সীমা ব্যানার্জ্জী-রায় - মায়াজম

Breaking

২০ সেপ, ২০১৫

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

                                         রামসেবক









       রামসেবকের  তখন সাত-আট বছর বয়েস। জীবিকার সন্ধানে তার বাবা-মা বিহারের জামালপুর শহর থেকে কলকাতায় আসে ছোট্ট রামসেবক-কে সাথে নিয়ে। সে আজ বেশ কিছু বছর আগের কথা।
প্রথম এসে কয়েকদিন হাওড়ার স্টেশনেই রাত কাটিয়েছে ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে। সাথে করে নিয়ে এসেছিল কালো ছোলা, ছাতু, ভেলি গুড়। কাজেই খাবার অভাব হয় নি তাদের। তারপর ভাগ্যক্রমে এসে পড়ে দক্ষিণ কলকাতায়। রামসেবকের বাবা এই দক্ষিণ কলকাতার বালিগজ্ঞ প্লেসেই একটা মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং- এ লিফট চালানোর কাজে লেগে গেল। ছোট রামসেবক-কে বিল্ডিং-এর বড় বাবুদের গাড়িগুলোকে ঝাড়পোঁছ করবার জন্য লাগিয়ে দিল। কাছেই একটা অবৈতনিক স্কুলেও ভর্তি করে দিল ওকে। বাবুর ছেলে মেয়েরা কী সুন্দর ঠিক সময় স্কুলে যায় আবার ফিরে আসে। সে তো কোন দিন যেতে পারে নি। তাই তার ইচ্ছে রামসেবকও স্কুলে যাবে। স্কুলের শেষে বিল্ডিং- এ এসে সে রোজ গাড়ি ঝাড়পোঁছ করত। রামসেবকের মা-ও বিল্ডিং-এ রান্নার কাজ আর কার্পেট পরিষ্কারের কাজ- এ ঢুকে পড়ল। ওদের ভালো স্বভাবের জন্য বিল্ডিং থেকেই নীচে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন বিল্ডিং এর ম্যানেজাররা।
কাজের শেষে বাবা আর মা এর সাথে জলে ভেজা ছাতু আর গুড় খেত রামসেবক। রোজ সকালবেলা কলি বার করা ছোলা আর একঘটি জল খেয়ে স্কুলে যায়। এর মধ্যে যদি বড়বাবুদের বাড়ি থেকে রামসেবকের ডাক পড়ত তাহলে তো কথাই নেই। বেশ ভালোমন্দ খেয়ে দিনটা কাটত রামসেবকের। জামা কাপড়ও কিনতে হত না তার। বাবুদের ছেলেদের জামা কাপড় , জুতো মোজা, সবই পেত। বাড়িতে ক্রমে প্রয়োজনীয় সবই হয়ে গেল বাবুদের বাড়ি থেকে পেয়ে। এখন আর কোন জিনিসের অভাব নেই ওদের। সন্ধ্যে হলেই মা আর রামসেবক রামলালার ছবির সামনে বসে ধূপকাঠি জ্বেলে “রামা হো-রামা হো” গান গায়।
দেখতে দেখতে রামসেবক উনিশ কুড়ি বছরের এক তরতাজা যুবক। ওর শক্ত কঠিন চেহারা দেখে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সেবিকা -আবাসনের দ্বাররক্ষী করে দিল চেনাজানা এক ডাক্তারবাবু। নিজগুণে সে ছিল সকলের প্রিয়পাত্র। মুখে তার হাসি লেগেই থাকত। কর্তব্য পালনে নিষ্ঠার একবিন্দু অভাব ছিল না তার।
ছেলে বড় হচ্ছে। এবার রামসেবকের বিয়ে দিতে হবে। কিছুদিনের ছুটি নিয়ে বাবা-মা রামসেবক-কে সাথে করে নিজেদের দেশে হাজির হল। তারপর বিয়ে করে নিয়ে এল পনেরো বছরের গোলগাল ছোটখাটো দুলারীকে।
স্ত্রী দুলারীকে নিয়ে রামসেবকের দিন বেশ ভালই কাটছিল। দুলারী এক মাথা মেটে সিঁদুর পরে সংসারের কাজ করে। খুব শান্ত-শিষ্ঠ মেয়ে। সে আসাতে সংসারে বেশ সুখের মুখ দেখতে পায় মা বাবা ছেলে -তিনজনেই। তাকে বাবুদের বাড়ি কাজ-এ পাঠায় নি রামসেবক। তারপর দেখতে দেখতে আরো সুখের দিন যখন তাদের দোরগোড়ায়... তখনই তার জীবনে এলো দারুণ দুশ্চিন্তার পাহাড়।
দুলারী মা হতে চলেছে কিন্তু দেখা দিল তার নানান শারীরিক সমস্যা। রামসেবকের চোখের ঘুম চলে গেল। মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। মা বাবাকে তার একমাত্র জিঞ্জাসা তার স্ত্রী বাঁচবে তো? সে বাবা ডাক শুনতে পাবে তো...? মা বাবা আর কি বলবে? ঠাকুরের উপর ভরসা করতে বলল।
রামসেবক মনে মনে মানত করল সবকিছু ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে, সে বৌ-বাচ্চা নিয়ে ছঠ পুজো দিতে যাবে তার নিজের শহরে । বিহারীদের ছঠ পূজা খুব ধুমধাম করে হয়। একে ছঠী মাইয়াও বলা হয়। বাঙালিদের দুর্গা পূজার মতন চারদিন ধরে খুব ধুমধামের সাথে পালন করা হয়। কার্তিক মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে এই পূজা করা হয়। সূর্য ওঠবার অনেক আগে বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক যিনি জলে নামেন। হাতে থাকে পূজার ফলমূল বেতের সাজিতে। তারপর সূর্য উঠলে বাড়ির অন্যান্যরা একে একে সেই থালায় জল ঢালে। তারপর সূর্যদেবকে প্রণাম সেরে জল থেকে উঠে পড়ে। পূজা দিয়ে নতুন জামা কাপড় পরে আর সারাদিন ভাল ভাল খায়। ঠেকুয়া হল সবচেয়ে প্রচলিত খাবার। ঘি, আটা বা ময়দা সাথে গুড় আর চাসনি মিশিয়ে তৈরী করে এই ঠেকুয়া। গান বাজনা করে। তাই সেই ছঠ মাইয়ার কাছে মানসিক রাখল রামসেবক।
একজন নয়, একেবারে ফুটফুটে দুজনের বাবা হল রামসেবক। আবার তার মুখে ফিরে এল সেই সরল সুখী হাসি। তাদের জীবন আনন্দের ঢেউয়ে কানায় কানায় ভরে উঠল। আদর করে দুই মেয়ের নাম রাখল মুনিয়া আর চুনিয়া। দুই মেয়েকে নিয়ে সুখে তাদের দিন কাটতে লাগল। বিল্ডিং-এরই সবার দেওয়া জামাকাপড় আর খেলনা দিয়েই বড় হতে লাগল ফুটফুটে দুই মেয়ে। বিল্ডিং এর গাড়ি বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করে খেলা করে যখন গাড়ি থাকে না সেখানে।
এমনিভাবে খেলতে খেলতে মেয়েরা যখন আড়াই বছরের হল... তখন রামসেবকের মনে হল …... আর দেরি করা উচিত নয়। এবার মানসিক পুজোটা দিয়ে দিতে হবে। ওরা সবাই মিলে গেল নিজেদের শহর জামালপুরে।
ছঠ পুজোর দিন সকলেই নতুন জামাকাপড় পরল। তারা একটা ঠেলা গাড়ি ভাড়া নিল শুধু যাবার জন্য। কারণ, এত পুজোর জিনিস নিয়ে আর সাথে দুই মেয়েকে নিয়ে ওরা সামলাতে পারবেনা। কাজেই ঠেলা গাড়ির ওপর রেলিং দেওয়া ছোট চৌকি শক্ত করে বাঁধল, তাতে মেয়েদের যত্ন করে বসাল। তারপর পুজ়োর ফলফুলের ঝুড়ি, আখ সব তুলে দিল ঠেলায়। ঠেলে ঠেলে দুজনে চলল জামালপুরের বিখ্যাত কালীপাহাড়ের নীচে কুলকুল করে বয়ে চলা গঙ্গার দিকে।
মা আর বাবাকে আর আনে নি এই ভিড়-ভারাক্কায়। তাঁরা বাড়িতে আছেন।
