সুবীর সরকার - মায়াজম

Breaking

২০ সেপ, ২০১৫

সুবীর সরকার

                                                    ঢোলসানাই











ক।
 
        যে অবস্থানেই থাকুক যেখানেই যাক হেরম্বকে ঘিরে রাখে,তাড়া করে ফেরে অনিবার্য কিছু গান।কালখন্ডের মতো।অদ্ভুত সুরেলা।সে হাতিমাহুতের গান মইষাল বন্ধুর গান মাঝি মাল্লার সারিগান গাড়োয়ানী গান বিবাহগান ধান কাটার গান ঢেকিপাড়ের গান বিষব্যথা নামানোর গান-যে কোন গানই হতে পারে।গানের গায়নরীতি সুর আবহ হেরম্বকে চলাচলের উপযোগী রাস্তাঘাট খুঁজে নিতে বাধ্য করে;বাধ্যবাধকতার ভিতর সে একটা যাপিতজীবনের মহার্ঘ্যতা নিয়ে মহার্ঘ্য এক ভাবনাও ভাবতে শুরু করে।ভাবনাচিন্তার নিজস্ব গতিস্রোত বাধাপ্রাপ্ত না হলেও হেরম্ব কিন্তু আবশ্যিকতায় এক দর্শনবোধে আক্রান্ত হয়।এটা কি মহাশূণ্যতার কোন অনুভব!সে চলাচল থামিয়ে না দিয়েও চলাচলের মধ্যে আরো আরো চলাচল নিয়ে আসে।জীবন কি নদীপাড় থেকে উত্থিত নিঃশব্দ বাতাসের মতো যা গতিপ্রাপ্ত হতে গিয়ে কেন জানি সূত্রসংযোগ রীতিপদ্ধতি হারিয়ে ফেলে।হারিয়ে ফেলবার ধারাবাহিক এক পদ্ধতির নিরপেক্ষ হতে চাইবার আশু প্রয়োজনীয়তাটুকু কেবল বুঝে নেবার প্রয়াস;এরপর দর্শন নিজের মতো করে দার্শনিকতা এনে দেয় যার ভিতর গানগুলি নাচগুলি হাসিকান্নাগুলি উংসবমুখরতায় আশ্চর্য লোকোলোকত্তরতার দার্শনিকতাই পুরোধা হয়ে পুরোভাগে এসে পড়ে।কবেকার কোনো এক হাটে সে হাতিকে নিয়ে রঙ্গরসের গান শুনেছিল,কোনো স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া চরাঞ্চলের কৃ্ষি বৌ-এর কণ্ঠনিঃসৃত ঢেকিপাড়ের গান আমূল এক বাধ্যবাধকতায় তাকে বিদ্ধ করেছিল সেইসব তার স্মৃতিতে পুরোপুরি না থাকলেও সে কিন্তু অনিবার্যভাবেই গাননাচের বৃত্তের মধ্যেই থাকবার দৃঢ়তা অর্জন করেই ফেলে!

