সীমা ব্যানার্জ্জী রায় - মায়াজম

Breaking

২ নভে, ২০১৫

সীমা ব্যানার্জ্জী রায়

                                  সীমন্তিনীর চিহ্ন





অঘ্রাণের গোধূলি। বাতাসে তখনও হাল্কা শীতের আমেজ। গাছের সবুজ পাতায় দেখা দিয়েছে হরিদ্রাভের রেখা। শরতের নীলাভ আকাশ কখন যে হেমন্তের সজ্জায় সাজিয়ে তুলেছে নিজেকে, কে জানে। শেফালী, জুঁই, চাঁপা মল্লিকা ফুলেরা তখন বিদায়ের লগ্ন গুনছে। খালি গোলাপেরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করেই চলেছে। এরকম এক পরিবেশে বাজি-বাজনায় শুভাগমন জানিয়ে বর এল। পাপিয়া দেবী বরণ ডালা সাজিয়ে বরণ করে নিয়ে এলেন বরকে। বেজে উঠল উলু আর শঙ্খধ্বনি। শুরু হল বিয়ের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান।
তিনদিন ধরে নহবত চলছে বাড়ির সদর দরজায়। আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধবে ভরে উঠেছে সুদেব বাবুর কলকাতার লেক গার্ডেন্সের বাড়ি। আজ তাঁর একমাত্র পুত্র ত্রিদেবের একমাত্র কন্যা বিদিশার বিয়ে। তাঁর আদরের একমাত্র নাতনি।
ঠিক চারবছর আগে ত্রিদেবকে হারিয়ে দারুণ শোকে ভেঙ্গে পরেছিলেন সুদেব বাবু। একমাত্র পুত্রের কাল মৃত্যুতে- এ বাড়িতে নেমে এসেছিল শোকের বন্যা। আজ উৎসবের মুখরতায় আর আলোয় সেজে উঠেছে চারিদিক। সারা বাড়ি লাল, নীল, সবুজ আর সোনালি আলোমালায় সেজে উঠেছে। যেন ঝলমলে পোশাক পরে উৎসবের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বাড়ি। সদর দরজায় জ্বলে উঠেছে মঙ্গল-প্রদীপ। তুলসী মঞ্চে পড়েছে নতুন আলপনা। সুদেব বাবুর ব্যস্ততার অন্ত নেই। আজ সারাদিনই হাঁক-ডাক চলছে তাঁর। দাস-দাসী, চাকর-বাকর সবাই খুব ব্যস্ত। লোকের ভিড়ে ভরে উঠেছে তাঁর প্রাসাদ বাড়ির প্রতিটি কক্ষ।

ঘরের এককোণে বসে বিদিশা। গলায় কুন্দনের হার, হীরের গয়নায় ঝলমল করছে তার দেহ। পরনে লাল বেনারসী, মাথায় জড়ি দেওয়া লাল ওড়না, কপালে সাদা আর লাল চন্দন। স্বচ্ছ লাল ওড়নার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওর অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানি। কাজল কালো চোখের সবটাই জুড়ে রয়েছে এক বিষণ্ণতার ছায়া।
শেষ হল বর-বধূর মালা বদলের পালা। শেষ হল বিয়েবাড়ির অপর্যাপ্ত ভুরিভোজ। বর কনেকে ঘিরে জমে উঠল বাসর ঘরে জমজমাট আড্ডা আর গান-বাজনা।
সবার মাঝে নীরব শুধু বিদিশা। কেমন যেন উদাসীনা! রাত্রি তখন দুটো বাজে। ওদের নিয়ম অনু্যায়ী বর-বধূকে আরাম করতে দিয়ে এক এক করে বাসর ঘর ছেড়ে চলে গেল সবাই। রইল শুধু বিদিশা আর অর্চিত।
চারিদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। রাতের আকাশে ঝিকমিক তারারা তখন প্রহর গণনায় ব্যস্ত। সামনের কালো স্যুইমিং পুলের জলে প্রতিবিম্বিত পূর্ণিমার চাঁদ। খাটের উপর বসা বিদিশা, মাথার ওপর এখনও সেই লাল ওড়না। রূপালী জ্যোৎস্নার আলো বিদিশার মুখে এসে পড়েছে। পাশে পড়ে আছে একখানা লাল গোলাপ পাপড়ির চাদর। ঘরের আলো-আঁধারীতে বিদিশার মুখের দিকে তাকিয়ে অর্চিতের মনে হল একটা কবিতার কটা লাইন-
'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে;-

কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অর্চিত বিদিশার মুখের দিকে। মনে হল কি অপূর্ব সুন্দর সৃষ্টি বিধাতার!
গুনগুন করে গেয়ে উঠল ওর ঘুমন্ত শরীরের দিকে চেয়ে:
“চন্দন সা বদন চঞ্চল চিতবান...
ধীরে সে তেরা ইয়ে মুস্কানা
মুঝে দোষ না দেনা জগবালেন...”
তারপর গিয়ে দাঁড়াল জানালায়। হাতে তার একটা জ্বলন্ত সিগারেট। কিন্তু একি? আকাশের সব তারারা গেল কোথায়? হঠাত কেন আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল? এইতো তারাভরা নীল আকাশ ছিল।
মনের মধ্যেও কেমন যেন উত্তাল ঝড় বইতে লাগল। রক্তের ধমনিতে উঠল এক অজানা স্রোতের ঢেউ। হৃদযন্ত্র চলতে লাগল আরও দ্রুত তালে। সমস্ত মনের মধ্যে জুড়ে এক অচেনা গোপন আনন্দ। উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠল অর্চিত। মনে হল, ওর সমস্ত জীবনের এ এক প্রতীক্ষিত লগ্ন। এ লগ্নের জন্য ও অপেক্ষা করে ছিল সারাটা জীবন-জন্ম-জন্মান্তর ধরে।
এ তার সমস্ত চাওয়ার পরম মুহূর্ত। নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে গেল বিদিশার আরও... আরও কাছে।
থমকে গেল অর্চিত। হৃদয়-তন্ত্রীতে বেজে উঠল বেসুরো সুর। সরে এল। সমস্ত চেতনা দিয়ে খুঁজে পেতে চাইল নিজের অস্তিত্বকে-। কেমন যেন ক্লান্ত, অবসন্ন বোধ করল।

হঠাত নিজের বৌদির ডাকে ঘুম ভাঙলো অর্চিতের; উঠে বসল বিছানায়। কখন ঘুমিয়ে পরেছিল, তা নিজেই জানে না। পাশে সদ্য বিবাহিতা বিদিশা ঘুমিয়ে আছে। ওর সারা মুখে ছড়িয়ে আছে এক প্রগাঢ় প্রশান্তি। কালো মেঘ সরে গেছে। পূব আকাশে তখন সিঁদুরে আলোর আভা। ভোরের পাখিরা নতুন দিনের আগমন ঘোষণা করছে চারিদিকে।
দরজা খুলতেই বৌদি ঘরে ঢুকল...... সিঁদুর পরাতে হবে কনেকে। অর্চিত বিদিশাকে ডাকল একবার... দুবার... তিনবার।
তারপর গায়ে হাত দিতেই চমকে উঠল অর্চিত- “বি দি শা-আআ...আ।”
সুদেব বাবুর প্রাসাদ তুল্য বাড়ির ইট-কাঠ-পাথরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল অর্চিতের আর্তনাদ। ডুকরে কেঁদে উঠলেন মা পাপিয়া দেবী। মেয়ে হারানোর ব্যথায়। বাসর ঘরে ঢুকে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সুদেববাবু। কান্নার রোল ভেসে বেড়াতে লাগল সারা বাড়ি জুড়ে। থেমে গেল নহবতের সুর মূর্ছনা।

তড়িৎবেগে বৌদির কাছ থেকে সিঁদুরের কৌটোটা চেয়ে নিলো অর্চিত। নিজের হাতের আংটি খুলে তাতে সিঁদুর লাগিয়ে বিদিশার সীমান্ত জুড়ে সাজিয়ে দিল সীমন্তিনীর চিহ্নে। নববধূর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট দুটো দিয়ে শেষ বারের মত এঁকে দিল ভালবাসার শেষ স্বাক্ষর।
দূ-উ-রে একটা কাক 'কা -কা' করে ডেকে উঠল। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন বৌদি। বিদিশার হাতের মধ্যে ঘুমের ওষুধের খালি শিশি। কান্না শুনে হঠাৎ মুখ তুলতেই অর্চিত দেখতে পেল বিদিশার হাতের কাছে ভাঁজ করা একটা কাগজ। তাড়াতাড়ি খুলে দেখল তাতে লেখা আছে:

