প্রথম পর্বের পরঃ
পর্ব ২
বিয়ের আসর থেকে সিদ্ধেশ্বর সোজা চলে গেলেন তাঁর পিসিমার বাড়িতে। হাতিবাগানের বনেদি বাড়িতে একদা
একান্নবর্তী পরিবার ছিল। এখন কয়েক টুকরো হয়ে গেছে। পিসিমার এক দেওর মারা গেছেন কয়েকদিন আগে।
তাই কালাশৌচ বলে বিয়েবাড়িতে তাঁরা কেউ যাননি। মধ্যরাতে সিদ্ধেশ্বরকে দেখে পিসিমা ও তাঁর ছোটো ছেলে
বিস্মিত। তাও আবার বিয়ের পোশাকে। তারপর তাঁর মুখেই ঘটনার কিছুটা শুনলেন। কেন এমন সিদ্ধান্ত সে
সম্পর্কে কিছুই বললেন না। তাঁরা জানেন সিদ্ধেশ্বর বরাবরই খামখেয়ালি। তাঁর যে বিয়ের ব্যবস্থা করা ঠিক হয়নি
একথাই মনে হল তাঁদের।
যে ঘরে সিদ্ধেশ্বরকে ঘুমাতে দিয়েছেন, সেখানেই বাড়ির ল্যান্ড ফোন। এঁরা কেউ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন
না। তাছাড়া এত রাতে এই ব্যাপারে ফোন করতেও তাঁর ছেলেকে বারণ করে দিয়েছেন পিসিমা। পরদিন খুব ভোরে
সিদ্ধেশ্বরকে না-জানিয়ে ছোটো ছেলে এ বাড়িতে এসে গতরাতের ঘটনার অনুপুঙ্খ জেনে ফিরে গেলেন। সেই সঙ্গে এ
বাড়ির সকলেই জেনে গেল যে সিদ্ধেশ্বর বড় পিসিমার বাড়িতে আছেন। অবশ্য ব্রজেশ্বর, তাঁর বাবা ও প্রায় সকলেই
জানেন, সিদ্ধেশ্বর চেনাজানা কারো বাড়িতেই থাকবেন। বাড়ি ছেড়ে এখানে-ওখানে চলে যাওয়া সিদ্ধেশ্বরের কাছে
নতুন কিছু নয়। কিশোর বয়স থেকেই কাউকে কিছু না বলে হুট করে কোথাও চলে যাওয়া তাঁর অভ্যেস। সম্প্রতি
বেশ কিছুদিন যাচ্ছেন না এটা ঠিক। তবু তাঁর এই স্বভাবের জন্য তাঁর অন্তর্ধান নিয়ে খুব চিন্তিত কেউই প্রায়
ছিলেন না।
সন্ধ্যায় নববধূ সুবর্ণাকে নিয়ে ঘরে এলেন ব্রজেশ্বর। তাঁর আগে ফোন করে বাবাকে বলে দিয়েছেন দাদা যেন
কোনোভাবেই বাড়িতে না-থাকেন। যে মেয়ে তাঁর বউ হতে পারতেন, তিনি এখন তাঁর ভ্রাতৃবধূ। সুতরাং তাঁর
সামনে ব্রজেশ্বররা দাঁড়াতে চান না একথা স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন তিনি।
তাঁদের বাবাও পিসিমার বাড়িতে ফোন করলেন। তিনি তাঁর বড়দিকে ফোনে জানিয়ে দিলেন সিদ্ধেশ্বর যেন আপাতত
এ বাড়িতে না-আসে। ব্রজেশ্বর এর মধ্যেই কোথাও ফ্ল্যাট কিনে চলে যাবে বা সিদ্ধেশ্বরকেই অন্য কোথাও থাকার
ব্যবস্থা করা হবে এইরকম বিষয়ও আলোচনা করে নিলেন তাঁর বড়দির সঙ্গে। অন্তত মাস খানেক তো এ ব্যাপারে
সময় লাগবেই। সিধুকে যেন এই ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন তাঁর বড়দিরা, তাও জানিয়ে দিলেন।
মাসখানেক নয়, সিদ্ধেশ্বর ফিরলেন প্রায় মাস সাতেক পরে। পিসিমার বাড়িতে তারপর আর এক রাত ছিলেন
সিদ্ধ্বেশ্বর। পরদিন ভোরেই বালিশের নীচে একটা চিঠি লিখে তিনি চলে গেলেন।
পূজনীয় পিসিমা,
আমি চললাম কিছুদিনের জন্য। অহেতুক আমাকে খোঁজাখুঁজি করে লাভ হবে না। পুলিশের দ্বারস্থ হওয়ারও
কোনো দরকার নেই। যদিও সে সম্ভাবনা কমই। তবু বলে রাখলাম। যথাসময়ে আমি ফিরে আসব।
ইতি
প্রণত সিধু
সিদ্ধেশ্বর তখন একটা এমএনসিতে চাকরি করতেন। কিছুদিন তিনি এখানে চাকরি করেছেন। এই সময়ই তাঁর বিয়ের
আয়োজন করা হয়েছিল। পরে অবশ্য রাইটার্স বিল্ডিংয়ে সেচ দপ্তরের অফিসার পদে যোগ দিয়েছিলেন। যাই হোক,
ব্রজেশ্বরের বিয়েপর্ব মিটে যাওয়ার পর ছোটো ভাই কমলেশ্বর বড়দার অফিসে একদিন খোঁজ নিতে এলেন। পিসিমার
বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার খবর পাওয়ার পরই ঠিক হয়েছিল বিয়ের কাজ মোটামুটি মিটে গেলে সিদ্ধেশ্বরের খোঁজ
নেওয়া হবে। খোঁজ নিতে এসে অবশ্য তেমন আশাব্যঞ্জক কিছু জানা গেল না।
~ আপনি মুখার্জিরদার ভাই ?
