মৃদুল দাশগুপ্তা - মায়াজম

Breaking

৩ আগ, ২০১৫

মৃদুল দাশগুপ্তা


 


মৃদুল দাশগুপ্ত , তার সম্বন্ধে নতুন করে কিছু বলার নেই , বাংলা কবিতার এইসময়ের প্রথম সারির কবি , মায়াজম এর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন , সোনালী মিত্র । 



 মায়াজমঃ-
একদিকে হাংরি জেনারেশনের শেষ প্রদীপ '' নষ্ট আত্মার টেলিভিশন'' বেরিয়ে গেছে , ওইদিকে ভাস্কর চক্রবর্তীর- '' শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা'' গনগন করছে , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতা থেকে সরে গদ্য নিয়ে মজে রয়েছেন , বিনয় মজুমদার হারিয়ে গেছেন কালস্রোতে , একমাত্র শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখছেন , জয় গোস্বামী সবে এসেছেন । এমনই এক মুহূর্তে বাংলা পাঠকরা- '' জলপাই কাঠের এসরাজ '' বাঁজাতে শুরু করলেন । এই গ্রন্থে রাজা-উজির মারা কথা নেই , বনানীর শান্ত শীতলছায়াঘন একটা নিবিড় পরিবেশ আছে । এই যুগসন্ধিক্ষণকে এই সময় এসে কী দৃষ্টিতে দেখেন আপনি ?

মৃদুল দাশগুপ্তঃ- 
   আপনাদের এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে দুটো কথা আছে । ফালগুনী  রায়ের ' নষ্ট আত্মার টেলিভিশন ' বইটির কথা বলে এ প্রশ্নের সূচনা করেছেন , আমরা যারা ৭০ দশকের কবিতাওয়ালা , তাদের ভেতর ওই বই বা হাংরি রচনার কোনও আবহ কাজ করেছে বলে আমার মনে হয় না ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওই ৬৮-৬৯ সালে তখন ও গদ্যে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ  করেননি । তবে , ' আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি ' কাব্যগ্রন্থটি সেসময় কাব্যিকতা মুক্ত নাগরিক ভাষায় নতুনত্ব প্রকাশ করেছিল ।
বিনয় মজুমদার কালস্রোতে হারিয়ে গিয়েছেন ( তৎকালে বা একালে ) --আপনাদের এ বিবেচনায় আমি স্তম্ভিত !
একথা ঠিক শক্তি তখন , তুমুল শক্তি ।
ভাস্কর চক্রবর্তীর ' শীতকাল কবে আসবে  সুপর্ণা  ' কাব্যগ্রন্থটি আমাদের ভেতর আলোড়ন তুলেছিল । আমার এখন মনে হয় , অলঙ্কারহীন ঝকঝকে নাগরিক ভাষায় ভাস্কর দেওয়াল তুলে পঞ্চাশ দশকীয় তরলোচ্ছ্বাস আমাদের ওপর আছড়ে পড়া রুখে দিয়েছিল ।
এবার আপনার প্রশ্নের জবাব । ঠিকই বলেছেন যুগসন্ধিক্ষণ । সময় তখন নাচছিল । সে এক স্বপ্ন ছিল তখন । আমার ধারনা , নৃত্যরত ওই সময় ৭০ দশকীয় কবিদের ছন্দিত করেছে । ' জলপাই কাঠের এসরাজ ' আমি স্মৃতিতে আপন মনে লিখেছি । সময় তখন দ্রুত বদলাচ্ছিল । ১৯৭০ আর ১৯৭১ এক নয় , ১৯৭৩ -৭৪ এক নয় । জলপাই কাঠের এসরাজে নানারকম কবিতা আছে ।
মায়াজমঃ -
কবিতা লেখা একটা নিরিবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া অনেকে মনে করেন । যেমন রোজ সকালে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে হয় , অনেকে এটাকে নিয়ম বলেন , অনেকে বলেন কবিতাসাধনা । আমি বলি এটাকে কবির ঋিসভ অবস্থান , যেখানে কবি নিজে ছাড়া আর কেউ নেই , আপনার কি এমন কিছু মনে হয় ? যেখানে কবি শুধু একা ...

