দোলনচাঁপা ধর - মায়াজম

Breaking

২০ সেপ, ২০১৫

দোলনচাঁপা ধর

                         মাৎসুও বাশো, হাইকু ও সংকীর্ণ পথ







“প্রতিটা দিনই পথচলা আর সেই চলার পথই নীড়”।
প্রায় সাড়ে তিনশ বছরেরও আগে এই কথা বলেছিলেন সেই প্রাচীন কবি তাঁর বিখ্যাত “দূর উত্তরের সংকীর্ণ পথ”(ওকু নো হোশোমিচি) গ্রন্থে। ১৬৪৪ সালে কিয়টোর দক্ষিণে উয়েনো গ্রামে এক সামান্য সামুরাই পরিবারে মাৎসুও কিনাস্কু নামের যে বালকটি জন্ম নিয়েছিল, অনেকগুলি ভাইবোনের সাথে বড় হয়ে ওঠার মধ্যে শিক্ষার আশা হয়ত চাষের মাঠেই ঘাম হয়ে ঝরত তার অন্য ভাইদের মত, যদি না তিনি মাত্র আট বছর বয়সে স্থানীয় জমিদারপুত্র তোদো ইয়াশিতাদার (মতান্তরে ইয়াশিকিও) ভৃত্য ও সহচরের কাজে নিয়োজিত হতেন। কবিতায় ও সাহিত্যে আগ্রহের জন্য তাঁর এই বালকপ্রভুই অনেকখানি কৃতিত্ব দাবী করতে পারেন। ১৬৬২ তে মাৎসুও চুয়েমন মুনেফুসার( কিনাস্কুর সামুরাই নাম)প্রথম কবিতা প্রকাশ পায় এবং ১৬৬৪ তে তার দুটি হোক্কু একটি সংকলনে প্রকাশিত হয় আর ১৬৬৫ সালে মুনেফুসা, ইয়াশিতাদা ও আরও তিনজন কবির ১০০ টি পদ্যের একটি রেনকু প্রকাশের আলো দেখে। যদিও গোড়ার দিকে তাঁর চীনা কবিতার প্রতি এতটাই আগ্রহ ছিল যে তাঁর “তোসেই” চীনা কবি লি পো এর সম্মানে উৎসর্গ করেন।১৬৬৬ তে ইয়াশিতাদার অকালমৃত্যু ও প্রেমিকা জুতেই(একজন সন্ন্যাসিনী বলে কথিত) এর সাথে বিচ্ছেদের পর বেদনার্ত মনে তিনি কিয়টো চলে আসেন এবং কিয়টোর প্রতিথযশা কবি কিগিন এর সৌজন্যে কবিতা লেখার শৈলী আয়ত্ত করেন।চীনা কবিতা ও তাওবাদ দ্বারা প্রভাবিত কবি ‘হাইকাই’ নামের যুক্তধারার কবিতা লেখা শুরু করেন যেগুলি সেইসময় শুরু হত অন্ত্যমিলহীন পাঁচ-সাত-পাঁচ মাত্রার তিন চরণের একটি কবিতা দিয়ে এবং মূলত সেগুলি প্রকৃতির ছবিকে প্রতিফলিত করত। তিন চরণের এই কবিতাগুলি যেগুলি আদতে রেনগা নামের ধারাকবিতার প্রথম তিনটি চরণ যা পরিচিত ছিল ‘হোক্কু’ নামে, পরে যা বাশোর বিখ্যাত সমালোচক মাসাওকা শিকির দেওয়া ‘হাইকু’ নামে জগদ্বিখ্যাত হয়।
সেটা ১৬৭২ সাল, বিশের কোঠার শেষ দিকের বয়সে কবি এদো(টোকিও)শহরে আসেন, সেটি তখন ধন জন মান নিয়ে সদ্য গড়ে উঠছে। কবি এলেন সে শহরে এবং নিহনবাশি নামে এদোর অভিজাত সমাজে আপ্যায়িত হলেন তার সরল সাবলীল রচনার জন্য। অল্পদিনেই জুটে গেল বেশ কিছু ছাত্র যারা তাদেরই আগ্রহে ১৬৮১ তে সুমিদা নদীর তীরে গড়ে তুলল এক পর্ণকুটীর তাদের প্রিয় গুরুর জন্য, হয়ত এই প্রথম কবি পেলেন তাঁর নিজের ঘর। এক ছাত্র এনে দিল বাশো (এক জাতীয় কলা) গাছের একটি চারা যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে ঘিরে ফেলল কুটীরটিকে এবং অচিরেই সেটি ‘বাশো কুটীর’ নামে পরিচিত হয়ে উঠল। আপন ঘরে প্রকৃতির মাঝে নির্জনে বৃষ্টিপাতের শব্দে এগিয়ে চলল কবিতা, ক্রমে কবি পরিচিত হয়ে উঠলেন গুরু বাশো বা মাস্টার বাশো নামে।
basho nawaki shite/ tarai ni ame o/ kiku yo kana
banana in a windstorm/ a night of listening to rain/ dripping in the tub
কদলীর গাছ, আশ্বিন ঝড়/ রিমঝিম সুর শোনা রাত/ টুপটাপ পাত্র ভরে ।

