রিয়া পাত্র - মায়াজম

Breaking

২৬ জানু, ২০২৪

রিয়া পাত্র




শীতের ভোর আর লেবুরঙা শাড়ি

রোদ অনেক দূরের কথা, আলো ফোটেনি তখনও ঠিক করে। কিছুটা হাঁপিয়ে আপে প্যাডেল করছে ওরা। হালকা প্রতিযোগীতা চলছে। দু'যজনকে বোঝা যাচ্ছে, তবে চেনা যাচ্ছে না। যাওয়ার কথা নয়। চোখ ছাড়া পায়ের পাতা থেকে কান, সব ঢাকা। মুখের যে টুকু অংশ বেরিয়ে তাতে ফালা ফালা করে কেটে ঢুকছে ঠান্ডা বাতাস। আপে প্যাডেল করতে গিয়ে কিছুটা হাঁপিয়ে গিয়েছে বলেই, বাকি রাস্তার আলোচনা এই মুহূর্তে কিছুটা বন্ধ। ডান দিকের রাস্তা ধরেই ফের শুরু হবে। মূলত দুজনের চিন্তা এখন লেবুরঙা শাড়ি নিয়ে। সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত আসছি পরে। তবে এই যে হিম হিম শীত, বৃষ্টি ছাড়াই ভেজা ভেজা সকাল, নিভু নিভু সন্ধে আর ঢিমে আঁচের প্রেম, এই মরসুমে খেজুর গাছের রস চুঁইয়ে পড়ার মতোই বালিকা কিম্বা যুবতীর ফাঁটা ঠোটের পাশে লেগে থাকে উদ্বেগ আর খুশি। সেরকম কয়েকজনের কথা বলতেই এই লেখা। যারা শীতের শুরুতে বিনুনির মতোই আলতো হাত বোলায় মটরশুঁটির লতায়, মায়ের ঘসে রঙ উঠে যাওয়া হলুদ চাদর মিলিয়ে দিতে চায় সরষে ফুলের ক্ষেতে, মহলের ছাই কুড়িয়ে আনে ঠাকুমার দাঁত মাজার জন্য আর বান্ধবীর দিদির বিয়ের জন্য খুঁজে বেড়ায় লেবু রঙা শাড়ি। এরা সকলেই ছোট জায়গার। ছোট পাড়া, ছোট গ্রাম, কিম্বা মফঃস্বলের। গ্রীষ্ম-বর্ষা পেরিয়ে শীত আসার মুখ থেকেই তারা মা-ঠাকুমাদের হাতে হাত মিলিয়ে বড়ি দেয়, মোটা লাল লেপ খাটে ফেলে দেয়। ওরা বলে, ছোট জায়গায় শীত আসে একান্ত আপন ভাবে। হুড়মুড়িয়ে নয়, একেবারে ধীরে ধীরে, আলতো ভাবে এসে ছুঁয়ে যায়। দিন গড়ায়, পরিচিতি বাড়লে জাঁকিয়ে বসে, জড়িয়ে ধরে। সেই শীতের সকালে বালিকা-যুবতীর দল গায়ে অলস চাদর চাপিয়ে যায় মহলের দিকে। ওই যে গাঁয়ের এক প্রান্তে এই বিশেষ সময়ে হয় মহল। এক কথায় খেজুর গুড় তৈরির জায়গা। খেজুর গুড় নিয়ে কত কথা ইদানিং। গুড়ের খাঁটি ভেজাল নিয়ে কথা, গুড়ের চা থেকে মিষ্টির রকমারি এবং বাহারি বিষয় নিয়ে নিরন্তর আলোচনা, পারলে বিশেষ অনুষ্ঠান। এরা ওসব জানে না। জানতে চায়ও না বোধহয়। নিজের ঘরের ধন নিয়ে কেই বা কবে ব্যাপারীর ভাবনা ভাবে? তবে একেবারে ভাবে না বললেও ভুল হবে। অনেকেই ইদানিং নিজেদের আবেগের সওদা করে বলেও চাউর হয়। তবে আবছা হয়ে যাওয়া ওই মেয়ে দুটি এসব জানে না। ওরা শুধু শীতের সকালে খসখসে ঠোঁটে ছুঁইয়ে দেয় কনকনে ঠান্ডা খেজুরের রস। ছাইয়ে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে গন্ধ নেয় ফুটন্ত গুড়ের। চোখ বন্ধ করে। সামনে সাদা রঙ তখন গনগনে আগুন রঙ হয়ে ফুটতে থাকে। ওই বিভৎসতার মাঝেও তাদের চোখের পাতা দিয়ে ভেসে যায় প্রেমিকের স্পষ্ট মুখ। সেই ছবিতে অবক্ষয় থাকে না, ভয় থাকে না ধসে যাওয়া সমাজের ছাপ পড়েনা। বেশিক্ষণ ভাবে কি সেসব? ভাবে না বোধহয়। তাদের কাছে ৭.