বড় সুটকেসটার উপর চেপে বসে চাবি মেরে দিল রায়হান। নিজের ছোট ব্যাগটা আবার দেখে নিল ভেতরের সব কিছু ঠিক ঠাক আছে কিনা। কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রোহানের মাথায় হাত রেখে বুক ভাঙ্গা একটি গভীর নিঃশ্বাস ফেলল সে । দীর্ঘশ্বাসের ভেজা বাতাস ছুঁয়ে গেল ছেলের কপাল। “শোন কোন কিছুর জন্যেই তোকে ভাবতে হবে না কখনো।” রোহন বোঝে ড্যাডার গলা বুজে আসছে। “আমি তো আছি বাবু।” খুব ধীরে দরোজার দিকে হেঁটে যায় রায়হান। রোহন দেখে দেয়ালে বাবার ছায়াটা কেমন ফ্রিজ হয়ে গেল। আবার চলতে শুরু করে রোহণের কাছে এসে থামে ছায়াটা। “তোর মায়ের উপর রাগ রাখিস না বাবু। কিছুদিন যাক দেখিস আবার তোকে কাছে ডেকে নেবে।”
আঠারোশো স্কয়ার ফিটের এই ফ্ল্যাটে এখন কেবল সে আর । শেষ মূহুর্তের দায়টা রায়হানের উপর দিয়ে মেয়েকে নিয়ে বিকেলেই বাবার বাড়ি চলে গেছে দিপু। মায়ের মন। শেষ মূহুর্তে নরম হয়ে যেতে পারে । মা ই তো ? রোহণের আপন মা। একই রক্তমাংস ! বারান্দার আলোছায়ায় বসে রায়হান ভাবে, কেমন মা তার স্ত্রী ? রোহন তোর মা কেমন মা রে ?
উত্তরা ক্লাবের জৌলুসে তার স্ত্রীর সুনাম গমগম করে। সমাজসেবায় অদ্বিতীয়া । যে কারো বিপদে প্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রায়হানের উত্থানের পেছনেও এই নারীর অনেক পরিশ্রম । কিন্তু এই দু বছরে দিপুর শরীর আর মন থেকে মাতৃত্ব মুছে গেছে । সেখানে কাঁকড়া বিছের জঞ্জাল। রায়হান অনেক বুঝিয়েছে, অনুনয় করেছে কিন্তু দিপু কিছুতেই রাজী নয়। শেষবারের মত বলেছে, “তুমি পারবে দিপু ? রোহন তোমার প্রথম সন্তান তোমার স্বপ্ন আবেগ ভালবাসা।” প্রবল মাথা নেড়ে পাগলের মত বলেছে,“পারব পারব মনে করব রোহন মরে গেছে। আমার রোহন নেই।” ব্যথাভরা হাহাকারে বলেছিল রায়হান, “তোমার সংসারের এক কোণে ছেলেটাকে থাকতে দিলে না দিপু। তুমি মা নও কেবলই মানুষ।”
রোহন তাদের প্রথম সন্তান। নামী ইংলিশ ইশকুলের ছাত্র। ভাল রেজাল্ট । ডিবেট , ছবি আঁকায় ছোটবেলা থেকেই পুরস্কার পায়। মায়ের অহংকারে দিপু তখন কেবল রোহনের মা । ইশকুল গেটে ছেলের সাফল্যে অন্য ভাবীদের প্রশংসায় খুব খুশী হয় দিপু। সংসারের টাকা বাঁচিয়ে রোহনের জন্য আরো ভাল টিউটর রাখে। আরো ভাল খাবার। ভাল জামা। ভাল আর্ট টিচার। কিন্তু গোলটি বাঁধে রোহনের পনেরোতম জন্মদিনে।