~ হ্যাঁ, দাদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
~ আপনার দাদা তো ছুটিতে আছেন। অফিসে আসেননি তো !
ইউনিয়নের সেক্রেটারি তরফদারবাবু এগিয়ে এলেন। প্রায় মধ্যবয়সী। কানের দুপাশে সাদা চুল। চোখে চশমা। মুখে
চালাক-চালাক ভাব থাকে সবসময়।
~ তোমার দাদার ব্যাপারটা কী বলো তো ভাই ? তুমি বললাম বলে কিছু মনে করলে না তো ?
~ না না, ঠিক আছে।
~ তা বেশ। বলছি বিয়েটা নিয়ে কী ক্যাচাল হল বলো তো ? আমাদের বৌভাতের নেমত্তন্ন ছিল। বিয়ের জন্য
১৫ দিনের ছুটিও নিয়েছিল, তা যেদিন বৌভাত হওয়ার কথা সেদিনই সকাল-সকাল অফিসে এসে হাজির !
~ আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, কী হে মুখুজ্জে, বৌভাতের দিন, বাড়িতে হইচই। তা কী মনে করে তুমি এই সময় ?
কথাটা বললেন সিদ্ধেশ্বরের আর-এক কলিগ। তারপর বললেন, তা বলে কিনা বিয়েটা আমার হয়নি। পরে একসময়
বলব। এখন একটু ব্যস্ত আছি। তোমাদের আজকের বৌভাতের নিমন্ত্রণ বাতিল করলাম। কিছু মনে কোরো না।
তারপর ড্রয়ার থেকে চেক বইটা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল।
এরপর নানা প্রশ্ন, উত্তর আর কথোপকথনে সেদিনের ঘটনা মোটামুটি জেনে গেল সিদ্ধেশ্বরের অফিস। আর কমলেশ্বর
জেনে গেলেন, দাদার খবর অফিসের কেউই জানেন না। শুধু বলে গেছেন কিছুদিন পরে আসবেন। কতদিন বাদে
সে ব্যাপারেও কেউ কিছু বলতে পারলেন না স্বাভাবিকভাবেই।
দিন কুড়ি পর বাড়িতে নিজেই ফোন করলেন সিদ্ধেশ্বর। জানালেন তিনি নিয়মিতই অফিস করছেন। কলেজস্ট্রিটের
কাছে এক মেসে থাকেন। তাঁকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। ভালোই আছেন। ইত্যাদি।
ফোনটা ধরেছিলেন তাঁর বাবা। সিদ্ধেশ্বর একে-একে বাড়ির সবার খোঁজ নিলেন। শুধু সেজো ভাইটির কথা
একবারও উচ্চারণ করলেন না। আগবাড়িয়ে বাবাই জানিয়ে দিলেন ব্রজ আর বউমাও ভালোই আছে। দিন সাতেক
বাদে ব্রজ ভিলাইতে চলে যাচ্ছে। সেখানে তাঁর চাকরির ট্রান্সফার হয়েছে। যে-কথা বললেন না, সেটা হল, এবার
তুই বাড়িতে ফিরতে পারিস। আর কোনো বাধা রইল না। সিদ্ধেশ্বরও সে-কথা বিলক্ষণ বুঝেছেন। তিনি সামান্য
নীরবতার পর বললেন, এখন রাখছি বাবা। আগামী মাসে একবার বাড়িতে যাব। তোমরা সবাই ভালো থেকো।
‘তুইও ভালো থাকিস’ এ কথাটা বলার সুযোগ পেলেন না। তার আগেই সিদ্ধেশ্বর ফোন কেটে দিলেন।
পরের মাসে নয়, সিদ্ধেশ্বর ফিরলেন প্রায় সাত মাস পরে। মেসে খেয়েই হোক বা অনিয়মের জন্যই হোক, পেটের
সমস্যা বাঁধিয়ে ঘরে ফিরলেন তিনি। চেহারার পারিপাট্য সামান্য টাল খেয়েছে। কেউ কেউ রটিয়ে দিয়েছিল সিধু
নাকি সন্ন্যাস নিয়েছেন। কেউ আবার নাকি হরিদ্বারে বেড়াতে গিয়ে তাঁকে সাধুর বেশে দেখেওছেন বলে দাবি
করেছেন। তাঁর বাড়ি থেকে যতই বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে তিনি কলকাতায় মেসে থেকে দিব্যি অফিস করছেন,
এ কথা কেউ মানতে চায়নি। বিয়ের পিঁড়ি থেকে চলে গেছেন তো সন্ন্যাস নেবেন বলেই এমন বদ্ধমূল ধারণা প্রচার
হয়ে গেল আশেপাশে। সিদ্ধেশ্বর ফিরে আসার পর তাঁর কানেও এমন সম্ভাবনার কথা এসেছে। তিনি জবাব এড়িয়ে
মনে মনে হেসেছেন। এই প্রশ্রয়ই আরও নানা ডালপালা ছড়িয়েছে। এর পাশাপাশি তাঁর নানা আচরণ তাঁর
পাগলামোর পরিচয় দৃঢ় করেছে। পরবর্তীতে তিনি যে পাগল ঠাকুর নামে পরিচিত হন তাঁর পিছনে তাঁর এহেন
আচরণও দায়ী।
৫
ভুবনকে নিয়ে সিদ্ধেশ্বর বসে আছেন বেলপুকুরের পাড়ে। ভুবনের স্কুল ছুটি এখন। পুজোর ছুটি। দুর্গা পুজো, লক্ষ্মী
পুজোও শেষ হয়ে গেছে। কিছুদিন পরেই কালীপুজো। এইসময় প্রকৃতি একটু শীতল থাকে। বাতাসে হালকা ঠান্ডার
রেশ। হেমন্তের হাওয়া বয়ে চলে। কিন্তু এবছর গরমটা কিছুতেই যেন কমছে না।
পুকুরপাড়ের হাওয়া খুব ভালো লাগছে ওদের দুজনের। ভুবন ছোটো ছোটো নুড়ি কুড়িয়ে জলে ফেলছে। আর
সিদ্ধেশ্বর জলের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। স্রোত বয়ে চলেছে। তিনি জলের তাকিয়ে ভাবছেন কীভাবে সময় বয়ে
চলে মহাশূন্যের দিকে। ভাবতে ভাবতেই তার মনে হল সময় কি মহাশূন্যেই বিলীন হয়ে যায় ? তাহলে সময়ের
হাত ধরে যেসব ঘটনাক্রম গড়ে ওঠে, যে হাসি-কান্নার জলছবি ফুটে ওঠে, সেগুলো কীভাবে ভেসে থাকে মানুষের
মনে ? তাহলে কি কোথাও থেকে যায় ? কোথায় থাকে ?