খ।
হেরম্ব কি অতিক্রম করতে পারবে সব প্রান্তর ও প্রান্তিকতা?নাকি প্রতিহত করতে না পারার ব্যর্থতায় সে পুর্নবার প্রান্তরের জ্যোৎস্নায় ফিরে যাবে।জ্যোৎস্না বড়জোর তাকে এগিয়ে দিতে সাহায্য করবে খেয়াঘাটের দিকে।একাকীত্ব অসহ্য মনে হলে সে সঙ্গী করতে পারে জলধোয়া বসুনিয়া খাটু পাইকার দুখীরাম মণ্ডলকে।খেয়াঘাট শূণ্যতার বিশালয়াকারে বিন্দুবৎ জেগে থাকতে পারে জেনেও হেরম্ব ব্যর্থতাকে সমুহ প্রতিহত করে খুঁজতে থাকে কবেকার কবেকার সব ঘাটোয়ালকে।ঘাটোয়াল এখানে প্রাধান্য পেতে পারে না তবু প্রধানতম বিষয়রূপে রুপান্তরিত নদীর ঘাটে ঘাটে হেরম্ব কেবল ঘাটোয়ালদের খুঁজতে থাকে।এটা অনস্বীকার্য তবু হেরম্ব একধরণের অসহায়তা অনুভব করে;তার অনুভূতির পরতে পরতে স্তরে স্তরে যেন সাজানো থাকে মেঘেরা,প্রান্তরের সবটুকুনই সে বিয়োগব্যথার বিশ্লেষণযোগ্য অংশ মনে করতে থাকে।অংশ কখন যেন স্বীকৃতির দাবী জানানোর প্রাথমিক প্রয়াসটুকু শুরু করে নদীর বহমানতায় প্রবাহিত হতে হতে ঘাটোয়ালের আত্মকথনের পরিণতি না পাওয়া এক জন্মান্তরকথন হয়ে প্রান্তরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে যায় চিরসত্য হয়ে।তার কার্যকারণগত ভিত্তিভূমি হয়তো থাকে না তবু দ্বিধাগ্রস্থতার এক বাস্তবতায় কবেকার মাটিকাদা ঝড়বাদল মাখা প্রান্তরের মানুষজন প্রান্তিকতাকে স্থিরতা দেবার দায়বদ্ধতায় অশ্রুসজল এক এক পরিপার্শ্বহীনতার অসহায়তাটুকু বিবৃতির ঢঙে পরিবেশন করতে থাকে।এই বাস্তবতা হেরম্বকে স্বীকার করতে হবে;কেননা এইরকম অস্বীকার আর যাই হোক হেরম্বকে স্বাভাবিকত্ব দিতে পারে না।
গ।
সংকটকাল পেরিয়ে আসতে গিয়ে নতুনতর সংকটের পাকে আটকে যাওয়া।ঘটনার মধ্যবর্তীতায় মধ্যবর্তী হয়ে যাবার সাবলীলতায় সময়ই প্রকৃতপক্ষে নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে এই সম্ভাবনার সূত্রে যাবতীয় প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে পড়ে;সংকটকাল আর অতিক্রম করা হয় না।জীবন তো এমনই এক সংকট সংশয় ঘেরা আবর্ত।কচুর পাতের জল টলমল টলমল করে;ধান কাটার পরের যে শূণ্য মাঠ খেত তার সাথে নদীপারের সন্ধ্যেরাত্রীকে সংকটকালের মধ্যে যদি নিয়ে যাওয়া যায় তবে তো পরিত্রাণহীন এক সংকটকালই পরিব্যপ্ত হয়ে উঠতে থাকবে।জীবনের সংশয় সংকট থেকেই তো তীব্র এক জীবনগাথা রচিত হতে পারে।রাত্রীর অন্ধকার ছমছম জোনাকীর ঝাঁক লুকিয়ে থাকা নদীনালা সবকিছুর মধ্যেই আবহমান এক জীবন লোকাচার গালগল্প ঢোলসানাই মানুষজন সবকিছু নিয়ে কেন্দ্র ও প্রান্তের বহুস্বরজাত এক বর্ণময় প্রান্তিকতাই যেন হয়ে ওঠে;হয়ে ওঠার প্রয়াসটুকুই অব্যাহত রাখে।যদিও প্রতিটি বাঁকে সংকটগুলি কালখন্ডের নির্ধারিত বর্ণময়তাটুকুও অগ্রাহ্য করতে থাকে,গ্রাহ্যতাকে বর্জন করবার দুঃসাধ্যটুকুও কেবলমাত্র মধ্যবর্তীতায় সংকটকালীনতার হাড়হিম অনুভূতির ভিতর তলিয়ে যায়,লিপ্ত হয়ে যায়।