সন্দীপ কুমার মণ্ডল

মায়াজম
1
                                                           বিসর্জন 


     বলো দূর্গা মাই কি... জয়...। এক ঝাঁক হুল্লোড়ের মাঝে দুর্গার চোখের সামনে থেকে সরে সরে যাচ্ছে প্রতিমা, পিছন দিকে চলা প্রতিমার চোখের সামনে থেকে সরে সরে যাচ্ছে মন্ডপ। কপালে মুখে লেপ্টে আছে সিন্দুর। ঠিক যে ভাবে দুর্গার চোখের সামনে থেকে সরে সরে গিয়েছিল ঘোষাল বাড়ির সদর দরজা, সরতে সরতে ক্ষীন ছায়ামূর্তি হয়ে অবশেষে মিলিয়ে গিয়েছিল সদরের পিলারে বাঁধা দারোয়ান রঘুকাকা। সেদিন কেউ চিৎকার করে নি, ‘আসছে বছর আবার হবে’ বলে। কে’ই বা চায় আবার ফিরে আসতে! স্নানের সময় দুর্গা দ্যাখে উরুতে অজস্র গুটি বসন্তের দাগ গত পাঁচ বছরেও মিলায় নি। হয়তো একদিন মিলিয়ে যাবে, কিন্তু যে দাগ উল্কি হয়ে পাঁজরের নীচে রয়ে গেছে, সেটা কি কোনোদিন মিলাবে! হয়তো না – দুর্গা জানে না।
তবু তো প্রতিমা আসে, প্রতিবছর আসে, চারদিনের মহা হুল্লোড় পাড়ার ছেলেদের। সেদিনও তাদেরই হুল্লোড় ছিল। এমন রাজসিক পরিবারের রাজবধুকে সারা মুখে সিন্দুর লেপ্টে, অত্যাচারিত খোলা চুলে উলঙ্গ দেখলে কার না হুল্লোড় হবে! এমন একজন যাকে মুখে অনেকে বৌদি, কাকিমা বললেও মনে যে কামিনী’ই কামনা করে বা করেছে সন্দেহের অপেক্ষা রাখে না। তাদের লোভাতুর চোখের সামনে থেকে রঘুকাকা’র বিটিয়া রানী’র কতটুকু সম্মান আগলাতে পেরেছিল সে শুধু রঘুকাকা’র গায়ের কালো চাদরটা’ই জানে।
শঙ্করের সাথে দুর্গার বিয়ে’র সময় সবাই বলেছিল একেবার হর-পার্বতী। শ্বাশুড়ি বিহীন সংসারে বিধবা বড়’দি কে দুর্গা মা বলতো। দুর্গা জানতো শঙ্কর নেশায় মেতে থাকেন। সে নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না কোনোদিনই। কিন্তু সেই হর-পার্বতি’র হর’কে ভগ্নাংশের লব হয়ে বিছানায় বিধবা বৌদির উপর দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি দুর্গা। বিনিময়ে যেটা হবার সেটাই হয়েছিল। রঘুকাকা’র বিটিয়া রানী পাড়ার চোখে হয়ে গিয়েছিল রঘুকাকা’র মক্ষীরাণী। সুতরাং রাজসিক পরিবারের রাজবধু’র শাস্তি ওই রঘুকাকা দের বস্তি’র স্টাইলে।
বিয়ের আগে পর্যন্ত দুর্গা পূজো দেখেছে বৎসরান্তের নতুন শাড়িতে, মুড়ি ভাজায়, নারকেল নাড়ুতে। সুন্দরী হওয়ার সুবাদে বড় বাড়ির বৌ হবার প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে পারে নি দুর্গার বাবা। এই পূজোতেই তো প্রথম দুর্গাকে দেখেছিল শঙ্কর বন্ধুর বাড়ি এসে।
প্রতিমা দূরে চলে গেলেও এখনও চোখের বাইরে চলে যায় নি। বিসর্জনের গাড়ির উপর বন্ধুর সাথে পরিচিত সেই মুখ, পাঁচ বছরের না দেখাতেও যা অপরিচিত হয় নি। যার দৃষ্টি আটকে আছে দুর্গার উপর। দুর্গা জানে, অসুর মায়ের দিকে কুনজরে তাকিয়েছিল, তাই দুর্গা তাকে বধ করেছে। দুর্গা দ্যেখে অসুরের চোখ বিস্ফোরিত হলেও দুর্গার চোখে কোনো রোষ নেই, দুর্গার চোখে মায়া, দুর্গার চোখে করুণা হয়তো মৃৎকার শিল্পীর দোষেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন