রৌপ্য রায়

মায়াজম
0
                               অন্ধকারের বিভীষিকা                      















ঘোর অন্ধকার সামনের হাত দুয়েক তো দূরের কথা , এক ইঞ্চি দুরে পর্যন্ত কিছু দেখা যাচ্ছে না । মাথার উপরে দুয়েকটা তারার আলো ছাডা রাস্তার কোন ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলছে না । বৈকালের প্রকাণ্ড ঝড়ে বিদুত্‍বাহী তার গুলোর যা হাল হয়েছে তাতে দু-একদিন বিদ্যুৎ আসবে বলে মনে হয় না । এমন নিচ্ছুক অন্ধকার আমি বাপের জন্মেও দেখিনি । রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বসন্ত মনে মনে ভাবতে লাগল কেন যে মরতে বন্ধুর জন্মদিনের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলুম কে জানে । আজ পথ হেঁটে ঘরে ফিরতে পারবো তো ! শীতের রাতে তো দুরের কথা সন্ধ্যা নামলে গ্রামের রাস্তায় কয়েকটা কুকুর ছাড়া কাউকে দেখা পাওয়া দায় । গ্রামটা যে একবারে অজপাড়া গাঁ তা বললেও চলে না । অল্প বিস্তর আধুনিকতা লক্ষ করা যায় । মাঝে মাঝে দুরে কুকুরের ঝগড়ার শব্দ , শিকারের আশায় বসে থাকা পেঁচার অব্যর্থ ডাক , জানালার দড়াম দড়াম ঝাপটার শব্দ কানে ভেসে আসছে । রাস্তায় জনমানবের কোন চিহ্ন মাত্র নেই । ইতি মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে দুয়েক বার জোরালো হোঁচট ও খেয়েছে । আর একটু হলে দাঁত মুখ হয়তো এক হয়ে যেত । রাস্তার ধারে গাছগুলোকে দেখে মাঝে মাঝে আঁতকে উঠছিল বসন্ত । যেন এক একটা প্রকাণ্ড দৈত্য এসে দাঁড়িয়ে আছে । মিনিট পৌনেরো হাঁটার পরে প্রথম সমস্যার সামনে পড়তে হল । দুর থেকে কিসের দুটো চোখ যেন মিটমিট করে জ্বলছে । ভয়ে মুখ থেকে কোন কথা বের হল না, চুপ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল বসন্ত । ধীরে ধীরে চোখ দুটো ক্রমশ এগিয়ে আসছে । কি হতে পারে ? গুটি মেরে বাঘ বসে নেই তো ! এই এলাকায় বাঘ যে আসে না । এমন কথা কোন দিন শোনা যায় নে বাপু । মাঝে মাঝে নদী পার হয়ে একটু আধটু আনন্দ করতে আসে বটে । চোখ দুটো ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে আসছে । চোখ দুটো যখন কাছে এসে ম্যাউ করে উঠল । তখন বসন্তর ভয়টা কাটল । একটা সামান্য বিড়াল যে এত ভয় পাইয়ে দিতে পার বসন্তর ধারনা করতে পারে নি । সুতরাং বেড়ালের উপর গজগজ করতে করতে বলল - হতচ্ছাড়া , পাঁজি বেড়াল আর একটু হলে আমার জীবনটা পাঁকে ফেলে দিচ্ছিল । নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বসন্ত আবার হাঁটতে শুরু করল । রাস্তার ধারে বড়ো বড়ো গাছের পাতার সরসর শব্দ মাঝে মাঝে গা ঝাঁকুনি দিয়ে কাঁটা মেরে উঠছিল । অন্ধের মত পথ হাতড়ে কিছুটা যাওয়ার পর বসন্তর মনে হল সে কাদায় পা তুলে দিয়েছে । এক হাঁটু কাদা ঠেলে কোন রকমে পা তুলে নিতেই বাতাসে একটা পচাটে দুর্গন্ধ নকে ভেসে এল । বসন্তর আর বুঝতে বাকী রইল না । যেটাকে সে কাদা ভাবছে সেটা আসলে কাদা নয় রাস্তার ধারে রাখা পচা গোবরের তাল । বসন্ত তাড়াতাড়ি রাস্তায় এসে দুর্ভেদ্য অন্ধকার ভেদ করে আবার হাটতে লাগল । উফ ! পচা গোবরের গন্ধে গলা থেকে যেন অন্নপ্রাশনের ভাত ঠিকরে বার হয়ে আসতে চায় রাস্তার ধারে বড়ো বাড়ি দেখে বসন্তর মনে হল এটা রাই বাহাদুরদের বাড়ি । যদি কোন মতে আর এক কিলোমিটার যেতে পারি তাহলে বাঁচি । ভাবতে ভাবতে পথ হাঁটতে লাগল । একটু আলো থাকলে হয়তো কয়েক মিনিটে ঘরে যেতে পারত । কিন্তু ঘোর আমাবস্যার গভীর অন্ধকার বসন্তকে কি সাংঘাতিক বিপদে না ফেলেছে । মিনিট কয়েক হাঁটার পর বসন্তর লক্ষ পড়ল একটু উপরে , মিটমিট করে দুটো আলো জ্বলছে । না তারা নয় । তারারা কয়েক হাত দুরে দুমানুষ উঁচুতে কেন জ্বলবে ? তাহলে ওই দুটো কি জ্বলছে ? বসন্তর মাথায় আবার বিনা মেঘে বজ্রপাত পড়লো । বসন্তর বেমালুম ভুতের ভয় । সন্ধ্যা হলে কোন দিন সে বাহিরে বার হয় না । এমন কি কারোর মুখে কোন গল্পই শোনে না । তবে কি আজ তাকে সত্যি সত্যি ভূতে ধরল । দূরে থেকে কুকুরের গোঙানি কান্না কানে ভেসে আসতে বসন্ত একটু শিউরে উঠল । সে লোকের মুখে শুনেছে কুকুর কাঁদলে নাকি মানুষের জীবন নিয়তি নাকি শেষ হয়ে আসে ।

