পিন্টু নৌকা থিকা নাইমাই মুতল ক্যা? আমি রে রে করে উঠতিই দাঁত দেখাইল। ভালো
লাগতাসসে না। যেন মনে লয় কেউ দ্যাখতাসে। তারক এদিক ওদিক তাকায়। এগিয়ে যায় মৌয়ালদের
দিকে। ফিসফিস করতেই সবাই কাজ থামিয়ে চারিদিকে তাকায় ততক্ষণে গন্ধ বাতাসে ভেসে
এসেছে। আজান কাঁটা হয়ে থাকে। ওর পাশে সামসের চলে এসেছে নিঃশব্দে। কারো মুখে কথা
নেই। প্রহর কেটে যাচ্ছে। সবারই পায়ের নীচের মাটি আঠার মতো জড়িয়ে যাচ্ছে এমন ভাব।
সামসের অনুচ্চ গলায় বলল, ধীরে ধীরে পেছনে হাঁটো। তিনপা যেতেই হাড় হিম করা দৃষ্টি
নিয়ে নিমেষে ঝাঁপিয়ে পড়ল ডোরাকাটা দাগ। বন্দুক তোলার আগেই পিন্টুর ঘাড় মটকে গেল।
সবাই জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগল, সামসের তাক করল বন্দুক। ঝলসে উঠল আগুন। পিন্টুর
নিষ্প্রাণ দেহটা গাছের ডালে বেঁধে কাঁধে তুলে নিল আজান, , আর তিনজন মৌয়াল। আজানের
মুখ থমথমে। বাঘটাকে নিয়ে যাবে বলে সামসের জেদ ধরলে তারক ফুঁসে উঠল। সামসের কুতকুতে
চোখে বলল, আমারে রুখব ক্যাডায় তুই! আজান নৌকার ভিতর পিন্টুর শরীরটা রেখে চেয়ে রইল।
ভাবতে লাগল বনবিবির রোষ নাকি দুর্ঘটনা। এমন সময় গর্জে উঠল বন্দুক। মৌয়ালরা ছটফট করে
উঠল। আজান বনের দিকে ছুটতে চাইলে ওর হাত চেপে ধরল বনমালী, যেও না বাপ আজ মনে হয় মা
রুষ্ঠ হয়েছেন। ছপছপ নৌকা চলতে লাগল। যতদূর চোখ গেল আজান চিল্লাতে লাগল, তারক রে! ও
সামসের ভাই! আরো দু তিনবার বন্দুক গর্জে ওঠে কিছু সময় পরপর। লোক ভেঙে পড়েছে
বিদ্যাধরীর তীরে। সামসের, তারক, ধনা, মঈদুল। কারো খবর নেই। নদীর পাড়ে উবু হয়ে বসে
মেয়েকে কোলে নিয়ে বিনিয়ে যাচ্ছে শিবানী। মালতি সেদিকে তাকিয়ে মুখ বেঁকিয়ে গৌরীকে
বলল, উম্ কত দুকখ, মরার অপেক্ষায় দিন গুনছিল আর এখন ন্যাওর করছে। নৈয়ম আজানের কাছে
দাঁড়িয়ে বলে, তারককে শ্যাষ কহন দেখছিলি? আজান ওর বাবার চোখে হিংস্র ভাব দেখে। কোনো
কথা না বলে এগোতে গেলে ওর ড্যানা চেপে ধরে, সবে যেই বলে, রহমতের মাইয়ারে...সাথে
সাথে আজান বাপের ঢ্যানা চেপে ধরে, আব্বা রহমতের মাইয়া আসমারে আমি নিকা করতাম, ওর
লগে শরীর বাঁধছিলাম ওর ইচ্ছাতেই কিন্তু শরীরে আসতিই হেয় কইল বুকির মইধ্যে ব্যথা
করতাসে, মাতায় ব্যাথা, আমি ওরে তহনি বাড়ি পাঠায় দিসিলাম। ওয় আমার জইন্য মরে নাই,
আপনে জানতেন আর ওই ডাইনি শিবানীও জানতো। ওরে বাঘে নিল ক্যামনে? বাঘে মানসেরে ছিঁড়া
টুকরা টুকরা ক্যামনে করে? এ সব আমি জানি আব্বা। আসমার মরণরে সামনে রাইখ্যা রহমতের
জইন্যে আপনার দরদ লোকের কাছে আপনেরে ফরিস্তা বানায় মনে করেন? ভুল! ইবলিশের গায়ের
গন্ধ উৎকট। আমারে ঘাটায়েন না, জান। নৈঈম দমে গিয়েও ফুঁসে ওঠে। -এই হারামির বাচ্চা,
এইসব কার জইন্যে, তোর জইন্যি নয়? -শিবানীরে ভোগ করবেন বলে তারকরে সরায় দিতি চান হেই
ও বুঝি আমার জইন্যে। নৈঈম চুপ করে যায়। বোকা বলদ ছেলেটা লোকজন ছেড়ে দূরে নদীর পাড়ে
বসে। ওর কাছে যেতে ভয় হয়। লোকজনের ঘেরাটপে চুপ করে তাকিয়ে থাকে। এমন হময় হৈহৈ নৌকা
দেখা যাচ্ছে। আসছে আসছে। সামসের হাউমাউ করে ওঠে। -খালু আপনে ঠিকই বুঝছিলেন কাল
রাতের থিকাই বন কাঁপতাছিল কিন্তু এই তারকে কারো কতা শুনলো না। কত নিষেধ করলাম, কয়
একবার বাঘ আসলি সেইখানে আর বাঘ আহে না। দেহেন লোভের পরিনাম। বন্দুক দিয়াও বাঁচাইতে
পারলাম না। গেরামে আবার জোড় ধরেই গেল। পিন্টুর শরীলডা তাও আনছি। এতক্ষণ খুঁজলাম
তারকের মরাটাও আনতি পারলাম না খালু। আছড়ি পিছাড়ি কেঁদে ফেলে শিবানী। বুক ফাটিয়ে
কাঁদতে থাকে, আসো গো ফিরে আসো, ও ঝিনুর বাবা ফিরে আসো গোওওও। আজান আকাশের দিকে চোখ
রাখে। ফিসফিস করে বলে, এ গ্রামে জোড়ে মরে, কিন্তু তারক তোরে কী মরা কয় না মারা
কয়রে? সামসের নৌকা থেকে ভাড়া ভাড়া মধুর পাত্র নামায়, চোখ টিপে নৈঈমকে বলে, নৌকার
খোলের মইধ্যে, বাঘ, দুইডা হরিণ আছে। রাইতে নিলিই হব। আজান কই? নদীর পাড়ে আবার হৈ হৈ
রব ওঠে। চিৎকার চ্যাঁচামেচি, বাঁশ ,ইঁট ছুঁড়েও গ্রামের জোড় ধরে মরার রেওয়াজ ব্যর্থ
হয় না। আজানের ল্যাতপ্যাত শরীরটা নদীর কাদায় ফেলে নদী সাঁতরে বনে যায় হলুদ কালো।
তাড়াহুড়ো তে সব মধু উল্টে পড়ে গড়াতে থাকে বিদ্যাধরীর জলে। আজানে চোখের উপর ভাসতে
থাকে মধুলোভী দুচোখ।
সুচিন্তিত মতামত দিন