সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

৬ মে, ২০১৬

সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

                   

মায়া




একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থামল ট্যাক্সিটা। ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ লেগে এসেছিল। কতদূর এলাম কে জানে? চোখ খুলতেই ড্রাইভারের সামনে রিয়ার ভিউ মিরর থেকে ঝোলানো পুতুলটার দিকে চোখে পড়ল। কাল থেকে এই নিয়ে তৃতীয় বার দেখলাম পুতুলটাকে। ছেঁড়া সাদা কাপড় পুঁটলি পাকিয়ে বানানো। পরনে ফ্লোরেসেন্ট সবুজ রঙের ফ্রক। সম্ভবত পুরোন শাড়ি কেটে তৈরি। অপটু হাতে আঁকা চোখ মুখ। দুই গালে লাল রঙের ছোপ। চমকে উঠলাম। ট্যাক্সিতে ওঠার সময় নজরে পড়েনি। দু-হাতে ভাল করে চোখ ঘষে আবার তাকালাম। চলমান আলো-ছায়ায় সদ্য চেনা কুরূপা পুতুলটা যেন দাঁত বার করে হাসছে।

সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরিই হয়েছিল। খালি ট্যাক্সিটা টি-বোর্ডের সামনে থেকে পেয়ে গিয়েছিলাম। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছিল। মনে হচ্ছিল আজ অফিস না এলেই হত। নেহাত বিদেশী ডেলিগেটদের সঙ্গে জরুরী মিটিং ছিল। তাই বাধ্য হয়ে। চোখ দুটো জ্বালা করছিল। গত রাতে ভালো ঘুম হয়নি। রাত তিনটের সময় ফোনটা এসেছিল। অন্যদিকে একটা কর্কশ কন্ঠস্বর, “আপনাকে এখুনি একবার আসতে হবে।”
সেই থেকে জেগে। ভোরবেলা দিল্লী রোডে ট্রাকের নীচে থেকে দোমড়ানো মোচড়ানো হলুদ রঙের ট্যাক্সিটাকে টেনে বার করার সময় দ্বিতীয় বার দেখেছিলাম পুতুলটাকে। কালিঝুলি মেখে ধাতুর চাঙ্গড় থেকে ঝুলছিল। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একমাত্র পুতুলটার অবয়বই চেনা যাচ্ছিল। পাশে দাঁড়ানো পুলিশ অফিসারটি বলছিল, “ভাল করে দেখুন, এই ট্যাক্সিটাই তো?”

বললাম, “তাই তো মনে হচ্ছে।”

মায়ার রক্তাক্ত শরীরটা তখন ট্যাক্সির ভেতর থেকে বার করছিল ওরা। কানের দুল, গলার হার, অনামিকার আংটি দেখে সনাক্ত করলাম। ড্রাইভার ছাড়া গাড়ির ভেতর আর একটি ক্ষত-বিক্ষত মৃত দেহ। কোনো যুবকের, পিছনের সীটে, মায়ার পাশে। পরিচয় জানার উপায় নেই। কে ছিল মায়ার সঙ্গে? মায়ার অফিসের কেউ? কোনো বন্ধু? জানি না। মাথা টলছিল। রাস্তার ওপরেই বসে পড়েছিলাম। অফিসারটির বোধহয় দয়া হল, চোখ কুঁচকে বলল, “এখন যান, পরে আবার কন্ট্যাক্ট করবো।”

ট্যাক্সিটা জ্যামে পড়ে দাঁড়িয়েছিল। আবার চলতে শুরু করল। জানলা দিয়ে শীত হাওয়া আসছে। বাইরে তাকিয়ে মনে হল দক্ষিণেশ্বরের ব্রীজ পেরোচ্ছি। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাচ্ছেন? সাউথের দিকে নিতে বললাম যে আপনাকে।”

সে কোন জবাব দিল না।

আমি আর মায়া দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়েছিলাম। পায়ের কাছে জল ছলছল করছিল। মায়া জিজ্ঞেস করল, “আমাকে আকাশের মত ভালবাসতে পারবি?”

“কে আকাশ? তোর কোন পূর্ব প্রেমিক?”

