তুষ্টি ভট্টাচার্য

মায়াজম
4










                             দেখার দর্শন




'দেখা' মানে যদি চোখ দিয়ে দেখা বুঝি, তাহলে বলতে হয় এই দেখার রকমটি একেক জনের একেক রকম। একজন শিল্পীর দেখার সঙ্গে একজন মারোয়াড়ী ব্যাবসাদারের দেখার বিস্তর ফারাক। একজন শিল্পী একটি ফুল দেখলে তার সৌন্দর্য নিয়ে ভাববেন, তার সৌন্দর্যের রহস্য নিয়ে ভাববেন। আর একজন ব্যাবসাদার ফুলটি কত মহার্ঘ (টাকার হিসেবে) তার হিসেব কষবেন। আবার এমনও হতে পারে ওই ব্যাবসাদার হয়ত পেশা সূত্রে ব্যাবসা করেন, কিন্তু মনটি তাঁর শিল্পীর। তাহলে তিনি নিশ্চই দুরকম সম্ভাবনার কথাই মাথায় আনবেন। এইরকমটা ওই শিল্পীর ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য হতে পারে।
এই দেখার বাইরে যে দর্শন বলতে তত্ত্বের কথা আসে, তার রূপ আর প্রকাশও বিভিন্ন জনের বিভিন্ন। মতবাদ আর ধারা উপধারায় এই দর্শন শাস্ত্রের তল পাওয়া আমাদের কাছে দুরূহ হয়ে ওঠে। খুব সাদা অর্থে বা সংক্ষেপে বলতে গেলে -
নন্দনতত্ত্ব (Aesthetics) দর্শনের একটি শাখা যেখানে সৌন্দর্য, শিল্প, স্বাদ এবং সৌন্দর্য সৃষ্টি ও উপভোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়। আরও বৈজ্ঞানিকভাবে বললে বলতে হয় নন্দনতত্ত্ব মানুষের সংবেদনশীলতা ও আবেগের মূল্য এবং অনুভূতি ও স্বাদের বিচার নিয়ে আলোচনা করে। আর একটু স্থূল বা বৃহৎ অর্থে বিশেষজ্ঞরা বলেন, নন্দনতত্ত্ব শিল্প, সংস্কৃতি এবং প্রকৃতি নিয়ে সূক্ষ্ণ ও সমালোচনামূলকভাবে আলোচনা করে। যা থেকে আনন্দ পাওয়া যায় বা যার দ্বারা আনন্দ দেওয়া যায়, তাই নন্দন। যেহেতু আনন্দের উৎস সৌন্দর্য তাই নন্দন শব্দের অন্য অর্থ হলো―সৌন্দর্য প্রদায়ক। এই বিচারে নন্দনতত্ত্বের আভিধানিক অর্থ হলো- সৌন্দর্যপ্রদায়ক তত্ত্ব। কিন্তু দর্শনবিদ্যার একটি বিশেষ শাখা হিসেবে নন্দনতত্ত্ব ব্যাপক অর্থ প্রদান করে। যতদূর জানা যায়, নন্দনতত্ত্ব শব্দটি প্রথম উল্লেখ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। 'পরিচয়' পত্রিকার ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের 'আধুনিক কাব্য' নামক প্রবন্ধে তিনি একটি বাক্যে এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন এই ভাবে− নন্দনতত্ত্ব (Aesthetics) সম্বন্ধে এজ্‌রা পৌণ্ডের একটি কবিতা আছে।'রবীন্দ্রনাথ নন্দনতত্ত্ব এবং সৌন্দর্যতত্ত্ব দুটো শব্দই ব্যবহার করেছেন। বর্তমানে Aesthetics-এর বাংলা শব্দ 'নন্দনতত্ত্ব'-ই প্রচলিত।
জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology) - জ্ঞানতাত্ত্বিক অভিযাত্রা মূলত ‘জ্ঞান কি’ এবং ‘কিভাবে এটি অর্জিত হতে পারে’- এ-প্রশ্নগুলো নিয়েই। যেকোনো বিষয় বা সত্তা সম্পর্কে কী মাত্রায় জ্ঞান অর্জন করা যায়- এটা নিয়েও আলোচনা চলে। জ্ঞানের স্বরূপ বা প্রকৃতির দার্শনিক বিশ্লেষণ এবং এটি (জ্ঞানের স্বরূপ) কিভাবে সত্য, বিশ্বাস ও যাচাইকরণ ধারণার সাথে সম্পর্কিত- বেশিরভাগ বিতর্ক এটাকে কেন্দ্র করেই। বাইসাইকেল চালনার সময়ে ভারসাম্য রক্ষার উদাহরণ দিয়ে বলা যায় যে, ভারসাম্য রক্ষা করা সম্পর্কে পদার্থবিদ্যার তাত্ত্বিক জ্ঞান কিভাবে তা চালানো যায় তার বাস্তব জ্ঞানের পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। কিভাবে উভয়কে প্রতিষ্ঠিত ও ভিত্তিশীল করা যায়, তা এই তত্ত্বের আলোচনা দ্বারা ফলপ্রসূ হতে পারে।
যদি কারো বিশ্বাস সত্য হয়, তবে তার বিশ্বাসের পক্ষে এটি যথেষ্ট নয়। অন্য কথায়, যদি কোনোকিছু প্রকৃতভাবে জানা যায়, তবে তা নিশ্চিতভাবে মিথ্যা হতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ, যদি কেউ বিশ্বাস করে যে, একটি ব্রিজ তার পারাপারের জন্য যথেষ্ট নিরাপদ, কিন্তু এটি অতিক্রম করার সময় দেখা যায়-এটি ভেঙে পড়লো, তখন এটা বলা যায় যে, ব্রিজটির নিরাপদ থাকার যে ‘বিশ্বাস’ তার ছিল তা ভুল ছিল। এ-বিশ্বাসকে ‘সঠিক’ বলা যাবে না এই জন্যে যে, ব্রিজটির নিরাপদ থাকার যে-ব্যাপারটি সে ‘জেনেছিল’, তা স্পষ্টভাবে ছিল না। ভিন্নভাবে বললে, যদি ব্রিজটি সঠিকভাবে তার ওজনকে সমর্থন করতো, তবে সে বলতে পারতো- সে বিশ্বাস করেছিলো যে ব্রিজটি নিরাপদ ছিল এবং এখন এটি প্রমাণ করার পর (অতিক্রম করার পর) সে ‘জানে’ ব্রিজটি নিরাপদ।
নীতিশাস্ত্র (Ethics) দর্শনের একটি শাখা যেখানে নৈতিকতা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ নিয়ে আলোচনা করা হয়। তাত্ত্বিক দিকগুলো, যেমন - ভাল-মন্দের সংজ্ঞা এর সাথে প্রায়োগিক দিক, যেমন - মানুষের ভাল বা মন্দ ব্যবহারের সংজ্ঞা-ও এর আলোচ্য বিষয়। মানুষের ব্যবহারগত সম্পর্কের তাৎপর্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে নীতিশাস্ত্র বিকাশ লাভ করেছে।
যুক্তিবিজ্ঞান (Logic) দুটি অর্থ আছে: প্রথমত, এতে কিছু কার্যকলাপ বৈধ যুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে; দ্বিতীয়ত, এটি যুক্তি আদর্শ গবেষণা বা তার একটি শাখার নাম, যেখানে ভাষায় প্রকাশিত চিন্তা সম্পর্কে যুক্তিসম্মত আলোচনা বা যুক্তিতর্ক করা হয়। আধুনিক অর্থে- দর্শন, গণিত ও কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্টরূপে যুক্তিবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যগুলি উপস্থিত রয়েছে। যুক্তিবিজ্ঞান ভারতের বেশ কয়েকটি প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে চর্চিত হয়, চীন, পারস্য এবং গ্রীস। পশ্চিমা দেশগুলোতে যুক্তিবিদ্যাকে একটি প্রথাগত শৃঙ্খলা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ও দর্শন-এর মধ্যে এটি একটি মৌলিক জায়গা দিয়েছেন এরিস্টটল।
অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স (Metaphysics) হল দর্শনের একটি শাখা যাতে বিশ্বের অস্তিত্ব, আমাদের অস্তিত্ব, সত্যের ধারণা, বস্তুর গুণাবলী, সময়, স্থান, সম্ভাবনা ইত্যাদির দার্শনিক আলোচনা করা হয়। এই ধারার জনকঅ্যারিস্টটল। মেটাফিজিক্স শব্দটি গ্রীক ‘মেটা’ এবং ‘ফিজিকা’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। অধিবিদ্যায় দুটি মূল প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয় – ১)সর্বশেষ পরিণাম কি ? ২) কিসের মত ? মেটাফিজিক্স এর একটি মূল শাখা হল –সৃষ্টিতত্ত্ব (cosmology) এবং অন্য একটি শাখা হল- তত্ত্ববিদ্যা (ontology) ।
এরপরে রইল রাজনৈতিক দর্শন।
কিন্তু ‘দেখা’ হল কি কিছু? অনর্থক চোখ বুজে চিন্তার খেলায় ‘দেখা’টি মাটি হয়ে গেল না তো? বেশির ভাগ মানুষই ‘সুন্দর’ দেখতে পছন্দ করে। অথচ সত্যি সব সময়ে সুন্দর হয় না। তাহলে কি বেশির ভাগ মানুষ ভয়াল, নিষ্ঠুর সত্যির থেকে মুখ ফিরিয়ে শুধু স্বপ্নময় সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে চায়? যা কিছু তার মনের মত, তাই শুধু দেখতে চায়? হয়ত তাই। আমি চাইব আমার পছন্দের রঙে ভরে উঠুক এই পৃথিবী। আমি চাইব, আমার সবটুকু চাওয়া যেন পাওয়ায় পরিণতি লাভ করে। আমার দেখায় কোন কান্না, হতাশা, হাহাকার, বিক্ষোভ না থাকে। মধুময় হোক আমার জীবন। কেউ কী আর সেধে দুঃখকে পেতে চায়! তাই আমার মত বোধহয় সবাই চায়, তাদের দেখায় শুধু সুন্দর থাকুক। তখন নিয়তির মত অস্পষ্ট কেউ বুঝি দূর থেকে দেখে যায় আমাদের!
অন্য কারুর কথা আমি জানি না। আসলে অন্য কাউকেই আমি দেখি না। আমি দেখি আমাকে। আমি কান্নাকে ঠিক মত দেখতে পাই না। কান্নার দিকে তাকালেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আর হতাশার দিকে তাকালে মাথাটা নুইয়ে আসে বুকের ওপর। দেখা হয় না ওকে। রাগকে খুব স্পষ্ট দেখতে পাই অবশ্য। ওর লাল লাল চোখ, ওর আগুন মুখ, ওর খাঁড়ার মত নাক...একদম থ্রিডি এফেক্ট নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পরে ওই কালো চশমা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ওর সামনে থেকে পালিয়ে যাই। আমার থেকে অনেক দূরে থাকে স্থিরতা। কোন টেলিস্কোপ ওকে দেখতে পায় নি আজ অবধি। আমার খুব কাছে থাকে একটা ছোট্ট ফ্রক পরা মেয়ে। যে মেয়েটা রোজ খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়ে আর ওর মা আঁচল দিয়ে ওর গায়ের ধুলো মুছতে মুছতে ওকে ঘরে নিয়ে যায়। তাই ওদেরও আমি স্পষ্ট দেখি। আমার বাড়ির পিছনে একটা অন্ধকার জংলা জায়গা আছে। রাত নামলে ওটাকে আমি দেখতে পাই না, আর দিনের বেলায় ওকে আমি দেখতে চাই না। আমার যখন ঘুম পায়, আমি স্বপ্নকে দেখতে পাই। সে আজও উড়ে উড়ে আসে যায় আগের মতই। আগের মতই সে ধরা দেয় না। ভাঙা স্বপ্নগুলোকে আজকাল আর দেখি না। তবে ঘুম ভেঙে গেলে আচমকাই আমার সামনে বসে থাকতে দেখি, বুকে মাথা নুইয়ে বসে থাকা ‘আমি’কে। এই ‘আমি’টার হাত থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে পাই নি এখনও। যখন তখন সে এসে আমাকে কান্না দেখায়, আমাকে ঝাপসা দেখতে বাধ্য করে।
