রৌপ্য রায়

মায়াজম
0
                                     বিসর্জন - মুক্তির পথ







'আজ তোমাকে মরতেই হবে কণি , মরতেই হবে ।'
অন্ধকার ভেদ করে রুমের চারদেওয়েলের ভিতর খিলখিল করে ভেসে এল এক কান ফাটানো অট্টহাসি । বাইরের জগত মেতে আছে দেবীর বিসর্জনের আনন্দে । চারিধারে লাইট, গান-বাজনা, মদ, গাজার নেশায় মত্ত হয়ে আছে সমাজবাসী । কেবল এক অর্ধ অন্ধকার ঘরে একজনের আনন্দ মিশে গেছে বিষাদে কানায় - কণিকা
, কণিক রায় ।
--'কেন, আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি ?'
--'ক্ষ-তি ! আমার জীবনের অনেক বড়ো ক্ষতি করেছো কণি , অনেক বড়ো ।'
--'কি এমন ক্ষতি করেছি যে যার মাসুল দিতে হবে আমার জীবন দিয়ে ?'
গম্ভীর চাপা কান্নায় কণিকা চোখ থেকে জল ঝরছে । আলো আবছায়ার কণিকার মুখ দেখা যাচ্ছে না ঠিকই কিন্তু চাপা গম্ভীর কান্নার শব্দ ভেসে উঠছে চারদেওয়ালের মাঝে ।
--'কেঁদো না কণি । আমি তোমার অধিক কষ্ট দেবো না । আর একটু অপেক্ষা করো । দেবী বিসর্জনের সাথে সাথে তোমারও বিসর্জন দেব আমি । ঠিক কৃতমের মতো ।'
--'কৃতম , মানে কৃতম বসু ।'
--'হ্যাঁ কণি । কৃতম বসু । তোমায় প্রাণের বন্ধু ।'
--'মানে কৃতমের মৃত্যু এক্সিডেন্ট নয় । আপনি খুন করেছেন ?'
--'হ্যাঁ । আমিই খুন করেছি । বিশ্বকর্মার সাথে সাথে ওকে ও আমি ছাদ থেকে
বিসর্জন দিয়েছি কণি ।'
--'আপনি একজন খুনি । আমি সবাইকে বলে দেব । এমনকি পুলিশকে ও ।'
--'বোকার মতো কথা বলছো কেন কণি ? তুমি বাঁচলে তবেই তো সকলকে বলবে । এমনকি
পুলিশকে ও ।'
চারদেওয়ালের ভিতরটা স্তব্ধ । মাঝে মধ্যে ছুরি ঠোকার ঝনঝন শব্দ ভাসছে । কণিকা বাম হাত দিয়ে চোখ-মুখ মুছে একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল -
আচ্ছা । আমাকে আপনি নিশ্চয় খুন করবেন । কিন্তু তার আগে আমাকে বলতে হবে
আপনি কেন আমাকে খুন করতে চান ?'
জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদ গেছে লুকিয়ে মেঘের কোলে । মুহূর্তের মধ্যে আবার খিলখিল করে অট্টহাসিতে ভোরে গেল অন্ধকারের চারদেওয়াল ।
--'জানতে চাও ?'
--'হ্যাঁ জানতে চাই । আমার মৃত্যুর কারণ কি ?'
--'নোকু কে চেনো তো ?'
--'নো-কুউউ । নোকু কে ?'
--'নোকু মানে নিভাস ।'
--' নিভাস ! নিভাস ব্যানার্জী ।'
--'হ্যাঁ নিভাস ব্যানার্জী । আমার একমাত্র সন্তান । যাকে তোমার জন্য মরতে
হয়েছিল । শুধু তোমার জন্য ।'
কণিকার মনের ভিতরটা হঠাত্‍ এক জ্বলন্ত আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল । পুড়ে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে অন্দরমহল । ভেজা চোখের পাতায় ভেসে উঠছে দুবছরের খত পড়ে যাওয়া এক মধুরজীবন্ত চিত্র ।
এক ঝড় জলের সদ্য শীতের সন্ধ্যা, বাসস্টপে দাড়িয়ে এক তরুন তরুনী, কলেজ থেকে ফিরছে । রাস্তার দুয়েকটা কুকুর ছাড়া জনমানব শূন্য । গাড়ি ঘোড়ার সংখ্যা প্রায় কমেও গেছে, ট্রেনের অনেক দেরি । সন্ধ্যা আবছায় অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে বলেছিল আমি নিভাস, নিভাস ব্যানার্জী । মেয়েটি তখনও চুপ, কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিল । গড়িয়ার বেলতলাতে থাকি ।
মেয়েটির মুখে এবার বোল ফুটলো কণিকা, কণিকা রায় । গড়িয়া, তেঁতুলবেড়িয়া ।
--'আরে ঘরের পাশে তো ।'
--'হ্যাঁ ।'
--'মনে হচ্ছে বাস পাওয়া যাবে না ।'
--'তবে ?'
