অর্ঘ্য দত্ত - মায়াজম

Breaking

২ নভে, ২০১৫

অর্ঘ্য দত্ত

                                  পল্টু ও একটি বিসর্জনের গল্প






      পল্টুর পা নাচছে ঠিকই কিন্তু নাচে ওর মন নেই। ওর মন ও চোখ দুই আটকে আছে সামনের লরিতে রাখা দুর্গা প্রতিমার হাতে। কখনো কখনো সামনে পেছনে নাচতে থাকা পাড়ার দিদি কাকিমাদের দলের মধ্যে ওর চোখ খুঁজছিল ইতুদিকে। প্যান্ডেলে প্রতিমা বরণের সময়েও ও ইতুদিকে দেখেছিল। এখন আর দেখতে পাচ্ছেনা। ব্যাঙাচি নাচতে নাচতেই ওকে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে- আব্বে নাচ না , দাঁড়িয়ে পড়ছিস কেন? গুম গুম করে আওয়াজ হচ্ছে দেবীমূর্তির দুপাশে রাখা বিশাল সাইজের বক্স থেকে। চেঁচিয়ে না বললে পাশের জনের কথাও শোনা যাচ্ছে না। পল্টুর চোখাচুখি হয় গীতুর সঙ্গে। জিন্স ও লাল টপ পরা গীতুকে ঘামে ভিজে যেন আরো কালো লাগছে। শুধু ওর বড় বড় চোখের সাদা অংশটা আলো পড়ে ঝকঝক করছে। গীতু ওর সমবয়েসি মেয়েদের সঙ্গে নাচতে নাচতেও তাকিয়েছিল পল্টুর দিকেই। চোখ সরিয়ে নেয় পল্টু।
নাচতে নাচতেই কোমরের কাছ থেকে বারমুডার মধ্যে নিজের হাতটা ঢুকিয়ে দিয়ে টাইট করে বসে থাকা জাঙিয়ার ইলাস্টিক ব্যান্ডের ওপর একটু হাত বুলিয়ে নেয় পল্টু। আজই প্রথম ও প্যান্টের নিচে জাঙিয়া পরেছে। কাল রাতে বাবাকে দিয়ে ওর জন্য এক জোড়া বড়দের মতো জাঙিয়া কিনিয়ে এনেছে মা। নীল রঙের। আসলে ক্লাস সেভেনে ওঠার পর থেকেই ও বায়না ধরেছিল। ও জানে অনেক প্রাইমারী স্কুলের বাচ্চা ছেলেও আজকাল প্যান্টের নিচে জাঙিয়া পরে। তবু দিচ্ছি-দেবো করতে করতে প্রায় দু-বছর কেটে গেছে। গতকাল, নবমীতে, বিকেলবেলা প্যান্ডেলের সামনে মাঠে ওরা সব দল বেঁধে বসে যখন ধুনুচি প্রতিযোগিতার জন্য নারকেল-ছোবড়া ছাড়াচ্ছিল, হঠাৎ ব্যাঙাচি খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হাসতে হাসতে পল্টুর দুপায়ের ফাঁকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলে – দেখ দেখ, পল্টুর গোডাউনের দরজা খোলা। শালার এখনো গোঁফ-দাড়ি না গজালে কি হবে গোডাউনে তো দেখছি...। হাতিবাগানের স্টল থেকে কেনা নতুন রেডিমেড প্যান্টের একটা বোতাম কখন খসে গেছে পল্টু টেরও পায় নি। ওর দুচোখ ফেটে যেন জল আসে। ও এক দৌড়ে বাড়ি এসে মায়ের ওপর চোটপাট শুরু করেছিল। আসলে তিন বছর ধরে একই ক্লাসে থাকা ব্যাঙাচি বা পাড়ার অন্য বন্ধুরা যতই বলুক যে সবার ওপরে নুংকু সত্য তাহার ওপরে নাই, ফুটবল পেটানো, এক সাঁতারে ঝিল পেরানো পল্টুর সাড়ে চোদ্দো বছরের শরীরটা স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠলেও ওদের মতো দু’পায়ের ফাঁকে এখনো লিবিডোর মৌরসিপাট্টা কায়েম হয় নি।
নাচতে নাচতে যতবারই ও কোমরে নিজের জাঙিয়ার ইলাস্টিকে হাত বোলাচ্ছিল, নিজেকে বেশ বড় বড় লাগছিল। এবছরের পুজো যেন ওকে এক ধাক্কায় অনেকটাই বড় করে দিয়েছে। গীতুর কথাটা আবার মনে পড়তেই ও একই সাথে আশ্চর্য এবং বিরক্ত হল। সপ্তমীর দিন দুপুরে প্যান্ডেলে ওকে একা পেয়ে, ইতুদির বোন গীতু বলেছিল – পল্টুদা,আজ আমাকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে যাবি?
-কেন? কাকু-কাকিমা নিয়ে যাবে না? অবাক হয়ে পল্টু প্রশ্ন করেছিল ।
-ওদের সঙ্গে আমি যাব না। আজ সন্ধ্যাবেলায় বরং চল না শুধু তুই আর আমি একটু বেরোই, কেউ টের পাবে না। কেমন এক অচেনা চোখে ওর দিকে তাকিয়েছিল ক্লাস সেভেনে পড়া গীতু।
-চল্ ভ্যাট। আমার আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই। আমি, শম্ভু, ডালু, অমরনাথ সব একসাথে বেরবো আজ। হোল-নাইট। পল্টু বলেছিল।
-আচ্ছা বলতো তুই কি হোমো? তোর বন্ধুরা সব ড্যাব-ড্যাব করে আমাকে দেখে, আর তোকে ডাকলেও তুই আসছিস না! পুজোর একবেলা না হয় ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে নাই ঘুরলি।
-পাকামো করিস না, ইতুদিকে বলে দেব।
- ঐ এক ইতুদিকেই খালি চিনেছিস। মুখ ভার করে চলে গিয়েছিল গীতু।

বিসর্জনের প্রসেশন নেতাজী কলোনি পেরিয়ে জনবসতিহীন সার্কাস-মাঠের ধার দিয়ে চলেছে বড়-পুকুরের দিকে। পল্টুর আগে-পিছে সবাই আনন্দে উদ্দাম নাচছে। গান বাজছে তারস্বরে। টিং টিং টিং টিং, তুনে মারি এন্ট্রি রে, দিল মে বাজি ঘন্টি রে...। কিন্তু পল্টু কিছুতেই যেন আর গত বছরের মতো মন দিয়ে নাচতে পারছে না। মনে হচ্ছে কখন বিসর্জনের শোভাযাত্রা বড় পুকুরে পৌঁছবে। বারবার ওর চোখ যায় দুর্গা প্রতিমার হাতের খাঁড়ার দিকে। চলন্ত লরিতে উজ্জ্বল আলো পড়ে ঝকমক করছে ছোট্ট রুপালি খাঁড়াটা। আজ সকালেই ইতুদি ওকে কথায় কথায় বলেছিল – জানিস, আমার না খুব শখ আমার ঘরের দরজার ওপরে দুর্গা-মার হাতের খাঁড়া সাজিয়ে রাখব। অনেককে বলেছি, গতবছর মানিককে বলেওছিলাম কিন্তু কেউই এনে দেয় নি। আসলে আমার নিজের তো ভাই বা দাদা নেই, কে আর এনে দেবে! ইতুদির গলায় যেন অভিমান ঝরে পড়ে। সেই থেকে পল্টু মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে আজ যে করেই হোক ঐ খাঁড়া এনে ও ইতুদির হাতে তুলে দেবেই। আসলে দেবীমূর্তির হাতের অস্ত্র-শস্ত্র নেবার জন্য এত কাড়াকাড়ি হয় বলে আজকাল সব অস্ত্র সমেতই প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে দেওয়া হয়। অনেকে সাঁতরে গিয়ে খুলে নিয়ে আসে যে যেটা পারে। কিন্তু ওরা তো বড় পুকুরে প্রায় পৌঁছেই গেল অথচ ইতুদিকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না কেন! ইতুদি কি তাহলে