“দূর বোকা! মাথার ওপর এতখানি খোলা নীল। জিজ্ঞেস করছিস কে আকাশ। এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়...।”

আমি ঘাড় গোঁজ করে বললাম, “আকাশে যে মেঘ জমে...।”

“জমুক মেঘ, তবু তার কত রঙ...।”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “নাঃ, তবে চাস যদি আমি তোকে কালবৈশাখীর ঝড়ের মত ভালবাসতে পারি।”
 “সে তো মুহূর্তের। সব ওলোট পালোট করে দেয়।”

“ঠিক, দামাল ছেলের মত। জানলার কপাট টেনে বন্ধ করার আগেই ঘরে ঢুকে পড়ব। চুল এলোমেলো করে দেব। দুহাত দিয়ে শাড়ির আঁচল সামলে রাখতে পারবি না।”

মায়া লজ্জা পেল, “নাঃ আমার চাই না অমন দস্যি বৃত্তি।”

“আচ্ছা, তবে আমি তোকে বনবাসী শবরের মত ভালবাসব। বনের মধ্যে একটা পর্ণ কুটীর বানাব। আমি পাখি শিকার করে আনব আর তুই জঙ্গল থেকে গাছের ভাঙা ডাল কুড়িয়ে আনবি। পাখিগুলো আগুনে ঝলসে দিবি। দুজনের দিব্যি চলে যাবে।”

“তুই একটা বন্য বর্বর।”

তবু আমরা ঘর বেঁধেছিলাম। পর্ণ কুটীর নয়, দক্ষিণ কলকাতায় একটা দু-কামরার এপার্টমেন্ট নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এক ছাদের নীচে থাকতে থাকতে হয় তো কোনোদিন মায়া আকাশ খুঁজে পেয়ে যাবে। আর আমি বনাঞ্চল। খুঁজতে খুঁজতে বয়স বেড়ে যাছিল। আর পৃথিবীর সব আকাশ ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় কালো হয়ে যাচ্ছিল। সব বনাঞ্চল আড়াল করে কংক্রিটের মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং উঠছিল।

গত কাল রবিবার ছিল। মায়া আমাদের যৌথ এপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। জানতাম যাবে, সম্পর্কটা কিছুতেই দাঁড়াচ্ছিল না। যতটা স্পেস চাইছিল মায়া, দিতে পারছিলাম না। ঘরের মধ্যে কি আকাশ পেড়ে আনা যায়? মায়া কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। জেদ করছিল। বড় স্যুটকেসটা হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে টেনে মায়া ট্যাক্সির ডিকিতে তোলার চেষ্টা করছিল। আমি হাত লাগালাম। মায়া বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ।”

বললাম, “সত্যিই চললি?”

যেন তখনও সন্দেহ ছিল। মায়া মুখ ঘুরিয়ে নিল। আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে গেল। আমি ট্যাক্সির জানলায় হাত রেখে ভিতরে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাচ্ছিস? কার সঙ্গে?”

মায়া উত্তর দিল না। ট্যাক্সিটা স্টার্ট দিল। আমি ড্রাইভারের দিকে ফিরে বললাম, “এক মিনিট, ভাই।”

দেখলাম রিয়ার ভিউ মিরর থেকে পুতুলটা দোল খাচ্ছে। তখনই প্রথমবার দেখেছিলাম পুতুলটাকে।
 আপাতত ট্যাক্সিটা ব্রীজ পার হয়ে নিরবিচ্ছিন্ন ছুটছে। হাতের ঘড়িতে চোখ নামিয়ে দেখলাম রাত প্রায় সাড়ে এগারো। এতক্ষণ চলেছি। ঘুমের মধ্যে বুঝতেই পারি নি। চোখ সরাতে গিয়ে থমকে গেলাম। ঘড়ির ডায়ালে দিন আর বার রবিতেই আটকে আছে। রবি বার? মানে গত কাল? ঘড়িটা চোখের কাছে এনে দেখলাম সেকেণ্ডের কাঁটাটা দিব্যি চলছে, যেমন চলে। আজ কত তারিখ? কী বার, রবি না সোম? জানাটা ভীষণ জরুরী। হঠাৎ সন্দেহ হল আজ ভোর থেকে যা যা ঘটেছে সেগুলো আদৌ সত্যি নাকি আমার কল্পনা? কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল। ভয়ের হিম স্রোত নামছিল শিরদাঁড়া বেয়ে। কালকে ট্যাক্সিতে মায়ার সঙ্গে কে ছিল? আমার অসাড় হাতের ওপর কেউ ভিজে হাত রাখল। আবছায়ায় ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম মায়ার কমনীয় মুখ। রাগ করে নেই আর। একটু যেন ভয়ই পেয়েছে। আমাদের দুজনকে নিয়ে ট্যাক্সিটা দিল্লী রোডের দিকে ছুটছে। সময়ের অন্যদিক থেকে আসা ট্রাকের হেড লাইটের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। আবশ্যম্ভাবী গন্তব্যে পৌঁছোনোর অপেক্ষায় আমরা পরস্পরের হাত জড়িয়ে বসে আছি। এখন থেকে ঠিক সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে, আমাদের খালি এপার্টমেন্টে টেলিফোনটা বেজে বেজে থেমে যাবে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র