মৃদুল দাশগুপ্তঃ-
    মৃদুল দাশগুপ্তঃ-
হ্যাঁ , আমারও তাই মনে হয় । মানবদেহের প্রয়োজনীয়  প্রত্যহিক কাজ কয়েকটি আছে । এসব কাজের কয়েকটি যেমন স্নান বা ওই দাঁত মাজা রোজ না করলেও চলে । কিন্তু আহার না করলে , জলপান রোজ না করলে , প্রাণধারন অসম্ভব ।
অভ্যাসে দাঁড়িয়ে   যায় এসব রোজকার কাজ ।
আমার মনে হয় কবিতা শাস্ত্রের বিষয়টিও এইরকম নিত্যকার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায় । নইলে , যেন বাঁচবো না - এই রকম ।
আমি তো সাংবাদিক কবি । কতো কাজে বাড়ির বাইরে গেছি। কাজের চাপে কোনও কোনও দিন স্ত্রীকে একবারও মনে পড়েনি , একবারও কন্যার কথা ভাবিনি । কিন্তু সেরকম কোনও দিন নেই , যেদিন কবিতার কথা আমি ভাবিনি ।
মায়াজমঃ-
   অনুসরণের মধ্যে দিয়েই সৃষ্টির পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে , আর অনুকরণের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি জাহান্নামের দিকে যাত্রা করে ।
আপনার কবিতায় পূর্বতন কোন কবির কোন সামান্য প্রভাব ও পরিলক্ষিত হয় নি , তবুও জানতে ইচ্ছা করছে আপনার কবিতা লিখবার প্রেরণা দিয়েছেন অন্তরে এমন কবি কী কেউ কেউ ছিলেন ?


   মৃদুল দাশগুপ্তঃ-
     রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র , মাইকেল মধুসূদন দত্ত , রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর , জীবনানন্দ দাশ - আমি মনে করি এই চার স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে   আছে বাংলা কবিতা ।
আমাদের ভাষায় তারা অদ্ভুত্থান ঘটিয়ে দিয়েছেন । আমি এঁদের  কাউকে দেখিনি । দেখিনি কি ?
আমার বিস্ময় লাগে কী করে ৮০ উত্তীর্ণ বয়সে অরুণ মিত্র লিখলেন '' খুঁজতে খুঁজতে এতদূর ? '' সবুজ মখলমে এখনও কী করে সোনালি জরির কলকা বুনে যাচ্ছেন আল মাহমুদ ? শুনেছি অন্ধ হয়ে গেছেন নাকি তিনি !
মৃত্যুর দেড়বছর আগে কী করে বিনয় মজুমদার লিখলেন '' আমার তারারা বলে বিনয় দা বেদনা ভুলুন \ প্রেম হল নুন । '' উৎপল কুমার বসু আমাকে একদিন সল্টলেক থেকে গাড়ি চালিয়ে আজকাল অফিসে পৌঁছে দিয়েছিলেন , শিহরণ এখনও টের পাই । অলোকরঞ্জনের বিশ্ববীক্ষণ আমাকে চমৎকৃত করে দেয় । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ওই নাটকীয় মৃত্যু - বিশ্বাস করিনা আমি । ভাস্করদাকে মনে হয় জীবিত , জীবিত ।
শুধু শম্ভু রক্ষিতকে ঈর্ষা করি আমি । জীবনচর্চায় ওঁর মত অপ্রতিষ্ঠানিক হতে পারলাম না কেন ?

মায়াজম- 
  কবিতায় ( যেকোনো শিল্পেই ) নিজস্ব একটা ভাষা বা ঘরানা তৈরি করতে অনেকটা সময় চলে যায় , কিংবা সারাজীবনেও কোন ঘরানা তৈরি হয় না অনেকের । একবার ঘরানা এসে গেলে অনেক কবি সারাজীবন তারমধ্যেই জ্ঞাত বা অজ্ঞাতভাবে অবস্থান করেন , আপনার কী এমনকিছু মনে হয়েছে ? নিজস্ব ঘরানার বাইরে কবির অবস্থান কেমন ?

