রিঙ্গোরেক্সিয়া-ঘাড়ের সঙ্গে যন্ত্র জুড়ে এক্কেবারে খাসা
‘বাগানে অনেক কাপড় মেলা আছে।সেগুলো বোধহয় তুলে আনা উচিত। যদি বৃষ্টি আসে? ফোনটা না আসা পর্যন্ত কাপড়গুলো তুলতে যেতে পারছি না। বাগান থেকে ফোনের শব্দ শোনা যায় না। এই ব্যাপারটা আমার জীবনে বড্ড টেনশন তৈরি করে। না, আসলে আমার একটা অবসেশন আছে, যখন ফোনের প্রত্যাশা থাকে, তখন কিছুতেই কাপড় মেলতে বা তুলতে যেতে পারি না।’
(নোটন নোটন পায়রাগুলি, কেতকী কুশারী ডাইসন)
ফোনের জন্যে নোটনের অস্থিরতাকে আজকাল এক গালভরা নামে ডাকা ডাকা হচ্ছে- রিঙ্গোরেক্সিয়া। যদিও নোটনের ল্যান্ডলাইনমুখী টানের চেয়ে এখনকার মোবাইলপ্রবণ দুনিয়ার অস্থিরতা অনেক বেশি,। রিঙ্গোরেক্সিয়ায় ভোগা মানুষেরা তাঁদের মোবাইল সেটটিকে চোখে হারান, তাঁদের বিশ্ব ঘুরে চলে একরত্তি ওই যন্ত্রটিকে ঘিরে। আক্ষরিক অর্থে ওই তাঁদের একমুঠো সুখ।
শিব্রাম হয়তো একে বলতেন কলের কব্জা। মদে মাতাল, চায়ে চাতাল মানুষেরা যেমন বরাবর ছিলেন, কলের কব্জায় পড়া মানুষেরাও একেবারে বিরল ছিলেন না। যন্ত্র তাঁদের কাছে যন্ত্রণা নয়, বরং চরম সুখের উৎস। হাতের কাছেই রয়েছে সুবোধ ঘোষের ‘অযান্ত্রিক’-র উদাহরণ। গাড়ির সঙ্গে মানুষের সখ্য সেখানে এক সংরক্ত চেহারা নিয়েছিল।তুলনায় অনেক কম আলোচিত, প্রায় কাব্যে উপেক্ষিতার মতো, পরশুরামের ‘একগুঁয়ে বার্থা’। বার্থা ছিল এক পতিব্রতা টাইপ জার্মান মডেলের গাড়ি, যে তার প্রাক্তন মনিবের হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিল!
অপ্রাণ পদার্থের প্রতি মানুষের আসক্তি কিন্তু বহু পুরনো। কেন যে ভুলে যাই কর্ণ কবচ কুণ্ডল নিয়েই জন্মেছিলেন। এ দুটি জিনিস আধুনিক গ্যাজেটের মতোই বহু বিপদ থেকে তাঁকে রক্ষা করেছিল, তেমনি বহু অজানিত বিপদও তৈরি করেছিল। তাঁর সহোদর ভাই অর্জুনের ছিল গাণ্ডীব আর কৃষ্ণের সুদর্শন চক্র। পুতুল বা টেডি বিয়ার জড়িয়ে যে শুধু খোকা খুকুরাই শোয় তাই নয়, অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষই কিছু কিছু জিনিসের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্ত থাকেন। গিন্নি মানুষের পানের বাটা আর চাবির গোছা ছাড়া চলত না এই সেদিন পর্যন্ত।