মাঝেমাঝেই এই বিষয়টা তাঁকে ভাবায়। সময় কোথায় যায় ? কোথায় গিয়ে মেশে ? নাকি সময় ধ্রুবতারার মতো
আদি অনন্তকাল জেগে থাকে ! হারিয়ে যায়, মিলিয়ে যায় মানুষ, মানুষের বহমান ধারা, মানুষের সভ্যতা !
~ জ্যাঠামশাই, কী ভাবছ ?
~ কই, কিছু না তো।
ভুবনের ডাকে সম্বিত ফেরে সিদ্ধেশ্বরের। তিনি সময়ের নানা জটিলতায় ডুব দিয়েছিলেন, সেখান থেকে চকিতে ফিরে
আসেন।
~ আচ্ছা জ্যাঠামশাই, মলয়কাকুদের বাড়িতে দেখলাম প্রদীপ রোদে দিচ্ছে ঠাকুমা। কেন গো ?
~ হ্যাঁ, আমিও দেখেছি। ওগুলো গতবারের প্রদীপ। রোদে দিচ্ছিলেন মলয়ের মা।
~ এত প্রদীপ দিয়ে কী হবে ?
~ সামনেই কালীপুজো না ? তখন প্রদীপ জ্বালাতে হবে। কালীপুজোর দিন সকালে প্রদীপগুলো জলে ভিজিয়ে রাখা
হবে।
~ কেন জলে ভেজাবে ?
~ জলে ভেজালে সন্ধ্যায় যখন জ্বালবে তখন তেল খরচ কম হয় নাকি শুনেছি। মনে হয় মাটির প্রদীপ জল টেনে
নেয়। তাই আর তেল বেশি টানে না। না-হলে অনেক তেল টেনে নিত।
~ জানো জ্যাঠামশাই, আমাদের বাড়িতে একটা বড় মাটির প্রদীপ আছে। সেটা কালীপুজোর আগেরদিন জ্বালানো
হয়। ভূতচতুর্দশীতে। আর কিছু ছোটো ছোটো প্রদীপও জ্বালে। সেগুলো ঘরবাড়ির নানা জায়গায় সাজানো হয়।
~ হ্যাঁ হ্যাঁ, তোদের তো আবার অলক্ষ্মী পুজোও হয় সেদিন ।
~ আচ্ছা ভূতচতুর্দশীটা কী গো জ্যাঠামশাই ?
~ মানুষ মনে করে চতুর্দশীর ঘন অন্ধকারে ভূতপ্রেতরা আসে। তাই প্রদীপ জ্বালিয়ে ভূত তাড়ায়। আচ্ছা, অলক্ষ্মী
পুজোটা কেমন হয় জানিস ?
~ আমি ঠিক ভালো জানি না। চালের গুঁড়ো আর গোবর দিয়ে কীসব বানায়। অনেক রাত্রে আমাদের এসব হয়।
আমি তখন ঘুমিয়ে পড়ি। আর বাবাও আমাকে এসব দেখতে দেয় না।
~ হা হা হা, বাবা পুজো দেখতে দেয় না বলে খুব অভিমান ?
~ কী জানি বাবা কেন দেখতে দেয় না। দেখতে চাইলে খুব রাগ করে। বলে ও পুজো তোমারে দেখতি হবে না।
তুমি ঘুমাও।
~ আসলে কী হয় জানিস ? অলক্ষ্মী পুজোর মন্ত্রে অনেক খারাপ খারাপ কথা আছে। তাই বোধহয় তোর বাবা
দেখতে দেয় না।
~ ও বাবা, পুজোর মন্ত্রে খারাপ কথা থাকে নাকি ?
~ এই পুজোটায় থাকে।
~ তুমি জানো পুজোটা কেমন ?
~ একটু একটু জানি।
~ আমাকে বলো না কেমন করে পুজোটা হয় !
~ প্রথমে আতপ চালের গুঁড়ো দিয়ে দুটো মূর্তি গড়া হয়। একটা লক্ষ্মী, আর একটা নারায়ণের মূর্তি। তারপর
কলার ভেলা তৈরি করে তাতে ঐ মূর্তি দুটো রেখে ফুল, বেলপাতা, তুলসী এইসব দিয়ে সাজিয়ে তুলে রাখা ঘরে।
~ লক্ষ্মী-নারায়ণের পুজো করে না ?
~ করে, তবে তখনই না। আগে তো অলক্ষ্মীকে বিদায় করতে হবে, তারপর তো লক্ষ্মী-নারায়ণের পুজো !
~ অলক্ষ্মী পুজো কেমন ?