এই সময়েই জেন বৌদ্ধবাদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে জেন সাধক বুচোর কাছে দীক্ষা নেন, তার চিরপিপাসিত হৃদয়ের শান্তির খোঁজে। কবির হয়ত স্থিতু হলে চলে না,১৬৮২ সালের শীতকালে এক বিধ্বংসী আগুনে ভস্মীভূত হল তাঁর প্রিয় কুটীর ও তার সংলগ্ন এলাকা, তাঁর হাহাকার সৃষ্টি হয়ে বেরিয়ে এল কলমে

Tired of cherry,/ Tired of this whole world,/ I sit facing muddy sake/ And black rice.
কৃষ্ণ বর্ণ ধান/ আমি বসে কর্দম প্রান্তর সম্মুখে/ ক্লান্ত, চেরীফুল আর পৃথিবী হতে।

প্রায় এই সময়েই তার মায়ের মৃত্যু সংবাদও এসে পৌঁছয়, পিতার, প্রভুর মৃত্যুর পর এবার তৃতীয়বারের মত অনাথ হলেন তিনি। মায়ের কেশগুচ্ছ হাতে নিয়ে লিখলেন

te ni toraba/ kien namida zo atsuki/ aki no shima.
should I hold it in my hand/ it would melt inmy burning tears-/ autumnal frost.
এ কি আমি ধরব দুহাতে/ এরা তো মিশে যাবে আগুন এই অশ্রুতে আমার/ হৈমন্তী তুষারে।

দীর্ঘদিন ছাত্র, অনুগামী ও গুণমুগ্ধ মানুষদের উৎসাহ ও ভালবাসার কেন্দ্রে থেকেও কবি চিরদিন ছিলেন যেন এক বিষাদের সাগরে এক বিরহী আত্মার মত, অদ্ভুত এক শূন্যতা ঘিরে থাকত তাকে যা জেন ভাবধারা অনেকটা প্রশমিত করলেও তাঁর একাকীত্ব ছিল একান্ত ভাবে তাঁরই। শূন্যতার বোধ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত পথে পথে, তাঁর নিভৃত যাপনে তিনি কাছে যেতেন প্রকৃতি, মানুষ ও সর্বোপরি ঈশ্বরেরও। জেন ভাবধারার মূল কথাই হল উপকরণের স্বল্পতা তা সে কবিতায় হোক বা গেরস্থালীতে, গুরু ও ছাত্রের সরাসরি যোগাযোগই হল এর মূল কথা, কোন কেতাব বা ক্রিয়ার বাড়তি বোঝা নেই এখানে। চোখে দেখা সাধারণ দৃশ্যই তাই সুন্দর ও অনন্য হয়ে ওঠে তাঁর হাতের স্বর্ণালী ছোঁয়ায় ।জাপানের সরল জীবনপ্রণালী, মানুষজন এবং অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতি তার নির্জনতা নিয়ে বারবার হাতছানি দিয়েছে তাঁকে। ১৬৮৬ সাল, কবি তখন সুমিদা নদীর তীরে তাঁর দ্বিতীয় ‘বাশো’ কুটীরে নির্জনবাসে। এক হৈমন্তী বিকেলে প্রাচীন এক দিঘীর পাড়ে সেদিন তাঁর সঙ্গী ছাত্র এনতেমো কিকাকু, একটি ব্যাং ছলাত শব্দে ঝাঁপ দিল দিঘীর জলে, সে শব্দ যেন শুধু প্রকৃতিকেই করল না চমকিত, জেন সন্ত কবির শূন্যস্থিত মনও দুলে উঠল আর পৃথিবী উপহার পেল তার সর্বকালের সবচেয়ে বেশী চর্চিত হাইকু-