বালক রবি যে দিদিমার পিঠে ফেলা চাবির গোছা কত সন্তর্পণে খুলে নিয়ে ঈপ্সিত বইটি বার করে নিয়েছিল, তা তো সবাই জানে। মাঝবয়সিনীদের যেমন চাবির গোছা, পানের বাটা, হাতপাখা, কিংবা পিকদানি, বয়স্ক বিধবাদের তেমনি ছিল জপমালা। পুরুষমানুষের ছিল ছড়ি। ছড়িকে বিছানায় শুইয়ে নিজে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে নিদ্রাহীন রাত কাটানোর বিখ্যাত গল্পটির মধ্যে শুধু অন্যমনস্কতা নয়, ছড়ির প্রতি নাছোড় প্রেমও ফুটে ওঠে। সঙ্গের এই সঙ্গীগুলো আবার ব্যাক্তিমানুষের ওপর নানান মুদ্রাগুণও আরোপ করত। কথামৃতে আছে কোট,প্যান্ট, হ্যাট পরলেই শান্তশিষ্ট লোক শিস দ্যায়, গটমট করে চলে আর কথায় কথায় ইংরেজি বলে। আর সারা পৃথিবী যে অপ্রাণ বস্তুটির বশ, তার নাম টাকা।
তবে প্রাণ আর অপ্রাণের একটা স্পষ্ট সীমারেখা টানা ছিল এই সেদিন পর্যন্ত। বাস্তব আর ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মিলেমিশে বকচ্ছপ মূর্তি ধরেনি। জপমালা চব্বিশ ঘণ্টা হাতে থাকলেও দ্রবময়ীদের চোখ সর্বদা সংসারের খুঁটিনাটির ওপর ঘুরে গেছে, মন পড়ে থেকেছে মুংলী গাইয়ের কাছে। কিন্তু এখন কলের যেমন চৌষ্টট্টি কলা, তেমনি তার আকর্ষণী ক্ষমতাও বহুগুণ।অচ্ছেদ্য কবচ কুণ্ডলের মতো বিবিধ ইলেক্ট্রনিক প্রহরণে সবাই এখন কর্ণ। ঘাড়ের সঙ্গে যন্ত্র জুড়ে এক্কেবারে খাসা- এই পরিস্থিতির চরম রূপ দেখা গেল জাপানে এই তো সেদিন।
সে এক অলীল পাখি। তামোগাচি। ডিম পাড়ে, ডিম ফুটে বেরোয় পাখির ছানা। খালি খালি খিদে পায় তাদের। খাওয়াতে হয়। মন খারাপ হলে একজন আরেকজনের সঙ্গে গল্পগাছা করে, এ ওর বাসায় বেড়াতেও যায়। তামোগাচির অসুখ করে, মারাও যায়। তখন তাদের জায়গা হয় গোরস্থানে। মাটি নয়, সাইবার স্পেস খোঁড়া সেই গোরস্থানের নাম ভার্চুয়াল গ্রেভ ইয়ার্ড। অলীক পাখির অলীক মৃত্যুতে কিন্তু সত্যি সত্যি অশ্রুপাত করে এই ভুবনগ্রামের হাজার হাজার শিশু , যাদের আঙ্গুলে আঙ্গুলে এতদিন চাবির রিঙের মতো ঘুরেছে রংবাহারি ছোট্ট ইলেক্ট্রনিক খেলনা তামোগাচি। পরম মমতায় আর উদ্বেগে যারা এতদিন লালন পালন করেছে অলীক পাখিটিকে। তামোগাচির পরেও জাপানে এসে গেছে কত নতুনতর খেলনা, যাদের ঘিরে শিশুরা গড়ে তুলেছে এক ভার্চুয়াল জগত। এ জগত কিন্তু এতদিনকার শিশুর কল্পনার জগত থেকে আলাদা।রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃখহারী’ কবিতার শিশু কল্পনায় জাহাজ বেয়ে সাগরপারে গেলেও বাড়ির সবার জন্যে উপহার আনতে ভোলে না, অর্থাৎ বাস্তবের সঙ্গে তার সংযোগ অটুট থাকে।
‘দাদার জন্যে আনব মেঘে ওড়া
পংখিরাজের বাচ্চা দুটো ঘোড়া
বাবার জন্য আনব আমি তুলি
কনকলতার চারা অনেকগুলি
তোর তরে মা দেব কৌটো খুলি
সাতরাজার ধন মানিক একটি জোড়া’
কিন্তু ইলেক্ট্রনিক খেলনা শিশুদের বাস্তবের বোধ লুপ্ত করে দিচ্ছে। গাড়ি চালাতে চালাতে তামোগাচিকে খাওয়াতে গিয়ে দুর্ঘটনার ঘটনা তো আছেই, শিশুরা স্বাভাবিক সামাজিক মেলামেশার জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