~ বুঝেছি, এটা নিয়ে খুব কৌতূহল হয়েছে তোর। শোন তবে। একটা মাটির বর আর একটা গোবরের বউ
বানানো হয়। বউ হল অলক্ষ্মী। ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো আলতা দিয়ে লাল রঙ করে তাকে পরানো হয়। আর
মাটির বরকে পরায় হলুদবাটা দিয়ে রঙ করা ধুতি। এরপর এই বর-বউকে একটা কলার ভেলায় বসিয়ে পুজো
করা হয়। একটু খই, চাল, একটা বাতাসা, কিছু ফুল দেওয়া হয়। এই হল পুজো। তখন মন্ত্রতন্ত্র বলা হয় না।
~ তবে যে বললে খারাপ ভাষার মন্ত্র আছে ?
~ আছে তো। সেটা পরে। পুজো শেষ হলে একটা কুলোয় ভেলাসুদ্ধ অলক্ষ্মী আর তার বরকে বসিয়ে কোনো
ছাইয়ের গাদার পাশে বা খারাপ জায়গায় নামিয়ে রাখতে হয়। তারপর পাটকাঠি দিয়ে ঐ কুলোটা বাজাতে বাজাতে
ঘরে ফিরবে। পেছন ফিরবে না একদম। পেছন ফিরলেই নাকি অলক্ষ্মী পেছন পেছন চলে আসবে। হা হা হা ...
এই হল অলক্ষ্মী বিদায়পর্ব। পাটকাঠি দিয়ে কুলো বাজাতে বাজাতে মন্ত্র বলে,
কুলো কুলো ঢব ঢবা ঢব
চুতমারানি বের হ, বের হ।
কুলো কুলো ঢব ঢবা ঢব,
চুতমারানি দূর হ, দূর হ।
~ চুতমারানি মানে কী জ্যাঠামশাই ?
~ এটা একটা খারাপ কথা। এর মানে তোর জানার দরকার নেই। বলারও দরকার নেই। তুই জানতে চাইলি
অলক্ষ্মী পুজোটা কীরকম তাই বললাম।
~ আচ্ছা। তারপর কী হয় ?
~ তারপর আর কী ! অলক্ষ্মী বিদায় করে লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। অলক্ষ্মী হল অশুভ শক্তি। অশুভ শক্তিকে
বিদায় দিয়ে শুভ শক্তির আরাধনা করাই হল এর উদ্দেশ্য, বুঝলি ?
ভুবন ঘাড় কাৎ করে বলল বুঝেছে।
ভুবন কতটা কী বুঝল তা নিয়ে সিদ্ধেশ্বরের সংশয় থেকেই যায়। বিষয়টা ওকে বোঝানো হল। বড় হলে ও
নিশ্চয়ই বুঝবে। কিন্তু সত্যিই কি বুঝবে ? যুগ যুগ ধরেই তো চলে আসছে এই পুজো। তবু সেই শক্তির বিনাশ
হল কই ? ভাবতে থাকেন সিদ্ধেশ্বর। সময়ের হাত ধরে সন্ধ্যা নামে ধীরে ধীরে।
৬
আমার যখন বছর তিনেক বয়স, তখন আমার মা মারা যান। ব্লাড ক্যান্সার। তারপর বাবা আমাকে নিয়ে চলে
আসেন এখানে, এই বারাসাতের বাড়িতে। কিছুদিনের মধ্যেই বাবাও ভিলাই থেকে কলকাতায় ট্রান্সফার নিয়ে চলে
আসেন। ঠাকুমাকেও আমি সেভাবে পাইনি। যে অল্প কিছুদিন পেয়েছি, তিনি নাকি আমাকে খুব ভালো বাসতেন
আর প্রশ্রয় দিতেন। বহুদিন ধরেই শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। এক রাতে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হল।
দিন তিনেক পরে সেখানেই মারা যান। বাবার কাছে আমি ঠাকুমার অনেক গল্প শুনেছি। এদিকে ঠাকুরদা যতদিন
বেঁচেছিলেন আমাকে আগলে আগলে রাখতেন। ঠাকুরদার হাত ধরে আমি ছুটির দিনে বাজারে যেতাম। ঠাকুরদা
প্রাচীনপন্থী গোঁরা ব্রাহ্মণ, তাই মিষ্টির দোকানের পরোটা খেতেন রসগোল্লার রস দিয়ে। অন্য দোকানের পরোটা
খেতেন না। আমার ঠাকুরদার সঙ্গে বাজারে যাওয়ার আগ্রহ ছিল ঐ লোভেই।
মেজো জ্যাঠা আমরা আসার আগেই দক্ষিণ কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছেন বলে জ্যাঠিমাকেও আমি সেভাবে
পাইনি। তাই মাতৃ-আদর আমার অধরাই থেকে গেছে।
বড় জ্যাঠামশাই আমার থেকে কেন যেন দূরে-দূরেই থাকতেন। আমিও খুব ভয় পেতাম। বাবার থেকেও লম্বা।
গম্ভীর গলা। বাড়িতে কারো সঙ্গেই কথা বলেন না। বাড়িতে থাকেনও কম সময়। সবমিলিয়ে আমার কাছে
জ্যাঠামশাই ভয়ের মানুষ ছিলেন। সেই দূরত্ব ও ভয় বহুদিন কাটেনি।
ভুবনও আমার মতোই শৈশবে মা-হারা। অবশ্য আমার মায়ের মতো ভুবনের মা মারা যাননি। ভুবনের বাবা
পরিমলকাকুর এক বন্ধু, প্রায়ই ওদের বাড়িতে আসতেন, তার সঙ্গেই ভুবনের মা পালিয়ে গেছেন। হয়তো এমন
মৃণাল সেন পাগল লোকের সঙ্গে তিনি ঘর করে উঠতে পারেননি। অনেকেই বলেছিল পরিমলকাকুকে আবার বিয়ে
করতে। কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হননি। “আমার সঙ্গে এতদিন ঘর করার পরও যখন ধরি রাখতি পারিনি কো,
আবার বিয়ে করলি যে পারব, সে কথা কি কওয়া যায় ? তাছাড়া আমার ভুবনরে যদি সে ভালো না-বাসতি
পারে তেখন কী করব’নে ? তার থে এরমই ভালো। এতে যদি ভুবন মানুষ হয় তো হবে, না হলি হবে না।”
কারো চাপের কাছেই তিনি মাথা নোয়াননি।
আমার জ্যাঠামশাই পাগল ঠাকুরকে পেয়ে ভুবন ক্রমশ পালটে গেল। বন্ধুবান্ধবহীন ভুবনের একমাত্র সাথী ছিলেন
জ্যাঠামশাই। ভুবন পড়াশোনায় ক্রমশ উন্নতি করল। একসময় সে ক্লাসে স্ট্যান্ড করা শুরু করল। এই নিয়ে
পরিমলকাকুর গর্ব ও সংশয় দুটোই ছিল। বলতেন, “ভ্যানওলার পোলা কেলাসে ফাস্ট-সেকেন হয়। ভাবলেই আমার
গর্ব হয়। আর ভয় লাগে ওর ভবিষ্যৎ ভাবলে। পাগল ঠাকুরের পাল্লায় পড়ে কী যে হবে ছেলেটার কে জানে !”