একটা মনের মত চশমা দেখতে চাইছি ভীষণ ভাবে। হ্যাঁ, মনের মতই। যে চশমা দিয়ে দেখলে সব কিছু সুন্দর দেখাবে, সব কিছু মনের মত হয়ে দেখা দেবে আমার চোখের সামনে। আমার না-পাওয়া গুলোও বদলে যাবে রাতারাতি, এক গাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আমার সামনে কোন ইচ্ছে খুশির দোলনা। সে দোলনাটা অনেকটা ছোটবেলার মত, যে দোলনায় দুলতে গেলেই যে কেউ পরী হয়ে যাবে, যে কেউ স্বর্গ দেখতে পাবে। আসলে এই সব ফ্যান্টাসিই আমরা দেখতে চাই। আমাদের মনের ভেতরে একটা সুন্দর দেখতে চাওয়ার চোখ লুকিয়ে থাকে, আর তারাই বুঝি এই কান্ড ঘটায়।
তবে শুধু নিজের দিকে তাকিয়ে থাকলে তো চলে না। শুধু নিজেকে নিয়ে তো আর এই পৃথিবী নয়। আমার চারপাশ, চারপাশেরও চারপাশ, সব নিয়েই তো আমার আমি। সমগ্রকে দেখতে গেলে হাসি, আনন্দের পাশাপাশি কান্না, দুঃখ, অপ্রাপ্তি, হতাশা, রাগ, ক্ষোভ, হিংসে- সব কিছুকেই দেখতে হয়। শুধু সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা কোন দর্শন নয়। সমাজ, ধর্ম, রাজনীতির ভালো বা সফল ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে যে সব স্বার্থান্বেষীরা এগুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের গুছিয়ে নেয়, তাদের দিকে আঙুল তুলে দেখানোটাও জরুরী। এর মানে এই নয়, যে ও পাচ্ছে বলে আমি হিংসে করছি! ওর পাওয়াটা যদি যুক্তিসঙ্গত হয়, তখন সেই পাওয়া দেখে আমাদের যেন অহেতুক ক্ষোভ না আসে, এটাই দেখার। আর ওই যে অপ্রাপ্তিগুলো, ওই যে হতাশা, কান্নারা রয়েছে আমার কাছে, তোমার কাছে, সবার কাছে, তাদের দিকেও তাকিয়ে দেখতে হয় মমতা নিয়ে। ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওদের ঘুম পারিয়ে দিতে হয়। ওদের টপকে যেতে গেলে জীবনের কতগুলো হার্ডল পার হতে হবে, তার দিকে তাকিয়ে থাকা কোন কাজের কথা না। দুচোখ ভরে দেখতে হয় সমগ্রকে। নিজেকে নিয়ে যেতে হয় ওই সমগ্রের খুব কাছে। আর তারপর দেখতে হয়, কেমন ভাবে আমার ‘আমি’টা মিশে যাচ্ছে ওই সমগ্রে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

  1. হুমম্, এখনও আমার আমি পর্যন্ত হেঁটে ও ফিরে আসতেই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি, বাইরের যাওয়ার সময় হলে অফিস টাইম হয়ে যায়...
    ভালোলাগলো দিদি, দেখার দেখাগুলো

    উত্তরমুছুন
  2. আমার আমি পর্যন্ত হাঁটলেই হবে

    উত্তরমুছুন
  3. নন্দনতত্ত্ব আর জীবনদর্শন, আমার আমি সব একাকার হয়ে একটা ভালোলাগার আবেশ তৈরি করল। ভালো লাগল তুষ্টিদি।

    উত্তরমুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন