ঝুমা চট্টোপাধ্যায়

মায়াজম
0
                                                        অলিন্দের জন্য 









       সেবার ডিসেম্বর মাসটা ছিল বিশেষ রকম ঠাণ্ডা আর স্যাঁতসেঁতে । বাগানের গাছপালা সব শুকিয়ে সোনালি রঙ ধরে গিয়েছিল । প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে সেই একই আর অপরিবর্তনীয় দৃশ্য দেখা আমার কাছে ছিল বেশ একঘেয়ে আর কষ্টকর । একদম একাই থাকতাম আমি । একটা একলা বাসা । কিছু খড়কাঠি আর কিছু শুকনো ঘাস ঠিক যতটা ওজন আমি আমার ছোট্ট হলুদ ঠোঁটে তুলতে পারি । ঘাস কাঠির বাসাটা যে ডালে আমি তৈরী করেছিলাম ডালটা অতকিছু মোটা ছিল না । কিন্তু পাতা টাতা গুলো বেশ আড়াল করে রাখত আমার ছোট্ট বাসাটাকে । শুনেছিলাম কাছাকাছি কোথাও একটা সমুদ্র আছে কিন্তু ও জিনিষটাকে স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছে আমার আমার হত না । দূরত্ব জিনিষটা আমার কাছে কেমন নিষ্ঠুর নিষ্ঠুর বলে মনে হত । ভয় পেতাম । এজন্য আমার বন্ধুরা হাসি মশকরা করত নিজেদের কানে কানে । আমার এই অকারণ ভয় পাওয়াটাকে নিজেদের মধ্যে নানাভাবে ব্যাখ্যা করত । ফলে কিচির মিচির শব্দে জায়গাটা ভরে থাকত সর্বক্ষণ ।
আমার বাবাকে আমি চিনতাম না । দেখিনি তাকে কখনও । কিন্তু মাকে আমার ভীষণ মনে পড়ে । কী ভীষণ ভালবাসত আমাকে । আমার সঙ্গে আমার আরও দুজন ভাই বোন জন্মেছিল । তিনজনে আমরা বাসার ভেতরে বসে ঠকঠক করে কাঁপতাম । ঘনঘন উড়ে আসত মা । ঠোঁটে তার ধরা থাকত ক্ষুদে পোকা । আমাদের সরু সরু হাঁ এর ভেতরে গোলাপি জিভ উঁকি দিত , তার ওপরেই সন্তর্পণে পোকাটাকে রেখে দিত মা । তারপর আবার কোথায় উড়ে যেত । ফের ফিরে আসত আমাদের কাছে । ঠোঁট দিয়ে পিঠ চুলকে দিত । ঘুম পেলে ডানা পালক ছড়িয়ে দিত গায়ের ওপর । নতুন ঘাস বয়ে আনত যখন মা , ঘর সাজাত , মায়ের সঙ্গে আমরাও ঠোঁট মেলাতাম । কি যে সুন্দর ঘর বোনা চলত আমাদের !
গরমটাতো কাটছিল এই রকমই । উড়তে শিখিনি তখনো । একদিন ভাইকে একটা চিল এসে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেল । বাসায় মা ছিল না । আমরা চীৎকার করলাম , বাঁচাও বাঁচাও ! কেউ কেউ এর প্রতিবাদ করল কিন্তু বাঁচাতে সক্ষম হল না । চলে গেল ভাই । বোন খুব কাঁদছিল । আমি মার কথা ভাবছিলাম । কি জানি আজ মা ফিরে এসে কতই না দুঃখ পাবে ! কিন্তু কি এক দুর্বোধ্য কারণে মা সেদিন বাসায় ফিরল না । ফিরল পরদিন সকালে । খেতে না পেয়ে বোন একটু নির্জীব হয়ে পড়েছিল । অত গা করল না মা । একটু টেরিয়ে দেখল মাত্র । তারপরই আমাদের দুই বোনের পিঠে খোঁচা দিল । ফলে একটু নড়ে বসলাম দুজন । ছোট্ট বাসার থেকে কয়েকটা শুকনো ঘাস খসে পড়ল নীচে । আবার খোঁচা দিল । খোঁচাতে আমার পিঠের একটা ছোট পালক একটু কাঁপল । আমার মনে হল এই কাঁপনটা যেন আমার ইচ্ছেগত । যেন ইচ্ছে করলেই পালকটাকে আবার আমি নড়াতে পারি । তাই করলাম , করা মাত্রই উড়তে শিখে গেলাম । কিন্তু বেশি দূর নয় । তবে এটা বুঝে গেলাম কি করে নিঃশ্বাসটাকে বুকের ভেতরে রেখে ডানা দুটোকে দুপাশে ছড়িয়ে দিতে হয় । তৎক্ষণাৎ মনে হল কৌশলটা দারুণ আনন্দদায়ক । সেই আনন্দ থেকেই কিঁচ কিঁচ শব্দের বদলে অন্য একটা ডাক আমার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল । বড়দের মত । আমি নিজেই নিজের মধ্যে মশগুল হয়ে গেলাম । এই তো বেশ কথা বলতে পারছি !
দু দিন পর , মা আমাকে বলল , মা এবার আমাদের থেকে দূরে থাকবে । এই বাসাটা ছেড়ে চলে যাবে ।মায়ের কথার কোন মানেই বুঝতে পারলাম না । কি মানে এর ? আমার বুদ্ধি কোন যুতসই উত্তর খুঁজেই পেল না । চলে গেল মা । যেদিন গেল , খুব কাছেই শুনতে পাচ্ছিলাম অন্য একজন কেউ খুব তীব্র কণ্ঠে ডাকছে মাকে । আর মাও সাড়া দিচ্ছে অনবরত । বেশ খুশী আর উচ্ছল দেখাচ্ছিল মাকে । যেন এ আমার সেই মা নয় । এ যেন অন্য কেউ । প্রথম উড়তে শিখে যে আনন্দ আমি পেয়েছিলাম সেই আনন্দ আমার ঘুচে গেল অচিরেই । ডানা মেলে উড়ে গেল মা আর যাওয়ার সময় একটি বারও পিছু ফিরে চাইল না ।
অনেক দূরের সেই সমুদ্র থেকে কুয়াশা উঠে আসছিল তখন । বাতাসকে ভারি করে বায়ুস্তরের একদম নীচে ঝুলছিল । ঘন কেশর ফোলানো মেঘ ভিড় জমিয়েছিল আকাশে । দলে দলে সাজছিল তারা । খাঁড়ির আগায় নারকেল গাছগুলো চুপ করে দেখছিল ওদের । সঙ্গীকে নিয়ে সেই গাছগুলোর ওপর দিয়ে মেঘ পেরিয়ে বহুদূরে উড়ে গেল মা । ভাঙা গলায় বোন ডাকছিল মাকে , মা মা ! শুনতেই পেল না কেউ । কুয়াশা হয়ে মিলিয়ে গেল ।
সেইদিন মাঝরাত্রে সমুদ্র থেকে ধেয়ে এল তুফান । সঙ্গে বজ্রবিদ্যুৎ সহ প্রবল ঝড় আর বৃষ্টি । সঙ্গীরা মারা গেল অনেকেই । আর মারা গেল আমার একমাত্র বোনটিও ।
একা বাঁচতে শিখলাম । নতুন একটা বাসা বানাতে হল আবার । কি করব ? মাথা গোঁজার ঠাঁই তো একটা চাই । রাত্রে থাকতাম সেটাতে আর দিনের আলো ফুটলে অন্য সঙ্গীদের দেখাদেখি ঝোপে ঝাড়ে নদীর চরে খাবার দাবাড়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতাম । সঙ্গীরা এক একদিন উড়ে যেত সেই দূর সমুদ্রের দিকে । আমি অবশ্য ওদের সঙ্গে যেতাম না । খালি মনে হত কি জানি ফিরে এসে যদি দেখি আমার সেই ছোট্ট বাসাটা আর নেই ! এই আশঙ্কায় বুক কাঁপত । পান্না বলে একজন বন্ধু ছিল আমার । বেশ দুরন্ত আর হাসিখুশী । গলার রঙ ঘন নীল আর পিঠের পালক হাল্কা আকাশী । সঙ্গীদের পেছনে লাগা ছিল ওর স্বভাব । বেশ বন্ধু হয়ে গেলাম আমরা । তখনি ও অনেকের সঙ্গে প্রেম করতে শুরু করে দিয়েছে । সারাদিনই ব্যস্ত । সবার সঙ্গেই হাসি আর মশকরা । এদিকে আত্ম সন্মানের তাগিদে ওকে আমি বলতেই পারলাম না যে আমি ওকে ভালোবাসি । আর এই অকাল মোহই আমার জীবনে এনে দিল দারুণ এক পরিবর্তন ।
পান্না আমার চাইতে বয়সে খানিকটা বড়ই ছিল । চেহারা সুন্দর তো ছিলই । প্রথম ক দিন আমরা একসঙ্গে থাকতাম । একসঙ্গে উড়ে যেতাম । কথা বলতাম । পাশাপাশি বসে একসঙ্গে বিশ্রাম করতাম যখন নিজের সরু ঠোঁট দিয়ে পান্না আমাকে আদর করত ক্রমাগত । তীব্র ভালোবাসা জানাত আমাকে । কিন্তু শীতের শুরুতে দেখলাম ও আমাকে এড়িয়ে যেতে শুরু করেছে হঠাৎ । ভাল করে কথাও বলতে চাইছে না । ব্যাপারটা পরিষ্কার হল ক দিন পর । দেখা গেল অন্য আর একটি সঙ্গী জুটে গেছে পান্নার । সঙ্গীটি পান্নার মতই দুরন্ত আর রহস্য প্রিয় । লজ্জায় নিজেই কুঁকড়ে গেলাম । কষ্টে প্রবল কান্না পেয়ে গেল কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না ওকে । এদিকে পান্নারা তখন দুজনে একসঙ্গে থাকতে শুরু করে দিয়েছে । মাঝে মাঝে অন্য সঙ্গীদের থেকে দলছাড়া হয়ে যাচ্ছে । সঙ্গীরাও কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না এ নিয়ে । সবাই নিজের মত ব্যস্ত । সবাই খুশী ।
তখন শীত কাল । ভোরের ভালো করে ফুটতে না ফুটতেই সবাই উঠে পড়ি । খাবারে খোঁজে অনেক দূর পর্যন্ত যাই । সঙ্গীরা গান করে , আমিও গলা মেলাই একসাথে । গান গাইতে গাইতেই ওরা উড়ে যায় আরো দূরে , পুরো তল্লাটটা বিলকুল নির্জন হয়ে গেলে আমি ধীরে সুস্থে চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখি । রোদের আলোয় চারদিক ঝিকমিক করছে বটে কিন্তু এই রকম শব্দহীন পৃথিবীতে নিজেকেও আমি ভাল করে চিনে নিতে পারি । ছুঁয়ে দেখতে পারি নিজের মনটাকে । ভাবি আমি কি সত্যিই একা ? সত্যিই কি আমার কোন বন্ধু নেই ? নলখাগড়ার ঝোপের মধ্যে ঐ যে একটা পা লম্বা সারস দাঁড়িয়ে , ওও তো একা । একাই নিজের ছায়া দেখছে । লজ্জাবতীর ডগায় ডগায় গুটি কয়েক ফুল ,আকাশের অনেক উঁচু দিয়ে মেঘ ভেসে যাচ্ছে এক আধটা , ওগুলো কেমন একা ! জলাভূমির গাছ গাছালির ওপরে শুকিয়ে যেতে যেতে কাঁচের মত জমে রয়েছে শিশির , দূর বনান্ত থেকে ভেসে আসছে