অন্য ছেলেদের যখন গোঁফ গজাচ্ছে তখনো রোহনের মুখ পেলব স্নিগ্ধ। বারো তেরো বছরে গোঁফের রেখা দেখা দেয় ছেলেদের। কিন্তু রোহানের পরিষ্কার ঝকঝকে মুখ। গোঁফ গজানোর কোন নাম নেই। ইশকুল গেটে পরিচিত এক ডাক্তার ভাবির সাথে কথাও বলেছে দিপু। ভাবি বলেছে চিন্তার কিছু নাই। কোন কোন ছেলের দাঁড়ি গোঁফ দেরীতে গজায়। রায়হানকে মিষ্টি করে খোঁচাও মেরেছে দিপু, কি গো তুমিও কি লেট খেয়ে পুরুষ হয়েছ ?” এরমধ্যে রোহনের গলার স্বর ভেঙ্গে গেছে তাই আর টেনশন করেনি ওরা । তবে মাঝে মাঝে খারাপ লাগত রোহনের বড়সড় বন্ধুদের দেখে। ওদের পাশে রোহনকে লাগত কেমন কোমল কিশোরের মত।
রোহন যে তাদের সামনে জামা গেঞ্জি খোলে না, কখনো খালি গায়ে থাকেনা এটাও ওরা পাত্তা দেয়নি। অনেক ছেলেরই ব্রেস্ট উন্নত থাকে। রোহন একটু মোটুও ছিল বরাবর। তাছাড়া ব্যস্ত বাবা মায়ের সময় কোথায় প্রতিটি বিষয় নিয়ে নজরদারি করার। ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা বা কথাই হয় কম। আর রোহন বরাবরই খুব সপ্রতিভ। স্মার্ট বয়। ওর জন্যে আলাদা কেয়ার নেওয়ার কথা তাই ভাবেনি কখনো।
পনেরোতম জন্মদিনে রোহনের প্রিয় ক্যালিফোর্নিয়ার ব্লাকফরেস্ট কেক নিয়ে ওর মা যখন রাত বারোটায় উইশ করতে যায় হাত থেকে পড়ে যায় কেক। এক মর্মভেদী চীৎকার দিয়ে ছুটে আসে দিপু। ছোট অবন্তী অন্য রুমে। সেচ প্রকল্পের বাজেট নিয়ে ব্যস্ত রায়হান বিরক্ত হয়, “কি হলো দিপু ?” দীপালি সর্বহারার মত চেয়ে থাকে। পরমূহুর্তে খাটের সাথে মাথা ঠুকে কেঁদে উঠে, “সব শেষ। আমার সব শেষ হয়ে গেল। ধ্বংস হয়ে গেল। ও আল্লাহ তুমি কি নিষ্ঠুর। কি নিষ্ঠুর তুমি!” রায়হান গলা তুলে রোহনকে ডাকে, “রাহি- -দিপু লাফ দিয়ে উঠে, “না না ওকে ডেকো না। ডেকো না প্লিজ। আমি মরে যাবো। ও আল্লাহ আমার একি করলে, কি পাপে এই শাস্তি দিলে তুমি!” এবার রায়হান উঠে আসে। ছেলের জন্মদিন বলে সারাদিন রান্না করে সন্ধ্যায় মা মেয়ে কেক এনে লুকিয়ে রেখেছে সারপ্রাইজ দেবে বলে। রাত দুপুরে একি ভড়কামি! মনের কোণে অজানা এক ভয় খেলে যায়। এই বয়সের ছেলেরা আজকাল খুব নেশা করছে। অনেকেই ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েদের দোষ দেয়। রোহন কি তেমন কিছু! দিপু খুব শক্ত মানের মহিলা, অনেক উচ্চাশা ওর। ধরেই রেখেছে রোহন ইঞ্জিনিয়ার না হয় আর্কিটেক্ট আর অবন্তীকে ডাক্তার হতেই হবে। সহজে ঘাবড়ানোর মানুষ নয় দিপু। তবে?
