শিমুল
মাহমুদ প্রথমত একজন মানুষ; দ্বিতীয়ত তিনি
একজন লেখক । জন্ম নিয়েছেন বাংলাদেশে, ১৯৬৭ সালের ৩ মে। বাংলাদশের
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পাঠ গ্রহণ শেষে তিনি পৌরাণিক
বিষয়াদির ওপর গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। কবিতার সাথে তাঁর সখ্য
স্বৈরশাসনের দুঃসহকাল গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে। সমান্তরালে কথাসাহিত্যে রেখেছেন
নির্মোহ ছাপ; সেইসাথে সক্ষম হয়েছেন নিজেকে একজন সিদ্ধহস্ত সমালোচক হিশেবে
প্রতিষ্ঠিত করতে।
বর্তমানে তিনি
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা
করেছেন সাহিত্যের কাগজ ‘কারুজ’। ইতোমধ্যে তিনি
‘কলকাতা
লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা পুরস্কার ২০০০’, ‘বগুড়া লেখকচক্র কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১২’ এবং পশ্চিমবঙ্গের ‘অচেনা যাত্রী ও
দ্বৈপায়ন ১৪২২’ কর্তৃক সম্মাননা প্রাপ্ত হয়েছেন।
এবার-ই প্রথমবার
‘মায়াজম
ব্লগজিন’ এর জন্য তাঁর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ‘বস্তুজৈবনিক’
আমাদের
হাতে তুলে দিয়েছেন; আমরা আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই কবিকে । বাংলা নিয়মতান্ত্রিক
কবিতা-ঘরানা ছেড়ে পাঠক পেতে চলেছেন এক ‘ভিন্ন-প্রকাশ-রূপ’—এ এক্থাটা কাব্যগ্রন্থ আজ এই কথা জোর গলায় বলা যেতেই পারে। বৃহৎ কবিতার
পাণ্ডুলিপি একবারে প্রকাশ করা ব্লগজিনে সম্ভব নয় বলেই আমরা তিনতে খণ্ডে ধারাবাহিক
প্রকাশ করতে চলেছি শিমুল মাহমুদের ‘বস্তুজৈবনিক’--- আমাদের বিশ্বাস,
পাঠকদের
আমরা হতাশ করবো না; আপনাদের ভাল লাগবে ।
প্রসঙ্গক্রমে
বলি, পাণ্ডুলিপি
যেমন ভাবে সাজানো ছিল আমরা তার থেকে বেরিয়ে একটু অন্যরকম ভাবে উপস্থাপিত করতে
চাইছি। আপনাদের তন্নিষ্ঠ পাঠ-সহযোগিতা কাম্য ।
বস্তুজৈবনিক-- (দ্বিতীয় পর্ব ) প্রথম পর্ব পূর্বে প্রকাশিত মায়াজম ব্লগে
৩--
ঘুমের বিভ্রমে ভেঙে গেলে ছবি
স্বপ্নের ভেতর যেন বা রাজপুরুষ আমি
জমিয়েছি সিন্দুকে
প্রত্নমুদ্রা।
চন্দ্রগুপ্তের রাজকোষ থেকে
নিয়ে এনে স্বর্ণমুদ্রা
তোমাকে কিনেছি আবার
সেক্স স্টার
ফ্রি ডাউনলোড
লাইক দাও যেখানে খুশি।
ফিরেছো যবনকন্যা
পারস্যের বাজিকর পারেনি রাখতে দখলে
ভার্চুয়াল মার্কেট
রূপজীবী শরীরের ভিড়
এইভাবে বহুরাত
ওয়েভ অ্যাডড্রেস
তারকা চিহ্নিত জৌলুস
ভার্চুয়াল বিশ্বে জমা রেখেছি জেদ
বীর্যের ভেতর ফেনিয়ে তুলেছি ঈর্ষা
ফিরে এসেছি আবার
মহাকবি কালিদাস।
তোমাকে বিশ্বাস করে
ক্রমাগত ঢুকে গেছি মাটির ভেতর
ঈর্ষার গলা টিপে হজম করেছি বিষ
কর্পোরেট নারী
তুমি নও ব্যক্তিগত আমার।
ডুবে গেছে অনার্যের জাহাজ
হাঙরের দাঁত ফাঁকি দিয়ে
নীল তিমির পিঠে ফিরেছি আবার।
সমুদ্রের কাছে জমা রেখে দীর্ঘশ্বাস
শূন্যতার বুকে ভেসে ওঠা শুকতারার মত
পরিত্যক্ত স্মৃতির কাছে ফিরেছি আবার।
তোমার ঠোঁটের ভাঁজে জেগে ছিল
বিষণ্ন তিলক
বদলে ফেলেছো
ঠোঁটের রেখা
মুখের মমতা।
গড়িয়ে নামছে প্রপাত
জলের গভীরে
পতনের শব্দ।
ডলফিনের তলপেট থেকে
চুষে নিয়ে যৌনগন্ধ
আদিকোষে ফিরেছি আবার।
কাঁপছে বিদ্যুৎতার
আতশবাজি উঠে যাচ্ছে ঊর্ধ্বে।
আদিবাসী বৃক্ষের ডালে ঝুলে আছে
অর্ধ ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ।
ডালে ডালে ঝুলে থাকা প্রবাদ-প্রণত চাঁদ
উড়বার প্রবণতায় মেলেছো পালক।
শূন্যতার ডানায়
ঝাঁক ঝাঁক রূপোলি সোনালি চাঁদ
উড়ন্ত শিশু।
অভিমান ভেঙে জেগেছি আবার
ফিরেছি জলের উৎসে
এতদিনে বুঝে গেছি
আমিই কারণ
পৃথিবীর যাবতীয় বিষাদ
মানস-ব্যাধি
এই সত্য মেনে নিয়ে
তন্তুবায়ি নারী
মোহমুগ্ধ নিপুণ শিল্পী
মাকড়সার জাল ছড়িয়ে দিয়েছ
দেহে ও সম্পদে।
চিরুনির আঁচড়ে
ঝরে পড়ছে দুঃখ-কাতর উকুন
কেশ-সজ্জার ভাঁজে জমে আছে চন্দ্রকথা
কষ্ট ও তিক্ততার সরবত পান শেষে
ভেসে গেছো সরযূর জলে।
প্রিয়তমা প্রভা
স্নানঘরে ফিরলে আবার!