মৃদুল দাশগুপ্তঃ-
   আমার বিশ্বাস কবিতা আকাশ থেকে নামে । কবি ধারক মাত্র । আমি বারবার বদলাতে চেয়েছি । পাশ ফিরেছি , চিৎ হয়েছি , উপুড় হয়েছি । এর চেয়ে কিছু এ বিষয়ে আমি ভাবিনি । এর বেশি কিছু আমি বলতেও পারব না ।

মায়াজম- 
   পৃথিবীতে গদ্য সাহিত্যে নাবালক পর্যায়ে আছে এখনো কবিতার নিরিখে । প্রত্যেক মানুষের ভিতরেই জন্মগত একটা কবিসত্তা অবস্থান করছেন , আপনি তো প্রথম থেকেই কবিতায় আছেন , গদ্য সাহিত্যে আপনার বিচরণ তেমন প্রভাব ফেলল না কেন ?
জনপ্রিয়তার দিক থেকে একজন গদ্যকার যে সুবিধা ভোগ করেন একজন কবি সেই সুবিধাজনক অবস্থানে আসা খুব মুস্কিল, এটা যদি স্বীকার করেন তাহলে বলব - গদ্য সাহিত্যে আপনাকে তেমনভাবে পাওয়া গেল না কেন ?


মৃদুল দাশগুপ্তঃ- 
  গদ্যকাররা বিশেষ সুবিধা ভোগ করেন বলে আপনার মনে হয় ! আমি তা মনে করিনা । কবিদের প্রাপ্তি পরমপ্রাপ্তি , টাকা পয়সায় , খ্যাতি হলে তার বিচার হয় না ।
প্রভাব ফেলার বিষয়টিও আমার জানা নেই । তবে আমি কবিতা সংক্রান্ত বা কবিদের সম্পর্কে কিছু গদ্য লিখেছি । '' কবিতা সহায় '' ও '' সাত পাঁচ '' নামে আমার দুটি গদ্যের গ্রন্থ ও প্রকাশিত হয়েছিলো । কয়েকটি গল্প লিখেছি , ছোট ছোট পত্রিকায় সেগুলি প্রকাশিত হয়েছে ।
আর একটা কথা , কবিরা সুবিধাজনক অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা খামোখা করবেন কেন


মায়াজমঃ- 
 সহজ -সরল শব্দের ব্যঞ্জনায় বোধগম্য কবিতা সাধারণ মানুষ শ্রুতির মত বাঁচিয়ে রাখেন শতক-শতক । আবার উল্টো ও দেখা যায় , যথারীতি একটা নিজস্ব সার্কেলে নিজেকে আবদ্ধ রেখে গুরুগম্ভীর শব্দের চলন , অহেতুক শব্দের হুংকার , নিজেকে সকলের চেয়ে পৃথক এই চেতনাকে প্রতিষ্ঠা করার একটা প্রয়াস , সঙ্গে বোদ্ধাকূলে কলকে পাওয়ার একটা সচেষ্ট প্রয়াস , তারা যা সৃষ্টি করেন সেখানে সকলের প্রবেশাধিকার নেই । এই বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত মতামত কী ? কবিতা কেমন হওয়া উচিত ? কাদের জন্যই বা কবিতা লেখা হয় ?

মৃদুল দাশগুপ্তঃ- 
   কবিতা কেমন হওয়া উচিত , আমি জানি না । কবিতা মানুষের জন্যই লেখা হয় ।
এ প্রসঙ্গে একটু গল্প বলি । আমার মা স্বল্প শিক্ষিতা ছিলেন । তাঁর ম্যাট্রিক পরীক্ষার বছর দেশভাগ হয়ে যায় । আর পড়াশুনা হয়নি । তিনি খুব বই পড়তেন । তারাশঙ্কর , আশাপূর্ণা দেবী , বনফুল ......। স্কুলের উচু ক্লাসে পড়ার সময় আমি যখন কবিতা লিখবার চেষ্টায় নেমে পড়লাম , কৌতূহলে মা আমার খাতা টেনে নিয়ে ছেলের কবিতা পড়তে শুরু করলেন । ক্রমে আমার বন্ধুদের কবিতা ... কবিতা আসক্ত হয়ে পড়লেন মা ।
রোগশয্যায় ওই মৃত্যু পথযাত্রীনী আমাকে শুধোতেন, পার্থপ্রতিমের নতুন কোন বই বের হলো ? রণজিতের ?
আমার কন্যাটিও তার ঠাকুমার মত কবিতা আসক্ত হয়ে পড়েছে বালিকা বয়সেই । বাবার বই , বাবার বন্ধুদের বই পড়তে শুরু করে । আমার স্ত্রী অবশ্য আমার কাব্যগ্রন্থগুলি উল্টেপাল্টে দেখেন , ঢুকতে পারেন না । তিনি আমার ছড়া পছন্দ করেন ।
কবিতা দীক্ষিত পাঠকের জন্যই ।

