সুখে থাকতে থাকতে অরুচি ধরে গেছে মিত্রার।বর ও দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার।মাথার ওপর মা,বাবা,দিদি,দাদা সবাই আছেন।কোথাও কোন অভাব নেই।না সম্পর্কের, না টাকাপয়সার।তবে কোথা থেকে এত দুঃখ,এত মন খারাপের বন্যা এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কে জানে!এমনই এক দিনে হঠাৎই এক উড়ো ফোন এসে সবকিছু তছনছ করে দিল।সুখের ঘর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মত।অ্যাক্সিডেন্টের খবর।মিত্রার বর সন্দীপের হঠাৎই হার্ট অ্যাটাক হয় অফিসে।হসপিটালে নিয়ে যেতে যেতে সব শেষ।আলোর মধ্যে বাস করতে অভ্যস্ত মিত্রা যেন হঠাৎই অন্ধকার কূপের একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে পড়ল।কোথায় কি টাকাপয়সা রাখা,মেয়েদের স্কুল,টিউশন—যাবতীয় ব্যাপারে সন্দীপই সব দেখাশোনা করত।মিত্রাকে টাকা পয়সার ব্যাপারে কোন চিন্তা সন্দীপ কোনদিন করতে দেয় নি।অথবা হয়ত ওই একটা ব্যাপার নিজের হাতে রাখতে চাইত নিজের গুরুত্ব বজায় রাখার জন্য।মিত্রাও কোনদিন এ ব্যাপারে জোর করেনি।ও খুবই উদাসী বাউল মনের মানুষ।অথচ অন্যদিকে আবার খুবই শৌখিন,ভীষণ সাজতে ভালবাসে।অর্থাৎ বৈপরীত্য ও বৈচিত্রে ভরা এক মানুষ।সংসারের জটিলতা ও কুটিলতাকে ও চিরদিনই এড়িয়ে,পাশ কাটিয়ে চলে এসেছে।সংসারের কোন কদর্যতাই ওর মনকে মলিন করতে পারে নি।মেয়ে দুটোকেও মানুষ করেছে সে ভাবে।মেয়ে দুটোও স্বভাবে একেবারে মার কার্বন-কপি হয়ে উঠেছে।শান্ত ও মিষ্টভাষী কিন্তু অলস।মনের সাম্রাজ্যে তিন সম্রাজ্ঞী কিন্তু বাইরের কূটনৈতিক জগতে একেবারেই অচল।সন্দীপও বাইরের জগৎ থেকে তিন কন্যাকে একেবারে দামী সম্পদের মত আগলে আগলে রেখেছিল।এই আগলানো স্বভাব থেকে কখন ধীরে ধীরে মিত্রারও বাবার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ফেলেছিল সন্দীপ অজান্তে,বন্ধু বা বর হতে পারে নি কখনো।আর এখানেই ছিল মিত্রার অসুখের চাবিকাঠি।মিত্রা অনেকবার সে কথা বুঝিয়েছিল সন্দীপকে কিন্তু সন্দীপ কখনো সে কথা বুঝতে চায় নি বা বুঝলেও নিজেকে পাল্টাতে পারে নি।আর মিত্রাও ধীরে ধীরে পৌঁছে গিয়েছিল ডিপ্রেশনের চরমে।এমন অবস্থা হয়েছিল যে, বাড়িঘর পরিস্কার করত না,স্নান করত না দিনের পর দিন।কোনওরকমে ডালভাত রান্না করে মেয়েদের খাইয়ে নিজে দুমুঠো খেত।সেটুকুও অনেকদিন করতে পারত না,সন্দীপকে হাল ধরতে হত শেষ পর্যন্ত।সন্দীপ সব বুঝেও নিজেকে না পাল্টে মানসিক চাপ নিতে নিতে অকালে ঝরে গেল।শেষদিকে সিগারেট খাওয়াও খুব বাড়িয়ে দিয়েছিল মিত্রার কথা না শুনে,সেটাই কাল হল।
২