fu-ru i-ke ya/ ka-wa-ju to-bi-ko-mu/ mi-zu no-o-to
an ancient pond / a frog jumps in / the splash of water
প্রাচীন সে দিঘী/ দাদুরীর ঝাঁপ/ ছলাত

আপাত সাধারণ, অতি পরিচিত এক দৃশ্য যা প্রকাশ করে এক গভীর ভাব যা মনকে নিয়ে যায় এক অনিবার্য শূন্যতায়, এইই জেন ভাবধারা।
১৬৮৪ তে বাশো প্রথমবারের জন্য পরিভ্রমণে গেলেন এদোর পশ্চিমে প্রায় এক মাসের জন্য যার ফসল তার প্রথম ভ্রমণ বিবরণী ‘জলবায়ু তাড়িত এক কঙ্কালের দিনপঞ্জী ’। এর পর ১৬৮৯ সালের ভেতর আরও তিনবার পরিভ্রমণে বেরিয়ে জাপানের আদিম প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলি পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেন তিনি যার ফল স্বরূপ আরও দুটি বৃত্তান্ত আমরা পাই যেগুলি রচিত হয় ‘হাইবুন’ হিসেবে, ললিত গদ্য ও হাইকু’র এক অনবদ্য মিশেল যা বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। ১৬৮৯ সাল, বাশো আবার অনুভব করলেন আরও কিছু দেখা বাকী রয়ে গেছে তাঁর কারণ এই পৃথিবী অতি বৃহৎ, চেয়েছিলেন শীতেই বেরিয়ে পড়তে কিন্তু ছাত্রেরা অনুরোধ করল জাপানের ভয়ঙ্কর শীতে নয় অপেক্ষা করা হোক বসন্তের জন্য। একমাত্র ছাত্র ও বন্ধু কাওয়াই সোরা, কিছু লেখবার সামগ্রী, বদলাবার জন্য সামান্য পোশাক আর অন্তরে আধ্যাত্ম পথপ্রদর্শক দ্বাদশ শতাব্দীর কবি সাইগিওর “উপস্থিতি” এই নিয়ে বাশো আবার ‘ হায়োহাকুশা ’-এক দিশাহীন পথিক। এই তাঁর শেষতম যাত্রা যা অনেকটাই আধ্যাত্মিক, বাশো যেন কেবল প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিই হাঁটেন নি হেঁটেছেন জাপানের আত্মার গভীরে। তাঁর সুন্দরতম কবিতাগুলি এই সময়েরই, পরিণত, পূর্ণদৃষ্টির এক জেন সন্ত যেন তিনি, অন্তরে যিনি নিয়ত আলাপে রত প্রাচীন চীনা ও জাপানী কবিদের সাথে তাঁর নিজের ভাষায় তিনি যাকে বলেছেন “conversation with ghost and ghost-to-be.” তাঁর এই অন্তিম যাত্রারই নির্যাস “ওকু নো হোশিমিচি”। বৌদ্ধ কবি মিয়াজাওয়া কেন্‌জির মতে ‘যেন এ কোন কবির লেখনী নয় এ হল সমগ্র জাপানেরই আত্মার কথা’। বিখ্যাত লিপিকার সোরয়ু যার উপসংহারে লিখলেন ‘যদি একবার পরে ফেলতে পারতাম বর্ষাতি, পা বাড়াতাম সেই একইরকম যাত্রায় যার অবসরে বসে ভাবতাম সেইসব দুর্লভ দৃশ্যের কথা। চিন্তার কি অমূল্য সব অরূপ রতন যা তাঁর তুলি এঁকেছে, আহা ! কি মানুষ ছিলেন তিনি’।
জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও দুঃখতাপ পিছন ছাড়ে নি তাঁর, এ সময় তাঁর তৃতীয় ‘বাশোগৃহে” ছাত্রদের সাথে দিন কাটছিল তাঁর, যখন সেই প্রথম জীবনের জুতেই নাম্নী প্রেমিকা ভগ্নস্বাস্থ্য ও সন্তানসসহ তাঁর কাছে ফিরে আসেন। তাঁর নিজের কথায় ‘আমি বারবার কবিতা ত্যাগ করে নীরব হতে চেয়েছি কিন্তু প্রতিবারই কবিতা নতুন মহিমায় আমার কাছে ফিরে এসেছে। কবিতার এমনই আশ্চর্য জাদু।” ১৬৯৪ সালে কবি আবার পূর্বের দিকে যাত্রা শুরু করেন কিন্তু পথেই জুতেই এর মৃত্যুসংবাদ ও তাঁর নিজের আন্ত্রিক পীড়ার জন্য দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে শেষ পর্যন্ত ওসাকা পৌঁছন আর সেখানেই ছাত্রদের মাঝে অবসান হয় তাঁর বর্ণময় অথচ সরল জীবনের। তাঁর শেষ কবিতা (মৃত্যুগাথা)
tabi ni yande / yume wa kareno wo / kake megur
on a journey, ill/ my dreams goes wandering/ over a field of dried grass
এই যাত্রায় রোগশয্যায় / উড়ে চলে স্বপ্নেরা আমার/ শুষ্ক ঘাসের প্রান্তরে।

বাশোর বর্ণময় জীবনে সবকিছুর উপস্থিতিতেও তিনি ছিলেন একাকী, তাঁর এই একাকীত্ব এবং তাঁর অসাধারণ প্রতিভাই যে কেবল তাঁর সৃষ্টির মূল কারণ তা নয়, বাশোর ভিতর যে ‘দিশাহীন পথিক’ এর বাস তাই তাঁকে চালিয়ে নিয়ে গেছে আজীবন। তাঁর শূন্যতার অনুভব প্রশমিত হয়নি কখনো তাই ফিরে পাবার ইচ্ছেও মেটেনি আর সেই হল তাঁর সৃষ্টির চালিকাশক্তি। বাশোর যাত্রা কোনকিছুর আবিষ্কারে নয় বরং তা অন্বেষণের তাই প্রথম জীবনে সামুরাই হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও তিনি অন্তরের কবিকে অবহেলা করতে পারেন নি। তাঁর কবিতা আসলে শব্দে আঁকা অপূর্ব সব ছবি যা খুঁজে পেতে আজও বহু মানুষ হাঁটেন তাঁর ফেলে আসা পথে। আজকের আধুনিক জাপানের সাথে সেদিনের দুর্গম, চরম জলবায়ু তাড়িত পথের তুলনাই চলে না তবু কেবল হেঁটে বেড়ানোর জন্যই হেঁটেছিলেন তিনি আর তাঁর সেই যাত্রাপথের বিবরণী তাঁর হাইকু। পশ্চিমের অনুবাদকেরা তাঁর প্রতি সম্মান বশত অনুবাদগুলির অক্ষর ছোট হাতের রেখেছেন এমন কি ‘আই’ (আমি) বর্ণটিও ছোট হাতে লেখা হয়। তাঁর হাইকু সমসাময়িক হাইকু শৈলী থেকে ছিল আলাদা, তাঁর ছাত্রদেরও তিনি তেমন পরামর্শই দিতেন। প্রকৃতি ও অবশ্যম্ভাবী ভাবে ঋতু তাঁর লেখায় চোখে দেখা দৃশ্য হয়েও এক গভীরতর জীবনবোধে উত্তীর্ণ হয়েছে যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়েও ছুঁয়ে যায় এক আধ্যাত্মিক বোধকে যা জেন হাইকুর মূল সুর আর তাইই তিনি হাইকু সম্রাট।

হাইকুর অনুবাদগুলি মূল জাপানী থেকে নয়, ইংরাজি অনুবাদ থেকে করা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র