বিহারীদের ছঠপুজো। ভিড়ের অন্ত নেই। পূজার্থীদের মধ্যে রীতিমত ঠেলাঠেলি চলছে। রামসেবক ভক্তিভরে পুজো দিল। তারপর ওরা বাড়ি ফিরে যাবার জন্য তৈ্রী হল। কারণ আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। হয়ত দাপিয়ে বৃষ্টি নামবে এক্ষুণি।
দুলারীর দুহাত ধরে ফিরছিল দুই মেয়ে। রামসেবকের কাঁধে ছিল নৈবিদ্যের ঝুড়ি। নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে ফিরছে ওরা। ইতিমধ্যে কখন যে মুনিয়া দুলারীর হাত ছেড়ে গিয়েছিল, খেয়াল ছিল না দুলারীর। দুলারী ভেবেছিল মুনিয়া রামসেবকের হাত ধরেছে।
কিন্তু একটু পরেই যখন বুঝতে পারল মুনিয়া রামসেবকের কাছে নেই তখন ওরা খোঁজাখুঁজি শুরু করল। বেলা আড়াইটের পর ওরা আর মুনিয়াকে খুঁজে পেল না। অনেক খোঁজাখুঁজি- -থানাপুলিশ--সব করেও আর মুনিয়াকে পাওয়া গেল না। রাতে যখন তারা ফিরে এল তখন তাদের সঙ্গে শুধু চুনিয়া। সারা রাস্তা বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এল ঘরে।
রামসেবকের মুখের সরল হাসিতে আবার অন্ধকার নেমে এল। তারপর আরো পনেরোটা বছর কেটে গেল।
এবার রামসেবকের চিন্তা শুরু হল চুনিয়ার বিয়ে দিতে হবে। --দেব-দেবীর আশিস নিয়ে তবেই তো ভাল ঘর-বরে মেয়েকে দিতে হবে। কারণ মেয়েকে ওরা একটা ভাল মেয়েদের স্কুলে পড়াচ্ছে। পড়াশুনায় খুব ভাল মেয়ে। বিল্ডিং এর একটা স্কুলের হেডদিদিমনি ওকে বিনা পয়সায় পড়াশুনা দেখিয়ে দেন।
তাই পুজো দেবার জন্য আবার ওরা চলল ছঠ পুজোর দিন গঙ্গার ঘাটে। এবার আর দুলারী মেয়ের হাত ছাড়ল না। দুজন দুদিক থেকে মেয়ের হাত ধরে চলল নৈবিদ্য নিয়ে। চুনিয়া কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। মা বাবার হাত ধরে যেতে তার লজ্জা করলেও মুখে কিছু বলল না। মনে হয় সে কিছু জানতে চায় মুনিয়ার ব্যাপারে। খালি তাকিয়ে থাকে মা বাবার মুখের দিকে।
গঙ্গাপারের বড় রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে বাস-লড়ি। স্টপেজে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বাসে ভিড়ের ঠেলাঠেলি। দুলারী বিষণ্ণ মনে সেদিকেই চেয়ে ভাবছিল ঠিক পনেরো বছর আগের সেই দিনটার কথা। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। বাইরে তাও কেমন একটা গুমোট ভাব ছিল। পাখীদের নীড়ে ফেরার সাথে সাথে তাদেরও এবার বাড়ি ফিরতে হবে।
হঠাৎ সামনের দিকে তাকাতেই একটা চলন্ত বাসের জানালায় চোখ আটকে গেল দুলারীর। জানলা দিয়ে মুখ বাড়ানো একটা মেয়েকে দেখেই চমকে উঠেছে দুলারী। সে কিছু বলার আগেই ... “হামরি মুনিয়া...?” বলে চেঁচিয়ে উঠল রামসেবক। দুজনে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে লাগল বাসের পিছন পিছন। কিন্তু পারল না বাসটাকে ছুটে গিয়ে থামাতে। পারল না... মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতে...তার নাম কি? কোথায় সে থাকে? সে কি তাদের হারিয়ে যাওয়া মুনিয়া?
ধুলো উড়িয়ে বাস চলে গেল অনেক দূ...উ...রে। রামসেবক দাঁড়িয়ে পড়ল মাঝ রাস্তায়। পা যেন আর চলছে না দুজনের। চুনিয়ার ডাকে দুজনের খেয়াল হল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। চুনিয়াকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার। আজকাল রাস্তা-ঘাট বড খারাপ হয়ে গেছে। কোথা থেকে কি হ্য় কেউ বলতে পারে না।
কি আর করবে। -আবার ওরা চোখের জলে বুক ভাসিয়ে চুনিয়াকে নিয়ে ঘরে ফিরে এল রাতে। দুজনে ঠিক করল ছঠ পূজোর কদিনই ওরা যাবে গঙ্গার ঘাটের সেইখানটাতে, যেখানে এসে বাসটা দাঁড়িয়েছিল। আবার ওই সময় কালই গিয়ে দুজনে দাঁড়াবে। চুনিয়াকে সাথে নেবে না। ওকে নিজের মা বাবার কাছে রেখে যাবে।
বৃষ্টি শুরু হয়েছিল দুপুরেই। দুপুর পেরিয়ে বিকেল। বিকেল পেরিয়ে রাত--- তবু বৃষ্টি থামল না। ঝিমঝিম ঝরঝর করে বৃষ্টি চলছে তো চলছেই। শেষ রাতে নামল অঝোর বর্ষণ।
রাতে দুলারীর চোখে ঘুম নেই, তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে ঘুমন্ত মেয়ের দিকে। মাঝরাতে হঠাৎ যখন পূর্ণিমার চাঁদ ফালা ফালা হয়ে ঠিকরে পড়ছে চুনিয়ার শরীরে তখন চুনিয়া-কে বুকে জড়িয়ে দুলারী কান্নাভরা চোখে বলে উঠল, “নাহি রে বিটিয়া, নাহি। তুহার সাদি হামরি নাহি দেওত হো। তু ইস ঘর খুশি সে রহত হো, হামরি ছোড় না যাও। না জানে হামরি মুনিয়াবিটি কঁহা …ক্যেসি হ্যায়?”
ছঠ পূজার চারদিন রোজ গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে মা আর বাবা মিলে। কিন্তু না! আর দেখা পায় নি সেই জানলা দিয়ে মুখ বাড়ানো মেয়ের...
পুজোর শেষে আবার ওরা কলকাতায় ফিরে এল। বিল্ডিঙের সবাই শুনে খুব বকাবকি করল রামসেবকদের। আর সান্ত্বনা দিল যে, এবার যেন চুনিয়াকে খুব সাবধানে রাখে।... চুনিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না মা বাবা। মা বাবা নিজেরাই তো জানে না উত্তর।
রামসেবক আর দুলারী ঠিক করেছে মেয়েকে ওরা এত অল্প বয়সে বিয়ে দেবে না। ওরা আর গ্রামেই যাবে না। চুনিয়া বড় হলে তখন যাবে। এটা তো আর গ্রাম নয়? কাজেই চিন্তার কোন কারণ নেই। বাবুদের মেয়েদের মতন পড়াশুনা শেখাবে, নিজের পায়ে দাঁড় করাবে চুনিয়াকে। তারপর মেয়ে যা ইচ্ছে তাই করবে।
...তারা এক মেয়েকে হারিয়েছে আর আরেক মেয়েকে প্রাণ থাকতে হারাতে চায় না... তারা মেয়েকে স্বাবলম্বী করে তুলবে, পণ করল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র