অগ্নি রায় - মায়াজম

Breaking

৩ আগ, ২০১৫

অগ্নি রায়

                                           পৌষালী সোনাটা




এক-
‘তখন আখের স্বাদ নোনতা লাগে, লবঙ্গ বনে ঝরে সাড়া জাগে…’
গলার স্বরের সঙ্গে মিশে যায় পায়ের শব্দ। অন্তরার কাছে এসে আরও বেড়ে যায় রাতচরা সুর আর হাঁটার দম।….‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা, যমুনা, মেকং ভলগা ঘুরে…’
রতনপল্লী থেকে পায়ে পায়ে ভুবনডাঙ্গার দিকে যাচ্ছে ওরা। ক্যানালের ধার ঘুরে। টিপটিপ বৃষ্টি ভিজিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, সঙ্গে হাওয়ার ঝাপট। হাড়ে ঠকঠকানি শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে না তার একটা কারণ যদি উলেন জ্যাকেট, ফিরন আর কান গলা বন্ধ ক্যাপ হয় তবে অন্যটা প্রথম ওড়ার উত্তেজনা। কোনও গার্জেন ছাড়াএটাই ওদের প্রথম বেড়াতে আসা! 
এই যে কুড়ি-একুশের কোঠার ছোট্ট দলটি গান গাইতে গাইতে এগোচ্ছে, যেন ব্রহ্মকমল না-পাওয়া পর্যন্ত থামবে না, পাঠক আসুন এই নিশুতিতে তাদের পিছু পিছু যাই। সবাই যে সমানতালে রাস্তা রোকো করে হাঁটছে তা তো নয়, সেটা হওয়ার কথাও নয়। এ তো কুচকাওয়াজ না! ওরা এগিয়ে পিছিয়ে চলেছে সঙ্গ এবং সঙ্গী বদলে বদলে। 
 
আজই বিকেলে হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির তলায় সবাই জড়ো হয়েছিল একরাশউৎকন্ঠা উত্তেজনা আর দুরুদুরু বুক নিয়ে।উৎকন্ঠার কারণ যথেষ্ট।প্রথমত,স্কুল কলেজের এক্সকার্শন বাদ দিলে এই প্রথম বাড়ির লোক ছাড়া বেড়াতে যাওয়া, বিশেষত অপালা, দেবযানী আর শ্রীময়ীর। দুই, এই প্রথম পৌষমেলায় বাউল শোনার উত্তেজনা। তিন, সঙ্গী তিনটে ছেলের সঙ্গে অপালাদের ক্যান্টিন-করি়ডর-পোর্টিকো-কলেজ যাতায়াতের পথে মুখচেনা থাকলেও আলাপ নেই। যদিও একই কলেজ কিন্তু ভিন্ন ডিপার্টমেন্ট ওদের। সবাই ফার্স্ট ইয়ার সবে টপকেছে, তাই আলাপের সুযোগও বেশি হয়নি। এদের সবার, অর্থাৎ ছ’জনেরই এক কমন বন্ধুর ডাকে সবাই আলাদা আলাদা করে একত্রিত হয়েছে বাড়িতে যথাসম্ভব টুপি পরিয়ে! শান্তিনিকেতনে সেই বন্ধুর দিদির বাড়িতেই ওরা যাচ্ছে পৌষমেলা দেখতে।
উদয়াস্ত ক্যান্টিনে ফিল্ডিং করা ওই কমন বন্ধুটির নাম অরিত্র। প্রমিত আর উদয়ন ফিজিক্স। দেবব্রত ইকো। অপালা আর দেবযানী ভূগোল। পাঠক, সবচেয়ে নির্জন হয়ে যাকে হাঁটতে দেখছেন, সেই-ই শ্রীময়ী।ওর বিষয় ইংরেজি।
‘একবুক ভালবাসা উজার করা….’, সবচেয়ে দরাজ কিন্তু মিঠে গলা প্রমিতের। আসবার পথে তাদের কামরাতেই উঠেছিল নিমাইচাঁদ বাউল। তারও গন্তব্য মেলা। নিমাইয়ের সঙ্গে ভাবসাব করে দু’ পুরিয়া জোগাড় করে ফেলেছিল উদয়ন। আর বেশ কয়েকখানা নতুন গান তুলেছে প্রমিত। অতিবাম ছাত্র ইউনিয়নের ডাকসাইটে পান্ডা তথা পল রবসনের ভক্ত, একমুখ দাড়িওয়ালা এই প্রমিত হায়ার সেকেন্ডারিতে প্রথম কুড়িজনের মধ্যে থেকেও এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যায়নি, স্রেফ অঙ্ককে ভালবেসে। ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিক্সের রহস্যময় অন্ধকার ওকে টানে।
খোয়াইয়ের দিক থেকে আসা এই ভিজে ঠান্ডা বাতাসে আজও যেন আরও গভীর কিছু টানছে ওকে।
‘গত সপ্তাহেও এই সময় কিছু ঠিক ছিল না বল। টিউটোরিয়াল থেকে ফিরে টিভির সামনে বসে ঝিমোচ্ছি। ভাবতে পেরেছিলি শেষপর্যন্ত আসা হবে?’ অপালা বলল শ্রীময়ীকে।
‘না, আমার তো কোনও চান্সই ছিল না। বাবা শেষপর্যন্ত ছাড়তে চাইছিল না। অরিত্র খুব করে বলাতে অবশ্য রাজি হল। তাও স্টেশন পর্যন্ত এসে খুঁতখুঁত করছিল। তবে পারেও অরিত্রটা কিছু গ্যাস খাওয়াতে’,হাসতে হাসতে বলল শ্রীময়ী। দেবযানী থাকে হস্টেলে। ফলে তার চাপটা কম ছিল। তবুও জামশেদপুরে বারবার ফোন করে সব ডিটেলস দিয়ে তারপর পারমিশন জোগাড় হয়েছে তার।

টর্চ হাতে অরিত্র হাঁটছে আগে আগে। ওরএলোমেলো দাড়ি চুল আর পাঞ্জাবি উড়ছে পতপত করে। মেক শিফট গার্জেনের রোলে এক সন্ধ্যাতেই যেন যথে্ষ্ট বয়স্ক দেখাচ্ছে, সারাক্ষণ চ্যাংড়ামো করা আর সবার টিফিন কেড়ে খাওয়া ছেলেটাকে! আফটার অল তার নেমন্তন্যেই সবাই এসেছে বাড়ি ছেড়ে। 
‘শোন আমরা সবাই রাতে থাকব ভুবনডাঙ্গায়। দিদিরা বাড়িটা ভাড়া নিয়েছে, আগামী সপ্তাহে শিফট করবে। এখন ফাঁকা রয়েছে। বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে যা বুঝলাম স্লাইটলি খিটকেল আছে। বেশি চ্যাচামেঁচি করবি না উদয়ন। ঘরের বাইরে যেন আওয়াজ না যায়’,বলল অরিত্র।
উদয়ন বলে, ‘যাহ বাল! আমি একাই কিচায়েন করি নাকি! অ্যাই শোন রাতে একবার আখড়ায় যাব না?’
‘গেট খোলার ডেসিব্যাল যদি কম রেখে বেড়োতে পারিস তো যাবি। মোট কথা আওয়াজ কম। আর মেলা তো শুরু হয়নি। এই বৃষ্টির মধ্যে গিয়ে কামটাই বা কি তোর’, হাল্কা ধমক অরিত্রর।
‘অ্যাই অরি, আমরাও যাব। উদয়ন একা কেন যাবে? এমন চান্স আবার কবে আসবে..’অপালার সঙ্গে গলা মেলালো দেবযানীও।
ওরা যখন ট্রেন থেকে নামে, আকাশ পরিষ্কার ছিল। রিক্সা করে স্টেশন থেকে দিদির এখনকার বাড়ি রতনপল্লীতে যাওয়ার পথটা ছিল জোছনামাখা। এখন যার তিলমাত্র নেই। রাস্তায় ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, নেড়িকুকুরের কীর্তন আর মাতালের বিশুদ্ধ প্রলাপ ছাড়া কিছু নেই। 
‘দ্যাখ, এই যে জার্নি—এর একটা ভিতরের অন্য দিকও রয়েছে কিন্তু। আমরা গত এক দেড় বছর একই কলেজে যাচ্ছি, মুখোমুখি হয়েছি, ক্যান্টিনে চা-ও খেয়েছি নিশ্চয়ই টেবিলের এপার ওপারে বসে। কফি হাউসের টঙে গিয়ে নোটসও জেরক্স করেছি। করেছি কি না? কিন্তু কথা বলার স্পেসটাই এতদিন তৈরি হয়নি’, থেমে থেমে কথা বলছে প্রমিত। বলার ঝোঁকেই বোঝা যাচ্ছে অরিত্র আর উদয়নের কাছ থেকে নিয়ে জীবনে প্রথম বার গাঁজা টেনেছে ও।
‘হুঁ। অথচ কয়েকঘন্টার ট্রেন জার্নিতেই মনে হচ্ছে অনেক আগের চেনা। আর এই যে এতদূর পর্যন্ত আকাশ, ঘড়ি ধরে কিচ্ছু চলছে না। লম্বা লম্বা গাছের ছায়াগুলো পর্যন্ত দ্যাখ আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে। এসবের একটা এফেক্ট থাকতেও পারে’,অনেকক্ষণ পর কথা বলল শ্রীময়ী। 
ভুবনডাঙ্গায় রাস্তার ধারের দু’তলা বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালো অরিত্র। পিছনে ওরাও। একতলার দু’টো ঘরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। একটা বাথরুম। দক্ষিন দিক থেকে একটা বারান্দা এল অক্ষরের মত বাড়িটার অর্ধেক ঘিরে রেখেছে। সামনে অবিন্যস্ত বাগানে মাতাল করা হিমঝুরি, ছাতিম গন্ধ নাইট ডিউটি দিচ্ছে। মেইন গেট এবং সদরের চাবি অরিত্রের পাঞ্জাবির পকেটে।
টর্চের আলো জ্বেলে সবাই ঢুকল একে একে।

দুই--

ফার্স্ট ইয়ারের গোড়ায় শ্রীময়ীকে প্রথম দেখেছিল অরিত্র, আর্টস লাইব্রেরির উল্টোদিকের বেসিনে একা বসে থাকতে। তার আগে ক্যান্টিনে অবশ্যই এই নবাগতাটি বহু আলোচিত। সিনিয়রদের মধ্যেও। লা মার্টস থেকে দুরন্ত রেজাল্ট করা, মার্গ সঙ্গীতে তালিম নেওয়া, সুচিত্রা মিত্রর প্রিয় ছাত্রী শ্রীময়ী।খুব নাকি স্নব অথচ কর্পোরেশনের লোক কলেজ থেকে ক্যান্টিনে প্রতিপালিত নধর নেড়ি দু’টিকে তুলতে এলে, কেঁদে মা গঙ্গা করে দিয়েছিল!মূলত ওই সিন দেখেই ঘাবড়ে গিয়ে ফিরে যায় কুকুর ধরারা! দেখতেও যাকে বলে ঝাক্কাস! সব মিলিয়ে পিকচার পারফেক্ট, সুনীল গাঙ্গুলির নায়িকার মত।
তো এহেন শ্রীময়ী-দর্শনের প্রথম দিনটিতেই পড়বি তো পর, মহম্মদ আলি পার্কের দিক থেকে কার্লস লিউইসের বেগে কলেজ স্কোয়ারের দিকে ধাবমান একখন্ড মেঘের ছায়া এসে পড়েছিল ওই একলা বসে থাকা মর্মরপ্রতিম শ্রীময়ীর চোখে। মেঘের ছায়াঘেরা ওই চোখ আর শ্রীময়ীর বসে থাকার ভঙ্গি, ত্রুফোর ফ্রিজ শট হয়ে গিয়েছে অরিত্রর বাকি জীবন জুড়ে। চিরস্থায়ী ভাবেই।
এই ঘটনার (অবশ্য যদি একে ঘটনা বলা যায়) মাস দেড়েকের মধ্যে কলেজ ফেট এ আক্ষরিক অর্থেই শ্রীময়ীর সঙ্গে গান গেয়ে পরিচয়! এরপর দুপুর সন্ধ্যা পার করা আড্ডা ক্যান্টিনের বাইরের উপর্ঝরণ বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, জলছপছপ কলেজস্ট্রিটে ছাতা বন্ধ করে হাঁটা, হ্যারিসন স্ট্রিট যেন শাখা নদী তখন! দলবেঁধে সিনেমায় যাওয়া। কিন্তু যতবার যতক্ষণ দেখা হয়েছে, বলা ভাল, যখনই শ্রীময়ীর চোখে চোখ পড়েছে, অরিত্র সেই মেঘেরই ছায়া দেখেছে। যে ছায়ার কাছে গিয়ে দুদন্ড বসা যায়। বলা যায়, ‘হেব্বি খিদে পেয়েছে। দিলখুসায় কবিরাজি খাওয়াবি!’ এবং হয়তো আরও কিছু।
‘অমন বোকার মতন তাকাস কেন বল তো? ক্যাবলামিটা কি তুই মাঝে মধ্যে অ্যা়ডপ্ট করিস!’কতবার বলেছে শ্রীময়ী। কখনও তারমুখসই জবাব দিতে পারেনি অরিত্র। ইংরিজিতে যাকে বলে ডিগনিটি, সেটা আসলে দেখতে কেমন? যদি কাঁচের মতনও হয়, তাহলে সেই সুদৃশ্য কাঁচ সবসময় ঘিরে রাখে শ্রীময়ীকে। সেই কাঁচ টপকে ঢুকতে হলে ম্যানড্রেকের জাদুছড়িটা চাই। তবে সে যে এককথায়, শান্তিনিকেতন যেতে রাজি হয়ে যাবে, ভাবেনি অরিত্র। শুধু বলেছিল, ‘তুই একটু বাবার সঙ্গে কথা বল। তোকে যদি হ্যাঁ, বলে আমার কোনও সমস্যা নেই। ভালই তো হবে, কখনও পৌষমেলায় যাওয়া হয়নি।’’
সেই শ্রীময়ী কাঠ সিমেন্ট কংক্রিটের বাইরে আগামী তিনদিনের জন্য ওর সঙ্গে।
‘হে বয় মেক হে বিফোর সান শাইনস’--গত কয়েকদিন ধরে জপের মত এই কথাটা তাই নিজেকে বলে যাচ্ছে অরিত্র।

তিন--

‘শোন একটা ঘরেই খাট রয়েছে। দু’টো তোষক থেকে একটা তুলে নিয়ে পাশের ঘরে পাতছি। আমি, প্রমিত দেবু, উদয়ন মাটিতেই শুয়ে যাব। তোরা তিনকন্যা এ ঘরেই থাক’,সিগারেটের খোল খালি করতে করতে ঘোষণা করল অরিত্র। সঙ্গে সঙ্গেই খ্যাঁক করে উঠল অপালা।‘এতো জেন্ডার সেনসিটিভিটি নিয়ে কী করে রাজনীতি করিস মাইরি। এ ঘর সে ঘর বেঘর!’
ইষৎ রক্তচক্ষু উদয়ন সামনে ঠ্যাং ছড়িয়ে গেয়ে উঠল ‘মেরে ঘর আনা, আনা জিন্দেগি…’
দেবযানীও সবেগে আপত্তি জানালো মাথা নাড়িয়ে।‘‘শোন অ্যাত্ত কাঠখড় পুড়িয়ে এসেছি, আর তোমরা পাশের ঘরে মজা মারবে দ্যাটস নট ডান। উই আর নট গোয়িং টু মিস আ সিংগল মোমেন্ট অব দিজ ট্রিপ। টানা বিছানা কর খাট হাটিয়ে। যার ইচ্ছা ঘুমাবে, কেউ বেড়োতে চাইলে বেড়োবে। ইনসি়ডেন্টালি, উই জেল়়ড ওয়েল। ইসন্ট ইট দেবু?’
দেবু অর্থাৎ দেবব্রতর সঙ্গে এদের তবুও একটা যোগাযোগ রয়েছে কলেজে। পুরোটাই শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসের জার্নিতে আলাপ নয়। দেবুর বান্ধবী সেঁজুতি, অপালা-দেবযানীর ক্লাসমেট। ওই সূত্রে সামান্য পরিচয়টুকু। গ্রন্থকীট এবং আদতে কবি দেবব্রতর জগৎ ওদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অরিত্রর মাঝে মাঝে মনে হয়, সেঁজুতির থেকেও হয়তো অনেক দূরের বাসিন্দা দেবু। কে জানে…। এবার সবার বাড়ি থেকে পারমিশন এলেও শেষপর্যন্ত সেঁজুতির মা বেঁকে বসায় তার আর আসা হল না। গোড়া থেকেই দেবব্রত তাই কিছুটা বিষন্নই। তবে সেটা চেপে রাখতেও ও পারদর্শী।
রাস্তার মোড়ে একটাই সিগারেটের দোকান খোলা থাকছে মাঝরাত পর্যন্ত। মেলা বলে টুরিস্ট রাশ বেশি।সবাই যখন গানে গল্পে মসগুল, হাল্কা পায়ে ঘর থেকে বেডিয়ে এল প্রমিত আর দেবু।
‘ছাতিম তার শেষ স্পেল-এ বোলিং করছে বুঝলি প্রমিত’, অল্প হেসে বলে দেবু। ম ম করছে ছাতিমগন্ধ। হাসল প্রমিতও। দু’জনে সিগারেট কিনে হাঁটতে লাগল কিছুটা উদ্দেশ্যহীনভাবেই। নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলতে বলতে।
সন্ধ্যায় নিমাইদাস বাউলকে পাশে বসিয়ে যখন দোতারাটা নিয়ে সুর বাঁধছিল প্রমিত, ‘লাল পাহাড়ি’র সঙ্গে, ওর ঠিক উল্টোদিকের সিটে বসেছিল শ্রীময়ী। ‘মরবি তো মরে যা ইক্কিবারে মরে যা হিথায় তোরে মানাইছে নাই রে…’ একুশ বছরের এই জীবনে এভাবে মরে যেতে ইচ্ছা তো করেনি প্রমিতের, আগে কখনও। অন্তত অন্য কারুর জন্য। ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট, পড়াশুনো ফাঁকফোকরে বাম রাজনীতি আর গান –--এসবের মাঝে কোথা থেকে সদলবলে এই অসময়ের ছাতিম গন্ধ গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছে তার সঙ্গে।
ট্রেন আলো করে বসেছিল শ্রীময়ী। ক্যান্টিনে যাতায়াত আর সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামার মাঝে কখনো কি চোখে পড়েনি, নিশ্চয়ই পরেছে। কিন্তু এভাবে নয়। এমনটা কখনও নয়। ঠিক যেভাবে কামরায় বসেছিল শ্রীময়ী, যেন সে এই দলের কেউ নয়। এই গ্রহেরও নয়। মাঝপথে উঠেছে। যে কোনও স্টেশনে নেমে যাবে। চলন্ত ট্রেনের বাইরে থেকে আসা হাওয়ায় ওর ফিরোজা রঙের ওড়না উড়তে উড়তে কখন যে আকাশ হয়ে গেল! প্রমোদদার ক্যান্টিনে গত এক বছরে যা সম্ভব হয়নি, সেই ম্যাজিকই ঘটে গেল এই ক’ঘন্টায়?
জিভে তিতকুটে স্বাদে সম্বিৎ ফিরল প্রমিতের। খেয়াল হল, সে ফিল্টারের দিকটি ধরিয়ে দু’এক টান দিয়ে ফেলেছে! পাশে এতক্ষণ থাকা দেবুও যেন কোথায় সরে পড়েছে তাকে থম মেরে যেতে দেখে। বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছে শুনল ভিতরে হুল্লোড়ের হাট বসে গিয়েছে।
ব্যাপার হল, কলকাতা থেকে আসার সময়ই ব্যাগে দু’টো হুইস্কির বোতল ঢুকিয়েছিল উদয়ন। (তার মধ্যে একটা বাবার থেকে ঝাড়া, জনি ওয়াকার)। এই ভেজা জামাকাপড়েই সেটি খুলেছে। সুঁড়ির স্বাক্ষী অরিত্র! দেবু সাধারণত এইসব বৃত্ত থেকে অনেক দূরে থাকে, বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটানো এবং পড়াশুনো--- তার জীবনকে আড়াআড়ি ভাগ করে রেখেছে। কিন্তু আজ নিজের নথ ভাঙতে চায় সে।
‘‘সেঁজুতির মা এটা কী করলেন বল তো?’’ প্রথম চুমুকের বিস্বাদ নেমে যাওয়ার পর স্বগতোক্তির স্বরে দেবব্রত বলল, পাশে বসা অরিত্রকে। অপালার সঙ্গে রয়েছে জিন টনিক, হস্টেলের স্টক, ব্যাগপ্যাক থেকে সেটিও বেরিয়ে পরেছে, কিন্তু ফাঁকা বাড়িতে গ্লাস নেই ততো। তাই এঁটো কাঁটার নিয়ম না মেনেই গ্লাসে নানা ঠোঁটের চিহ্ন পড়ছে! 
মদের আড্ডায় সাধারণত ক্যাপ্টেনশিপ করে থাকে অরিত্র। নেচে, কুঁদে, ভাট বকে, কবিতা পড়ে সিন জমিয়ে দেওয়া যাকে বলে।কিন্তু কাল রাত থেকেই যেন সেই বিখ্যাত প্রজাপতিটা ঘুরপাক খাচ্ছে তার পেটে। দু’দিন আগে সে চলে এসেছিল বোলপুরে।অ্যাতোগুলো বন্ধুর ল্যাঠা সামলানোর জন্য। কিন্তু করার কিছুই নেই, দিদিরাই যা ব্যবস্থা করার করেছে। ভি্তরে ভিতরে ছটফট করেছে অরিত্র।

চার--

গত বছর মিলিউতে ভীমসেনজী এসেছিলেন গাইতে। ও তখন ইউনিয়নের তরফে গোটা বিষয়টা দেখভালের দায়িত্বে। ভীমসেন আসবেন শুনলে যা হয়, সম্ভ্রান্ত অভিভাবকদের ভিড় বিকেল থেকেই বেকার হলে উপছে পড়ে। ভীমসেন এসে বসেন প্রথমে কমন রুমে। তাঁর শার্গিদদের সঙ্গে। একটি ১লিটারের শিভাস রিগালের অধের্কটি শেষ করে যখন উঠে দাঁড়ান, তখন তিনি টুপ ভুজঙ্গ! শীতকালেও টেনশনে দরদর করে ঘামছিল অরিত্ররা। যদি বেসামাল কিছু হয়, একটা মারও বাইরে পড়বে না! কেলো হবে বড় স্কেলে। নেহাতই ছেলেমানুষি ভাবনা ছিল সেটা। ওই স্টেজ পর্যন্ত যাওয়াটুকুই যা বেপথুভাব পন্ডিতজীর। বাকিটা মন্ত্রশক্তি। স্টেজে বসার পর কিছুক্ষণ নম তোম করার পর শূণ্যে মুঠি ছুঁড়ে তাঁর লেজেন্ডারি স্টাইলে যখন সুর পাড়তে লাগলেন, যেন মেঘ ডাকতে লাগল ঘরে। বাজ চমকাতে লাগল। সন্ধ্যে যখন রাতে গিয়ে মিশছে ভীমসেনজী ধরলেন গৌড় মল্লার।‘ঘন ঘেরি আয়ো রে মা...দামিনী দমকে চমকে....’
টেনশন কমে এক স্বর্গীয় আনন্দে ভরে যাচ্ছে ওরা। অরিত্র পিছনের গেট দিয়ে এসে সিগারেট ধরাতে যাবে এমন সময়--ও দানি তোম তা না না তা নোম দা রে দানি--- এক পা এগোলেই ধাক্কা খাবে এমন দূরত্বে দাঁড়িয়ে শ্রীময়ী। একাগ্র হয়ে শুনছে। অথচ সোজা তাকিয়ে তার দিকেই। ততোক্ষণে সুর তার পাগলামি শুরু করেছে, পাতাল ফুঁড়ে আরও গভীরে ঢুকে যাচ্ছে তার শলাকা। যেখানে পেতলরঙা সিংহাসন আলো করে বসে আছে শ্রী! 
‘‘শোন আজ ড্রাইভারের ছুটি। গাড়ি আসবে না। কেউ গলফগ্রিনের দিকে ফিরছে কিনা খোঁজ নিয়ে জানাবি প্লিজ। এত রাতে কীভাবে যাব বুঝতে পারছি না’’, বলল শ্রীময়ী।
‘ছেড়ে গিয়ে আসতে পারি তোকে। একটু ওয়েট কর। ট্যাক্সি ধরে নেব।আমিও ফিরব এবার। সকাল থেকে অনেক হু্জ্জোত গিয়েছে, আর ভাল্লাগছে না। যেন শালা মেয়ের বিয়ে।’’
আলাদা কিছু ছিল কি সেই গৌড় মল্লারের রাতে? 
সব যাত্রাই শেষ হয়। সেদিন বেলফুলের মালা জড়ানো ট্যাক্সিযাত্রাও শেষ হয়েছিল। স্বরোপিত আইন অমান্য করে সেই রাতে সেজেছিল শ্রীময়ী। কাজলের টান, ঝুরো টিপ, মায়ের ভারী শাড়ি আর মাথায় বেলফুলও। সবই রক্তের ভিতর এক পাগল টান ধরিয়ে দিয়েছিল অরিত্রর। ভিতরে ভিতরে চিৎকার করে বলেছে সে, সর্দারজী আপ সিধা চালাইয়ে। কঁহি পঁহছনা নেহি হ্যায়। 
কিন্তু সে সব কিছু হয়নি। শুধু কবিতার ঈশ্বরেরাই বুঝি ট্যাক্সি ড্রাইভার হয়ে আসেন! গল্ফগ্রিনে নেমে জোর করে অরিত্রর পকেটে টাকা গুঁজে ফ্ল্যাট-চরাচরে মিশে গিয়েছিল শ্রীময়ী।
দূরপাল্লার কোনও দৌড়ের আগে ফুসফুসে হাওয়া ভর্তি করে নেন স্প্রিন্টাররা। সেই রাত থেকেই দমবন্ধ করে রেখেছে অরিত্র। কাউকে বলেনি কিছু। এমনকি, প্রায়শই নিজেকেও নয়। কলেজ ক্যান্টিন পাড়া, ইউনিয়ান--—ওর অলিতে গলিতে বন্ধু। বান্ধবীও কম নয়। সঙ্গে কবিতার জন্য ঘোরে পাওয়া দিন রাত জাগা। উচ্চাকাঙ্খাহীন, অদূরদর্শী এক জীবন, অল্প বয়সে বাবা চলে যাওয়ার ফলে আরও অ্যাঙ্করহীন। এই সিচুয়েশনে দূরের বাতিঘরে এক এক করে চোদ্দটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছিল শ্রীময়ী, সেই গৌড় কানাড়ার রাতে।
শান্তিনিকেতনে সবাইকে ডাকার প্ল্যানটা করেছিল অরিত্র শুধু এতদিন ধরে রাখা নিঃশ্বাসটা ছাড়ার জন্য। খোয়াইয়ের কাছে কোথাও, ক্যানাল পাড়, কঙ্কালিতলার কোনও ধাবা অথবা ভিড়ে ভরা মেলার মাঝখানে আচমকাই দাঁড়িয়ে সে শ্রীময়ীকে নিয়ে ফ্রিজ শট হয়ে যেতে চায়।
যার আগে কিছু নেই, পরেও কিছু থাকবে না। কখনও।

পাঁচ---

‘এরপর কিন্তু কুকুর ছাড়া কিছু থাকবে না মাঠে। বাউলরা সব টুল হয়ে গিয়েছে বাপা!’ একটু ঝোঁক দিয়ে দিয়ে বলা কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণ উদয়নের। প্রমিতের মত ব্রিলিয়ান্ট কেরিয়ার না হলেও সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পরীক্ষায় নম্বর যথেষ্ট ভাল তার। আর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং, জীবন নিয়ে তার এই সুপার ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচ। কেঁদুলি আর ক্যালকুলাস একইসঙ্গে সামলাচ্ছে, সঙ্গে মাত্রা রেখে নেশাভাঙও! 
ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সবাই। বারান্দার দিকের চেয়ারে প্রমিত এসে বসল। পাশেই শ্রীময়ী। এই মাঝরাতে তাকে দেখাচ্ছে তাজা স্থলপদ্মের মত। সত্যিই দেখাচ্ছে? নাকি নেশার ঝোঁকে প্রমিতের মনে হচ্ছে? এসব স্রেফ ইলিউশান!
‘কলেজেও দেখি তোকে খুব গম্ভীর। এখানেও তাই। কী অ্যাতো ভাবিস সব সময়?’ বলল শ্রীময়ী।
চমকে উঠল প্রমিত, কেননা প্রশ্নটা তাকেই করা। করেছে শ্রীময়ী। ‘কলেজেও দেখি’ মানে কী? তাকে দেখে শ্রীময়ী! নাকি সামান্য জিনেই এই প্রগলভতা তার? কী উত্তর দেবে ভাবতে ভাবতেই অরিত্র বলল, ‘চল উদয়ন, যদি যেতে হয়, এখনই মেলার মাঠে এক পাক মেরে আসি। বৃষ্টিটা ধরেছে।’ 
কাল থেকে মেলা শুরু। আজ শেষ রাতে সে মুখোমুখি বসবে শ্রীময়ীর। এতদিন কায়ক্লেশে ধরে রাখা নিশ্বাসটুকু ছাড়বে। নিজের কিছুটা আয়ু নির্ঘাত মিশে যাবে সেই নিশ্বাসে। তা যাক। নিজের বাকি আয়ুটুক ওর পায়ে আলতার মত করে সাজিয়ে দেবে আজই। অসহ্য এই অপেক্ষা শেষ হোক এবার। তার আগে প্রস্তুতির জন্য এক রাউন্ড হেঁটে আসা।
অপালা বলল, ‘আমিও যাব, একমিনিট দাঁড়া, চুলটা বেঁধে নিই।’
‘মাঝরাতে তোর ইকোবানা কে দেখবে সোনা’, টিপ্পনি কাটল শ্রীময়ী। আর এটাও জানিয়ে দিল ওর শরীরটা জুৎ লাগছে না। বিছানায় গড়িয়ে নিতে চায়। একই মত দেবযানীর। প্রমিত বসেছে বারান্দায় নতুন একটা পেগ নিয়ে। ওরই আব্দারে বা অনারে জনি ওয়াকারটা খুলেছে উদয়ন। ফলে নড়তে নারাজ অরিত্রও।
‘ছাড় ও ব্যাটা প্রথম মাল খাচ্ছে।ওকে না নেওয়াই ভাল। উল্টি যদি করে এখানেই করুক। রাস্তাঘাটে করলে ঝামেলা আছে।’ বলল উদয়ন। দেবব্রত যদিও অনেকটাই খেয়েছে কিন্তু সে নির্বিকার এবং বেরোনোর নামে এক পায়ে খাড়া।
অপালাকে নিয়ে তিনবন্ধু যথাসম্ভব কম শব্দে গেট বন্ধ করে, এগিয়ে গেল মেলামাঠের দিকে। অন্ধকারে ওদের মধ্যে জোনাকি বদলের মত বদলাচ্ছে জ্বলন্ত সিগারেটের আভা।

ছয়-- 

‘মেলায় আছে কত মানুষ কে বা চেনে কাহারে তুই যদি না ডাকিস মনের কথা কব কাহারে’…. অনেকদিন পর প্যারিস থেকে পবন এসেছে। ওদের সঙ্গে জমে গেল নিমেষেই। কলিকা বিনিময় হল, আর গান। ওর বিদেশিনি বউ নেচে নেচে গাইতে লাগল, ‘দিন দুনিয়ার মালিক খোদা তোমার দিন কি দয়া হয় না….’
‘শ্রীময়ীর আসা উচিত ছিল, তাই না রে! ও এলে কনসার্ট জমে যেত,’ দেবুর কানে ফিস ফিস করে বলল অপালা। উদয়ন মজে আছে শুকনো নেশায়। শুধু অরিত্রর বুকে লাবডুব শব্দটা এত জোর হচ্ছে যে ওর নিজেরই ভয় করছে দোতারা ছাপিয়ে না কারও কানে তা ধরা পরে যায়। ওদেরকে ওখানেই ছেড়ে গিয়ে কিছু না বলে আখড়া থেকে হঠে এল অরিত্র। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে লাগল রতনপল্লীর দিকে। শেষ রাতের রাস্তা শুনশান, ফলে তার বুকের ড্রাম পেটার আওয়াজ কারও শুনতে পাওয়ার ভয় নেই। 
গেট থেকে মোরামের রাস্তার দুপাশে বাগান। একটু এগিয়ে তিনধাপ উঠেই সদর দরজা। দরজার ডানদিকে থেকে শুরু হয়ে কোণাকুনিভাবে পিছনের দিকে চলে গিয়েছে বারান্দা। মেঘ কেটে যাওয়ায় চাঁদ আবার স্বমহিমায়। এমন আলোতেই ধোঁকা খেয়ে যায় পাখিরা। দিনের আলো ভেবে ভূল করে ডাকতে শুরু করে। দুধের পাতলা সরের মত ফকফকে কুয়াশায় বারান্দা ভাসছে। ঘরের ভিতরে কোনও সাড়াশব্দ নেই। সবাই ঘুমিয়ে পড়ল তবে? 
না, ভীষণ চেনা গলার গুণগুণ সুর শোনা যাচ্ছে বাড়ির পিছনে। শ্রীময়ী! কয়েক পা সেদিকে এগিয়েই যেন মোমের পুতুলবৎ হয়ে গেল অরিত্র। তবে আজ তো ওর ফ্রিজ শট হওয়ার রাতই ছিল! 
মোড়ায় বসে খুব চাপা স্বরে গান গাইছে শ্রীময়ী। গান ঠিক গাইছে না, কোনও সুরকে ছঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর গলা। আর ওর পায়ের কাছে বসে হাঁটু ছুঁয়ে রয়েছে প্রমিত। কোনওদিন কোনও মেয়ের চৌহদ্দি না মাড়ানো, বরাবরের ফার্স্ট বয়, কেরিয়ারের উড়াল দেওয়ার ঠিক আগের প্রমিত। আর শ্রীময়ীর ওই কাঁচের বর্ম খানখান হয়ে পড়ে রয়েছে চারধারে। জোছনায় তা যেন চিকচিক করছে। ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হচ্ছে ওরা।
কুয়াশা আর জোছনায় অলীক দেখাচ্ছে এই ফ্রেমটিকে। ভীষণ সুন্দরও কি নয়? পায়ে পায়ে পিছু হঠতে চেয়েও পারল না অরিত্র। গাছের মতনই তার পায়ের থেকে মূল, শাখা মূল মূলরোম বেরিয়ে চারিয়ে যাচ্ছে বারান্দা খুঁড়ে মাটির গভীরে। গেঁথে যাচ্ছে পলিস্তরের নীচে হাওয়া আলো বাতাসহীন লক্ষ লক্ষ বছরের অন্ধকারে। নড়তে পারছে না সে।
পরিত্রাণহীনভাবে আরও একটা সিগারেটের জন্য পাঞ্জাবির পকেট হাতড়াতে থাকে অরিত্র।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র