আসলে ছেলের রেজাল্ট ভালো হওয়ার পেছনে জ্যাঠামশাইয়েরও যে ভূমিকা থাকতে পারে তা তিনি বোঝেন না, বা
মানতে পারেন না। তবে এটা ঠিক, পরিমলকাকু অনেক কষ্ট করে আয় করেন, আর তা থেকেই ভুবনের জন্য
সাধ্যমতো খরচ করেন।
ভুবন যেবার মাধ্যমিক দিল, পরীক্ষার মাস দুয়েক আগে পরিমলকাকু মারা গেলেন। ভুবন তখন ঘরে একা একাই
পড়ছিল। দুপুরে ঘরে ফিরে এলেন ভ্যান নিয়ে। যে সময় ফেরেন তার থেকে একটু আগেই ফিরেছেন। ভুবনকে
জলের জগটা এগিয়ে দিতে বললেন। সেই জল খেয়ে বেড়ার দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে
থাকলেন। সেই চোখ আর খোলেননি। সেভাবেই হৃদযন্ত্র তাঁর বন্ধ হয়ে গেল।
আমি তখনো চাকরিতে জয়েন করিনি। রেলের চাকরি। চিঠি পেয়েছি জয়েনের। দিন পনেরো বাকি। তাই আমিই
উদ্যোগ নিতে পারলাম সৎকারের। জ্যাঠামশাই বাড়ি ছিলেন না। ফিরলেন বিকেলে। ফিরেই সব জেনে ভুবনকে
জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদলেন। এই প্রথম দেখলাম জ্যাঠামশাইকে কাঁদতে। ততক্ষণে সৎকারের আয়োজন
অনেকটাই করে ফেলা গেছে। পাড়ার ক্লাবের ছেলেরাই সব ব্যবস্থা করেছে।
শ্রাদ্ধশান্তির ব্যাপারে আমার বাবাই যতটুকু সম্ভব আর্থিকভাবে এগিয়ে এলেন। তাছাড়া আরও অনেকেই সাহায্যের হাত
বাড়িয়ে দিল। যথাসময়ে শ্রাদ্ধের কাজ মিটেও গেল। জ্যাঠামশাই ভুবনকে নিয়ে এলেন আমাদের বাড়ি। ঘোষণা করে
দিলেন এবার থেকে ভুবন এখানেই থাকবে। বাবার তাতে আপত্তি ছিল না। আমারও আপত্তির কারণ নেই। তাছাড়া
জ্যাঠামশাই এমআইএসের টাকা যথেষ্ট পান। চাকরি ছাড়ার পর যা-কিছু অর্থ পেয়েছেন, তার প্রায় সবটাই পোস্ট
অফিসের এমআইএস স্কিমে রেখে দিয়েছেন। তা থেকে যা সুদ আসেতা মন্দ নয়। প্রতি মাসে আমার বাবাই সেই
টাকা তুলে আনেন।
অদ্ভুত ব্যাপার হল সকাল হলেই যিনি বেরিয়ে যান কোথায়, সে তিনিই এখন বাড়িতে দিনরাত ভুবনের পাশে।
ভুবনকে পড়াতেন নিজের মতো করে। ভুবন অবশ্য তার প্রতিদান দিয়েছে। মাধ্যমিকে অসম্ভব ভালো রেজাল্ট
করেছে। আমাদের অঞ্চলে বা আশেপাশে ভুবন সবথেকে বেশি নম্বর পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
এইসময় থেকেই জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গেল। অফিস থেকে ফিরে মাঝেমাঝেই ক্লাবে যেতাম না।
ছাদে বসে জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে গল্প করতাম। পাগল ঠাকুর নামে পরিচিত আমার জ্যাঠামশাইকে আমি যেন
আবিষ্কার করেছি নতুন নতুন ভাবে। এমন জ্ঞানী, বিচক্ষণ এবং বিরাট হৃদয়ের জ্যাঠামশাই আমার কাছে ক্রমশ
মহান হয়ে দেখা দিচ্ছেন।
জ্যাঠামশাইয়ের সামনেই আমি সিগারেট খেতাম। আমাকে উনিই সামনে সিগারেট টানার পারমিশন দিয়েছেন। একদিন
ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলাম। জ্যাঠামশাইকে আসতে দেখে সিগারেট দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। উনি কাছে এসে
কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন, দেখ বিল্টু, ওরকম সম্মান আমি চাই না রে।
~ কীসের সম্মান ?
~ ওই যে সিগারেট ছুঁড়ে দিলি আর মনে মনে আমাকে গালাগাল দিলি, এতে কি আমার সম্মান বাড়ল ?
~ না না, আমি একটুও গালাগাল দিইনি। অপ্রস্তুত আমি জবাব দিলাম।
~ তা হয়তো দিসনি, কিন্তু মনে মনে খুব বিরক্ত তো হয়েছিস ? এতে কি আমার সম্মান বাড়ল ? আসলে তো
অসম্মানই করলি, নাকি ? একটু থেমে বললেন, এবার থেকে আমার সামনেই খাবি। তোর বাবাকেও বলেছিলাম।
কিন্তু আজও লুকিয়ে খায়।
এইরকমই এক বর্ষার দিনে আকাশের অবস্থা দেখে অফিস থেকে ফিরে আর ক্লাবে যাইনি। হঠাইই বৃষ্টি শুরু হয়ে
গেছে। সিগারেট টানব বলে চিলেকোঠার দিকে গেলাম। দেখি ছাদের দরজা খোলা। আর-একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি
আমার পাগল জ্যাঠামশাই দু’হাত আকাশে তুলে বৃষ্টিতে ভিজছেন। তুমুল বৃষ্টির জলধারা দেখতে পাচ্ছি স্ট্রিট লাইটের
আলোয়। আর সেই সোনালী ধারায় জ্যাঠামশাই কী পরম তৃপ্তিতে ভিজে চলেছেন। এই অপূর্ব দৃশ্য দেখে আমি চোখ
ফেরাতে পারছিলাম না। হঠাৎ আমার দিকে চোখ পড়তেই ছুটে এলেন কাছে।
~ বিল্টু চলে আয়, বৃষ্টিতে ভিজি। খুব ভালো লাগবে।
~ আমার খুব গলা ব্যথা জ্যাঠামশাই। আপনিও চলে আসুন। এই বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবে।
~ না না, আমি ভিজব, যতক্ষণ বৃষ্টি হবে ভিজব। সারারাত হলেও ভিজব।
তারপর আবার চলে গেলেন ছাদের মাঝখানে। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি এক কিশোরবেলাকে, নিজের খেয়ালে ভিজে
যাচ্ছে, স্কুল থেকে ফেরার পথে মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তার সঙ্গে আর কেউ নেই। সে একা-একাই বৃষ্টির
কোমলসুধা পান করে চলেছে। তিরতিরে হাওয়ায় পরজের সুর।
একবার মনে হল ছুটে গিয়ে ডেকে আনি ভুবনকে। সেও এই অপূর্ব দৃশ্য দেখুক। কিন্তু এই পরমানন্দের দৃশ্য ছেড়ে
যেতে পারলাম না। ‘সাবিনা, সাবিনা, এসো, বৃষ্টিতে ভিজি’। কথাটা কানে ভেসে এল গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির জলের
সঙ্গে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। আবার, আবারও একই শব্দগুচ্ছ ! জ্যাঠামশাই কাকে বলছেন ?
কথাগুলো কয়েকবার আমার কানে এসে আছড়ে পড়ল। ঠিক শুনলাম তো !
বৃষ্টিটা কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে গেল। আমি নীচ থেকে তোয়ালে নিয়ে এলাম।
~ এইসময় বৃষ্টিতে ভিজলেন ? জ্বর হবে তো !
~ পাগলের কোনো রোগ হয় না রে বিল্টু।
~ পাগল !
~ হ্যাঁ, লোকে তো তাইই বলে। পাগল ঠাকুর ! হা হা হা ...
হাসতে হাসতেই নীচে নেমে এলেন। একটু আগে যে কিশোরকে দেখলাম ছাদের জলধারার নীচে, আর এখন যাকে
দেখছি, দুজনের সঙ্গে কোনো মিলই নেই।
আমার মনে হয় জ্যাঠামশাই সচেতনভাবেই এমন একটা ইমেজ তৈরি করেছেন, যাতে সবাই তাঁকে পাগল ভাবে।
কেন যেন আমার কথাটা মনে হয়। সেই যে একবার স্বগতোক্তি করেছিলেন, “সবই পাগলের অভিনয়”, তার জন্যই
কী ? কে জানে !
ছাদের বৃষ্টিভেজার ঘটনার কয়েকদিন বাদেই ঘটে গেল একটা দুর্ঘটনা।
খগেন দত্ত বাড়িতে কালীমন্দির তৈরি করছেন। আমাদের বাড়ির থেকে বেশ খানিকটা দূরে তাঁর বাড়ি। নিজের
বাড়ির পাশের ফাঁকা জমিটা কিনে নিয়েছেন। সেখানেই বিরাট এক মন্দির তৈরি হচ্ছে। খগেনবাবু কাস্টমসে চাকরি
করতেন। প্রচুর টাকাপয়সার মালিক। মন্দির বানাতে তাই খরচের দিকে খুব-একটা তাকাচ্ছেন না। দেদার খরচ
করছেন। শ্বেত পাথরের মেঝে, চারিদিকে ফুলের বাগান, প্রচুর ফুলের টবও সারি সারি রাখা আছে, সবুজ মখমলের
মতো ঘাস লাগানো হয়েছে। সবমিলিয়ে দারুণ লাগছে মন্দির ও তার চত্বরটা।
মন্দির বানানো প্রায় শেষ হয়ে গেছে। রঙ করাও প্রায় শেষ। বাকি শুধু মন্দিরের চূড়া রঙ কারা। চূড়ায় তিনটি
কলস তৈরি করা হয়েছে, তার ঠিক মাঝখানে ত্রিশূল। এখন সেইসবই রঙ করার কাজ চলছে। এমন সময় সমস্যা
তৈরি হল একটা।
এক রঙ মিস্ত্রির নাম হাবু। তার পুরো নাম হাবিব আলি মণ্ডল। জাতিতে মুসলমান। নিজের নাম লুকিয়ে
কালীমন্দিরের রঙের কাজ করছে বলে রটে গেল। রঙের কন্ট্রাক্টর হরিপদ জেনেশুনেই ওকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে।
এতে হিন্দু মন্দিরের ক্ষতি হবে। কী যে অমঙ্গল হবে কে জানে !
এইসব রটনা নিয়ে তুমুল হইহট্টগোল। খগেনবাবু কিছুতেই আর এই কন্ট্রাক্টরকে দিয়ে রঙের কাজ করাবেন না।
হরিপদ বলছে সে নাকি জানতই না হাবু আসলে মুসলমান। জানলে ওকে দিয়ে মন্দিরের কাজ করাত না। ওকে
বাদ দিয়ে বাকিরা কাজটা করুক। কিন্তু খগেনবাবু তা কিছুতেই মানবেন না। হরিপদ নানাভাবে এই নিয়ে অনুনয়
করে চলেছে, কিন্তু খগেনবাবু সেই এক কথা। শেষে বলে দিলেন, তোমাকে দিয়ে আর কাজ করাব না। টাকা যা
অ্যাডভান্স দিয়েছি আপাতত ওটুকুই। এখন আর পাবে না। আগে কাউকে দিয়ে কাজ শেষ করি, তারপর দেখা
যাবে। এই নিয়ে তুমুল তর্কাতর্কি।
ইতিমধ্যে আসরে নেমে পড়েছে রাজনীতির কারবারিরা। বিজেপির স্থানীয় নেতা রঘুনাথ কুশারি আসরে নেমে
পড়েছেন। সম্প্রতি এই এলাকায় বিজেপি কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে। রঘুনাথ আঞ্চলিক সভাপতি। “এ দেশ হিন্দুধর্মের
দেশ, এখানে এইসব অনাচার মেনে নেওয়া হবে না। হরিপদকে ক্ষমা চাইতেই হবে। আর হাবুরও শাস্তি চাই।”
জানিয়ে দিয়েছেন রঘুনাথ। তাঁর কথায় কেউ যে খুব আমল দিল তা বলা যাবে না, কেননা তাঁর সমর্থনে
তেমনভাবে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল না। তবে পাশের পুকুরে যেমনভাবে একটুকরো থারমাকল ভেসে
আছে, সেভাবেই ই্যসুটা ভেসে রইল। অনেকেই বলতে শুরু করল হরিপদ কাজটা ঠিক করেনি। হাবুরও পরিচয়
গোপন করা চরম অন্যায়। এখন খগেনবাবুর প্রায়শ্চিত্য করতে হবে আর তার খরচ দিতে হবে হরিপদকেই।
খগেনবাবুরও একই মত। তাঁর বাড়ির মন্দির তৈরি করার কাজে বিঘ্ন ঘটেছে, অনাচার হয়েছে, তাই প্রায়শ্চিত্য
করা দরকার। তাই তিনি নারায়ণ চক্রবর্তীকে ডেকে পাঠালেন। নারায়ণ চক্কোত্তি নামে পরিচিত পুরোহিত লম্বা ফর্দ
লিখে দিলেন, প্রায়শ্চিত্যের বিধিবিধান জানিয়ে দিলেন। পুরো ব্যাপারটা এবার চলে গেল তরুণ সঙ্ঘের হাতে। ক্লাবের
সদস্যরাই ফর্দ ধরে ধরে জিনিসপত্র যোগাড় করার দায়িত্ব নিল। আর দায়িত্ব নিল হরিপদর থেকে চাপ দিয়ে টাকা
আদায়ের। সেইমতো হরিপদকে ক্লাবে ডেকে পাঠানো হল। এই এলাকায় তরুণ সঙ্ঘের প্রতাপ সবাই জানে। যখন যে
দল সরকারে থাকে তরুণ সঙ্ঘ সেদিকেই তার ডানা মেলে দেয়। তাই ডেকে পাঠানো মানেই আসাটা বাধ্যতামূলক
তা জানে হরিপদ।
ক্লাবে যখন হরিপদকে টাকা আদায়ের জন্য প্রবল চাপ দেওয়া চলছে, সেইসময়ই জ্যাঠামশাই হাজির। রাস্তা দিয়ে
যেতে যেতে সম্ভবত তিনি ঘটনাটা শুনে থাকবেন। তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ করলেন। প্রথমটায় পাগল ঠাকুরের
কথায় কেউ তেমন গুরুত্ব দিল না। তিনি জোর দিয়ে বললেন, মুসলমানকে দিয়ে কাজ করানোয় কোনো অন্যায়
হয়নি। এতে কোনো অসুবিধা নেই। এদেশে হিন্দু-মুসলমান হাতে হাতে অনেক কাজ করেছে। ইতিহাসে অনেক ভালো
ভালো উদাহরণ আছে। সেসব ভাববে না একবারও ? আমাদের স্বাধীনতার সময়েও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাই
লড়াই করেছে। সেই স্বাধীনতা কি একেবারেই অচ্ছুৎ হয়ে গেল ? প্রায়শ্চিত্যেরই-বা দরকার কী ? এসব কী হচ্ছে
?
প্রথমদিকে আমল না-দিলেও পরের দিকে আর সহ্য করতে পারল না কেউ কেউ। রঘুনাথ কুশারির কানেও কথাটা
গেল। তিনিও কয়েকজন সঙ্গীসাথি নিয়ে সেখানে হাজির। এমনিতেই ক্লাবের অনেকে জ্যাঠামশাইয়ের আচমকা নাক-
গলানোয় তেতেই ছিল, রঘুনাথের উস্কানিতে আগুনটা জ্বলে উঠল। প্রথমে তর্কাতর্কি হল খুব। তারপর কেউ একজন
ধাক্কা দেওয়াতে টাল সামলাতে না-পেরে পড়ে গেলেন জ্যাঠামশাই। সুযোগ বুঝে কেউ কিছু একটা ছুঁড়ে দিলে সেটা
লাগল জ্যাঠামশাইয়ের নাকে। গলগল করে রক্ত বের হল।
এই নিয়েই দুটি পক্ষ ভাগ হয়ে গেল। পাগল ঠাকুরের গায়ে হাত দেওয়া ঠিক হয়নি বলে একদল অপর দলের প্রতি
দোষারোপ করল, তেড়ে গেল একে অপরের দিকে। মাঝে পড়ে জ্যাঠামশাইকে আরও ধাক্কা, লাথি, ঘুষি, চড়চাপড়
খেতে হল। তাঁর সাদা ফতুয়া ছিঁড়ে দিল কেউ। আর রঘুনাথ ‘তাহলে এটা কেন রেখেছিস হারামজাদা’ বলে
জ্যাঠামশাইয়ের পৈতে টেনে ছিঁড়ে দিলেন।
এই ডামাডোলের মধ্যেই তরুণ সঙ্ঘের দু-চারজন আর হরিপদ মিলে জ্যাঠামশাইকে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেল সেখান
থেকে। নাকে আর বাঁ হাতে ব্যান্ডেজ, ডান হাতের কনুইয়ের কাছে ওষুধ লাগানো তুলো, এখানে-ওখানে ছড়ে
যাওয়ার চিহ্ন নিয়ে জ্যাঠামশাইকে বাড়ি পৌঁছে দিল তারা। ওদের থেকেই শোনা গেল দুর্ঘটনার কথা।
যাকে কেন্দ্র করে এত সব ঝামেলা বা গণ্ডগোল, সেই হাবুল মণ্ডল গা-ঢাকা দিয়েছে অনেক আগেই। এবার সুযোগ
বুঝে গা-ঢাকা দিল হরিপদও। মাঝখান থেকে মার খেল পাগল ঠাকুর, মাথা ফাটল তরুণ সংঘের সেক্রেটারি
বলরাম চাটুজ্জের, কমবেশি আহত হল বচা, রথিন, মহীতোষ, শংকররা।
৭
জ্যাঠামশাইয়ের আঘাতটা ঠিক কতটা বুঝতে পারিনি আমরা। শরীরের সঙ্গে মনের আঘাতটাও যে ছিল সে-কথা
আমাদের মাথায় আসেনি। তখন যতটুকু শুনলাম, তাতে সামান্য হাতাহাতি ভেবেছিলাম আমরা। কিন্তু পরদিন
বিকেলে তরুণ সঙ্ঘে গিয়ে পুরো ব্যাপারটা শুনলাম। ক্লাবের সেক্রেটারির মুখে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ শুনে
বুঝতে পারলাম ভয়ংকর ঘটনার মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন জ্যাঠামশাই। কতটা ভয়ানক যে পরিস্থিতি হতে পারে তার
খানিকটা আঁচ পেলাম রঘুনাথ কুশারির হুমকি শুনে। ক্লাব থেকে ফেরার পথে রঘুনাথ কুশারিকে দেখলাম ঐ পথ
দিয়েই কোথাও যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখতে পেয়ে জানিয়ে দিলেন পাগল ঠাকুরের বাড়াবাড়ি তাঁরা ভালোভাবে
নেননি। সুযোগ পেলে তিনি যে ছাড়বেন না সে-কথাও জানিয়ে দিয়েছেন।
ক্লাব থেকে ফিরে এলাম সন্ধ্যার কিছুটা পরে। এসে দেখি জ্যাঠামশাইয়ের প্রবল জ্বর। ভুবন বসে আছে
জ্যাঠামশাইয়ের পাশে। বাবাও পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তাড়াতাড়ি গিয়ে ডাক্তার মৈনাক সরকারকে ডেকে আনলাম।
ইনি আমাদের পারিবারিক ডাক্তারের মতোই। দরকার হলেই ডেকে আনি। তিনি দেখেশুনে জ্বর আর ব্যথার ট্যাবলেট
লিখে দিলেন। প্রেশার সামান্য বেশি। তেমন ভয়ের কিছু নেই। তবে রেস্ট দরকার বলে জানালেন।
ডাক্তারবাবু বললেন তাঁর কানেও খবরটা পৌঁছেছে। ভয়ের কিছু নেই। তবে আপনারা পুলিশকে ইনফর্ম করলে
পারতেন। বাবাও তাই চাইছিলেন। সেদিনই বলেছিলেন পুলিশের কথা। কিন্তু জ্যাঠামশাই কিছুতেই রাজি হলেন না।
আমিও সে-কথা বলেছিলাম। কিন্তু জ্যাঠামশাইয়ের অবস্থা দেখে খুব-একটা জোর দিলাম না। ক্লাব থেকে ফিরে এবং
রঘুনাথ কুশারির কথা শুনে মনে হল থানায় একটা ডায়েরি করা উচিত। ডাক্তার চলে গেলে জ্যাঠামশাইকে বললাম
পুরো ব্যাপারটা। আর পুলিশে জানানোর ব্যাপারেও জোর করলাম।
~ তোরা বুঝতে পারছিস না, পুলিশকে জানালে ওই কচিকচি ছেপেপুলেদের ধরে নিয়ে যাবে। সেটা কি ঠিক হবে ?
ওরা ক্ষণিকের ভুল করে ফেলেছে।
~ মারধরকে ক্ষণিকের ভুল বলছেন আপনি ?
~ তা নয়তো কী ? আর-একটা ব্যাপার ভাব তোরা। ও পথ দিয়ে যাওয়ার সময় রোজই ওদের মুখ দেখি।
ওদের অনেকের বাপ-মাকেও আমি চিনি। ওদের বিরুদ্ধে এফআইআর করব ? পুলিশে জানাবো ?
~ যারা তোমার মতো মানুষের গায়ে হাত তুলতে পারে তাদের কচিকচি ছেলে বলছ দাদা ? এটাকে মামুলি ভুল
বলে মনে করছ তুমি ?
(ক্রমশ)
সুচিন্তিত মতামত দিন