রুখসানা কাজল

মায়াজম
0
                                       ভালবাসার আরেক নাম প্রতীক্ষা









  এসএমএস টা পড়েই রাগ ধরে যায় রুমকির। রাগের চোটে  প্রথমেই ভাবে অসম্ভব কিছুতেই ও যাবে না এই অনুষ্ঠানে । অসহ্য এদের সঙ্গ ।  অশুদ্ধ  উচ্চারণে দুজন পুরুষের অনবরত ফিজিক্যাল ইয়ার্কি মেরে ছুঁকছুঁক করা কত সহ্য করা যায় ! রুপু অবশ্য খুব তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে কিন্তু রুমকির গা জ্বলে যায় ঘেন্নায়। ধ্যুত যাবে না রুপুর জন্মদিনে। পরে স্যরি টরি বলে দেবে ভাল কিছু গিফট দিয়ে।   
                  রাগ ফেলে রেখে কনকর্ডের উপর নীচ শক্তির কবিতার  বই  খোঁজে ও । আশ্চর্য একটুকরো  শক্তি নেই কোনো দোকানে। অথচ ওর মাথার মগজের কুয়োর ভেতর আজ কদিন ধরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য। বুকের ভেতর যখন তখন তুমুল বৃষ্টি নামাচ্ছে মন খারাপের কালো মেঘেরা, ভারী  ব্যাপক কষ্টের সেই রক্তবৃষ্টি । খুব মনে পড়ছে আদিত্যকে। খুব।  চাপ চাপ বিস্মৃতি ঠেলে স্পষ্ট হয়ে উঠছে আদিত্যের স্পর্শ, ঝগড়া, বিচ্ছেদ, সুখের  টুকরো টুকরো আলো ছায়া। 
                   পায়ে পায়ে সিঁড়ি ভাঙ্গে। নীচের দোকানগুলি দেখবে বলে।  ভেতরের কষ্ট ছড়িয়ে পড়ছে শরীরে । যেন যন্ত্রণার ঢেউ পেরুচ্ছে এভাবে তিনটে সিঁড়ি নেমে আবার উঠে আসে কাক প্রকাশনীতে। সাদা কবুতরের মত মেয়েটি হিসাব মেলাচ্ছিল।রুমকিকে দেখে হেসে ফেলে। ফিঙ্গের মত পনিটেল নেড়ে জানায়, আপু সবাই এখন একুশ নিয়ে ব্যস্ত । শক্তি চাইলে আজিজে যেতে হবে আপনাকে।  
                   রাগের ভোল বদলে যায় মেয়েটির চমৎকার সাজানো দাঁত দেখে । দুপাশের ড্রাকুলা দাঁত দুটি ঝকঝক করছে। রুমকিকে খুব ক্ষেপাতো আদিত্য ড্রাকুলা  সুন্দরী বলে। আদিত্যার ভীষণ পছন্দের দাঁতে ধারও ছিল অসম্ভব ।  রুমকি  অনায়াসে কুট করে কেটে ফেলতে পারত কাগজ সুতো, কাপড়, চিপস চকোলেটের  প্যাকেট। রেগে গেলে কি শীৎকারে এই দাঁত ছিল রুমকির মোহন অস্ত্র। লিটল  ম্যাগগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বুকের কোথাও মেঘ ভেঙ্গে পড়ার শব্দ হয়। এই লিটল ম্যাগে কবিতা দেওয়ার সুতো ধরেই তো আদিত্য এসেছিল  ওর জীবনে। ছন্দ বুঝতে বুঝতে কখন যেন মিলে গেছিল দুজন। ওদের ভাবসাব দেখে রুপু অবশ্য  আগেই সাবধান করেছিল, শোন তোকে তো চিনি হ্যাংলা প্রেমে তোর খুব আগ্রহ। আদিত্যদের কিন্তু দিন আনে দিন খায় অবস্থা। টাকা নাই তো প্রেম নাই কথাটি মনে রাখিস।  
                     দোতলায় শক্তি না পেয়ে নিজেকে বকে রুমকি, কি খুকি কেমন লাগে এখন ?  ইমোশনের ঘিয়ে ভাজাপোড়া হয়ে খুব তো বইগুলো ফেলে দিলে। ওগুলো থাকলে কি এমন ক্ষতি হত শুনি!  কয়েকটি অক্ষরেই তো ছিল শুধু  আদিত্যর নাম। বইগুলোর পাতা উল্টালেই নামটি যেন রক্ত মাংসের শরীর পেতো। আর রি রি করে রাগ বেড়ে যেত রুমকির। স্মৃতি হিসেবে কিছুই রাখতে চায়নি। যতগুলো বইয়ে আদিত্যর নাম ছিল রাগে কাঁপতে কাঁপতে কিছু বিলিয়ে দিয়েছে বাকিটা ফেরিওয়ালা ডেকে বিক্রি করে সেই পয়সায় এস্প্রো কফি খেয়েছে। সাদা গোলাপি টিস্যু পেপারে ঠোঁট মুছতে মুছতে মুছে ফেলতে চেয়েছিল সব চুমুর উষ্ণতা । আহ রাগে অভিমানে, ঘৃণায়, বিশ্বাস অবিশ্বাসে এখনো আদিত্য এসে দাঁড়ায়।  মাথা ঝাঁকায় রুমকি, হেট য়ু আদিত্য, ফাকার লুজার মাই ফোট!   
                      খুঁজে পেতে রিলকের কবিতা নিয়ে বেরুনো  একটি ছোট পত্রিকা কিনে যখন বেরিয়ে আসবে নাকে মুখে নোংরা একজন পুরুষকর্মি স্মার্ট হওয়ার প্রচেষ্টায়  শুদ্ধ বাংলায় ইম্প্রেস করার চেষ্টা করে, শক্তি পেলেন ম্যাম ? রুমকি ফিরেও তাকায় না। গা গুলিয়ে উঠে। বমি পায়। সাতদিন সাতরাত সাবান  ঘষলেও এরা পরিষ্কার হবে না এ  জন্মে । ভ্যাক! সরে আসে কিছু না বলে। আজিজেই যাবে। শক্তিকে তার চাই ই চাই ।  আজকেই। এক্ষুণি। 