জীবনের ধরতাইগুলি তো আর নদী নদী দিয়ে রচিত এক নিজস্ব নদীপথ নয় যে কেবল জায়মানতার বিস্তারে পরিব্যপ্ত হতে হতে ছোট ছোট মোচার খোলের দুলে ওঠা নৌকোগুলির মতো মাঝিমাল্লার পেশীবহুল প্রকৃতির শান্ততায় নাব্যতায় যেন নদীভরতি গানগুলি নিয়ে আদ্যন্ত ভেসে যাওয়া।ভেসে যাওয়ার সত্যতায় খাদহীনতা থাকলেও সংকটকাল আর পেরিয়ে আসা হয় না!গানভরা নদীগুলি তবু থেকেই যায়।
ঘ।
ঘরের মধ্যে ঘর।ঘরবাড়ির বিন্যাসে অগোছালো এক ভাবভঙ্গী বিন্যাসের সামান্য অদলবদলেই অগোছানোটা অনায়াসেই সুসজ্জিত সাজানো পথঘাটের রূপধারণ করতেই পারে।চরাঞ্চল থেকে রাত্রির খুব মাঝামাঝি থেকে জল ছুঁয়ে পাক খাওয়া বাতাসের অসামান্য মৃদু এক মন্থরতা সমস্ত সংজ্ঞার তীব্র বদল ঘটিয়ে দিয়ে যাবতীয়তাটাকেই সংজ্ঞায়িত করে তোলে।চর কিন্তু চিরস্থায়ী নয়,কোন না কোন চরকে সামগ্রিকতা সহই তলিয়ে যেতে হয়,ডুবেও যেতে হয়।আবার নুতন নামের ধারাবাহিকতাকেই অব্যাহত রাখে।এখানেই তো রহস্য।রহস্যের স্থবিরতাকে সচল করে তুলতে পারলেই পুর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের ডুবে যাওয়া চরের ফিনিক্স পাখির মতো পুনরুথথান।সাদৃশ্য অসাদৃশ্য তখন আর কোন বিতর্কের বিষয় হতে পারে না।বিষয়হীনতাই ঘরের মধ্যে ঘরের ভিতর কেবল অন্তহীন সব ঘরবাড়ি ঢুকিয়ে দেয়।নমোপাড়া যূগীপাড়া ঢুলিপাড়া দিনাজপুর কলোনী বামনপাড়া কাঁসারীপাড়া যাবতীয় সব টুকরোটাকরায় যেন ফেলে আসা এক দেশ হয়ে পুননির্মিত হতে চায়।হতে পারাটা সম্পূর্ণ না হলেও হতে চাওয়াটাই অনায়াসসাধ্য এক যৌথতা এনে ফেলে।যৌথতার শর্তসাপেক্ষ সামর্থের বিচিত্রতরতার ব্যাপ্ত সময়পর্বের ভিতর আবহমানের সব চরাঞ্চল ঘরবাড়ি আমোদপ্রমোদ পাশাখেলা স্মৃতিময়তা নিয়ে অনিশ্চিত ললাটলিখনের মতো জীবনের খন্ডে খন্ডে ভঙ্গ বিভঙ্গের মরমিয়া গানের আবহের নৈকট্যের সারাৎসার হয়ে গন্ডীর ভিতর গন্ডী ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া পেশীময় স্মৃতিময় প্রাবল্যের দোলায় দোলায় ভাসে।ভাসতেই থাকে।ভেসে যায়।এত এত জটজটিলতায় সূর্যোদয় সূর্যাস্ত চাঁদ ও অন্ধকার সবই নিজস্ব অধিকারে মর্যাদায় ঘরবাড়ির বিন্যাসটুকু এলোমেলো করে দিতে থাকে জীবনের জরুরীতম কার্যকারণসূত্রে।
ঙ।
অতিক্রমণের এক পর্বে হেরম্ব পরিচিত অপরিচিত নিসর্গের গমখেত ধান পাট তামাক তালগাছ নারকেলসুপারীর সারি_ এসবের মহামহিম গাম্ভীর্যময় অস্তিত্বের সামনে এসে দাঁড়ায়।তার দাঁড়ানোটা দাঁড়াবার ভঙ্গীটা অতিরাজকীয়।নিসর্গের অতিনিবিড় প্রাণবন্তে স্নিগ্ধতায় শুশ্রূষায় হেরম্ব তার অস্তিত্বের সকল সংকটকাল যেন অতিক্রম করতে থাকে।খুঁজে পেতে থাকে আত্মপরিচয়ের শিকড়বাকড়।প্রকৃতির চিরচেনা দৃশ্যপট অচেনা সব অনুপম মানুষেরা দৃশ্যকেন্দ্রের আধোআঁধারের ঘনঘোরজাত নুতন হতে থাকা মানবশাবকের মহামান্যতাই অর্জন করে ফেলে।অতিক্রমণের পর্ব থেকে পর্বান্তরে যাওয়া আসার শূণ্যশাসিত অংশগুলি থেকে সুর করে যেন পাঠ করে যাওয়া পুরাণপুস্তক আরো আরো পুরাতন হতে থাকা মরজীবন নিসর্গের কিনার ঘেঁষে সদ্য রচিত নিসর্গেরই হাত ধরে নিসর্গকে স্থাপিত করে অনিবার্য নিসর্গগাথার ভিতর।হাট থেকে হাট চরাঞ্চলে ধানবাড়ি গাননাচের হাটের মধ্যে রেখে আসা জলধোয়া বসুনিয়া আব্রাহাম মিনজ খড়ম জোতদারের আধিভৌতিক পৃথিবীর জনপদের সহজিয়া আখ্যানের মরমিয়া আহ্বানের তীব্র অংশগ্রহণ করতে চাওয়া হেরম্বকে কি তবে বনভূমি চা-বাগানের হাট আদিবাসী গ্রাম ময়ূরময়ূরী বাইসন বাঘের ডাক হাতিধরা গান নুড়িপাথরশ্যাওলানদীর সব বন্ধন সম্পর্ক ছিন্ন করে আপাতত অন্য কোন পরিক্রমণের অংশীদার হতে হবে।হেরম্বর তাতে কোন ক্ষয়বৃদ্ধি নেই কারণ তার স্মৃতিকাতরতা নেই;থাকলেও স্মৃতিকাতরতাকে অজস্র স্মৃতির ছায়া উপচ্ছায়ায় সে বিনির্মাণ করে তুলবে ভিন্নরকম কোন স্মৃতিময়তায় মিশ্রিত করে দেবার সহজাত সংক্রমণে।
চ।
এই যে জটপাকানো ভূগোল ইতিহাসের ভিতর হেরম্বকে ঢুকে পড়তে হয় একধরণের বাধ্যবাধকতায়,সে ভূগোলবাহিত সময়ের কথক হয়ে উঠতে থাকে একসময়।জীবনের নিজস্ব নিয়মেই এটা ঘটে।এইসব জটপাকানো জটিলতায় হেরম্ব কি দমবন্ধ পরিবেশ পরিস্থিতির অস্বস্তিটুকু এড়িয়ে চলতে চায়;সে কি ইতিহাস ভূগোলের বাইরে খোলা বাতাসের মধ্যে আসবার তাগিদ অনুভব করে।বাধ্যবাধকতার নিঃসঙ্গতায় হেরম্ব ক্লান্ত হয় কিন্তু ক্লান্তি তাকে গ্রাস করতে পারে না,সে আবার বাধ্যবাধকতায় চলে যায়।ইতিহাসের অংশ হয়ে ভূগোলের খণ্ডাংশ হয়ে হেরম্ব নিজের মতোন এক জীবনযাপন বয়ন করতে থাকে।জীবনযাপন্টা জীবনযাপন হয়ে উঠবে কিনা সেই সংশয় গ্রাস করলেও সংশয় থেকে সে আর সংকটের দিকে কিছুতেই চলে যেতে চায় না।এটা কি তবে তার আত্মগোপন!সে হাট হয়ে ওঠবার গোটাটাই প্রত্যক্ষ করে।হাট থেকে হাটে রাতের বনভূমি অতিক্রম করতে করতে সে প্রতিদিনের প্রতিদিন হয়ে ওঠার পর্ব-পর্বান্তর অগ্রাহ্য করে করে নির্জনতার পথে নির্জন সব সাঁকো ও শালবনের দিকে পা বাড়ায়।সে কি পলায়নের কথা ভাবে;না কি পলায়নটাই তার জন্য পূর্বনির্দিষ্ট।হেরম্ব তার জটপাকানো ইতিহাস ভূগোলের এক জীবনকে জীবনযাপনের ধরাবাঁধার সঙ্গে সংযুক্ত বিযুক্ত করতে থাকে।হয়তো এও এক বাধ্যবাধকতা;তবু সাঁকো হাট নদী নদী দিয়ে সে পুরাণ ইতিহাসের সমস্ত মিথগুলোকে উপেক্ষা করতে করতে অন্য এক মিথ ইতিহাসেরই চমকপ্রদ দৃশ্যায়ন ঘটাতে থাকে।এই পর্বে তার সঙ্গে অফুরন্ত ও জটজটিল সব স্মৃতিকাতরতা কিংবা কাতরতা থেকে চুঁইয়ে পড়া স্মতিরা নিরপেক্ষভাবেই থাকে;নিরুপায় হয়েই অথবা!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র