রৌপ্য রায় - মায়াজম

Breaking

২০ সেপ, ২০১৫

রৌপ্য রায়

                   
                                        সোমবারের গল্প  ৩য় অংশ 






রাতে ভিন্ন বাবু এসে ডিনারে ডাকলেন । ক্যাপ্টেন আর মিল্কি খুবই চিন্তিত । রহস্যটা বেশ ঘোলাটে । দুজনে তেমন কিছু মুখেই দিল না । ডিনার সেরে আমরা দোতলায় এলাম । মিল্কি আবার গোটা আটেক বই নামিয়ে বসেছে । বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল । মিল্কি আড় চোখে এদিকে তাকিয়ে বলল - ক্যাপ্টেন , দা ! তোমরা শুয়ে পড়ো তবে ডাকলে যেন সাড়া পাই । দরকার হলেও হতে পারে ।আমরা আর কথা বাড়ালাম না । দুজনে দুদিকে ঘাড় নাড়িয়ে শুয়ে পড়লুম । মিল্কির ডাকে মাঝ রাতে উঠে বসতে হল । দু এক কথা জিজ্ঞাসা করে বলল - শুভরাত্রি ।
রাতে আর কোন সাড়া পাই নে । কাক ভোরে ফজরের আজানে ঘুম ভাঙল । পাশ ফিরলাম । দেখি মিল্কি বিছানায় নেই । এদিক ওদিক তাকালাম । জানালায় গামছা আর টাওজার ঝুলছে । ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম গামছা আর টাওজার ভিছে । সম্ভবত মিল্কি স্নান সেরে কোথাও বাহির হয়েছে । চেয়ে দেখি ঘড়িতে পৌঁনে পাঁচটা । বাথরুম সেরে ক্যাপ্টেন কে ডাকলাম । ক্যাপ্টেনের বাথরুম সারতে প্রায় ছটা । সিড়িতে নামতে ভিন্ন বাবু আর ভিন্ন বাবুর স্ত্রী মিনতী দেবীর সাথে দেখা । মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরছেন । ক্যাপ্টেন বলল - গুড
মর্নিং আঙ্কেল আন্টি । ভিন্ন বাবু ও ওনার স্ত্রী বললেন - গুড মর্নিং ।
' আঙ্কেল সিংহ আঙ্কেলকে দেখেছেন ? '
' কৈই না তো । '
' ঘরে ও নেই বাগানে ও নেই তাহলে গেল কোথায় ? '
এদিক ওদিক খুঁজতে শেষমেশ মিল্কির হদিশ পাওয়া গেল । ঠাকুর ঘরে ! ধুতি পাঞ্জাবি পরে ধ্যান করছে । আমাদের আসা টের পেয়েছে । মিল্কি ভিন্নবাবুকে রেখে আমাদের বাহিরে যেতে বলল । আমরা বাহির হলাম । কথা হল । ভিন্ন বাবু আমাদের স্নান সারতে বললেন । আমরা সোয়া আঁটটায় স্নান সেরে ঠাকুর ঘরে প্রবেশ করলাম । ভিন্নবাবু সবশেষে দরজা বন্ধ করে দিলেন । মিল্কি ভিন্নবাবুকে ডেকে কাজ আরম্ভ করল । প্রথমে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি তারপর লক্ষ্মীর মূর্তি । এভাবে পরপর সব কটি ঠাকুর মূর্তি ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হল । কিন্তু কিছুই মিলল না । মিল্কি খুবই চিন্তিত । মাথায হাত দিয়ে চুল পাকাছে । ভিন্নবাবুর ও হতাশ
হয়ে পড়েছে । মিল্কি হঠাত্‍ হন্তদন্ত হয়ে বলল - এক মিনিট । গণেশের মূর্তি কে দেখেছে ? ভিন্নবাবু বললেন - আজ্ঞে ; আমি ! কেন ?
' না তেমন কিছু না । গণেশের মূর্তির গলায় দাগ আছে , দেখেছেন ! '
' হ্যাঁ , দেখেছি । '
' একবার ও গলা পাক দিয়ে ছিলেন ? '