তবে বড়দের যন্ত্রের নেশা আরও মারাত্মক। তার মাশুল দ্যায় গোটা সমাজ। বহুবছর থেকেই আমরা আমাদের বাড়ির অতিথিদের চোখে চোখে চেয়ে কথা বলতে পারি না। সেটা যে একটা অসুখ তা জেনেছি সম্প্রতি। অসুখের নাম অ্যাটেনশন ডেফিসিট ডিসঅর্ডার সিনড্রোম, সংক্ষেপে অ্যাডস। এইডসের থেকে কম খারাপ নয় সে রোগ। আর তা সারার আগেই নতুন নতুন রোগ এসে আমাদের পেড়ে ফেলছে। যেমন এই রিঙ্গোরেক্সিয়া। বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোখ বারবার চলে যাচ্ছে মোবাইলের পর্দায়। ‘সখি ওই বুঝি বাঁশি বাজে/ বনমাঝে কি মনমাঝে’। কয়েক সেকেন্ড পর পর ফেসবুকে ঢুকে লাইক কমেন্টস দেখা এখন জাতীয় রোগ। আজকাল কেউ আর মাথা উঁচু করে হাঁটে না, নিচু মাথা ঢুকে থাকে মোবাইল ফোনে! শুধু কি তাই? যন্ত্রের নেশা ঠেলে দিচ্ছে সাংঘাতিক বিপদের দিকে। মোবাইল কানে রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়া তো নৈমিত্তিক ঘটনা। সেলফি তুলতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ার ঘটনাও আকচার ঘটছে। প্রতারক ইমেলের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়াও নতুন কিছু নয়। আজ যাঁদের বয়স আশির ওপর, তাঁদের ছেলেবেলায় পাঁজির বিজ্ঞাপন দেখে লুধিয়ানার ছুরি কি ম্যাজিক কিটবাক্স ডাক যোগে আনাতে গিয়ে ঠকে যাবার স্মৃতি আছে। তবে সে চোটটা যেত ডাকমাশুল এবং মৃদু আশাভঙ্গের ওপর দিয়ে। এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় খোলাখুলি ব্রেক আপের পোস্ট ঠেলে দিচ্ছে আত্মহননের দিকে। হাত ধরাধরি করে হাঁটছে সাইবার অপরাধ আর অবসাদ , কল আর মনোবিকলন। হঠাৎ সেদিন মেট্রোতে কানে এল এক মাঝবয়সিনী আর তাঁর তরুণ বন্ধুর সংলাপ। সেই মহিলার মোবাইল সংস্থা শুধু সেই রাতের জন্যে দিচ্ছে বিনাপয়সায় কথা বলার সুযোগ, তাঁদের সংস্থারই অন্য ফোনের সঙ্গে। ,মহিলাটি হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁর দোসর নম্বরটি, যার সঙ্গে সারারাত কথা বলে এই বিনিপয়সার ভোজের পুরো মজা উশুল করতে পারবেন তিনি। এমন আমোদ কি রোজ রোজ ঘটে?
জানি না, তিনি তাঁর সে রাতের সঙ্গীকে খুঁজে পেয়েছিলেন কিনা, তবে কলের শহর কলকাতার এই কল্লোলিনীকে দেখে যারপরনাই চমৎকৃত হয়ে আমি ভাবছিলাম, খুঁজে পেলেও কী কথা হবে, দীর্ঘ রাত ভরাবার মতো এত কী কথা হতে পারে, তাহার সাথে, তার সাথে?
হয়তো সে কথা জানেন নব্য আরব্য রজনীর নবীনা কোন শাহারাজাদি।
সুচিন্তিত মতামত দিন