মিত্রা এখন বরের অফিসে বেশ ভাল পোস্টে কাজ করে।সন্দীপের স্মৃতিসহ পুরনো বাড়ী পুরনো খোলসের মতই ত্যাগ করে দুই মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছে পশ্ এলাকায় নিজস্ব ফ্ল্যাটে।নিজের গাড়ীও কিনেছে। শ্বশুরবাড়ীর নিজের অংশ ও বাপের বাড়ীর নিজের অংশটুকু বিক্রী করে ভালোই টাকা পেয়েছিল। মেয়েদের শিখিয়েছে আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে, মেয়েরা সেই চেষ্টাতেই রত। সন্দীপ চলে যাওয়ার পর প্রচুর পুরুষ এসেছে ওর জীবনে ভাগ বসাতে কিন্তু মিত্রা অনড় অটল ওর সিদ্ধান্তে। বিবাহিত জীবনের স্বাদ পাওয়া ওর হয়ে গেছে, ওই চর্বিত চর্বন জীবনে ও আর দ্বিতীয়বার পা ফেলতে চাইবে না। তাছাড়া স্বাধীন জীবনের স্বাদ একবার পাওয়া হয়ে গেলে সাধ করে কেই বা আর পরাধীন হতে চায়! তবে জীবনে একজন পুরুষের অভাব ওকে কুরে কুরে খায়। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে জীবনে চলার পথে নারীর পুরুষ ছাড়া ও পুরুষের নারী ছাড়া চলা অত্যন্ত কষ্টকর। অনেক ভেবে ও একজন কাউন্সেলারের সাহায্য নিল। তিনি উপদেশ দিলেন প্রেম করতে, দায়িত্বহীন প্রেমই একমাত্র সব সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু দায়িত্বহীন প্রেম আর যাই করুক, চরিত্রে কলঙ্ক লেপতে আর বাকি রাখবে না। সে যাই হোক প্রেম তো আর হাতের মোয়া নয়, যে চাইলেই হয়ে যাবে।কাউকে যে সেভাবে মনেই ধরে না। কিন্তু ভেতরে কোনো চাহিদা বা চিন্তা থাকলে ঠিক যেভাবেই হোক্ কোনো না কোনো ব্যবস্থা হয়েই যায়। ঠিক সেভাবেই কিকরে ওর বহুদিনের পুরনো প্রেম একেবারে সামনে চলে এল। হঠাৎই যোগাযোগ। প্রথমে ও বিশ্বাসই করতে পারেনি ওর চোখকে,ঠিক দেখছে তো! ওর স্বপ্নের পুরুষ অনন্ত একেবারে চোখের সামনে। কিন্তু কি চেহারা হয়েছে! আগের সে জৌলুষ নেই, ফর্সা রং-ও পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। তবে মানুষটা সেই একই আছে। মিত্রা মনে মনে একেবারে ঠিক করে ফেলল, একবার যখন তার স্বপ্নের পুরুষকে সে পেয়েছে, এবার আর কোনো ভুল করবে না। সমাজ সংসার সব চুলোয় যাক্, এই পুরুষকেই তার চাই। পৃথিবীর আর কোনো পুরুষের কাছে সে নিজের ইজ্জত বিক্রী করতে পারবে না।
৩
মিত্রা ও অনন্ত বহুদিন হল এক সংসারে আবদ্ধ।মাঝে প্রচুর ঝক্কি-ঝামেলা সামলে এক সংসারে মিলিত হতে পেরেছিল দুজন।এখন মেয়েদেরও বিয়ে হয়ে গেছে, যে যার সংসারে সুখে আছে।মিত্রা আবার একা,আবার এক অনন্ত বিষাদ ঘনিয়ে এসেছে ওর জীবনে।আবার সুখ এসে বাসা বেঁধেছে ওর সংসারে, তাই এ বিষাদ।এ বিষাদ থেকে আর বোধ হয়ে মুক্তি নেই ওর।
সুচিন্তিত মতামত দিন