--'চলো হাটি ।'
--'হাটতে হাটতে বাড়ি তে ? আমি পারবো না'
--'দূর ? পাগল নাকি । স্টেশানে , যদি ট্রেন পাওয়া যায় ।'
--'চলো তবে ।'
এভাবেই পথ চলা শুরু হয়ে ছিল তেঁতুলবেড়িয়া আর বেলতলার । তারপর একটা বছর কেটেছে , কখনো স্টেশানে ঝালমুড়ি খেতে খেতে , কখনো অন্ধকারে পথ হাতড়াতে হাতড়াতে, কখনো সিনেমা হলে বাংলা হিন্দি সিনেমা দেখে , কখনো বা মানা-অভিমানে , কখনো বা আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে । কণিকার মনে দুবছর ধরে একখান প্রশ্ন দানা বেঁধে আছে । কেনই বা থাকবে না, নিভাসে মৃত্যুর রহস্য আজও অজ্ঞাত । নিভাসের মৃত্যুর পিছনে কি ছিল আসল সত্য ? কণিকার ভালোবাসা কি এতটাই কম জোর ছিল যে দেবীর বিজয়ার সাথে সাথে তলিয়ে গেল । সামান্য তো পুকুর ছিল । এক কোমর তো মোটে জল । তবুও হাজার
চেষ্টার শর্তেও নিভাসের হদিশ পাওয়া গেল না , পাওয়া গেল ভোরে রাতে । তখন নিভাসের দেহে আর প্রান নেই , একখান জড় পুতুল । অনেক কেঁদে ছিল কণিকা । দুবছর হল তার কাছে দেবীর আগমন ও বির্সজন একেবারে তুচ্ছ । আজও সে নিরামিশ খায় । মাছ মাংস নিভাসের সাথেই ছেড়েছে । বহির্জগতে আনন্দে মেতে উঠেছে গড়িয়াবাসী । গান বাজনায় গমগম করছে চারিপাশ । ধীরে ধীরে উচ্চস্বরে কেঁপে কেঁপে উঠছে বিজয়ের ধ্বনি । অভ্যন্তরের চারদেওয়াল একেবারেই শান্ত । সেখানে কোন শব্দ নেই, কেঁপে
কেঁপে ওঠা ধ্বনি নেই । সেখানে কেবল একটাই ধ্বনি , ছুরির ঠকঠকানি ।
--'এত কি ভাবছো কণি ? তোমার সময় যে ঘনিয়ে এলো ।'
--'আসুক । আমার দুঃখ নেই ।'
--'কেন ?'
--'আমি আপনার হাতে মরছি তাই ।'
কণিকার মুখে একথা শুনে বিস্মিত হয়ে গেল । একটু চুপ করে বলল - কেন ?
অন্ধকার ভেদ করে খিলখিল করে হেসে উঠল চারদেওয়ালের মাঝে ।
--'তুমি হাসছো ।'
--'হ্যাঁ'
--'ভয় করছে না'
--'কিসের ভয় ?'
মুহুর্তের মধ্যে মাথাটা তেতে উঠল । বাইরে গান বাজনার সাথে দেবীর বিসর্জন চলছে । দেবীকে সাতপাক ঘুরিয়ে সযত্নে ভাসিয়ে দেওয়া হলো । দেবী আকাশের পানে চেয়ে ধীরে ধীরে অতল জলে তলিয়ে যাচ্ছে ।
--'কণি দেবীর তো বিসর্জন হয়ে গেল , এবার তোমার পালা ।'
কণিকার চোখে মুখে এক উজ্জল হাসি , সমস্ত দেহ উজাড় করে দিল । আজ সে নিভাসের কাছে যাবে চিরদিনের জন্য ।
--'এই নাও । হত্যা করো আমার ।'
--'চোখ বন্ধ করো কণি ।'
--'হ্যাঁ করছি । তার আগে এবার আমি আপনাকে বাবা বলে ডাকতে চাই ।'
বিশ্বনাথ অবাক চোখে বলল - কেন ?
--'আমি আপনার ছেলের স্ত্রী । আপনাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছিলাম ।'
বহির্জগত একেবারে শান্ত । মুহুর্তের মধ্যে সেই বিজয় ধ্বনি, গান-বাজনা হৈই-হুল্লোড় যে কোথায় হারিয়ে গেল তার হদিশ কেউ রাখে নি । মেঘের আড়াল থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে চাঁদ । রুপালি রৌদ্র বিছিয়ে আছে চারিপাশে । জানালার ফাঁক দিয়ে রুপালি রৌদ্র বিছিয়েছে তার অন্তঃজাল চারদেওয়ালের মাঝে । মেঝেতে পড়ে ঝাঁ চকচকে একখান ছুরি । যেটা এখনো রক্তের স্বাদ পায়নি । দেওয়ালের দুকোন দুটো জীবন্ত চিত্রমূর্তি বসে । ধীরে ধীরে গভীর চাপা কান্নার শব্দ ভেসে উঠচ্ছে চারদেওয়ালের বাতাসে ।।
.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)