অপরাজিতা নাট্যকর্মী ফ্রাঙ্কা রেমে
আজ আপনাদের একটা গল্প বলি। ইতালি নামে দেশটার একজন অভিনেত্রীর গল্প। ১৯৬৮ সাল গোটা ইতালি শ্রমজীবী মানুষদের বিক্ষোভে উত্তাল। চরম দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্টদের দল ক্ষমতার মসনদে। শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না। থাকার জায়গার অবস্থা তথৈবচ। অথচ শাসক শ্রেণী তখন মুনাফার নেশায় মশগুল। এক অসহ্য পরিবেশ এ শ্রমিকরা ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন সর্বত্র।আন্দোলন ক্রমশ হচ্ছে হিংসাত্মক। শাসকের তরবারি নেমে আসছে তাদের ওপর। কিন্তু এই বিদ্রোহ এরকমভাবে দমিয়ে দেবার নয়। একের পর এক ফ্যাক্টরিতে ধর্মঘট হচ্ছে। দখল করে নেওয়া হচ্ছে পরে থাকা কারখানা। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে কবি, সাহিত্যিক, অভিনেতা, নাট্যকার প্রত্যেকে রাস্তায় নেমে এই উত্তাল আন্দোলনের শরিক তখন। ঠিক এই রকম যখন পরিবেশ, বিপ্লবের রঙ্গমঞ্চে তখন এই অভিনেত্রীর আবির্ভাব। পেশাদার মঞ্চের প্রতিষ্ঠিত এই অভিনেত্রী সমস্ত ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মানুষের আন্দোলনে। নাট্যকার স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ করতে লাগলেনএকদম মানুষের সামনে। জেল-এ ,স্কুলে , শ্রমিকদের অধিকার করা কারখানায়, বাজারে। বলতে লাগলেন শ্রমজীবী মানুষের কথা । স্বভাবতই শাসক শ্রেণীর চক্ষুশূল হয়ে উঠলেন অচিরেই।
১৯৭৩ এর মার্চ এর এক রাত। মিলানের মাথার ওপর নেমে এসে রাতের কালো চাদর। সরু গলির একাকী রাস্তায় অভিনেত্রীর পায়ের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। খুব দ্রুত ও দীর্ঘপায়ে অভিনেত্রী হেঁটে আসছিলেন বাড়ির পথে। অকস্মাৎ সামনে এসে দাঁড়ালো একটা কালো গাড়ি। মুখ চাপা ৫ জন মানুষ জোর করে তুলে নিল গাড়িতে। তারপর চললো পৈশাচিক উল্লাস। পাঁচ জন অচেনা লোকের শিশ্ন একের পর এক প্রবেশ করলো অভিনেত্রির শরীরে। নারকীয় তাণ্ডবের পর কলার খোসার মতন ছুড়ে দিলো বিধ্বস্ত শরীরটা এক নির্জন পার্কে।
একসময় জ্ঞান ফিরল। উঠলেন কোনওমতে। তারপর ছেঁড়া খোঁড়া শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চললেন অনন্ত সময় ধরে। কতক্ষন তিনি নিজেই জানেন না। তক্ষণ না দেখতে পেলেন সেন্ট্রাল পুলিশ স্টেশন। হাঁটার সমস্ত শক্তি শেষ। বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গকে নিভিয়ে দেবার ব্যর্থ চেষ্টার বোবা স্বাক্ষী তিনি। উঁচু বিল্ডিং-এর দেওয়ালে হেলান দিয়ে ভাবলেন - নাহ, এখন নয়। কাল সকালে যাবেন পুলিশ স্টেশন।
প্রায় ২৫ বছর পরে সরকারি এক অফিসার সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, অভিনেত্রীর ধর্ষণের খবর যখন Pastrengo-র পুলিশ স্টেশনে আসে, তখন সমস্ত অফিসার হর্ষধ্বনি করে উঠেছিলেন। না ভুল শুনছেন না। ঠিক এটাই হয়েছিল।
দাঁড়ান। গল্প শেষ হয়নি এখনও। অভিনেত্রীর হাতে বোমা বন্দুক, গুলি কিচ্ছু নেই। শিল্পিদের কিচ্ছু থাকে না। ফ্যাসিস্ট শক্তি জানে না, এরকমভাবে শিল্পীদের গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফিনিক্স পাখির মতন তারা ছাই থেকে জন্ম নিতে পারে। বারবার। তুমি কে হে হরিদাস পাল আমাকে মারবে ?ওয়াআক থুঃ। পৃথিবীর কোনও বোমা বন্দুকের যে শক্তি থাকে না, সেই শক্তি তাদের আছে। কলম আমাদের গল্পের অভিনেত্রী ঘুরে দঁড়ালেন দ্বিগুন আগুন নিয়ে। ১৯৭৫ সালে একক অভিনয় একটা ১০ মিনিটের মনোলোগ লিখলেন- Lo stupro (‘the rape’)। গোটা বিশ্ব চমকে গেল অভিনেত্রীর সাহসে। শোনা যায় প্রথম অভিনয়ে দেখে কয়েকজন দর্শক জ্ঞান হারায়, এতটাই নিখুঁত অভিনয় ও বর্ণনা ছিল সেই নৃশংসতার। পৃথিবী জেনে গেল, শিল্পিদের হাত শিকলে বাধা যায় না। খেটেখাওয়া সর্বহারা মানুষদের পাশে থেকে কেড়েও নিতে পারবে না কোনো শক্তি।
ইতালি তো আমাদের দেশ থেকে কতদূর। কিন্তু একটুও অবাক হবেন না যখন আমাদের দেশের ফ্যাসিস্ট শাসকদের পোষা গুন্ডা ঠিক, ঠিক ,ঠিক একইরকম ভাবে মানুষের আওয়াজকে কেড়ে নিতে সর্ব শক্তি নিয়ে ঝাপায় ।মুঠো করা হাত কে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে ফেলতে চায় যেনতেন প্রকারেন। ভারতীয় সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ এর মুখটা একাকার হয়ে মিলে যায় সেই ইতালিয়ান অভিনেত্রী ফ্রাঙ্কা রেমের সাথে ।
ফ্রাঙ্কা রেমে-কে ধর্ষণ করে, গৌরী লঙ্কেশ-কে খুন করে দেশের মানুষের হাত থেকে এরা বাঁচেনি। বাঁচবেও না। কারণ দেশটা আমার, দেশটা তোমার, দেশটা কারও বাবার নয়।
সুচিন্তিত মতামত দিন