-- আমাকে বিয়ে করতে পারবে আজ এখুনি ? আদিত্যর চেক শার্টে চুঁইয়ে পড়ছে ধবল আমন্ত্রণ।   
রুমকি হেসে লুটিয়ে পড়েছিল।
-- খুব হ্যাঁ । কি এমন শক্ত কাজ। বিয়েই তো মাত্র । চলুন। চলুন।
আদিত্য সিরিয়াস মুখ করে বলেছিল
গরিব হয়ে যাবে কিন্তু। এই যে রানী ফড়িঙয়ের মত রঙ্গিন উড়ছ পারবে না আর।  
রুমকি আদিত্যর হাত ধরে বলেছিলআমি গরিব হব আদিত্য।  
                     কনকর্ডের লাস্ট সিঁড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল । তিনবার জুতো খুলে গেল পা থেকে। কারো হাত ধরে সিঁড়ি ভাঙতে, রাস্তা পেরুতে, লম্বা পথে পা মেলাতে কি যে আনন্দ। একটু হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি খেয়ে উহ আহ করা! আজন্মের লতাগাছ রুমকি। আগে কাঁটা ছিল না। এখন কাঁটাযুক্ত কুঞ্জলতা।  ভালবেসে কেউ কাছে আসতে চাইলেই কাঁটাগুলো পটপটিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আড়ালে অনেকেই বলে, মুডি। কি আছে এত মুড দেখানোর। ঐ-তো একটি দুটি ছক্কাপাঞ্জা কবিতার বই!   
                       নীচতলায় সুন্দর করে সাজানো পরিচিত দোকানটিতে ঢুকে  জানতে চায়, শক্তি এনেছেন ? না নেই । তিনমাস ধরে বলেই যাচ্ছে ফুরিয়ে গেছে  দিদি। এই ত আনব শিগগীর। অনেকগুলো গালি দিতে দিতে বেরিয়ে আসে রুমকি। পাশ থেকে একজন লেখক প্রকাশক ফাজলামো করে, দিদি শক্তিতে কি পাবেন গো ? মদের জালা চাইলে আরো অন্নেক্কেই আছে ন্নতুন পুরান্নো ---   
রুমকি হেসে ফেলে --নারে আমার শক্তিই চাই।
দুষ্টুটি ত্যাদরামো করে, ওরে দিদিকে চা করে দে। চেনি এট্টু  বেশি ফেলিস। বড় শক্তিহীন নাগচে গো তোমাকে দিদি।
                       রুমকি হেসে কিল দেখিয়ে বেরিয়ে আসে। নির্জন লম্বা ফাঁকা করিডোরে একা হাঁটতে রুমকির খুব ভাল লাগে। অনেক কালের প্রিয় অভ্যাস ।  এরকম ঝুম সময়ে নৈঃশব্দ খুব ঘন হয়ে কাছে আসে। নোখের নেইলপালিশ ছুঁয়ে গোড়ালি জুড়ে শুয়ে থাকা রূপার মলে সশব্দে চুমু খায় । রুমকি এদিক ওদিক তাকিয়ে চকিতে একটু নেচে নেয়। তারপর আয়না খোলে শব্দহীন চপলতায়। আয়নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে শিশু রুমকি, বালিকা রুমকি, কিশোরী রুমকি, ভুলেভরা তরুণী রুমকি। ঝমঝম নেচে যায় ওর পা। মাত্র কয়েক সেকেন্ড!       
                      সন্ধ্যা উতরে যাচ্ছে । ঘরে ফিরতে হবে এবার। এখানে এলে দুই প্রকাশকের অফিসে বসে দুই বন্ধুর সাথে কথা বলে দুই রকমের  অনুভূতির স্বাদ নেয় সে। যাবে কি যাবে না ভেবে শেষ পর্যন্ত দেখা করে। অল্পবয়সি প্রকাশক মেয়েটি চনমনে।  অন্য জন জীবন যুদ্ধে সাঁতরাচ্ছে । কখনো শ্যাওলায়, কখনো বা কচুরিপানার চুলে আটকে যাচ্ছে ওর পা। ফেলে আসা বৈভবের গল্প বলতে বলতে  কখনো থেমে যায়। খেই হারিয়ে কথা হাতড়ায়।  আর তখন করুণ হলুদ হয়ে উঠে চোখ দুটি। রুমকির মনে হয় একটি বেলুন আস্তে আস্তে চুপসে যাচ্ছে। ও হাত ছুঁয়ে বলতে চায় , থাক না এসব । যা গেছে তাতো ফিরবে না আর।
                       কিছুই বলা হয় না। বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে প্রেম।   সন্ধ্যার অন্ধকারে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরছে রুমকি।  রিকশার অন্ধকার গুহায় অসংখ্য শব্দ আর জ্যামে ওর কান্না ডুবে যাচ্ছে।
                                                     

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)