“অর্চিত,
ঠিক চার বছর আগে এমনই এক হেমন্তের গোধূলিতে, আর একজনের সাথে জড়িয়ে ছিলাম আমার জীবন। শুভদৃষ্টি আর মালা বদলের উৎসবে দুজনে দুজনকে নিবিড়ভাবে দেখেছিলাম। তখন একটুও জানতাম না, যে এই দেখাই শেষ দেখা হবে আমাদের। নিয়তির অদ্ভুত পরিহাসে সে চলে গেল ইহলোক ছেড়ে। হল না আমাদের বাসরঘর, হল না আমাদের ফুলশয্যা। অনেক যুদ্ধ করেছিলাম মনের সাথে। ঠাকুরদাদু আর মা এর চোখের জলের থেকে বাঁচতে আজকে এই দিনে তোমাকেও পেলাম। পারলাম না নিজের মনের সাথে প্রতারণা করতে...তাই আজ তারই কাছে নিজেকে ফিরিয়ে দিলাম। ক্ষমা করো আমাকে, তুমি।

-”বিদিশা”

চিঠিটা হাতে নিয়ে অর্চিত কিছুক্ষণের জন্য স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আসতে আসতে ভিড় ঠেলে ঘরের বাইরে চলে গেল। আবার একটু পরেই ফিরে এসে বিদিশার পাশে বসে পড়ল। সবাইকে বলল: “আমাদের ফুলশয্যার ব্যবস্থা করো। নিয়মমতো বিদিশা এখন আমার বিবাহিতা স্ত্রী।”
সবাই অবাক এই কথা শুনে। কিন্তু বার বার অর্চিতের কথায় তারা কিছু ফুল এনে ছড়িয়ে দিল বিছানায়। তারপর অর্চিত বিদিশার ঠাণ্ডা হাতটা নিজের হাতে নিয়ে ওর পাশে শুয়ে পড়ল। আর বলল: “বিদিশা তুমি কারো কখনই ছিলে না । কারণ তুমি আমারই ছিলে সব সময়। তাই আজও তুমি আমার রইলে”...বলে বিদিশার হাতটা দিয়ে নিজেকে বেষ্টন করে নিলো।
সবাইকে বলল- “একি! তোমরা দাঁড়িয়ে কেন? আমাদের ফুলশয্যা তোমরা তো দেখবে না, তাই না? কাজেই দেখো না, প্লিজ। তোমরা দরজা টেনে দিয়ে বাইরে চলে যাও। আজ আমার আর বিদিশার মধুরাত।”

দরজা ভেজিয়ে দিয়ে সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে।

সকাল হতেও সবাই দেখে দরজা বন্ধ- তাই সবার আগে সুদেব বাবু ঘরে ঢোকেন। দেখেন অর্চিতকে বেষ্টন করে তাঁর আদরের নাতনি ফুলশয্যার রাত কাটাল। এইবার তিনি অর্চিত -এর গায়ে হাত দিয়ে কাঁপা গলায় ডাকলেনঃ “দাদুভাই...দাদু...ভাই”।
কি...ন্তু...অর্চিত-এর দেহও তো ঠান্ডা বরফ। উত্তেজিত হলেন না একটুও। নিজের মনকে শান্ত করে শুধু হাঁক পাড়লেন... “তোমরা বর বৌকে বিদায় জানাতে সাজগোজ আরম্ভ করো। ফুলের গাড়ি ডাকো। বিদায়ের সানাই বাজুক......”
আমার একমাত্র আদরের দিদিভাই তার স্বামীর সাথে নিজের বাড়ি যাচ্ছে। খুব ধূমধাম হবে এই যাত্রা, যা কখনও কেউ দেখেনি আগে।
সবাই ভেতরে এসে দেখে... আশ্চর্যভাবে শান্তিতে শুয়ে আছে স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি। বিদায়ের সানাই বেজে উঠল......

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র