-- তাহলে কি আজ তার শেষ দিন । কথাটা ভাবতেই বসন্তর চোখে জল এসে গেল । কান্না চেপে রেখে একটু সামনের দিকে এগিতে যাবে এমন সময় দুরে ঝিঝির রি-রি ডাক কানে ভেসে এল । বসন্ত ছোট ছোট পায়ে সামনের দিকে বার দুয়েক পা ফেলেছে এখন সময় হলকা হাওয়া বইল । হালকা হাওয়ায় আলো দুটো ক্রমে উড়ে আসছে তার নিজের দিকে । আলো দুটো উড়ে আসতে দেখে বসন্তর জীবন শেষ বসন্তে পৌঁছে গেল । নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে পিছন ফিরে সবে দৌড়াতে যাবে অমনি পা পিছলে সোজা হরিদের পুকুরে ঝাঁপাস করে পড়ল । ঝাঁপাস ! ঝাঁপাস ! শব্দ শুনে হরির বাবা বলে উঠল - কোন হনুমানের বাচ্চা মাছ ধরছিস ? হরি , ওই হরি পুকুর ধারে গিয়ে দেখ তো । হরির বাবা পুকুর পাড়ের জানালা খুলে সোজা পুকুরে এপার ওপার টর্চ মারল ।
' আরে বসন্ত এই শীতে তুই পুকুরে কি করছিস ? ' বসন্ত অপ্রস্তুত ভাবে উত্তর দিল - কাকু অনেক দুর থেকে আসছি , খুব গরম লাগছিল । তাই ভাবলাম স্নানটা সেরে যাই । হরির বাবা টর্চ নিভিয়ে জানালা বন্ধ করে দিল । আলো দুটো ততক্ষণে উড়ে এসে ঘাটের কাছে জবা গাছে এসে বসেছে । শীতে বেমালুম কাঁপতে কাঁপতে বসন্ত ঘাটে এসে দাঁড়ালো । মাথা নিচু করে ভালো করে বেশ কিছুক্ষণ দেখল । তারপর বসন্ত ফিক করে হেসে বলল - যা দুর হ । আলো দুটো আসলে আর কিছু নয় ডেমরা ডেমরা দুটো জোনাকি পোকার আলো । হরিদের কেবেল তারে অল্প দূরত্বে বসেছিল । ঘাট থেকে রাস্তায় এসে আবার হাঁটে শুরু করল । কোন রকমে আর পঁচিশ তিরিশ পা হাঁটতে পারলে হলো - সোজা বাড়ী । হালকা শীতে জলে পড়ে যা দশা হয়েছে তা আবার বাহিরে । ভেজা কাপড়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে পথ হাঁটছে । শীতের কাপড়টা গায়ে থেকে খুলে হাতে নিয়ে বেশ কয়েক পা যেতে এবারে আর আলো নয় দুমদুম শব্দ কানে এলো । শব্দটা আসছে ওই পোড়বাড়ির দিক দিয়ে ।
লোকে পোড়বাড়ি বলে ওই দিকে কেউ যাওয়া তো দুরের কথা চোখ তুলে কেউ তাকায় না । পাড়ার লোকেরা নাকি ওই বাড়িতে ভূত দেখেছে । কথাটা যেই মনে পড়ল বসন্তর দেহে থেকে প্রাণটা যায় যায় অবস্থা । ভিজে কাপড়ে আরো বেশি কাঁপতে লাগল । মনে মনে রাম রাম জব করতে লাগল আর ভাবল তাহলে কি ঘরের কাছে এসে আর ঘরে যাওয়া হবে না । দাড়িয়ে দাড়িয়ে নানান কথা চিন্তা করতে লাগল । এমন সময় পিছন থেকে কে যেন এসে বলে উঠল - হ্যাঁ বসু এখানে দাড়িয়ে কি করছিস ? জলে বা ভিজলি কি করে ? কথাটা শুনে বসন্তর বুক ধড়াস করে উঠল । ভয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল - কে ? কে ? ' কে ? কে ? মানে আমি তোর কাকা । এখানে দাড়িয়ে কি করছিস । চল বাড়ি চল । 'কাকার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বসন্ত বলল - কাকাই ওটা কিসের শব্দ ? কাকা একগাল হেসে বলল - ওটা তো মনি কামারের হাতুড়ি পেটার শব্দ । মনে হচ্ছে বসু ! তুই খুব ভয় পেয়েছিস ।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)