বাড়ি ফিরে গেছে! ইতুদি যদি বিসর্জনের ঘাটে না থাকে তাহলে ও খাঁড়াটা দেবে কী করে! খাঁড়া ওর কাছে দেখলেই তো অন্যরা তখন ওর ওপর হামলে পড়বে। এইতো আজ ইতুদিকে বলতে শুনেই গীতুও ওকে ঠোঁট উলটে বলেছিল – শখ তো আমারও। কিন্তু আমাকেই বা কে এনে দেবে! বেদম হাসি পেয়েছিল পল্টুর। ও গীতুকে বলেছিল – তোকে কালী ঠাকুরের খাঁড়াটা এনে দেব। ওটাই ভালো মানাবে।
পল্টুর ন’বছরের বড় দিদির প্রাণের বন্ধু ছিল ইতুদি। ওর বড়দির গত বছর চেন্নাইতে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ইতুদি অবশ্য আর আগের মতো পল্টুদের বাড়িতে আসে না। তবে পল্টু সেই আগের মতোই ওদের বাড়িতে যায়। পল্টুদের এ্যাসবেসটাসের চালের দু-কামরার বাড়ি আর ইতুদি-গীতুদের পাঁচিল ঘেরা বাগান সহ দুতলা বাড়ির মধ্যে শুধু মৃদুলদার মুদির দোকান, যুবক সংঘের টালির চালের ক্লাবঘর এবং চারটে একতলা বাড়ির ব্যবধান। ইতুদির মা কাকিমাও ওকে খুব ভালবাসে। কাকিমা এখনো মাঝে মাঝে মজা করে ওকে জিজ্ঞেস করে – কিরে পল্টু, তুই তোর ইতুদিকেই বিয়ে করবি তো? পল্টু এখন লজ্জা পায় একথা শুনে। বড়দের মুখে শুনেছে ছোটোবেলায়, মানে ওর ছ-সাত বছর পর্যন্ত কেউ যদি ওকে জিজ্ঞেস করতো, তুই কাকে বিয়ে করবি রে? পল্টু জবাব দিত – ইতুদিকে। ইতুদিদের বাড়ির ছাদে ছোটোবেলায় যখন প্রায় সমবয়সি গীতু আর পল্টুকে খেলনা-টেলনা দিয়ে বসিয়ে রেখে ওর দিদি আর ইতুদি গল্প করতো, ও না খেলে নাকি ওদের গা ঘেঁষে বসে হাঁ করে ইতুদির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। পল্টুর এখনো মনে হয় ইতুদির গায়ের গন্ধ, চুলের গন্ধ সব ওর চেনা। অনেক মানুষের মধ্যে থেকেও চোখ বন্ধ করে ও ইতুদিকে খুঁজে নিতে পারবে। ইতুদিকে যে ও বিয়ে করবে না সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি ওর অনেকদিন আগেই হয়ে গেলেও, ইতুদির কাছাকাছি এলেই ওর মন যেন ভালো হয়ে যায়। মনে হয় ইতুদির জন্য ও সব কিছু করতে পারে। সব।
বিসর্জনের শোভাযাত্রা বড় পুকুরে এসে পৌঁছলে , ক্লাবের দাদারা ধরাধরি করে লরি থেকে সব প্রতিমা ঘাটে নামিয়ে রাখে। আবার শেষবারের মতো প্রতিমাদের পা ছোঁয়ার হিড়িক পড়ে। আর একদফা বরণ হয়। ধুনুচি নিয়ে নাচ-টাচ হয়। ঘাটে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাদের মধ্যে পল্টু আর একবার ইতুদিকে খুঁজে নেয়। কিন্তু কোথাও দেখতে পায় না। বিসর্জন শুরু হলে পাড়ার দাদাদের সঙ্গে সঙ্গে পল্টু নেমে পড়ে বড়-পুকুরের জলে। ওর চোখ থাকে দুর্গা মূর্তির হাতের খাঁড়ার দিকে। যে মুহূর্তে ‘বলো দুর্গা মাঈকী জয়... আসছে বছর আবার হবে...’ বলতে বলতে জলের মধ্যে সাত পাক ঘুরিয়ে মূর্তি জলে চিত করে ফেলে দিয়ে সবাই মিলে ঠেলে দেয় গভীর জলের দিকে, ক্ষিপ্র শিকারির মতো পল্টু ঝাঁপিয়ে পড়ে দেবীমূর্তির ডান হাত থেকে খুলে নেয় চোখ আঁকা রুপালি খড়্গ। আরও কেউ কেউ একই রকম ভাবে খুলে নিতে থাকে অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র। কিন্তু পল্টুর সেদিকে মন নেই। ও টি-শার্ট উঠিয়ে নিজের পেটের ওপর খাঁড়াটা শুইয়ে হাতে ধরার দিকটা ঢুকিয়ে দেয় কোমর দিয়ে বারমুডার মধ্যে। নতুন জাঙিয়ার টাইট ইলাস্টিক ওর দেহের সাথে চেপে ধরে রাখে টিনের ছোট্ট খাঁড়াটাকে। ওই অবস্থায় দু'পা স্থির রেখে যতটা সম্ভব হাত কম নাড়িয়ে জলের তলা দিয়ে ডুব সাঁতারে ও এগিয়ে যেতে থাকে যে দিকে বিসর্জন হল তার উল্টো পারে। নামেই বড়পুকুর, আসলে তো এর পেটের মধ্যে ছ-আটটা বড় বড় পুকুর ঢুকে যাবে। অনেকে একে লেক বা ঝিলও বলে। মাঝেমাঝে ও চিৎ সাঁতার দিয়েও এগোতে থাকে। পা নাড়াতে গেলেই থাইতে খাঁড়ার হাতলের খোঁচা লাগতে থাকে বলে পল্টু শুধু হাত দিয়ে জল কেটে কেটে এগোয়। মাঝ বরাবর এসে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ছেড়ে আসা ঘাটে বিসর্জন শেষে চলছে ফিরে যাওয়ার তোড়জোড়। পল্টু জানে উল্টো পারে একটা ছোটো ঘাটের মতো আছে। আর আই সি কোম্পানির পেছন দিকের পাঁচিল লাগোয়া। জনবসতি নেই বলে দিনের বেলাতেও এদিকে বিশেষ কেউ আসে না। ঘাট ঘেঁষে একটা ডুমুর ও দুটো পেয়ারা গাছ। একদিন ব্যাঙাচি ওদের সবাইকে এখানে নিয়ে এসেছিল সিগারেট খাওয়াবে বলে। ঐ ঘাটে উঠে পুকুরের উত্তর দিক দিয়ে হেঁটে ঘুরপথে ও ইতুদিদের বাড়ি পৌঁছে যাবে। পল্টু মনে মনে যেন খাঁড়াটা হাতে পেয়ে ইতুদির অবাক হয়ে যাওয়া ভ্রূভঙ্গি ও ঝিলিকমারা দাঁতের হাসিটাও দেখতে পায়।
সাঁতরে পারে পৌঁছেই পল্টু ঘাটের অদূরে একটা দাঁড় করানো কালো রঙের মোটর বাইক দেখতে পায়। এত রাতে এখানে কে এসেছে! ও অবাক হয়। একটু ভয়ও লাগে। সন্তর্পণে ঘাট থেকে একটু এগোতেই পল্টু দেখতে পায় ডুমুর গাছের নিচে ভাঙাচোরা বেদীর মতো উঁচু জায়গাটাতে এক অসুর ওর দিকে পেছন ফিরে বসে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আছে এক দাঁড়িয়ে থাকা দেবীমূর্তির কোমর। দেবীমূর্তিও দুহাতে মুঠো করে ধরে আছে অসুরের ঝাঁকড়া চুল। পেয়ারা গাছের ফাঁক দিয়ে দশমীর চাঁদের মায়াবী আলো এসে পড়েছে দেবীমূর্তির আনত মুখে, অনাবৃত বাম বুকে। অসুরের মুখে দেবীর ডান স্তন। ঠিক যেন কাপড় পরানোর আগে কুমোর বাড়িতে দেখা রঙ করা নিরাবরণ প্রতিমার মতো মনে হয়। ওরকমই উজ্জ্বল গোলাপি, নিটোল।
পল্টুর পা আটকে যায় মাটিতে। স্থাণুর মতো সেই যুগল মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে ও। হঠাৎ ওই দেবী প্রতিমা মুখ তুলে সামনে পল্টুকে দেখেই পুরুষ মূর্তিটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে লুটিয়ে পড়া আঁচল বুকে তুলে নিয়ে অস্ফুট আর্তনাদের মতো উচ্চারণ করে – একী তুই এখানে?
-ইতুদি!! পল্টুর গলার স্বর ওর নিজের কানেই অচেনা লাগে।
পুরুষটি বাধা পেয়ে তড়াক করে উঠে মুখোমুখি হয় পল্টুর। পল্টু দেখে নতুন পল্লীর বাসুদা, যার বিল্ডিং মেটেরিয়াল সাপ্লাইয়ের ব্যবসা। পল্টু সম্বিত ফিরে পেয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতেই বাসুদা সজোরে এক লাথি কষায় ওর পেছনে – শালা গান্ডু। তোকে এখন এখানে কে আসতে বলেছে? কেউ জানতে পারলে তোর কী করি একবার দ্যাখিস। ভাগ বোকাচোদা। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়তে পড়তে সামলে নেয় পল্টু। পাঁচিল ঘেঁষা সরু রাস্তা দিয়ে ও প্রায় দৌড় লাগায় পুকুরের উত্তর দিকে।
সেদিন রাতেই পল্টুর জ্বর আসে। কপালে জল পট্টি দিতে দিতে ওর মা বলে – হবে না! অতো রাতে ছেলে বড় পুকুর সাঁতরে পার করেছে। দস্যিপনা দেখো! আর বাবা বলে – রাম পিটুনির দরকার। জাঙিয়া পেয়ে বাবু লায়েক হয়ে গেছে।
পরের দিন সকালে গীতু আসে – জানিসতো পল্টুদা, কাল রাতে বিসর্জনের পরে শম্ভুদা আমাকে দেবীর হাতের চাঁদমালাটা দিতে এসেছিল। আমি নিই নি। ওই বলল তুই নাকি দুর্গার হাতের খাঁড়াটা নিয়েই পালিয়েছিলি? আমি অবশ্য জানি তুই ওটা কাকে দিবি। দিদিকে, তাই না?
ছাদের দিকে তাকিয়ে পল্টু চুপ করে শুয়ে থাকে। কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করে না। দুদিনেই পল্টুর জ্বর ছেড়ে যায়। প্রতিবছরের মতো কোজাগরীর দিন ওদের বাড়িতেও লক্ষ্মী পুজোর আয়োজন হয়। ওর দায়িত্ব থাকে সন্ধ্যাবেলা আশেপাশের বাড়িতে প্রসাদ বিলি করা। ইচ্ছা না করলেও ওর মা জোর করে পাঠায় ইতুদিদের বাড়িতেও। ও শুধু যাওয়ার সময় তোষকের তলা থেকে বের করে খাঁড়াটাকে সেদিনের মতোই লুকিয়ে নেয় ওর জামা-প্যান্টের নিচে। ইতুদিদের বাড়িতে ওদের মতো সরা নয়, বেশ বড় প্রতিমা এনে ঘটা করে পুজো হয়। নানান রকমের প্রসাদ, বারান্দা- সিঁড়িতে আলপনা, সারা বাড়ি টুনি লাইটে সাজানো। পল্টুর হাত থেকে প্রসাদের প্লেটটা নিয়ে ইতুদির মা বলেন – আয় আয়, তোর নাকি জ্বর হয়েছিল! তাই বলি ছেলেটা এবার বিজয়া করতে এলো না কেন! ইস! মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে রে। বোস, ভোগ খেয়ে যাবি। এই ইতু ওকে প্রসাদ দে।
ইতুদি মাথা নিচু করে একটা প্লেটে প্রসাদের কাটা ফল, নাড়ু, সন্দেশ তুলতে তুলতে চাপা স্বরে বলে – পল্টু বোস, আমি প্রসাদ দিচ্ছি খেয়ে যাস। ইতুদির গোলাপি অনাবৃত বাহু, সাদা কপাল, পিঠের পরে লুটিয়ে থাকা লম্বা বিনুনি এসব দেখে আজ আর পল্টুর ভেতরে আগের মতো সেই জরজর ভাবটা জাগে না। বরং আজ যেন বড় পুকুরের আঘাটায় বিসর্জনের কদিন বাদে পড়ে থাকা রঙ-চটা, খড়-ওঠা প্রতিমার কাঠামোর মতো মনে হয়। ইতুদির দিকে আর না তাকিয়েই পল্টু বলে – কাকিমা, শরীরটা ভাল নেই, আজ কিছু খেতে পারবো না। পরে একদিন আসব।
আর অপেক্ষা না করেই ও বেরিয়ে আসে ইতুদিদের দোতলার পুজোর ঘর থেকে। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে বারান্দা ডিঙিয়ে চলে আসে ইতুদিদের সদর দরজায়।
-এই পল্টুদা, সত্যিই তোর শরীর খারাপ? প্রসাদ না নিয়েই পালিয়ে যাচ্ছিস কেন রে? গীতু পেছন থেকে ডেকে বলে।
পল্টু ঘুরে দাঁড়ায়। গীতুর মুখের দিকে তাকায়। গীতুর চোখের দিকে তাকায়। এই প্রথম পল্টুর নজরে পড়ে গীতুর পান-পাতার মতো মুখ, সরু অথচ সুডৌল গ্রীবা, ছোট্ট ঢেউ তোলা বুক, মসৃণ দুই বাহু, পাতলা কোমর। নিজের জামার তলা থেকে পল্টু টেনে বের করে আনে ছোট্ট চকচকে রুপালি খাঁড়াটা।
-এই নে। তোর জন্য এনেছিলাম।
-সত্যি!! গীতুর চোখে মুখে বিস্ময়। দুহাত বাড়িয়ে ও পল্টুর হাত থেকে খাঁড়াটা নিয়ে নিজের বুকের পরে চেপে ধরে জোরে। যেন কেউ কেড়ে নিতে পারে সেই ভয়ে।
পল্টু দেখে পাঁচিলে ঝোলানো টুনি লাইটের আলোর ছায়া আর গীতুর চোখের নিজস্ব বাষ্প বিন্দু মিলে গীতুর বড় বড় পল্লবে ঘেরা চোখ জোড়া যেন এক উৎসব বাড়ির তোরণ হয়ে উঠেছে। গীতুর চোখ দুটো যেন এক আলো ঝলমল পুজো মন্ডপ।
পল্টু হেসে বলে – তোর জন্যই তো। পাগলী, না হলে আর কার জন্য!!

৪টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র