নানান শব্দাশব্দি, ওগুলোও তো একাই । বিচ্ছিন্ন এবং নিজের মত । এমনই সব অদ্ভুত অনুভূতি হত আমার । এবং অনুভব চলাকালীন মনে হত একলা হলেও ঠিক কোন একটা অদ্ভুত কারণে আমি একলা নই । এই অদ্ভুত কারণটা কিছুতেই আমি খুঁজে দেখার চেষ্টা করলাম না । মনটা আমার ওদিক পানে গেলই না । বরং আর কি কি জিনিষ বা বস্তু একলা রয়েছে সেইগুলোই খুঁজতে শুরু করে দিলাম । কেমন নেশা ধরে গেল । আমার সঙ্গীরা আমার এই ভাবান্তর নিয়ে মাথাই ঘামালো না । সেটাই স্বাভাবিক । পান্নাকে দেখা যেত মাঝে মাঝে । সেই একই রকম আনন্দে ভরপুর । রূপা নামে আমার আর এক বন্ধু , এক কালে পান্নার সঙ্গে ভালোবাসা হয়েছিল রূপার , রূপাই আমাকে একদিন প্রায় জোর করে জলা জমির ধারে নিয়ে গেল । গেলামও আমি । ঠোঁট না খুলেই খুব তীব্র মিষ্টি রিনরিনে শিষ দিতে পারত রূপা । সরললতা ভরা আগাছাগুলোর নীচে বারোমাস জল দাঁড়িয়ে থাকত । মাছ টাছও পাওয়া যেত এক আধটা । তখন বেশ রোগা হয়ে গিয়েছিলাম আমি । জলপারের ভিজে কাদামাটির ঠাণ্ডা আমেজ আমার ভেতরের গভীর চিন্তা স্রোতকে লঘু করে তুলল । মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম রূপাকে । খুব ভালো লাগছিল । কিন্তু বেশিক্ষণ টিকল না সেই খুশী । হাতে লোহার আঁকশি আর শক্ত জ্বাল নিয়ে কিছু লোক , সঙ্গীদের কাছে এদের কথা আগেই শুনেছিলাম , এবার স্বচক্ষে দেখলাম এদের , দেখলাম আমাদের কয়েকজন সঙ্গী আগেই ধরা পড়েছে । পান্নাও আছে সেই দলে । বাকি ছিলাম আমি আর রূপা । লোকগুলো এগিয়ে এল আমাদের দিকে ।
ধরা পড়ার পর বিষণ্ণ অথচ সেই রকমই তীব্র স্বরে ডেকে উঠল রূপা । কালো চামড়ার টুপি পরা লোকটা বলল , আজ ভাগ্য দারুণ ভাল , এটাকে চড়া দামে বেচব ।’’
শোনা মাত্রই আমার মনে হল মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে তার কথা । তার কাজ নয় । যারা কথা দিয়ে নিজেদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এই দুনিয়ায় তারাই অদ্ভুত রকমের সুখী মানুষ । অদ্ভুত কিছু মানুষ অদ্ভুত রকমের সুখী ।
শিকারি লোক গুলো আমাকে নিয়ে তর্ক করতে শুরু করে দিল । একজন বলল , আরে এটাকে ধরেছিস কেন ? কি হবে এই ঘেয়োটাকে নিয়ে ? এখুনি ছেড়ে দে !
কেন কেটেকুটে মাংস খেলেও তো হয় !
বলামাত্রই একজন চকচকে ধারালো একটা ছুরি বার করল । জলার কিনারে ঘাস আগাছার মধ্যে লোকটা আমার টুঁটি চিপে ধরেছে যখন , দেখলাম ঘোর অন্ধকারে আমি একা হারিয়ে যাচ্ছি ,দ্রুত ওঠাপড়া করছে আমার বুক । নিঃশ্বাসের প্রবল কষ্টে আমার অন্তরাত্মা ছটফটিয়ে উঠেছে । ছুরি বেঁধা স্থান বেয়ে গলগলিয়ে গরম রক্ত বেরিয়ে এল কিন্তু কি আশ্চর্য কোন একাকীত্ব বোধ আমায় আর ঘিরে ধরল না । সেই মুহুর্তে নিজেকে ভীষণ সুখী বলে বোধ করলাম । বোধ করলাম এখন থেকে আমি সমস্ত সংশ্লেষ রহিত ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)