' আজ্ঞে , দিয়েছি কিন্তু কোন লাভ নেই । ওটা ডাইসের দাগ । '
' উমম হুম ; আমার মনে হয় না । মূর্তিটা আনো তো একবার আমি দেখবো । '
ভিন্নবাবু গনেশের মূর্তি এনে মিল্কির হতে দিলেন । মিল্কি মূর্তিটা কে উল্টে পাল্টে অতি তীক্ষ্ণ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল । পর্যবেক্ষণের পরে মিল্কির মুখে আকস্মিক রহস্যের হাসি দেখা গেল । মিল্কি হাসতে হাসতে
বলল - দা ! কোন দিন দেবতার কান মুলেছো ?
আমি বললাম - ঠাট্টা করছিস ।
' না । সত্যি বলছি । '
' না দেবতার কান মুলিনি বটে তবে তোর কান মুলেছি বহুবার । '
' আজ একটা চান্স দিতে পারি । মুলবে । '
' না । তুই মোল । '
আচ্ছা তাহলে দেখ । মিল্কি গণেশের মূর্তির বাম কানটা ধরে মুলতে লাগল । আশ্চর্য ব্যাপার গণেশের মূর্তির মুণ্ডু এন্টি ক্লক ওয়ায়িস ঘুরে দেহ থেকে মুণ্ডু ছেদ হয়ে গেল । মিল্কি মূর্তির গলায় হত দিয়ে একটা চাবি বার করল । অসাধারণ চাবি । শুনলে অবাক হবে । কম সে কম আশি নব্বই বছরের চাবি একটু ও মরিচা পড়েনে । দেবতার মূর্তি ও চাবি একই মেটালে গড়া । সুতরাং তালাও একই মেটালের গড়া হবে । মিল্কি চাবিটা পর্যবেক্ষন করে ভিন্ন বাবুর
হাতে দিল । ভিন্নবাবু চাবি নিয়ে দেখে বললেন - চাবি তো পাওয়া গেল ।
কিন্তু পিতামহের গচ্ছিত ধন. . . । '
' চিন্তা করবেন না । চাবি পাওয়া গেছে যে কালে আপনার গচ্ছিত ধন ও পাওয়া যাবে । '
' কিন্তু কি ভাবে ? '
' আপনাদের আগের মানে পূর্ব গৃহের ঠাকুর ঘর কোথায় ছিল ? '
' এখানে । বাড়ি চ্যাঞ্জ হয়েছে কিন্তু ঠাকুর স্থানে কোন পরিবর্তন হয় নি । '
' তাহলে সাবল কোদাল এনে সিংহাসন সরিয়ে খুঁড়তে আরম্ভ করুন । আপনার পিতামহের গচ্ছিত সম্পদ পেয়ে যাবেন । '
ভিন্নবাবু কাঁদল নিয়ে আধকোমর মাটি পৌনে এক ঘন্টা ধরে খুলে সিন্দুকের হদিশ পেলেন । উপরে তুলে বালতি তিনেক জল দিয়ে ধুয়তে বোঝা গেল সিন্দুক ও তালা সেম মেটালে তৈরী । অতি কষ্টে ঘা চারেক হাতুড়ি মেরে চাবি ঘুরিয়ে তালা খোলা হল । ভিন্ন বাবু ও তার পরিবার প্রচণ্ড খুশি । সিন্দুকে শুধু বাদশাহী মোহর আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির টাকায় ভরা । বর্তমান মূল্য কয়েক কোটি টাকা ।
মধ্যাহ্নকালীন ভোজ সেরে চারটে দশের ট্রেন আমরা বাড়ি ফিরলাম । ফেস হয়ে সন্ধ্যার জলখাবের বসে সমস্ত ঘটনা গুছিয়ে বলতে আরম্ভ করল । ভিন্নবাবুর পিতামহ ছিলেন অত্যন্ত ধূর্ত । দেশে যখন কৃষক আন্দোলন শুরু হয় । স্বর্গীয় জ্ঞানেন্দ্রবাবু তার সমস্ত সম্পত্তি রাতারাতি মাটির নিচে লুকিয়ে রাখেন । এতে সাহায্য করে তার বন্ধু । যিনি জার্মান সিলভার ও রুপ গলিয়ে ভিন্ন ধরনের আসবান পত্র দেবতার মূর্তি প্রভৃতি তৈরীতে পারদর্শী।
স্বর্গীয় জ্ঞানেন্দ্রবাবু বেশ কিছু টাকা খাইয়ে কিছু দেবতার মূর্তি , তালাচাবি ও সিন্দুক তৈরী করে নেন । সুযোগ বুঝে রাতারাতি সমস্ত সম্পত্তি সিন্দুকে রেখে চাবি বন্দি করে চাবি গণেশের গলায় লুকিয়ে রাখে । ডাকাতের গুলিতে তিনি মারা যান ফলে ছেলে বৌকে কিছু বলে যাওয়ার সুযোগ পান নি - বলে মিল্কি একটু থামল । তাৎক্ষনিক ঘোচুময় চার পেয়ালা চা আর গরম গরম ভাজি নিয়ে এল । চায়ে চুমুক দিয়ে আমি বললাম - কিন্তু তুই বুঝলি কি করে ?
' সবটাই অনুমান করে । '
' কি ভাবে ? '
' খুবই সোজা দা । স্বর্গীয় জ্ঞানেন্দ্রবাবুর বর্তমান সম্পত্তি বলতে কি আছে ? '
' স্বর্গীয় জ্ঞানেন্দ্রবাবুর বর্তমান সম্পত্তি বল-তে বিঘা দশেক জমি আলমারি খাট আর ঠাকুর ঘরের ঠাকুর । '
' ভিন্নবাবু মতে চাবি আলমারিতে নেই , খাটে ও থাকার কথা নয় । স্বর্গীয় জ্ঞানেন্দ্রবাবুর মত কৃপণ ও ধূর্ত লোক আর যাই হোক চাবি জমিতে লুকিয়ে রাখবেন না । রাখতে হলে ঠাকুর ঘরের ঠাকুরে না হলে অন্য কোথাও । দেবতার মূর্তিতে আছে সিওর ছিলাম না । ক্যাপ্টেন তা সিওর করে দেয় । '
' কেমন করে । '
' ভিন্নবাবু আপনাদের দেবতার মূর্তি কোন মেটালের গড়া যা এত চকচকে । '
' হুম ঠিক । তারপর . . . । '
' তোমরা টেরাকোটা শিল্প স্থাপত্যের নাম শুনেছ ? '
ক্যাপ্টেন বলল - হ্যাঁ । ইতিহাস বইয়ে পড়েছি । খুবই উন্নতমানের শিল্পস্থাপত্য ।
' এই দেবতার মূর্তি গুলো তারই একটা নিদর্শন । '
' কিন্তু সম্পত্তির হদিশ পেলে কি করে ? '
' তোমরা বোধয় চাবিটা ভালো করে দেখনি । চাবির গায়ে একটা তীর আঁকা ছিল যার ইঙ্গিত ছিল নীচের দিকে । ' ঠিক বলেছ আঙ্কল আমি দেখেছিলাম কিন্তু তুমি বুঝলে কি করে যে চাবি গণেশমূর্তি তে আছে । - ক্যাপেন বলল ।
মিল্কি মুখে রহস্যের হাসি টেনে বলল - চোখ থাকলে পৃথিবী দেখে যায় আর বুদ্ধি থাকলে পৃথিবী বেচে দেওয়া যাবে । দিন তিনেক পরে পিওন আসে একখানি সরকারি রেজিস্টি করা চিঠি দিয়ে গেল । চিঠির সঙ্গে একখানা চেক , দুখানা বাদশাহি মোহর ও তিনখানা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির টাকা । টাকার অঙ্ক , বাদশাহি মোহর ও ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানীর টাকা দেখে চক্ষু চরক গাছ । বর্তমান টাকার অঙ্কে সব মিলিয়ে পঞ্চাশ ষাট হাজারের কম নয় । চিঠিখানি এইরূপ - প্রিয় একলব্যবাবু ,
আপনার পারিশ্রমিক আমার জানা নেই । তবুও যাহা পাঠাইলাম তাহা আশা করি আপনার অমনোনীত হইবে না । আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ । ভবিষ্যৎ যে কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে সর্বপ্রথম আপনার স্মরণ করিব । রৌপ্যবাবু ও ক্যাপ্টেন রবি কে স্নেহ ও ভালোবাসা জানাবেন ।
।। নমস্কার ।।
ইতি
ভিন্ন ব্যানার্জী ।।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র