মায়াজমঃ- 
    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অস্বীকার করে বাংলা কবিতার যে দিক পরিবর্তন হয়েছিল তাতে দেখা গেল মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া সেভাবে সর্বজন গৃহীত কবি হতে পারলেন না যারা সত্যিকারের রবীন্দ্রভাব মুক্ত কবি । এটাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন ? অস্বীকারের মধ্যেই কোথাও স্বীকার পর্ব থাকে কী ?

মৃদুল দাশগুপ্তঃ- 
    কবি তো আঙুলে গোনা কয়েকজনই । বরাবর ।

 মায়াজমঃ- 
    সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে প্রত্যেক মানুষই সমাজের ভেতরে অবস্থান করেন । অতএব কোন কবি যা সৃষ্টি করবেন সেটা সমাজের অঙ্গ । সমাজের বাইরে কোন অবস্থান নেই । আপনি কি মনে করেন যা সৃষ্টি হচ্ছে সবই সমাজের দায়বদ্ধতা থেকে , তাই আলাদা করে সমাজের কোন বিষয় না লিখলেও একজন কবি যিনি সারাজীবন প্রেমের কবিতা লিখে গেছেন , আর একজন কবি যিনি সারাজীবন রাজনৈতিক কবিতা লিখে গেছেন , দুজন ই সমাজের সমকেন্দ্রে অবস্থান করছেন ?

মৃদুল দাশগুপ্তঃ- 
   সমাজ কবিকে নিগ্রহ করে । সমাজ কবিকে কুর্নিশও করে । এটা একটা খেলা । এটা একটা কৌশল - এভাবেই কবি জীবনধারন করেন । ঢিল পাটকেল - করতালি সবই তাঁর প্রাপ্য । সমাজের দায়বদ্ধতা , রাজনৈতিক কবিতা - এসব অতি ছেঁদো প্রাচীন বিষয় । এসব নিয়ে আর কোনও ভাবনা ভাবার অবকাশ নেই ।

 মায়াজমঃ-
     ৫০-৭০ এর দশক পর্যন্ত বাংলা কবিতায় যে তুমুল তুলকালাম একটা চরিত্র গড়ে উঠেছিল ধীরে ধীরে সেই উন্মাদনা মিইয়ে গেল । কবিতা কেমন করে যেন মানুষের জীবন থেকে সরে আসতে লাগলো , এর কারণ কি আধুনিক ভোগবাদী বিপ্লবের আগ্রাসন ? বাড়িতে বাড়িতে ফোন টেলিভিশন বর্তমানে ইন্টারনেট কি মানুষকে কবিতা থেকে সরিয়ে দিল ?

মৃদুল দাশগুপ্তঃ-
    মিইয়ে গেছে নাকি ? আমার তো তা বোধ হচ্ছে না । তামাম বাংলা তো টগবগ করছে , চারিদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন না । 
 মায়াজমঃ
   ষাটের দশকের বাংলা ছবিতে যেমন প্রেমিক প্রেমিকার ক্লোজআপ সিনের দৃশ্যে দেখাত দু'টি ফুল এক হয়ে যাওয়া , বা বাতি নিভিয়ে দিলে অন্ধকারে শুধুই পাখির কাকলী । দিনে-দিনে ধীরে ধীরে দৃশ্য খোলস ছেড়ে বেরিয়ে বাস্তবমুখী হল। আমরা কবিতার ক্ষেত্রেও তাই দেখি। হাংরি আন্দোলন থেকে শব্দের মোড় ঘুরছে । খুল্লমখুল্লা শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার কবিতায় বেনো জলের মত এসে গেছে । কবিতায় কোন শব্দ নাকি অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট নয়।এটাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন ?


মৃদুল দাশগুপ্তঃ- 
    আপনার এ প্রশ্নে আপনি যেসব   সিদ্ধান্ত বা বিবেচনা ব্যক্ত করেছেন আমি তার সহমত নই । ফলে এ প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিতে পারছি না ।  শ্লীল অশ্লীল  বিষয়ে এসব আদ্যিকালের প্রশ্ন আপনাদের মতো একালের তরুণ তরুণীদের মাথায় আসবে কেন ?
শব্দের ব্যবহার বা প্রয়োগ বিষয়ে একটু বলতে চাই । কবিতায় আমার মনে হয় , শব্দ এমনি এমনি আসে । উড়ে উড়ে । কবিতা স্বয়ংসম্পূর্ণ । কোনও কবিতা প্রাণী যা নই শব্দ আরোপ করেন , অর্থাৎ কপটভাবে বসিয়ে দেন , তখনই আসক্ত পাঠক তা টের পান , ধরতে পারেন । শব্দের ব্যবহারই শব্দকে শ্লীল   বা অশ্লীল   করে দেয় ।


মায়াজমঃ- 
   জলপাই কাঠের এসরাজ , এভাবে কাঁদে না , গোপন হিংসার কথা বলি, সোনার বুদবুদ , - ইত্যাদি আপনার বিখ্যাত গ্রন্থ । বুদবুদ যখন হাওয়ার প্ররোচনায় আকাশে ভেসে থাকে সেই দৃশ্য কজন আর দেখতে পান , যেমন সেই বহুল প্রচলিত
''দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু। ''
যা আপনার কবিতা আন্দোলনের সঙ্গে পুরোপুরি ভাবেই মেলে। চুপচাপ নিজের কাজটি করে যাচ্ছেন আপনি । আপনার কবিতা বিশেষ করে প্রেম- ভালবাসার কবিতা শান্তজলে ছোট্ট ডিঙি নিয়ে ভেসে চলার মত , প্রেমের সেই সোচ্চার উচ্চারণ দেখা যায়না , কখনো কি মনে হয় আরও দীর্ঘ উচ্চারণ করা যেত প্রেমের কবিতায় ? আরও তীব্রভাবে মানুষের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত ?

মৃদুল দাশগুপ্তঃ- 
   আমি যেভাবে ভাবি , তাতে ছোট কবিতা , দীর্ঘ কবিতা বলে কিছু নেই । এক লাইনের একটি কবিতাও সুদীর্ঘ হতে পারে । তীব্রভাবে মানুষের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাধ আমার কখনও জাগেনি ।
বরানগরে আমি কিছুকাল ভাড়া বাড়িতে ছিলাম । জন্মস্থান , নিজেদের বাড়ি ছেড়ে এসেছি , মনমরা হয়ে অলিগলি ঘুরে বেড়াতাম । একদিন দগ্ধ দুপুরে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ  দেখলাম একটি বাড়ির বারান্দায় এক কিশোরী '' এভাবে কাঁদে না '' বইটি পড়ছেন , বইটির প্রচ্ছদে রোদ পড়েছে ।
আমি অতক্ষণ তাকিয়ে আছি , হঠাৎ খেয়াল করে মেয়েটি ঘরের ভেতর চলে গেলেন । এই প্রাপ্তি হাজার মানুষের আলিঙ্গনের চেয়ে ঢের বেশি ।
কবি তো আর চিত্রতারকা বা রাজনৈতিক নেতা নন ।

মায়াজম১২ঃ- 
এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে। আপনি এত উৎকর্ষ প্রেমের কবিতা লিখেছেন \ লিখছেন ।যা পাঠকের হৃদয় দহনে সক্ষম। আচ্ছা , প্রেম না করে তো প্রেমের ভাষা বলা যায় না। কবি মাত্রই রোম্যান্টিক বলেই জানি। আপনার এই প্রেম কবিতার পিছনে কি সেই সময়ে কোন নারীর প্রেরণা বা বর্তমানে ও কোন চিরন্তন প্রেমিকা ছিলেন ? সময় বদলে গেলে ইতিহাস ও বদলে যায়। আজ কবি নীরা কে নিয়ে লিখছেন কাল দিতি গুপ্তকে নিয়ে লিখবেন । সময় ও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কবি ও নারী ও প্রেমের একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা  যায় , আপনার ক্ষেত্রেও ও কি এমন কিছু ঘটেছে , পাঠকদের জানতে খুব ইচ্ছা করে ।

মৃদুল দাশগুপ্তঃ-
  সেসব তো কবিতায় লেখার চেষ্টা আমি করেছি , করে চলেছি । হাট করে এসব কথা খুলে বলবার দরকার কী !

মায়াজম ১৩ঃ- 
   ক্ষতস্থানে খোঁচালে অঝোরে রক্ত ঝড়ে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে একজন মানুষ একটি পত্রিকার সম্পাদনায় আসে। নিজেকে নিঙরেও পত্রিকা বাঁচিয়ে রাখে।১৯৭২সালে ''বাইসন'' পত্রিকায় আপনাকে আমরা ভিন্ন রূপে দেখতে পাই। শুনেছি সকলের কাছে পৌঁছে দিতে বিভিন্ন রেলওয়ে হকার ভাইরা বিক্রি পর্যন্ত করেছে ১ ফর্মার এই পত্রিকা । হয়ত বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারেন নি , আসলে কবি যখন সম্পাদক ও প্রকাশক তখন একটা চাপ এসেই যায় । আজ পর্যন্ত সমানে এই  ট্রাডিশান চলছে । লিটিল ম্যাগ বাঁচিয়ে রাখা মহাসংগ্রাম , আপনার দৃষ্টিভঙ্গি এ ব্যাপারে জানতে ইচ্ছা করছে । 

মৃদুল দাশগুপ্তঃ-
    আমি লিটল ম্যাগাজিনের লিখিয়ে । 'বাইসন' পত্রিকার দুটি সংখ্যা বের হয়েছিল । আমার মনে হয় একটা লিটল ম্যাগাজিন জন্মাল , কয়েক সংখ্যা বের হওয়ার পর মরে গেল - এটা তেমন কিছু বিষয় নয় । 
তামাম বাংলায় অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিন বের হয়। লিটল ম্যাগাজিন , বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের অনন্ত আয়ু । নতুন নতুন লেখক কবির উদয় হবে নতুন নতুন লিটল ম্যাগাজিনে- এই ব্যাপারটা থাকবে অনন্তকাল । তবে কি , সময় বদলেছে আগে লিটল ম্যাগাজিন ছিল , এখন হয়ে গেছে বাজারের বস্তা , এমন দেখা যাচ্ছে এখন , বেশ কয়েকটি । লিটল ম্যাগাজিনের সপ্রতিভ সম্পাদক ছিলেন , এখন তাঁকে লাগছে সাহিত্য মাফিয়া- এমন ঘটছে ।
আবার বড় সংবারপত্রকে টেক্কা দিতে মাঝারি  , ছোট সংবাদপত্রের  কতৃপক্ষ  রবিবারের সাময়িকীকে করে তুলেছেন লিটল ম্যাগাজিন ধাঁচের  , এমনও ঘটছে ।
ঘটুক , লিটল ম্যাগাজিন কিন্তু আছেই অলিগলিতে , ঝোপেঝাড়ে , গাছের তলায় সারা বাংলায় ।

১৪মায়াজমঃ- 
     গীতায় আছে "কর্ম করে যাও ফলের চিন্তা করো না"...১৯৭৪ সাল থেকে ২০১২ একটা লং জার্নি .... এর পর সেই বহু প্রতীক্ষিত পুরষ্কার । .বলা যায় ২০১২ আপনার মার্বেলেবেল টাইম।এই দীর্ঘ জার্নি নিয়ে কিছু বলুন ? আপনি কি ভেবে ছিলেন জনপ্রিয়তার নিরিখে অন্য কবিদের পেছনে ফেলে রবীন্দ্র পুরষ্কার লাভ করবেন ? কোন কবির চোখে কি পুরষ্কার পেয়ে ঈর্ষার পাত্র হয়েছেন ?

মৃদুল দাশগুপ্তঃ- 
   ২০১২ আমার গুরুত্বপূর্ণ বছর - এমন কখনও ভাবিনি । জনপ্রিয়তা নিয়ে আমার কোনও ভাবনা নেই । কখনও ছিলো না । কাউকে পেছনে ফেলে দেওয়ার বাসনাও আমার নেই । কখনও ছিলো না । ২০১২ তেই আমি রবীন্দ্র পুরষ্কার পেয়েছিলাম ? আচ্ছা । ওই পুরষ্কার আমি আচমকাই পেয়েছিলাম । বেশ ভড়কে যাই । অবশ্য এর আগেও কয়েকটি পুরষ্কার আমি পেয়েছি । আমাকে কেউ ঈর্ষা করেন বলে আমার জানা নেই । আমি একটা অতিসাধারন এলোমেলো ধরনের মানুষ - আমাকে ঈর্ষা কেউ করতে যাবেন কেন ।
ও আর একটা কথা , ১৯৭৪ নয় , আমার লেখালেখি শুরু ৬৮-৬৯ সাল থেকে । তখন স্কুলে নবম দশম শ্রেণীর ছাত্র ।
১৫ মায়াজমঃ- 
   আমার সৃষ্টি আমার সন্তান।ভালো হোক বা মন্দ। ২০১২আপনার জীবনের মাইলস্টোন ধরে নিয়েই এখনো আপনি লিখে চলেছেন।কখনো কি ফিরে দাড়িয়ে নিজের শুরু থেকে এখনো অব্ধি সৃষ্টি গুলো দেখে মনে হয়েছে অনেক কিছু লেখার বাকি রয়ে গেছে।নিজের মনের মত সেই লেখা টা হয়ে উঠল না।বা যা লেখা হয়েছে তার মধ্যে অনেক ভ্রান্তি রয়ে গেছে নব্বই দশকে যা আপনার ধ্যান ধারনায় ছিল এখন শূন্যদশকে সেই লেখা টাই ভিন্ন চোখে দেখতেন আপনি!

 মৃদুল দাশগুপ্তঃ-
   আবার ২০১২ কে আমার জীবনের মাইলস্টোন বলছেন কেন ?
না , এপ্রশ্নে যা   জিগ্যেস করেছেন , সে সব ভাবনা আমার নেই । নিজের লেখাপত্র নিয়ে আমার কোনও পুনর্বিবেচনা নেই । কারণ আমি মনে করি সে সব আকাশ থেকে পড়েছে , আমি ধারক মাত্র । রোজ রাতে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি

 মায়াজমঃ-
     লেখা থেকে সরে এসে একটা প্রশ্ন করি। আমরা সৃষ্টিকর্তাকে ধ্রুব মনে করি।কবি যা লিখছেন তার মধ্যে দিয়েই সাধারণ পাঠক জীবন দর্শন খুঁজে পায়। কবিকে বিচার করা হয় তার কলমের মধ্যে দিয়েই। আপনার লেখা পড়ে একজন নিরীহ ক্লেদ বর্জিত মানুষ বলে মনে হয়।যেখানে এখন অন্য কবিরা একে অপরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি করে যাচ্ছেন। খুব জানতে ইচ্ছে হয় মৃদুল দাশগুপ্ত ব্যক্তিগত জীবনে কেমন মানুষ?

মৃদুল দাশগুপ্তঃ-
  এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় । আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করুন । আমার কন্যাকে । আমার ভাই বোনদের । আমার বন্ধুদের ।
আপনারা আমার প্রশংসা করলেন , ধন্যবাদ । কিছুটা সঙ্কোচ ও লাগছে ।

মায়াজমঃ - 
   এই সময়ের কবিতার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ  ভাবেই আছে , এখনকার কবিদের বিশেষত শূন্যদশকের  কবিদের লেখাকে আপনি কেমন দৃষ্টি তে দেখেন ? এই সময়ের কবিতার সঙ্গে ৭০-৮০-৯০ দশকের কবিতার পার্থক্যই বা কী আপনার দৃষ্টি ভঙ্গিতে ?

