সোনালী মিত্র - মায়াজম

Breaking

২ নভে, ২০১৫

সোনালী মিত্র

                                                   সম্পাদকীয় বিসর্জন সংখ্যার





অথচ তারাদের মতো ভাসমান , বিদ্যমান । অথচ 'তারা' জানে পুনরায় ভাসতে গেলে , জেগে উঠতে হলে , মুছে যাওয়া দৈব সংকল্পের নির্দেশ । মুছে যাওয়াটা খুব জরুরী পুনরায় জেগে উঠবার জন্য । ধরো , সেই হাতঘড়িটার কথা , শুনেছিলে একদিন , দেখেছিলেও বা , কিংবা দেখা হয়নি , হয় না , হবে না । শুধু একটা কাঁটা  অথবা তিনটে কাঁটা  আর টিকটিক টিকটিক একটা উদ্দেশ্যে-নির্মিত শব্দ । তবে কি চলে যাওয়ার একটুকরো মাংসের মতো শব্দ থাকে ? কোথাও শুনতে পাওয়া যায় ? ১২ টার ঘর পেরিয়ে গেলে আবার ১২ টা ফিরে আসে ! আসেই , আসেই তো ! ১১টা ৫৯ বিসর্জনের সন্ধি মুহূর্ত , ১২ -টা শূন্য , ১২ টা০১ ভ্রূণের নির্মাণ , অর্থাৎ ফেরতমুখী বিমান । ফেরতযোগ্য অভিপ্রায় গুলো থাকে বলেই মানুষের মুখে সর্বদা নির্মাণের রৌদ্রসঙ্কেত । বিসর্জন একটা আর্ট । স্কুল- কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট এর মধ্যে সেই আর্ট খুঁজলে তার পতন শূন্য । বিসর্জন কাঁঠালি কলা , ঈশ্বর শুধু বোঝেন দ্বিতীয়বার ও এই কলার প্রয়োজন , তাই কলার উৎপাদন রাখেন সচল । ওই উৎপাদন বিসর্জনকে নিয়ন্ত্রণ করে । 

     'এলি, এলি লামা শবক্তানী?' কে কাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে ? কেনই বা মানুষ ডাকেন ? ঘুণপোকা টাইপের ব্যাপার হল যাওয়া বা থাকা বিষয়ক শব্দ । মনে করুন বাঁশের বা  মুলিবাঁশের বেড়া বেঢপ দৃষ্টিকলুষিত ভঙ্গীতে ঠাই বৃষ্টির সাথে ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যস্ত । আর সেই ফাঁপরে উইপোকা ভস্মজ্ঞানে বেড়া মাটি করে দিচ্ছে , দিচ্ছে , দিচ্ছিল দেবে ও বা । ধপাস পতনের শব্দ উঠল । ঘরের ছেলেটি ঝুপ করে টসে যাওয়া বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখল মাথালি মাথায় বাপধন দা- নিয়ে কুপিয়ে - কুপিয়ে কাটছে আস্ত বাঁশের ঝাঁর-মূল । আসলেই কি একটা যাওয়ার প্রয়োজন হয় আর একটা আগমনের জন্য ? সাময়িক একটা চলনের নাম বিসর্জন ! যারা চাষাবাদ করেন তারা জানেন , ফসলের নিমিত্তে একটা বীজই যথেষ্ট । একটা বীজের মধ্যেই পৃথিবীর প্রথম সমস্ত সৃষ্টির আগমনের গল্প লুকিয়ে ছিল । বিসর্জন আগে নয় । আগে আগমন , আগমনকে বিশেষণে যুক্ত করতেই বিসর্জনের উৎপাদন । বিসর্জন উৎপাদনশীল একটা অবস্থান । যেখানে বর্তমানের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা গুপ্তবিদ্যার মতো অদৃশ্য থাকে । দেখা যায় না , অনুভব করা যায় না । 

     জটিল সংখ্যাতত্ত্ব । ঢাক বাজছে । মায়েরা সিঁদুর খেলছে । কাঁসর বেজে চলেছে । জল বয়ে চলেছে জলের দিকে । কম্পাস দিক নির্ণয় করছে দিকের দিকে । একটা ঘটমান বর্তমানের ওপর চেপে বসছে বিষাদের বিস্বাদ মেঘ । মেঘটা অনেক দূর থেকে বিসর্জিত হয়ে এখানে পৌঁছেছে । ওখানের ফাটামাঠ , শুকিয়ে যাওয়া পুষ্করিণী , হলদে গাছের পাতারা ভেবেছিল বৃষ্টি হবে সেখানে । ছিটেফোঁটা হল , তারপরে বিসর্জনের দিকে এগিয়ে চলল মেঘ । অন্য দ্রাঘিমায় । অন্য রঙের পৃথিবীর দিকে । মানে কোথাও বিসর্জন মানে কোথাও আগমনী । কোথাও পাতা হলুদ তো কোথাও সবুজের মানপত্র । সময়ের কোন চিত্রটাকে রাখবে ? একটা চিত্রের মধ্যে আর একটা চিত্রের গুপ্ত অবস্থান যীশু হন্তারকরা মাপতে পারেনি সেদিন । কৃষ্ণার বস্ত্র হরণের মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত কাপড়-কলের মালিক শ্রীকৃষ্ণকে মাপতে পারেনি সেদিন ।
ইসমাইল চাচা । চাচা ৭০ বছরে স্ত্রী বিয়োগের পরে নাতি নাতনির সংসারে বুকের মধ্যে উজানটানের হাওয়ার হাহাকার টের পেলেন । চাচার ছোটছেলে সবে ২১ । কলেজে পড়ে । চাচা নিকা করলেন বছর ৩৫ এর হামেদা বিবিকে । চউখুস । ৪ ছেলের মা হামেদা । গনি মিয়াঁ মরার পরে শরীরের মাঠ ফাঁকা । তাছাড়া ইসমাইল ৪ বিঘে ধানী জমি লিখে দিয়েছে । ইসমাইল চাচার মনে পড়ে বিন্নির কথা । এত বছর প্রিতিপালন করেছে , ছেলেপুলে মানুষ করেছে , রাত হলে বিছানায় এসে শুত যখন , ইসমাইল চাচার কলজেতে বান ডেকে উঠত । হুহু হুহু হাওয়া দিচ্ছে । বিন্নির বিসর্জন হয়ে গেল । টিকটিক । খনা । হামেদা এলো । টিকটিক খনা । ইসমাইল চাচা পিঠে হাত বোলাতে - বোলাতে বুঝল , মোটেই ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় , মোটেই বিসর্জন ততটা অর্থবহ নয় যতটা মানুষ মুখে বলে । আর কপাল পোড়া হলে বিসর্জন নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায় । ছোট-ছেলেকে শেষ পর্যন্ত হামেদা গিলে নিল যেদিন , ইসমাইল খড়খড়ে নদীর পাড়ে বাবলা গাছের নীচে বসে ডাকলেন , বিন্নি দেখতে পাচ্ছ ? আর দেখল জল থেকে উঠে আসছে জলপরী বিন্নি ।

   'অঘটন আজো ঘটে । ' এমনভাবে ভাবাটা যতটা ভাবার্থ বহন করে , উদাস- উদাস বহন করে ঢের বেশি । ট্রামখানা চলছিল ঝিকঝিক ঝিকঝিক । পিচ রাস্তা । 'বাংলার মুখ' কি কলকাতার পিচ রাস্তার সঙ্গে মিশে নাগরিক ঘরনি হয়ে উঠতে পাড়ে ? দোয়েল ফিঙ্গে কাকাতুয়া লক্ষ্মীপেঁচা এই শহরের ছাদের বনসাই বাগানে ছেড়ে দিলে কেমন হয় ? অথবা সুইমিং পুলের প্রস্রাব মিশ্রিত জল তুলে নিয়ে ডাইরেক্ট গাঙ্গুর বা ইছামতী যদি তুলে আনা যেত ? ছেলেরা গুছিয়ে সাঁতার কাটত কি ? না , ভিড়ভাট্টা কোলাহল ধান্দা ফিকিরের শহর ভাল লাগছে না । বরিশালের কলেজ চাকরিটা পেতেই হবে ...
আর তক্ষুনি বিসর্জনের মাতম । ভুস । হাওয়া শেষের বেলুন মুখ থুবড়ে গোত্তা খেয়ে ট্রাম লাইনে । রে রে তেড়ে এলেন মানুষ । হাসপাতাল । গোল্লাছুট শেষ । শেষ । বিসর্জন শেষ । ও হরি , এইটুকুর নাম বিসর্জন ? যা হরি , এর জন্য এত মারামারি ।

এসব দেখে ভিখারিনী কান্না অনুচিত মনে করলেন । জল কি এতই সস্তা ? কান্নার মতো দিস্ত্রিল ওয়াটার পাওয়া এত সহজ নয় । যদি কাঁদতেই হয় বৈকুণ্ঠে গিয়ে কাঁদব । দিস্তিল ওয়াটারের অপচয় রোধের নিমিত্তে সেদিন থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কান্না স্থগিত রেখে দিলেন ভিখারিনী । তিনি এখন ''সাইকেলের দুদিক চাকা মধ্যে ফাঁকা '' গান গান ট্রেনে । বেশ দু'পয়সার মুখ দেখেন , শ্রোতারা উৎসাহী হয়ে বায়না করে মাসি , ' নিশি রাতে সিঁদুর পরে বেটি পালাইছে' গাইতে । ঝকঝক কণ্ঠে মাসি গেয়ে দেন , নেমে যান পরবর্তী ষ্টেশনে ...
এসব বিসর্জনের দৃশ্য সংগ্রহ করে রাখেন নিতাই পাগলা । নিতাই পাগলাকে উপেক্ষা করার মতো কিন্তু নই । আকাশের দিকে চেয়ে বলে দিতে পাড়ে ঝড় উঠবে , আজকে বৃষ্টি হবে , আজকে এক্সিডেন্ট হবে । পাবলিক নিতাইয়ের পাগলামিকে মোটেও পাত্তা না দিয়ে অফিস যায় , বাড়ি ফেরে , বিড়ি খায় ...
কিন্তু , এসব কোনটাই নিতাই মিথ্যা বলেনি আজপর্যন্ত । নিতাইয়ের গণনা ভুল প্রমাণিত করতে পারেনি স্বয়ং ঈশ্বর । কোথাও ও তো বিসর্জন হচ্ছেই , কোথাও তো হচ্ছেই , তোমার দৃষ্টি যদি ছোট থাকে তাহলে মিতাইয়ের দোষ দেওয়া কি যায় ?

কোথাও ঘটছে , হচ্ছে এটাই হল আসল ব্যাপার । বিসর্জন ব্যাপারটা সীমান্তে প্রহরারত প্রহরীর গুলি ছোরার মতো অবস্থান । একটা গুলি ছুড়লে তাতে রক্ত একটু না একটু লেগে থাকবে । আর এত জীবাত্মা আছে বলেই তাকে দ্বিতীয় গুলি ও ছুড়তে হয় বিসর্জন ঘটানোর নিমিত্তে । একটা প্রসেস । নিরিবিচ্ছিন্ন ও সমান্তরাল একটা ঘটনার আবহ । বিসর্জন একটা পরবর্তী কাজের বা পরবর্তী ঘটনার বা পরবর্তী অবস্থানের প্রাক-মুহূর্ত । ফুল ঝরে যাওয়ার মুহূর্ত যেমন বিসর্জন , ফুল ফুটবার মুহূর্ত ও তেমন ই বিসর্জন ।
এবার মায়াজম এমন কত বিসর্জনের সুর তুলেছে ভায়োলিনে । পড়তে হলে আপনাদের খুলত হবে মায়াজম ব্লগজিন । অসংখ্য এমন বিসর্জনের সুর বেঁধেছেন এসময়ের শিল্পীরা । তাহলে আর দেরি কেন ? আসুন আমাদের সঙ্গে ।
এবারের সংখ্যায় যে- লেখার সঙ্গে যে সমস্ত ছবি দেখবেন , সেই ছবি গুলি তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের তোলা , তাকে ধন্যবাদ জানাই । 


                                                                           সোনালী মিত্র ( মায়াজম ) 
২রা নভেম্বর ২০১৫ , নিউ দিল্লী 


৪টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র