কিরে তোর আবার কি হল ? হেড ডাউন ছেলের দিকে বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করে রায়হান। ১৫ বয়েস হলেও কোমল শরীরের জন্যে মাঝে মাঝে মনে হয় বেশ মিষ্টি বব চুলের এক কিশোরী যেন। পিঠে হাত দিতেই একটু চমক লাগে। কি ব্যাপার হাতে যেন হুক লাগল। মনে হল রোহনও কেঁপে উঠল আবছা । ও আবার রোহনের পিঠে সচেতনভাবে প্রশস্ত হাত রাখে। হ্যাঁ কনফার্ম। রোহন ব্রা পরেছে। কিন্তু কেন ? একি খেয়াল তার ছেলের। সহসাই মনে পড়ে এবার বৈশাখে খুব স্পষ্ট একটি মিছিল হয়েছে। সাধারণ কেউ সহজে বুঝতে পারেনি। এমন কি অনেক সাংবাদিকও প্রথমে বোঝেনি। পরে জেনেছে মিছিলটি ছিল সমকামীদের ।পত্র-পত্রিকায় সমকামীদের নিয়ে প্রচুর লেখা পড়েছে । তারপর ফেলে দিয়েছেন মাথা থেকে। একবার ভেবেছিল রোহনের বয়েসটা এখন যেমন ওকে নিয়ে একটু আলাদা করে বসলে ভাল হয়। কাজের চাপে ভুলে গেছে। তাছাড়া ও নিজেও তো পুরুষকালের এই সময় একা একাই পার করেছে। তাকে তো কেউ শিখিয়ে পড়িয়ে পুরুষ বানায়নি।
রোহন কি গার্ল ফ্লেভারে আসক্ত হল! একটু শক্ত সুরে তিনি বলেন রোহন কি হয়েছে তোর মায়ের ? কি করেছিস তুই ?” কাঁপতে কাঁপতে মুখ তোলে রোহন। অপূর্ব সুন্দর কিশোরী মুখ। চোখে কাজল ঠোঁটে লিপস্টিক। কে এ ? রোহনই তো! কিন্তু তারপর ? ধপাস করে বসে পড়ে রায়হান। পৃথিবী ভেঙ্গে পড়ছে মাথায়। হাঁটু কাঁপছে । ঘর দুলছে। পিঙ্ক কালারের ক্যালেন্ডারে আরো ডিপ পিঙ্ক গোলাপগুলো রোহানের রুমটিকে মেখে দিচ্ছে অনিন্দিত সুন্দরতায়। গোলাপি শার্ট পরেছে রোহন। দিপুর ওড়না ঝুলছে কাঁধের পাশে। উদ্ধত কিশোরী বুক। একরাশ মেয়েলি কুণ্ঠা নিয়ে মাথা নিচু করে ফ্লোর দেখছে। কোন রকমে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় রায়হান। “তুই এরকম সেজেছিস কেন মেয়েদের মত? ছিঃ যা মুখ ধুয়ে আয়।” শেষ কথাটি একটু কড়া করে বলে । ইচ্ছে নেই খুব এমন ভঙ্গীতে গা মুচড়ে উঠে যায় রোহন । অই মুহুর্তে রোহনের টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ায় রায়হান। পরিপাটি গোছানো ড্রয়ার। আলমারি খুলে দেখে সুন্দর করে গোছানো সব পোশাক। হ্যাঙ্গারে ঝোলানো শার্টপ্যান্ট দেখে একটু আশ্বস্ত হয়ে কবাট লাগানোর আগে কি মনে করে শার্টগুলো সরিয়ে দেখে চমকে ওঠে রায়হান। মেয়েলি জামা কাপড়ে ঠাসা কয়েকটি হ্যাংগার। রঙিন ব্রা, প্যান্টি , ট্যাংটপ, ল্যাসে, স্কার্ট -- মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। আলমারি বন্ধ না করেই অপেক্ষা করে রোহনের । নাহ দেরী করছে। অতিরিক্ত সময় নিচ্ছে । অস্থিরভাবে দরোজায় নক করে । রঙ ধোয়া ভেজা মুখে বেরিয়ে আসে রোহন। ওড়না খোলেনি। হ্যাঁচকা টানে বিছানায় বসিয়ে দেয় রায়হান, এগুলো কি পরেছিস তুই ? কেন পরেছিস? জানিস কারা পরে এসব?” বুক ভেতরে চেপে কাঁধ ঝুঁকিয়ে মেয়েলি সংকোচে লাজুকভাবে ওড়না খুটে রোহান। মনে মনে আরো ক্ষেপে রায়হান, এই সোজা হয়ে বোস্। কে দিয়েছে এসব ?” ছেনাল একটি হাসি খেলে যায় রোহনের ঠোঁটে । “আমি কিনেছি । আমার ভাল লাগে।” এক থাপ্পড়ে গাল ফাটিয়ে দেয় ছেলের। “শয়তান, ফাজলামো হচ্ছে।” অবাক হয়ে দেখে গালে হাত রেখে রোহন স্বাভাবিকভাবেই তাকিয়ে আছে তার দিকে। আশ্চর্য স্বাভাবিক। যেন ও জানতই এমন হবে। রায়হানের শরীর জুড়ে রাগ আর বিস্ময়ের ঘোড়া অসহায় দাবড়ে বেড়ায়। নিষ্ঠুর রাগী গলায় বলে, রাহী বল এই সব মেয়েদের জামা কেন পরেছিস ? তুই না ছেলে ?” রোহান সমস্ত রাগ, বিস্ময়কে উড়িয়ে দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে, নো ড্যাডা নাউ আই এম এ গার্ল। ইন ফ্যাক্ট, আই এম, আন্ড আই এম হ্যাপি গার্ল।” সমস্ত রাগ এবার ঝুলে পড়ে। তবুও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় রায়হান বলে, তুই কি করে বুঝলি ?” “আই নো ইটস। মাই বডি ইজ চেঞ্জিং এন্ড গোয়িং টু বি লাইক দ্যা গার্ল।”
বাবার দিকে তাকিয়ে কষ্ট পায় রোহন। কেমন ভেঙ্গে পড়েছে। কিন্তু দিনের পর দিন ওর শরীরে যে পরিবর্তন হচ্ছিল রোহন তা প্রথমে বুঝতে পারেনি। একদিকের বুক চুলকাচ্ছিল, একটু ব্যথা, টাচ লাগলে অদ্ভুত আরামের শিহরন স্পার্ক করছিল শরীরে। এক সময় ফুলেও উঠল কিছুটা। হাত লাগলে কি যে অন্যরকম ভাল লাগত তা বলার নয়। কিছুদিন পরে অন্য বুকেও একই রকম অনুভূতি টের পেল। ছেলেদের পাশে গেলে শরীর কেমন যেন শিরশির করে। কেন যেন মনে হয় ওরা আদর করুক ওকে। কেউ হাত দিয়ে ধরে দেখুক ওর নতুন পাওয়া বুক দুটোকে। সাদমানকে বলেছে, তোর হয় দোস্ত?” বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে ড্রিবলিং করতে করতে সাদমান জানায় সিওর। বাট আই লাইক গার্ল। গার্লস ব্রেস্ট এন্ড বিউটিফুল পিঙ্ক কান্ট।” সাদমান খুব বিএফ দেখে। রোহনও দেখে তবে মাকে লুকিয়ে। ওর পেনিস ছোট হয়ে যাচ্ছে । মরা চামড়ার মত ঝুলে থাকে আজকাল। বলবে সাদমানকে ? এক সময় কোচিং ক্লাসের ফাঁকে সিগ্রেট খেতে গিয়ে মামুর দোকানে বসে বলে ফেলে, দোস্ত ইট উইল হ্যাপেন। মাই ব্রেস্ট ইজ বিগার বাট পেনিস বিকামিং স্মলার। আই এম দা গার্ল ?” সাদমানের চোখ গোল হয়ে যায়। সেই সন্ধ্যায় সাদমানের বাসায় ওরা গুগল সার্চ দিয়ে জেনে নেয় কেন এরকম হচ্ছে। মন খারাপ হয় রোহনের । লজ্জায় কেঁদে ফেলে। ভেঙ্গে পড়ে মনে মনে। ছিঃ সে কি তবে হিজড়া হলো ? কিন্তু সাদমান সাহস দেয়, ইটস ন্যাচারাল। এখন এটা কোন প্রবলেম নয় বেব্স। ছোট্ট একটি অপারেশন করলেই তুই মেয়ে হয়ে যাবি। আজকের সম্পুর্ণা । দেন উই উইল মেক লাভ ডার্লিং।” সাদমানের আদর খেতে খেতে রোহনের মনে হয়েছে ইয়েস আই উড বি এ কমপ্লিট উওম্যান। কিন্তু বাবা মা ?
কলবেল বেজে ওঠে। রায়হান ভাবে শেষপর্যন্ত সন্তানের টানে দিপু এলো বুঝি। যাক মনের ভার কিছু কমানো যাবে। রোহনেরও ভাল লাগবে মাকে দেখে। দরোজা খুলে অবাক হয়। রোহনের বন্ধু সাদমান। সাথে ওর ডাক্তার বাবা মা । “আংকল সালাম। আমরা রোহানের সাথে যাচ্ছি।” মানে ?” রায়হানের সমস্ত দুশ্চিন্তাকে উড়িয়ে দিয়ে সাদমানের বাবা মা জানায় ওরা সব জানে। হাসপাতালে ওরা রোহনকে এটেন্ড করবে। এরকমই কথা হয়েছে। ওদেরও ইচ্ছা হায়ার স্টাডিটা সাদমান সিঙ্গাপুরে রোহনের সাথেই শেষ করুক। আপাতত একটি সদ্য তরুণ হাত বিহ্বল রায়হানের দিকে বাড়িয়ে দেয় সাদমান, হে বাডি বি ব্রেভ ডিয়ার।”
সুচিন্তিত মতামত দিন