মৃদুল দাশগুপ্তঃ-
   আমি আমার সাধ্যমত তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে নজর করার চেষ্টা করি । শূন্যদশকের এপার -ওপার বাংলার কয়েক জনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে । ৭০-৮০-৯০ এতগুলি বছরের কবিতার বদল তো ঘটছেই । সবটা বিশদে বলতে গেলে আলোচনায় বসতে হবে বা অনেকটা লিখতে হবে । এখন তা সম্ভব নয় । কিন্তু মনে তাদের মুখগুলি ঝলমল করে , আমি দেখতেও চেষ্টা করি । একটু একটু কথা হয় ।

 মায়াজমঃ-
 সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা বাজেরে প্রচুর কবি শিল্পী চলে এসেছেন একদম হাতের মুঠোই । আপনার কি মনে হয় না একটা দূরত্ব থাকলে সম্ভ্রম ও সম্মান টা আরও একটু বেশি বেঁচে থাকে ? সহজাত যা পাওয়া যায় তার দিকে মানুষের আকর্ষণ চিরকাল কমে আসে , আপনার কি  মনে হয় যে তথাকথিত প্রখ্যাত শিল্পীরাও সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছেন ?

মৃদুল দাশগুপ্তঃ- 
  হ্যাঁ , একটু আড়ালে আবছায়ায় থাকাটাই ভালো । অনেকেই নিজেকে প্রকট করে তুলেছেন । এটা অবশ্য প্রচারের যুগ । বাজারের যুগ । মন বলে , লুকিয়ে থাকো , লুকিয়ে থাকো ।
যুগ এমনই বদলেছে যে , খেলতে হবে , বেশ কঠিন খেলা ।

 মায়াজমঃ- 
    চিরকাল  কবিতার পাঠক খুব কম । তবুও এখন ও যে  হাজার হাজার কবিতা লেখা হচ্ছে  ও প্রকাশ হচ্ছে , কিছু নতুন একটা করে দেখানোর তাগিদ দেখা যাচ্ছে , এরাই কি বাঁচিয়ে রাখবে বাংলা কবিতা ? নাকি আমাদের পেছনের দিকের ইতিহাস নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে । কবিতার এই চলনকে আপনি উপভোগ করছেন কি ?

মৃদুল দাশগুপ্তঃ- 
     কবিতার পাঠক যেমন কম , কবিও খুব কম । কিন্তু কবিতার পাঠক যুগের পর যুগ ধরে আসেন , কবিতাও তা-ই । এভাবে ভেবে দেখুন , কত পাঠক , কত পাঠক , যারা এখনও জন্মাননি ।
চিরকাল  কবিতার পাঠক খুব কম । তবুও এখন ও যে  হাজার হাজার কবিতা লেখা হচ্ছে  ও প্রকাশ হচ্ছে , কিছু নতুন একটা করে দেখানোর তাগিদ দেখা যাচ্ছে , এরাই কি বাঁচিয়ে রাখবে বাংলা কবিতা ? নাকি আমাদের পেছনের দিকের ইতিহাস নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে । কবিতার এই চলনকে আপনি উপভোগ করছেন কি ?

 মায়াজম- 
      আমরা আর প্রশ্ন করব না , আপনি আমাদের পাঠকদের সময় দিয়েছেন এইজন্য ধন্যবাদ । আগামী দিনে আপনার কলম আরও এগিয়ে চলুক । আপনার আগামী প্রোজেক্ট সম্বন্ধে কিছু কথা শুনে এবারের মত আমরা শেষ করব সাক্ষাৎকার , ধন্যবাদ ।  

মৃদুল দাশগুপ্তঃ- 
      আপনাদেরও ধন্যবাদ ।
আমার পরের কাব্যগ্রন্থ বের হতে হয়ত কয়েক বছর লাগবে । ১০০ টি কবিতা থাকবে তাতে , এরকম ভেবেছি । ২৬ টি লেখা হয়েছে ।
আমি কয়েকটি গল্প লিখেছি । ৮ টি গল্প নিয়ে একটি বই হয়তো আগামী বছর বের হবে ।
অনেক ছড়া লিখেছি । ১০০ টি ছড়ার একটি বই , ভাবনায় আছে ।
কবিতার বিষয়ে , কবিদের নিয়ে বেশকিছু লেখা পত্র পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে , তা নিয়ে হতে পারে আরেকটি গদ্যের বই ।
আপনারাও ভালো থাকুন ।                                

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র