রঙিত মিত্র - মায়াজম

Breaking

২ নভে, ২০১৫

রঙিত মিত্র

                                                আলোচনা 











 এক


         
লুকিয়ে থাকা জীবনবোধ থেকে লাফিয়ে ওঠা ধূষর পৃথিবীর ধূ ধূ মাঠের আলতো স্রোতে,মাথা ধোয়া সূর্যরা পাখিদের ডানায় মোলায়েম মাখনের মতো বন বন করে ঘুরতে ঘুরতে শূণ্যতায় এক মায়া অথবা বিচ্ছিন্নতায় এক রূপকথার দ্বিতীয় হুগলি সেতু বানিয়ে,পুরাতনকে ভালোবেসে ফ্যালে।বিকাশ সরকারের কবিতায় তেমনি ভালোবাসা খেলে বেড়ায়। যেমন আঁধারজামাকবিতাটা। কবিতাটিতে রোদ নিবে আসা শীতকালে বালকবেলানেমে আসছে ।সেখানে তার তুষের চাদর থেকে জীবনের সবুজ রং-এর , ‘অলীকপুকুরে আঁজলা ভরা কুয়াশায় মুখ ধোওয়া কুলকুচির শব্দ, মৃত্যুকালো সাপেদের খেলায় অনুভব করছে শীতের বিকেল যেন ফেলে দেওয়া কোন-এক সাপের খোলস।অথচ সবই নকল। এই ভয়,বিষাদ,অনিশ্চয়তা নাম এক বিভ্রমে উদালের কান্ড বেয়ে নেমে আসে বিকেলের বিষমাখা কষ। কবি সার শরীরে জীবনের সব বিষ নিয়ে চেতনা অন্বেষণ করতে থাকেন । কখনো আবার কবিতা ফুল হয়ে ওঠে।তাই কবি লিখে ফ্যালেন , ‘ অবশেষে একটি কবিতা তুলে খোঁপায় দিয়েছি গুঁজে তার/বিকেল হ্যাঙারে রেখে এইবার পরি আমি অন্ধ অন্ধকার
এইবার বিকাশ সরকারের আরেকটি কবিতা পাঠ করি। কবিতাটির নাম রাত,অসম্পূর্ণ কবিতার মতো।এই কবিতাটা আমার কাছে একাকিত্বের কবিতা। যখন নিঃসঙ্গ ভিনরাজ্যের অবেলা রাতে,বিরক্ত জমে থাকে,তখন আমিও বলতে থাকি, ‘অসম্পূর্ণ কিছু কবিতার দিকে ঝুঁকে থাকি আজ সারারাত/নিঝুম হাওয়া এসে চেটে দেয় অক্ষরের আলোর প্রপাত।আর এইখানেই সমাপ্তির যন্ত্রনা হারিয়ে যাওয়া নস্ট্যালজিয়া,মনোজগতের বিভোর করে হারিয়ে যাওয়া প্রত্নস্বর এবং ফেউ-এর মতো পিছনে ডাকা রোমান্টিকতা ভেঙে অজান্তেই নতুন অক্ষরের জন্মদিন। তাই ভাটফুলে মধু খেতে তবু আসে উড়ে কত অকথিত রাত/ ডানা মেলে আজ ওড়ে জোছনায় মাখামাখি কবিদের হাত’... এ যেন লিখতে লিখতে হারিয়ে যাওয়া কবিতা,যাকে কোনোদিনই ফিরে পাওয়া যাবে না। যে শুধু সময়ের হিটারে পুড়তে পুড়তে হারিয়ে যাবে,তখন আনন্দের ভিতর শোকের খনি থেকে মাতাল প্রেতের দল আরো গভীরতার সুরে ভাল আর মন্দের মিশ্রণে ভাসা আকাশ-গঙ্গায় পবিত্রতা ফেলে দেয়।সেখানে আলো যেন যন্ত্রনার উদ্ঘাটক, তাই সব অর্থ বদলে যাচ্ছে। পাঠক,আপনারা দেখুন কবি লিখেছেন, ‘অসম্পূর্ণ কিছু কবিতার দিকে ঝুঁকে থাকি আজ সারারাত/নিঝুম হাওয়া এসে চেটে দেয় অক্ষরের আলোর প্রপাত। আসলে সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণের বিভেদ রেখা থেকে জীবন উঁকি মারে। আর ভেসে যাওয়া চিত্রকল্পের স্রোতে যাযাবর মুহূর্তরা ,সেখানে শূন্যের বোবা অস্ত্র কেটে দেয় যত ছিল শোক

সৃষ্টির ভিতর থেকে উঠে আসে কবিদের স্পর্শ ,কখনো সুখ-অসুখ বদলে ফ্যালে তার মেরু,সেখানেই অস্থিত্বের প্রশ্নে অপ্রাপ্তিজ-বিষাদ জেগে ওঠে। তাই যেন এই কবিতারও শেষ লাইনে কবি লিখে রেখেছেনতারপর আলো দিয়ে বেঁধে রাখি যত ছিল মহামারি,ক্ষত/রাত পাশে শুয়ে থাকে অসম্পূর্ণ কবিতার মমিদের মতো।

দুই

পাঠক এইবার বিকেলবাবুনামক কবিতাটি পড়তে শুরু করি।এই কবিতার প্রকৃতির ছবি এঁকেছেন,কবি। তিনি লিখছেন, ‘মেঘ বাজে ;সবচেয়ে উঁচু গাছটির মেঘময় ডালপালাজুড়ে/বনে জাগে সেইসব অপার্থিববন,ধুলো ওঠে বিকেলের খুরে। এইসব লাইন পড়লেই বোঝা যায়,প্রথাগত পরিচিত ও জনপ্রিয়ধারার থেকে বিকাশ সরকারের কবিতা কতটা পৃথক। পাঠক আপনারা এই কবিতা জোড়-শব্দের দারুন ব্যবহার খেয়াল করবেন।
প্রকৃতি-চেতনা ছাড়াও ইতিহাস নিঃশব্দে প্রবাহমান হয়ে ওঠে বিকাশ সরকারের কবিতায়। সেখানে জীবনের গভীরতার ভিতর থেকে সময়ের চাল-চলন অক্ষরের উপত্যকায় নক্ষত্র ফুলের মতো জেগে থাকে। আর সেখানেই পাঠক,আপনি নির্মল ভালোবাসা ও ভালো লাগার স্বাদ পাবেন।

 
তিন

যজ্ঞকবিতায় কবি নিজেকে অনুবাদ করছেন।তিনি লিখছেন, ‘যজ্ঞ করি।আগুনে ঢালছি মেঘ।সমুদ্র ও ঝড়/আগুনে ঢালছি আগুন।ঢালছি ঈশ্বরে ঈশ্বর। এইখানে বর্ণময় হয়ে উঠছে,সৃষ্টিরত কবির অন্তর্জগতের ছবি। আসলে সমস্ত সৃষ্টিই, ‘যজ্ঞথেকে উঠে আসে। তারপর যজ্ঞের নিয়মের হাত দিয়ে,জীবনের সব কিছু উজান নৌকায় ভাসতে ভাসতে উধাও হয়ে যায়। আবার কখনো ক্রমাগত ভাঙা-গড়ার ভিতর থেকে জীবনের মূল উত্তর উঠে আসে। তাই বোধহয় কবি লিখেছেন, ‘মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে ওঁম তৎ সৎ। আর এইখানেই একজন দার্শনিকের যাত্রাপথ সমাপ্ত।কারণ তিনি এই দীর্ঘ্য যাত্রায় যে উত্তরের সন্ধান করে ছিলেন,তা যাত্রার সমাপ্তি-লগ্নে তিনি পেয়ে গেছেন ।এই কবিতাটি পড়ার পর,বিকাশ সরকারের আরেকটি কবিতা,যার নাম বিকাশ বলেছেসেটা পড়বো। এই কবিতায় কবি সরাসরি নিজের কথায় , নিজেকে লিখে যাচ্ছেন বিকাশ বলেছে সে যাবে অন্ধকারে; অন্ধকার মানে অন্ধপ্রেম/এক অন্ধতারই ঘর। আগেও সে গেছে ভাটিয়ালি গাইতে-গাইতে/ফের এসেছে বেরিয়ে একখানা আস্ত বাউলসংগীতের মতো...
মুক্তিহীন এক নিঃসঙ্গতায় কবি আক্রান্ত হয়েও ,কি করে তাকে এতো প্রিয় বলে মনে করেন,সেই বিস্ময় চিন্তার ফলক হয়ে উঠেছে এই লেখাটি।পাঠক উপরিক্ত কবিতাটিতে, আলো-অন্ধকারের ভিতর কবির রহস্যময় গমন এবং সেখান থেকে আরেকটি কবিতার বীজ থেকে গোলাপ ফুল হয়ে ওঠার জার্নিরং রামধনু হয়ে আছে,লেখার উপর।

চার

নির্জনতা,নিঃসঙ্গতা,বিষাদ,বিভেদ,অন্ধকারের ভিতর দিয়ে কবির যাত্রাপথ রেখায় সূর্যের সৌরভের ভিতরও কলঙ্ক আবিষ্কৃত হয়। তবু সেই আবিষ্কারের উত্তেজনা অবাধ্য হয়ে,বিরোধীতা করে। আর সেখানে দ্বন্দ্বের জন্ম হয়। তবে এই জন্ম সুখ না অসুখের ,তা নিয়ে কবির কোনো মাথা ব্যথা নেই।তিনি বরং নতুনত্ব সন্ধানী। তাই কবিই সত্য।কবিকে কখনোই আটকে রাখা যায় না বলেই,তিনি দেওয়ালের ফিস ফিসের ভিতর কেল্লার অলিখিত ইতিহাসের পান করতে সক্ষম হন। তাই একজন সার্থক কবি হিসেবে,বিকাশ সরকারই লিখতে পারেন, ‘ মদের বোতলে ভরছি সূর্য,আর খসে পরা কতগুলি তারা

পাঁচ

বিকাশ সরকারের কবিতায় বেজে ওঠে উত্তর-পূর্ব ভারতের সুর । সেখানে ঝরনা জল,পাহাড়িয়া সুখ ও শোক,কখনো আবার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকার মতো অবসর চোখ খুলে দেখায় । যদিও নির্জনতার একটা সুগন্ধ আছে।সেই সুগন্ধ-সুধা পান করে,কবি তাঁর সব সামাজিক জটিলতাকে পরিত্যাগ করে,প্রেমিক হতে চান। কিন্তু বাস্তব আর অবাস্তবের মিশ্রণের ভিতর দিয়ে ,কবিতা খুব ক্রুদ্ধ হয়ে বলে ওঠে, ‘ কঙ্কালের জলসায় আমি ঠিক বেহালার বোনকে বাজাব। আর এইভাবে কবি বিকাশ সরকার ,পাঠককে তাঁর নিজের কবিতার জগতে নিয়ে আসেন।আমি একজন পাঠক হিসেবে,সেখানে যাবার নিমন্ত্রন পত্র পেয়ে,এখন ভ্রমণরত। পাঠক,আপনারাও আমার পিছু পিছু আসুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র