৪৫ এর গ্যালোপিন কিম্বা ৮.২০ এর লেডিস স্পেশালও থাকে না। খেজুরের রসের থেকে টানা মেরে নিজেদের সরিয়ে এনে রান্নাঘরের উঠোনে ফেলে এক গোছা পালং শাক। তারপর চায়ের সঙ্গে বসে এক বাটি মুড়ি নিয়ে। মিনিট ১০ পর বেরোয় সাইকেল নিয়ে। তখনও রোদ ওঠে না। প্যাডেলে চাপ দিয়ে একে একে পের করে বড় বল গ্রাউন্ড, ছোট বল গ্রাউন্ড। এই যে দুদ্দাড় জীবন শুরু করে ভোরে, দিনভর ছুটে চলে তারা। আলগা হয়ে বিনুনি, আলগা হয়ে সাইকেলের কেরিয়ার, তবু ছুটে চলে। বুকের ভেতর স্বপ্ন থাকে, মাঘে বান্ধবীর দিদির বিয়েতে দুজনেই পরবে মায়ের লেবু রঙের শাড়ি। বড় হওয়ার পথে মায়ের যত্নের শাড়ি পরার থেকে আনন্দ বোধহয় আর কিছুই নেই। যেন এই আস্কারাটুকু পাবে বলেই ঘাড় বেকিয়ে তাকিয়ে থাকা প্রতি শীতে। কবে অনুমতি মিলবে, সেসব শাড়ি ছুঁয়ে দেখার। তার আগে পর্যন্ত লুকিয়ে প্রেমিকের হাত ধরা বা চুমু খাওয়ার মতোই নিষিদ্ধ সেসব। অনুমতি মিললে খোঁপায় দেওয়ার জন্য বাগান থেকে ছিঁড়ে নেবে গোলাপ ফুল। এটুকু সাহস দেখাবে ই দেখাবে তারা।
এই সামান্য ইচ্ছে বুকে নিয়ে আচমকা তারা দেখে ক্রমে কমে যাচ্ছে আলো। ডিসেম্বর, জানুয়ারির বিকেল বড় ছোট। তারা তখনও জানে আলো নিভলেই ফুরিয়ে যায় অর্ধেক জীবন। সেই অর্ধেক জীবনের মাঝেই আলাদাও হয়ে যায় তারা। দুজনের দুই আলমারিতে পড়ে থাকে মায়ের শাড়ি। একজন থেকে যায় অজ গাঁয়ে, একজন যায় শহরের দিকে। যে থেকে গেল মটরশুঁটির লতার মাঝে, সে আলো জ্বালে না আর শীতের রাতে। সংক্রান্তিতে হইচই হয়। পিঠের বাহার হয় ঘরে ঘরে। তবু চালের গুড়ি ছুঁয়ে তার মনে আসে দূরে যাওয়া বন্ধুর মুখ। সেই বন্ধু তখন দীর্ঘ পথ ঘুরে ঘুরে মরে। গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, এই সাইকেল রাতেও কি তাকে বয়ে নিয়ে যাবে চালের গুঁড়ো ছড়ানো উঠোনে? তার বিষন্নতা আলো জ্বালা শহরে, চাদর গায়ে মানুষেরা দেখতে পায় না। হয়তো ছুঁয়ে যায় ছাইয়ের গাদায় শুয়ে থাকা কালু ভুলুকে। তারা নড়ে চড়ে উঠলে, গুমটির পিছনে তাস খেলে যারা, খেদিয়ে দেয়। একলা মেয়ে আরও একলা হয়ে যায় শীতের শহরে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে তার, গলা বসে যায়। কেউ শুনতে পায় না সে চিৎকার। বেকারির সুবাস আর উৎসবের আলোয় কেউ ঠাওর করতে পারে না লেবু রঙা শাড়ির আবেগ। তবু বছর বছর আবার দুজনে সাইকেল শেখে, সরষে ক্ষেতে যায়, মটরশুঁটি আর সিমের ফুল আসার অপেক্ষা করে। বল গ্রাউন্ড পেরিয়ে টিউশনি যাওয়ার সময় মায়ের শাড়ি নিয়ে স্বপ্ন দেখে এবং একটা সময় স্বপ্নের খোঁজে তারা আলাদা হয়ে যায়। তার আগে দু' জনের পর্যন্ত সাইকেলের ঝুড়িতেই থাকে চন্দ্রমল্লিকা, কুল। গ্রাম, শহরতলির জীবন আদতে বড় সুন্দর, শুধু স্বপ্নের খোঁজে আলাদা হয়ে যাওয়াটুকু ছাড়া।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র