স্নানঘরে তয়লা হাতে
দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি
পৃথিবীর প্রথম কবি
যৌনতার প্রতীক
সমুদ্রের বিষণ্ন মর্মর।
মাটির বুক থেকে টেনে তুলেছ দুধ। পিঙ্গল-বৃক্ষ।
মায়ের বুক থেকে চুষে নেই মধু
মাটির শিরায় কেঁপে ওঠে রক্ত। প্রাণকণা।
মায়াকাতর ফুলেরা আমার বোন
হরিণ আমার ভাই
পাহাড়ের চূড়া
সবুজ প্রান্তর
ভেড়ার পশমের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা উষ্ণতা
বলছি আবার
পৃথিবী আমার মা
আমরা এই মায়ের সন্তান।
এই কথা ভুলেছি আবার
ভুলেছি জন্মক্ষত।
শকুন-মাতার স্তন্য পানের পর
জেগে উঠে
জড়িয়ে ধরেছি আবার
রাজা দুষ্মন্তের শরীর।
বন্ধুরা এসো
ছড়িয়ে যাও
গৃহে গৃহে মায়া ও আনন্দ
যখন ইচ্ছে হয় এসো
মরুতে অথবা গহন বনে।
ত্বকের নীচে রেখেছি মায়া
দেহের শিরা খুলে দেখাব
জল ও মাছের প্রেম।
বাঘ বাঘিনীর সঙ্গম দৃশ্য দেখে
শিখেছি জন্মপুরাণ।
পেয়ালা ভর্তি কাঁচা রোদ
কাঁচা হলুদে ডুব দিয়ে জেগে ওঠা
সোনালি রোদ
তোমার চুম্বনে সহস্র বছরের মমি থেকে
জেগে উঠে দেখি
সহস্র বৃষ্টিতে ভিজছে এক জোড়া চড়ুই
ভাই-বোন
জায়া ও পতি
প্রতিবেশী মেঘেদের আত্মীয়।
প্রিয়তমা চড়ুই
আকাশের গায়ে লিখে রাখ বর্ষার কবিতা
পালকের তুলিতে আঁকো বরফ-পাহাড়
মৃত পাখিদের কবর
ধূসর স্মৃতি।
আমাকে ছোঁয়নি কখনও কোনও চড়ুই
অনুভবে
আকাঙ্ক্ষায়।
রুমালের গায়ে লিখে নিয়ে আমার নাম
রেখে যায় নি কেউ বালিশের নীচে।
উড়িয়েছি নিরাকার রুমাল
সমুদ্রের সত্তায় জেগে আছে নীল
ব্যথা ও
বিরহগাঁথা।
নীল তিমিদের অনির্দেশ সাঁতার
বুকে জ্বলছে মুগ্ধতার আগুন
মাছের ত্বকের ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছি
নালন্দার পুঁথি
কবি অশ্বঘোষের প্রেমিকা
প্রভা-র প্রতিভা নিয়ে ফিরে যাচ্ছে
জলস্রোত
ঢেউয়ে ঢেউয়ে জলহংসীর গান
অরণ্যের গভীর থেকে খুঁজে এনেছি
চিতাকাঠ
পাখিদের শব।
মৃত্যুর অনেক গভীরে
মৃত্যুর গহীনে শুয়ে গল্প করছে ওরা
এক জোড়া মানব-মানবী।
ডাকছে আকাশ
আকাশের ডাক শুনবো ভেবে
গাছেদের সাথে মেলেছি ডানা।
দূর কোনও চিনিকলের চিমনি থেকে
ভেসে আসছে সন্ধ্যা
কুয়াশার চাদর
জন্মসখা যমুনা
জন্মসখা নদী আমার
নদীসঙ্গমে হয়ে উঠি, যথার্থ পুরুষ।
পিরপুকুরের ঘাটে
পাথরের ওপর
ওজু সেরে ফিরে যাচ্ছে
হাজার বয়সি পুরুষ।
নেমে আসছে অমাবস্যা
জোছনার বিপরীত লিঙ্গ।
ফিরে এসেছি আমি
যবন পুরুষ
আদমের দেহ নিয়ে
জেগে উঠেছি আবার
ঘন-জোছনার সুরত।
পথে পথে ফুটে আছে ফুল
আসমানি কিতাবের দিকে হেঁটে গেছি আমি
হাতে নিয়ে নামহীন ফুল
পবিত্র পুরাণ।
জায়নামাজের ওপর
পিপড়েরা সার বেঁধে হেঁটে যাচ্ছে
মাবুদের মসনদ-সন্ধানে।
পিপড়েদের কাছ থেকে শিখে নেই
মহাকাব্যের স্লোক
টুকে রাখি স্লোক
নকলবিদ্যা
তাবিজ-লিখন।
মহাকাব্যের পাতা থেকে তুলে এনেছি প্রেম
পাহাড়ের গায়ে লিখে রাখি
প্রণয় পরিনাম
প্রাগৈতিহাসিক ভুল
পুঁথি হাতে নতজানু কালিদাস। চন্দ্রগুপ্তের চাকর।
আমি দাস
দাঁড়িয়ে রয়েছি নকলবিদ্যা মুঠোয়।
সাপলুডুর ছকে সাজিয়েছি সংসার
মই বেয়ে উঠে যাই অভিজাত পালঙ্কে।
কে তুমি বাড়িয়ে রেখেছ হাত
অভিশপ্ত গ্রীষ্মের ভেতর।
স্পর্শ কর হাত
ঝরে পড়বে সব কটি আঙুল
মমির গন্ধ লেগে আছে ঠোঁটে
ট্রেনের কামড়া থেকে ভেসে আসছে
মানুষ পোড়ার গন্ধ।
ভুল পরিচয়ে বেঁচেছি এতকাল
দলিলে লেখেছি ভুল নাম
ভুল বুক থেকে চুষে নিয়েছি দুগ্ধরস-স্বেদ
অপ্রসন্ন কৈশোর বসিয়ে রেখেছে আমাকে
আমারই মুখোমুখি।
তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম
তুমি পাথর হলে।
তোমার বুকে হাত রাখলাম
আর
মসলিন কাপড়ে বাঁধা রূপোর কাচুলি
তাও পাথর হল।
পাথর প্রসবরত নদী
তারপর অনেক দিন
তোমার মুখ মনে পড়ছে না আর
আরও এক সোনার মেয়েকে
বসিয়েছি তোমার মুদ্রায়।
চাপকল থেকে টেনে তুলছি জল
তৃষ্ণার জল
তোমার শরীর
আমিও ছিলাম
সেই মহল্লাফেরৎ যুবকদের ভেতর
বহুবার উলঙ্গ করেছি তোমাকে
বহুবার
মৃতের মুখের মত
তোমার মুখ থেকে খসে গেছে
প্রাত্যহিক কাম।
তীক্ষ্ন খঞ্জর হাতে তুর্কি-নারী
কেটে নিচ্ছে সবুজ আপেল।
কব্জিতে বাঁধা, সময়-স্মারক
কামুক কণ্ঠে ডাকছে ঘড়ি
ফেলে আসি ঘড়ি, ভারত সাগরে।
যিশুর জন্মের আগে
এই ঘড়ি জমা রেখেছিলাম আমি
সূর্যের
কাছে।
পিছু ছাড়ছে না সময়
সর্বভুক
সময়।
পিছু ছাড়ছে না সময়
মৃত্যু ও
ক্ষয়
পৃথিবীর
যাবতীয় পাপ।
উটের পিঠে চেপে ফিরে যাচ্ছে চৈত্রের রোদ
আরব্য রজনীর যৌনতা জমাট বেঁধেছে আবার
লোকালয়ে
বাজারে ও গৃহে
বাজারে ও গৃহে সাজিয়ে রেখেছি ঘোড়া
পাথরের ঘোড়া।
নির্বীজ সময়
মৌন মোমের মত
এই চোখ জমা রাখি সময়ের কাছে।
মগজে মৌমাছির মৌ
ঘুমিয়ে পড়েছে শিশু।
মগজে মধুপোকা ডাকছে
ঘুমিয়ে পড়েছে শিশু।
ফলের দোকান থেকে সবগুলো মৌপোকা
ঢুকে যাচ্ছে নির্বীজ মগজে
ঘুমিয়ে পড়েছে শিশু।
কোথাও সাক্ষী ছিল না কেউ
অজস্র ঘুমন্ত শিশু
অনন্ত মৃত্যুর মুদ্রা।
দেহ ছেড়ে চলে গেছে মায়া
যন্ত্রণা
কষ্ট ও দুঃখ
পৃথিবীর যাবতীয় বিষাদ
জোছনার জলে ভেসে যায় দুঃখ ও মৃত্যুর পাণ্ডুলিপি।
৪
পাহাড় থেকে গড়িয়ে নামছে পাথর
তুমি শক্ত পাথরের ওপর রাখতে চাচ্ছ পা
মা হাওয়া রেখেছিলেন যেমন
হাতের পাঁচ আঙুল পাথরের শরীরে।
আমার বোন
শিমুল কুড়াতে ব্যস্ত
প্রস্ফুটিত
লাল
যেন বা অস্ট্রিক দুপুরের ভিড়ে
প্রিয়তমা আত্মীয়ার পদচিহ্ন
যেন বা
রাগি
বদমেজাজি
অথবা বিপ্লবী
অথবা
থু থু নিক্ষেপকারী
রাস্ট্রদ্রোহী।
অসভ্য রাষ্ট্রের পিঠে প্রশ্রাব করে
এগিয়ে যাচ্ছি আমি কবরের দিকে।
সীমানা ছেড়ে চলে যাচ্ছি
যেখানে কোনও রাজা
অথবা রাস্ট্র নেই।
তখনও গড়িয়ে নামছে পাথর
পাহাড়ের চুড়া থেকে।
খুঁজছিলাম রাস্ট্রবিহীন মাটি
দাঁড়াবার মত একখানা সমর্থ পাথর।
আমবাগানের নীচে বাতাস
নির্লিপ্ত
পূর্বজন্মের অচরিতার্থ ইচ্ছেরা
ঝাঁক বেঁধে বেড়াতে এসেছে
পলাশির প্রান্তরে।
তুমি এখনও দাঁড়িয়ে
তৃতীয় বিশ্বের বিকেলের বুকে।
এগিয়ে আসছে মূর্খ অন্ধকার
জাদুচাবি ঝুলছে কপালে
তুমি ঘেমে উঠেছ
ভয়ে?
নাকি লজ্জায়?
আমি ঈশা খার মত বদমেজাজি
লোভে ও প্রতাপে
পিতলের আকাঙ্ক্ষা করেছি পরিত্যাগ
স্বর্ণমোহরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে
ধোঁয়াগন্ধ
পুড়ে যাওয়া বাতাসের ব্যর্থতম নৃত্য
শীতরাত্রির হারিয়ে যাওয়া উষ্ণতা
ব্যক্তিগত জন্মদিনের পরিত্যক্ত মোমবাতি।
নিঃসঙ্গ কুয়াশায় নিভে যাচ্ছ তুমি
আমি ঠাণ্ডায় অপেক্ষা করছি
আমাকে সঙ্গ দেবে এমন একজন বন্ধু
আমি অপেক্ষা করছি
মোমবাতি পুড়ছে।
গুপ্তধনের লোভে নেমে গিয়েছি নদীর গভীরে
সুরঙ্গ খুড়ে পেয়েছি প্রত্নপুত্রের পাত্র
প্রণয়ের ডালে সবুজ পিপড়ার দংশন
অবশেষে গুপ্তধনের আশায় পেয়ে গেছি
জাদুগৃহ
নারীর শরীর
শিল্পের বলিরেখা
একফোটা চাঁদজন্ম
ধুধু গ্রামপথ
বালি আর বালিয়ারি খেলা।
হারিয়েছি শ্রাবণবৃষ্টি
গ্রামশিক্ষক
হাটের জিলাপি
তালপাতার বাঁশি
সন্ধ্যার বাস ফেল করে বসে আছি
বটতলার প্রাচীন শেকড়ে।
আমি কি সুতোকাটা হলুদ ঘুড়ি?
বালিহাঁস উড়ছে আকাশে
ধুলো মেখে গায়ে
ঘুমিয়ে পড়েছি
ফিরতে চেয়ে
হেরে গেছি তোমার কাছে।
জন্মই যদি সহজ ইচ্ছে আমার
গর্ভে নাও আমাকে
এশিয়ার গর্ভ থেকে জেগে উঠুক কেউ
পৃথিবীর পৌরাণিক ফুল।
জরায়ু-শয্যা থেকে জেগে উঠে
অনেক দিন ঘুমাইনি আমি।
গর্ভে ধরে বসে আছেন মা
এশিয়ার ইতিহাস
বর্ধিষ্ণু পুত্র।
তিনবিঘা কড়িডোর পিছে ফেলে
দহগ্রামের দুঃখ ফিরে আসছে আবার।
আমাকে কেউ একজন পিতা
একটি শাদা জামা দিন
মানচিত্র এঁকে বুকে ও পিঠে
ফিরে যাব অমীমাংসিত সীমানা-ঘৃণায়।
কাটাতারে ঝুলে আছে গুলিবিদ্ধ বালিকা
নারীর নিতম্বের দিয়ে তাকিয়ে বুঝেছি
আমরা সবাই ভারবাহি পশু
কাঁটাতারে রেখে আসা গুলিবিদ্ধ কন্যা
আমরা চিৎকার করছিলাম
রাষ্ট্র তখন বধির
আমরা গর্জে উঠেছিলাম
রাষ্ট্র তখন নিপুণ অভিনেত্রী
শিল্প শিল্প! এক একটি মৃত্যু
এক একটি নিখুঁত শিল্পসৌধ
যেন বা এক একটি মৃত্যু
এক একটি ব্যক্তিগত ঘৃণা
ব্যক্তিগত আগুন
আগুনের অবশেষ শিল্প
টেরাকোটা।
অবশেষ আগুনের ঘৃণা থেকে
টেরাকোটা হাতে দাঁড়িয়েছি আবার
পিছে রেখে এসেছি
চল্লিশ বসন্তের ঘৃণা
অশুভ দ্রোহ।
পাতা ঝরছে
কাঠুরিয়ার কাঠ কর্তনের শব্দ
মিশে যাচ্ছে চৈত্রের মুখরতায়।
প্রত্যেক বাঙালির একটি ডাকনাম থাকে
ডাকনামের ভেতর থেকে
নীলদীঘি-জলে ভেসে উঠেছিল যে শপথ-বাণী
সেই শপথ-বাক্যের কাছে
ফিরে এসেছি আবার।
ক্ষমা চাইছি প্রাকপুরাণ
জোনাকির মাতা
আলোর কন্যা
চলে যাচ্ছি বসন্তের অন্তরালে
ঋতুহীন
অসভ্য আদিম।
পাশের বাড়ির বিছানায়
জোছনা ঘুমিয়ে আছে
উজ্জ্বল
স্বপ্রতিভ মায়া
মগ্ন শরীর।
এখনও আকাশকে পাখিদের
শিক্ষিকা বলে জানি
আজও কুয়াশার হাত ধরে
ছোটো বোন স্কুলে যায়।
চিলের ডানার নীচে ছড়ান গমক্ষেত
ঔষধি সবজি
লজ্জাবতী কিশোরি
গ্রাম্য
ময়লা
কষ্ট সহিষ্ণু
কয়লার গুড়োতে দাঁত মেজে
দাঁড়িয়ে রয়েছে যে মেয়ে
আমি ওর কানের লতিকায়
খুব আস্তে ঢেলে দিতে চাই
গুপ্ত মন্ত্র
আমি সেই ঘুড়িবালক
কোন এক ব্যক্তিগত সন্ধ্যায়
জমা রেখেছিলাম
সুতোমাখা বাঁশের লাটাই
সাপে কেটেছিল যাকে
আমি সেই বালক
শোকতপ্ত দেহে পুড়েছিলাম
পরিত্যক্ত শশ্মানে
আমার ছাইয়ের ওপর
পাখিরা পেড়েছিল ডিম
সেই থেকে পাখিরা আমার আত্মজ।
গার্হস্থ্য বেদনায় ফিরেছি আবার
পোয়াতি সন্ধ্যায়
লবণ ও উষ্ণতা মেখে
নারীর দেহে
তোমার ঠোঁটের কাছে এগিয়ে যেতেই
পেয়ে যাই কবরের ঘ্রাণ।
শীতের চামড়া ছেড়ে
জেগে উঠেছে ফাল্গুন
নাভিতে কস্তুরি ঘ্রাণ
নাভি থেকে ঝরছে
সাতরঙ মাছরাঙা।
তুমি অন্ধ পাথর
গড়িয়ে নামছো
সবুজ পাহাড় ভেঙে।
নভোযানের ক্যাপসুলে বসে
ছুটে যাচ্ছ তুমি, বিগত শতাব্দি।
বস্তুজৈবনিক-- (দ্বিতীয় পর্ব )
গদ্যর দ্বিতীয় পর্ব শুরু হচ্ছে ---
পরিবেশ নির্মাণ
তথা চিত্রকল্পের আশ্রয়ে ঘটনার ইঙ্গিত প্রদান এবং গুটিকয়েক চরিত্রের আনাগোনা, সেসাথে
বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেসেজ পাওয়া যাচ্ছে কবিতার শুরুতেই। যেমন, স্ফটিক উইলো, জলের পপলার, উঁচু ঝরনার ওপর
বাতাসের ধনুক আর এদিকে বৃক্ষদের শেকড় মাটির গভীরে প্রোথিত। অর্থাৎ আমাদের শেষাবধি
শেকড়ের নিকটই প্রত্যাবর্তন করতে হচ্ছে। যদিও নদী এগুতে থাকে। অগ্রসর হয় নক্ষত্রের
নির্বিকার গতিপথ অথবা যদিও শোনা যায় উপচে পড়া জলের তরঙ্গে দৈববাণী। সারারাত। অথবা
প্রতিটি দিন। সবকিছুকে নিয়ে অক্ষয় সবুজের দুর্নিবার আধিপত্য আর বিশাল উদার আকাশে
পাখনার পর পাখনা সতেজ আলোর মত ঝলমলে দৃশ্য। অতঃপর এমন ইঙ্গিতময় ছবির ভেতর প্রবেশ
করে গুটিকয়েক পরোক্ষ চরিত্র। যারা বনের ভেতর অনাগত দিনের পথ নির্মাণে বিভোর।
তাদেরকে ঘিরে থাকে বিষণ্ন দুঃখের সমারোহ।
অতঃপর জ্বলন্ত অট্টালিকার ছবি ভেসে উঠতে দেখা গেল। দেখা গেল পৃথিবীর বুকে ভাসমান
সমুদ্র আর বাতাসে ভাসমান পর্বত। আলোর বিভাজন। আলোর জঙ্ঘা। আলোর তলপেট। উপসাগর।
সৌরপ্রস্তর। আলোর মেঘবরণ শরীর। প্রাণবন্ত আলো। লাফ দিয়ে ওঠে দিনের রঙ। ঝকমক করে
ওঠে প্রহরের পর প্রহর। দৃশ্যমান জগৎ যেন তোমার স্বচ্ছতায় স্বচ্ছ। অর্থাৎ কবিতাতে
আরও একটি পজেটিভ চরিত্রের আগমন ঘটতে দেখা গেল। অতঃপর পৃথিবীর প্রতিটি শব্দ কবির
নিকট এক একটি স্বয়ম্ভূ চরিত্র। অর্থাৎ প্রতিটি শব্দ যা কিনা শেষাবধি একটি স্বয়ম্ভূ
কবিতা। পাজ-এর উক্তি অনুসারে এই কবিতা হচ্ছে হারানো মানুষের অনুসন্ধান।
পরাবাস্তববাদের
প্রঘোষক আন্দ্রে ব্রেতোঁর মত পাজও মনে করেন, (যদিও পাজকে পরাবাস্তববাদী কবি বলা
যৌক্তিক নয়) কবিতা হচ্ছে অহম্ এর আত্মরক্ষার নিয়ামক। এক্ষেত্রে কোনও ধর্ম নয় বরং
ধর্মনিরপেক্ষ নভোচারিতা। ধর্মের ভেতর থাকবে না কোনও ঈশ্বরবোধ। অথচ রহস্যময় ধর্মীয়
চেতনায় যে অসীমের প্রতি আকুলতা লক্ষ করা যায়, সেই আকুলতা
পাজ-এর দীর্ঘকবিতার একটি ঐক্যসূত্রও বটে। যদিও এক্ষেত্রে ইপ্সিত গন্তব্য
স্বর্গপ্রাপ্তি নয় অথবা নয় কোনও নির্বাণ লাভ তথাপি ইন্দ্রিয়গোচর জগতের ভেতরে ও
বাইরে যে অতীন্দ্রিয় অনুভূতির জগৎ আছে, সেই জগতের
অস্তিত্বকে অবয়ব দিতে পারার কারণেই পাজ-এর দীর্ঘকবিতার অভিব্যক্তি এত বিশাল; যে বিশালতার
ভেতর রয়েছে মানব সভ্যতার রূঢ় বাস্তবতার আকুলতা; আর এই ধরনের
আকুলতাকে পাঠক উপভোগ করেন দীর্ঘকবিতাপাঠে। এবং এই অনুভূতির উৎস হচ্ছে জগৎ ও জীবন।
সুতরাং পাজ নিশ্চিত বিশ্বাসে উচ্চারণ করেন, কবিতা এবং জীবন
ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শ্রেষ্ঠ কবিতার জীবন্ত চিত্রকল্প ব্যবহারিক জীবন ও কর্ম
অভিব্যক্তিরই ফসল। সুতরাং,
তুমি সমুদ্র
আক্রান্ত এক নগরী
আলোয় বিধ্বস্ত
এক গড় কেল্লার,
টসটসে পীচ ফলের
রঙ দু’ভাগ
হয়ে যায়,
লবণ পাথর আর
পাখির এলাকায়
উদাসীন দুপুরের
রাজত্বে
(হায়দার আলী খান অনূদিত)
এরপর কামনার রঙে
সেজে ওঠে একটি চরিত্র। যে কিনা কবির চিন্তার মত নগ্ন হয়ে উঠতে ইচ্ছুক। ইচ্ছুক, চোখজোড়াকে
সমুদ্র বানিয়ে ফেলতে। এবং যে চোখজোড়ায় বাঘেরা স্বপ্নের সুধা পান করে; আর ঐ চোখের
জ্যোতিতে পৃথিবীর তাবৎ গানের পাখিগুলো পুড়ে পুড়ে আত্মাহুতি দেয়। অতঃপর দৃশ্যপটে
একটি চাঁদ প্রবেশ করে। কাহিনি দানা বেঁধে ওঠে। ইঙ্গিত তীব্রতা লাভ করে। ক্রমশ
কবিতার ক্যানভাস ছড়াতে থাকে। অতএব অবশ্যই কবি তার কাঙ্ক্ষিত নারীর চিন্তার ভেতরে প্রবেশ করেন এবং
কবি স্বপ্নের মত নারীর তলপেটের খুব কাছাকাছি ঘন হয়ে আসেন।
আর এদিকে
সারাদেশময় শস্য বোনা শ্যামল ঘাঘরার ঢেউ। সঙ্গীত গীত হয় এবং প্রিয় রমণীর ওষ্ঠাধার, ঘন কালোচুল আর
চোখের দৃষ্টি সরারাত... রাতভর... দিনভর...; জলেরও শেকড় আছে
আর কবির বুক উন্মুক্ত হয়, উলঙ্গ হয়। অতএব প্রিয় মেয়ে বৃষ্টি হয়ে কবির
ত্বকের ওপর ঝরে পড়তে থাকে। সুতরাং কবির বুকের গভীরে তরল এক গাছের জলীয় শেকড় গজাতে
শুরু করলো। এবং কবির নিঃসঙ্গ একাকি শরীরী প্রতীকের মাধ্যমে ক্রমাগত উন্মোচিত হতে
থাকে দেশ-কাল-পাত্র আর কূটাভাষ দ্বন্দ্ব। সুতরাং ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো
ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বের সত্তা। সুতরাং মানুষগুলো অশরীরী; পথ হাতরায়।
চরিত্রগুলো নস্টালজিয়ায় হাবুডুবু খায়। পচা গ্রীষ্ম, অতীত পিপাসা, ছায়ার মত একটি
মুখ মনে পড়তেই আবার হারায়। একটি হাত, আঁকড়ে ধরতেই
চুরচুর হয়ে যায়। অপরিচিত হাসি যেন মাকড়সার জাল। তারপরও বছর পার হয়। আয়নার
প্রতিবিম্বে ভেসে ওঠা মুখায়ব ভেঙে টুকরো টুকরো; রাস্তায় পড়ে
থাকে। বিকেলের সূর্য লুকিয়ে যায় কোথাও। ফেটে পড়া আঙুর ফলের ভেতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে
মেয়েরা বেরিয়ে আসে। স্কুলের আঙিনায় মেয়েগুলো ছড়িয়ে পড়ে। আর ওদের মধ্যে একজন, যে কিনা
দীর্ঘাঙ্গী সে আলোর শিশমহল ধরে হেঁটে গেলে শূন্য প্রান্তর ওকে জড়িয়ে ধরে টেনে নিল
আত্মার গভীরে।
রবীন্দ্রনাথের
মত অথবা র্যাঁবোর মত ওক্টাভিও পাজও মনে করেন, ইন্দ্রিয়কে
সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর করে তোলার প্রচেষ্টাতেই কবিতার উদ্ভব। এই উদ্ভাবনা
দীর্ঘকবিতার ক্ষেত্রে বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শময় জগৎ নিয়ে নতুনভাবে ধরা দেয়। অর্থাৎ
বাস্তব জগতের বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শ কবির শরীর ও মন থেকে কবিতার শরীরে সংক্রামিত হয়।
কবির চোখ যেন কলমেরই চোখ। জন্ম হয় আরও নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গির। সুতরাং এ কথা বলা
সম্ভব, চিরন্তন এবং ধ্রুব আমাদের ইন্দ্রিয়ের বাইরে নয় বরং তা ইন্দ্রিয়
দ্বারা স্পর্শযোগ্য এবং যাকে অবশ্যই কবিতাতে স্থানান্তর করা সম্ভব। যেমনটি ঘটতে
দেখা যায় পাজ-এর দীর্ঘকবিতায়।
কুয়াশার স্তম্ভ।
পাহাড়ি ঝর্ণা। চাঁদের চকোরী। ঈগল পাখির বাসা। সাগরের নীচের উপত্যকায় রাখালি বালিকা
এবং প্রেতলোকের দ্বার রক্ষিণী। অসংখ্য ছবি মিলে জন্ম নেয় জীবন্ত কিছু চরিত্র।
চরিত্রদের ঘিরে তৈরি হয় উপগল্প। উপগল্পে দেখা যায় খাড়া পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে
পড়ছে একটি চিতা। সেখানে দ্রাক্ষালতার পাশাপাশি বেড়ে উঠছে বিষাক্ত উদ্ভিদ আর
স্বর্গীয় ফুলের অন্তরালে রসে টইটম্বুর আঙুর। দৃশ্যপটে ভেসে উঠতে দেখা যায় বিদ্যুতে
তৈরি রমণীদের। জেসমিনের বাগান ভরে যায় আলোতে। গুলি খেয়ে আছড়ে পড়া যুবকের ক্ষত থেকে
নুন ঝরছে। গোলাপের ডালগুলো নুইয়ে পড়ছে আর আগস্ট মাসের তুষারপাতের ভেতর দেখা গেল
ফাঁসিকাষ্ঠে লটকানো একখানা বিবর্ণ চাঁদ। অতঃপর সমস্ত নগরময় যন্ত্রণা। মরুভূমি থেকে
এক বুক ভাষা নিয়ে বাতাসেরা ভেসে আসতে থাকে। বাতাসে ভেসে ওঠে সভ্যতার শেষ সৌরলিপি; যা কিনা বেদনা
অথবা গম অথবা যবের আগুনের সমান্তরালে নিঃশেষ। লোভী মানুষের ভয়ার্ত মুখ-গহ্বর।
পাশাপাশি অশরীরী সময়ের ওপর ভেসে উঠলো একজন কিশোরীর মুখ। মুহূর্তে ভেঙে যায় শহরের
সজীবতা। এবং চারিদিকে মৃত্যুর হাতছানি। এক একটি রাত্রি দীর্ঘ ভয়ঙ্কর আয়েশি হাই
তুলে ক্রমাগত এগিয়ে আসতে থাকে মানুষগুলোর দিকে; নগরবাসীর দিকে।
জীবন্ত মৃত্যুর অবয়ব ভয় দেখায় ওদের। তারপর আরও হাজারও সংঘাত অতঃপর ঘটনাক্রম। অতঃপর
ওরা মানুষগুলো বাস্তুহারা হয়। ওদের চিন্তাগুলো বাস্তুহারা হয়। গাছের ডালে বসে থাকা
পাখিগুলো বাস্তুহারা হয়। চিন্তার পারদ ছড়াতে থাকে শিরায় শিরায়। অথচ মানুষগুলো
জানতো বাঁচার মত বাঁচতে পারার নাম জীবন। অথচ সেই জীবন এখন অতীত। সমুদ্রের উচ্ছ্বাস
এখন অতীত। এমনকি অতীতও অতীত নয়; এখনও সে বয়ে চলে নিঃশব্দ অনুবর্তী অদৃশ্য
মুহূর্তের দিকে। এ পর্যায়ে এসে দীর্ঘকবিতা পুরো মাত্রায় জমে ওঠে। জমে ওঠে
ক্লাইমেক্স। ঘটনার উত্থান ও গতি। শিহরণ জাগাবার মত ভয়ানক অনুভূতি নিয়ে পাঠক আরও
অগ্রসর হন। একে একে উন্মোচিত হতে থাকে দৃশ্যের পর দৃশ্য। অনুভূতি। বিস্ময়। ভয়। আর
প্রজ্ঞালব্ধ জগতের ধ্যানমগ্ন বাসস্থান। ধ্যানের মধ্যে জন্ম নেয় ভাষা। যা কিনা
চাঁদের জমজ সহোদরার মত মানুষের বুকে গর্ত করে করে অগ্রসর হয়। ভাষারা জন্ম দেয় অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। এবং
মহাকালের পথে প্রবাহিত হয় মানবগোষ্ঠী। অথচ তবুও আমার বন্ধুরা শুকরের পালের সাথে
কাদায় গড়াগড়ি দিয়ে চিৎকার করে অথবা পাহাড়ি খাদে রোদে পচতে থাকে। মানুষটা ভুলে যায়
ওর নাম। ওর স্মৃতি। সভ্যতা এতটাই ভয়ানক যে ওরা অবশ্যই ফিরে আসতে বাধ্য প্রকৃতির
কাছে। কেননা এতদিনে এই পাঁচশ কোটি বছরের বিবর্তনে ওর ভেতরে এক বিশাল ক্ষত ছাড়া আর
কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। গবাক্ষবিহীন বর্তমান। তারপরও জেগে থাকে মিথ। মানুষের ঐতিহ্য
আর আত্মবিশ্বাস। সুতরাং আবারও ফিরে আসে মৎসকন্যা মেলুসিনা। পাখির মত চিৎকার করে
জেগে ওঠে এক নারী। অতঃপর ভগ্ন ফ্যাকাশে আর্তনাদ, সময়ের শেষ
প্রান্তে রুগ্ন চোখে ছানি বুকে শ্লেষ্মা মাখানো বৃদ্ধা। কুৎসিত সেই নারী। এরই নাম
জীবন। হায় আপসোস! কেনই বা মানুষের জন্ম হয় আর কেনই বা তরতাজা যুবতীরা বৃদ্ধা হয়ে
যায়! আমরা কেউ নই। ভষ্মিভুত ছাইয়ের গাদা। অথবা পরিত্যক্ত ঝাঁটা ছাড়া অন্য কিছুই
নই। তারপরও আমি খুঁজতে থাকি হাজার বছর আগে ডুবে যাওয়া এক মেয়ের দুটি চোখ। গভীর
কূপে ডুবে থাকা চাহনিগুলোর অনন্ত ভাষা।
অতঃপর কবিতায়
দেখা যায়, একজন মা তাকিয়ে আছে তার ছেলের দিকে। ছেলে এখন তরুণ পিতা। অথচ এই তরুণ
পিতার চোখের দৃষ্টিতে লুকিয়ে আছে মৃত্যুর ফাঁদ। হোটেল ভের্নের একটি কক্ষে একটি
মেয়ে কেশচর্চায় ব্যাস্ত। অনেক শহরের অনেক নাম। স্থান। রাস্তা আর রাস্তা। প্লাজা।
আরও রাস্তা। পার্ক। স্টেশন। সিঙ্গল রুম। দেয়ালের দাগ। কেউ চুল বাঁধছে। কেউ আমার
পাশে গাইছে গান। কেউ বা পোশাক পরছে। কামরা। স্থান। রাস্তা। নাম। কামরা। ১৯৩৭ সালের
মাদ্রিদ। প্লাজা দেল আনজেলে। মেয়েরা সেলাই করছে। ওদের বাচ্চাদের সাথে গান গাইছে।
হঠাৎ সাইরেনের আওয়াজ। অতঃপর হট্টগোল। চিৎকার। চোখের সামনে বড় বড় দালান হাঁটু মুড়ে
প্রথমে বসে পড়লো রাস্তায়। অতঃপর সকলে শুয়ে পড়লো এবং সৃষ্টি হল একটা ধ্বংসস্তুপ।
উঁচু উঁচু মিনারে ফাটল। অতঃপর পতন। দরজাগুলো ধ্বসে যাচ্ছে। প্রচ- ঝড়ের মত শব্দ।
এবং এমনই এক ভয়ঙ্কর দৃশ্যের মাঝে ফিল্মের মন্তাজ টেকনিকে পর্দায় ভেসে উঠলো মৈথুনরত
ওরা দুজন; উলঙ্গ। অর্থাৎ সভ্যতাকে ওরা বুড়ো আঙুল দেখালো।
এরপর
দীর্ঘকবিতার চারণভূমিতে আরও একটি নতুন চরিত্রের অনুপ্রবেশ। যে কিনা একটি স্বাভাবিক শহরের ছবি উপহার দেয়। চরিত্রটি লাল
গেঞ্জি গায়ে একজন পুরুষ। পুরুষটি দৈনিক কাগজ পাঠরত। আর একজন রমণী নিজেদের পোশাক
ইস্ত্রি করতে থাকে। সূর্যকরোজ্জ্বল কক্ষ। মানুষের নগর সভ্যতা। অথচ ওরা নিঃসঙ্গ।
ওদের একমাত্র অতিথি একখানা পীচ গাছের ডাল। আর এদিকে
বারান্দায় তিনটি ছেলে ক্রন্দনরত। ওরা মরচে ধরে সবুজ হয়ে গেছে। ওদের কক্ষগুলো
জাহাজের মত দোল খায়। সাবমেরিনের মতো ঘর। নিঃশব্দতা গলে যায় সবুজ ঢেউয়ের মাঝে।
গালিচার জীর্ণ সুতো খসে পড়ে। পাখির খাঁচাগুলো পাল্টে যায়। উড়ে যায় পাখিগুলো
স্বাধীন আকাশে। আর মানুষগুলো ফিরে আসে অনিবার্য এক পল্লীর দিকে। প্রত্যেক টেবিলেই
ভোজসভা। ওরা শঙ্খের মত অভেদ্য। সময়ের অবরোধ বৃথা। এখন সময় বলে কিছু নেই। দেয়াল
নেই। অবারিত মহাশূন্য। জীবনের উৎসবে তুমি মাতো। এই বৃক্ষের নীচে শুয়ে তুমি এই
মদিরা পান করো। সবই সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সবকিছুই পবিত্র। প্রতিটি কক্ষ এখন পৃথিবীর কেন্দ্র। এখনও সৃষ্টির প্রথম
রাত্রি প্রথম দিন। পৃথিবীর জন্ম হয় তখনই, যখন একজন পুরুষ
আর একজন নারী চুম্বনে বিবশ। পরিত্যাগ কর ইঁদুরে খাওয়া আইন। ব্যাংক অথবা কারাগারের
লৌহ দরজা। পরিত্যাগ কর তারকাঁটার বেড়া। রাবার স্ট্যাম্প অথবা যুদ্ধসঙ্গীত; টপহ্যাট পড়া
ভদ্রলোক অথবা রেডক্রস বোর্ড। কোনও কিছুরই এখন ওদের প্রয়োজন নেই। ওরা প্রত্যাবর্তন
করেছে শুধুই একটা নির্ভেজাল নিরেট পৃথিবীর কাছে। প্রয়োজন নেই নিরামিষভোজী ক্লাবের
প্রেসিডেন্ট অথবা স্কুলের গাধা মাস্টার; রক্ষকের
ছদ্মবেশধারী কুমির, জাতি, পিতা, মুনাফালোভী মালিক, হাঙ্গররূপী শাসক, ভবিষ্যৎ
নির্মাতা, ইউনিফর্মধারী শুয়োর, ধর্মযাজক অথবা গণতন্ত্র অথবা ইংরেজি শেখার
ক্লাস অথবা পচনধরা মুখোশ যা মানুষকে অন্যের থেকে পৃথক করে; মানুষকে নিজের
থেকে বিচ্ছিন্ন করে। আমরা প্রত্যাবর্তিত মানবগোষ্ঠী; আমরা সূর্য আর
মৃত্যুকে ভাগাভাগি করে নেই। বেঁচে থাকার আশ্চর্য বিস্মরিত বিস্ময়। ভালবাসার অর্থ
সংগ্রাম, দুজনের চুম্বন। ভালবাসা মানে মিথ্যা নাম যশের বসন খুলে উলঙ্গ হওয়া।
এই যে পজেটিভ
অনুভূতি, এই নান্দনিক ইন্দ্রিয়ানুভূতির ভেতর দিয়েই একজন দীর্ঘকবিতার কবি
বিশ্বের সুপ্ত শক্তির সন্ধান লাভ করেন। সুতরাং প্রকৃতি, নারী এবং জগতের
সাথে এক বৈদ্যুতিক কামাবেগ তাড়িত ভালবাসার সম্পর্কের অনিবার্য প্রকাশই দীর্ঘকবিতা।
দীর্ঘকবিতার শব্দ হচ্ছে এক জাদুর বাক্স। যার ভেতর ভাষা সম্ভাব্য প্রসব উন্মুখ ও
উত্তপ্ত। যা কিনা চিত্রভাষ্যের মাধ্যমে বয়ান করে আবহমান মানবগোষ্ঠীর অনুন্মোচিত
সত্যভাষ্যসমূহ। যার কোনও নির্দিষ্ট কাল নেই, পরিমাপ নেই বরং
দীর্ঘকবিতার শব্দরাজির রয়েছে এক নিজস্ব জীবন, ওজন এবং
তুল্যমূল্য। যা কিনা মুহূর্তে আমাদের মগজে দৃশ্যের জন্ম দেবার সাথে সাথে বোধ ও
অভিব্যক্তি, অভিব্যক্তি ও প্রজ্ঞার উন্মেষ ঘটায়। যা পাঠককে পৌঁছে দেয় এক
বিস্তৃর্ণ ক্যানভাসে মোড়ানো গতিশীল সেলুলয়েডের নিকট।
আলোচ্য
দীর্ঘকবিতায় আমরা অজস্র গতিশীল ছায়াছবির মুখোমুখি হই। পাজের এই কবিতারই একটি অংশে
ভেসে ওঠে প্রেমিকের লিঙ্গচ্ছেদের দৃশ্য। বারবণিতা। প্রেমিকা। সমাজ ও বেআইনি অপরাধ।
সহোদর-সহোদরার রমণ; যেন বিষাক্ত রুটি, ভষ্মের শয্যায় ব্যভিচার। হিংসা, রিরংসা, উন্মাদ প্রলাপের
বিষাক্ত লতা। সমকামীর থুথু। জনতার নিক্ষিপ্ত পাথরে ক্ষত বিক্ষত শরীর। জীবনের সমস্ত
রস নিংড়ে নিয়ে ঘানি টানা বলদ। সবই তাম্রমুদ্রার ফলশ্রুতি। সুতরাং,
এর চেয়ে ভালো
বরঞ্চ সতীত্ব, যে অদৃশ্য ফুল
নীরবতার ডালে
অবলীলাক্রমে দোল খায়,
সাধু-সন্তদের
সেই সুকঠিন হীরক খণ্ড
যা কামনাকে শোধন
করে, সময়কে তৃপ্ত করে,
(হায়দার আলী খান
অনূদিত)
তুলনাযোগ্য
টলস্টয়ের ফাদার সিওর্গির জীবনাচার। কিন্তু টলস্টয়ের ফাদার সিওর্গি যা পারে নি তা
সম্ভব করেছে পাজের এই দীর্ঘকবিতার নায়ক। যে কিনা বয়সহীন এক সূর্যের নীচে হেঁটে
বেড়ায়। তার পাশেই সবুজ বৃক্ষের মত পা ফেলে চলে তার প্রেমিকা। নদীর মত প্রেমিকা তার
সাথে কথা বলে। আর গমের শিষের মত সেই নারী বেড়ে ওঠে। হাজার পাখির মত উড়ে যায় সেই
নারী। কমলালেবু খেতে খেতে সেই মেয়ে হেসে ওঠে। সুতরাং পৃথিবী আবার সবুজ হয়। আকাশ
নেমে আসে ভূমিতে আর গাছেরা উঠে যায় আকাশে। মহাকালের সাক্ষ্য যেন প্রতিটি দৃশ্য এবং
ঘটনা। ঘটনা ও মানুষের জীবন। এবং শুধুই আলো আর নীরবতা। সাদা মেঘের দলগুলো একে একে
চলে যায়। শরীর নোঙর তোলে। আত্মা পাল তুলে দেয়। ওরা ওদের নাম ভুলে যায়। ওরা ভেসে
বেড়ায়। অতঃপর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। পর্দায় ভেসে ওঠে হোমারের ইলিয়ড ওডেসির
যুদ্ধযাত্রা। প্রাচীন ব্যাবিলন। প্রাচীন গ্রীক। সক্রেটিস। অতঃপর সেক্সপিয়ার।
আগামেমননের বিকট হুঙ্কার। সমুদ্রের অবিশ্রান্ত গর্জনের চেয়েও ভয়ঙ্কর কাসান্ড্রার
চিৎকার। শৃঙ্খলিত সক্রেটিস।
ক্রিটো। এস্কুলাপিয়াসের মোরগ। ধ্বংসস্তুপে ভেসে ওঠে শৃগালের সুভাষিত বচন এবং
যুদ্ধের আগমুহূর্তে ব্রুটাসের প্রেতদর্শন। মকটেজুমা ইনসম্নিয়ার কন্টকশয্যা।
ভগ্নচোয়াল দু’হাতের মাঝে গুঁজে রোবসপীয়রের মুহূর্ত গণনা। চুররুকার কফিন। অথবা
থিয়েটার শেষে লিনকনের সন্তর্পণ পদক্ষেপ। মুমূর্ষু
ট্রটস্কীর অস্থির ঠকাঠক আওয়াজ। দীর্ঘশ্বাস। নীরবতা। বাক্যবাগীশ কুকুর আর
বিজয়ের হর্ষধ্বনি। ঘাতকের চিৎকার। অগ্নিশিখা এবং একজন চিন্তাশীল মানুষ যেন একটি অগ্নিশিখা।
প্রজ্বলিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। এখন জল্লাদ নেই। দণ্ডিতও নেই। মৃতেরা সব সময়েই মৃত। ওরা
অস্পৃশ্য। এলোয়াজ, পার্সিফোনে, মারিয়া, মুখ তোল, আমাকে দেখাও।
যাতে সবশেষে আমার আপন মুখ আমি দেখতে পারি। আমার মুখ সর্বকালের জন্য সকলের মুখ।
যারা রুটি বানায় তাদের মুখ। গাড়ির চালকের, মেঘের, নাবিকের মুখ।
সূর্যের, নির্ঝরিনীর, পেদ্রোর এবং পাবলো পিকাসোর মুখ। নিঃসঙ্গ জনতার
মুখ। আমাকে জাগাও। আমি তো ইতিমধ্যেই জন্ম নিয়েছি। জীবন ও মরণ। এইমাত্র আমি
স্বপ্নবিহীন পাথরের স্বপ্ন দেখলাম। শুনলাম আমার রক্ত কারাগারে গান গাইছে। সমুদ্র
আলোর মর্মরে গান গাইছে। একে একে সব দেয়াল ধ্বসে গেল। সব দরজার কবাট গেল ভেঙে। আমার
কপালের ভেতর দিয়ে সূর্য ফুটে উঠল। সত্তাকে মোড়ক কেটে বের করে আনল। আমার হাজার
বছরের জৈবনিদ্রা ভেঙে গেল। নদী বয়ে চলে বঙ্কিম ভঙ্গিমাতে। এগোয়। পিছু ফেরে।
বৃত্তের পরিধি ঘুরে ফিরে আসে। বিশাল পর্দা জুড়ে দিগন্তে ভেসে উঠলো একটা মস্ত বড়
নীলাকাশ। যেখানে একটিও পাখি নেই। শুধু বৃত্ত আর বৃত্ত।
ক্রমশ ---
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন