এবং ড্যাস
প্রথম পর্বের পরঃ
২পর্ব
অফিসে নিজের কেবিনে বসেছিল তিতিক্ষা। বড় এম.এন.সি-র এইচ.আর-এ আছে ও। মুলতঃ বাবার উৎসাহেই এম.বি.এ-টা করে নিয়েছিল দীপ্ত যাবার পরপর। তার সুফল এখন পাচ্ছে। অফিসে বেশ সুনাম তিতিক্ষার। মিষ্টি কথায় কাজ হাসিল করতে জানে। ম্যানেজমেন্টও খুশি তাই। মেন ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার হবার পর,কাজের চাপ বাড়লেও,স্যালারির অঙ্কটাও মোটা হয়েছে আরো। তবে টাকা জমায় না তিতিক্ষা। শপিং ওর নেশা। যা দেখে-কিনে ফেলে। এর জন্য বাবার বকুনি খায়। বাবাই বেশ কিছু ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান করে দিয়েছেন। এল.আই.সি,পেনশন প্ল্যান,এস.আই.পি। মুনাই-এর জন্য চাইল্ড প্ল্যানও করা আছে,নেক্সট ইয়ার ম্যাচিওর হবে। তিতিক্ষা জানে ওর মেয়েকে কোথাও ভর্তি করতে ডোনেশন অন্তত দিতে লাগবে না। কিন্তু ভর্তি করবে কোথায়? ভাইয়ের মনে হয় ইচ্ছা আই.আই.টি। কিন্তু এই মেয়েকে হোস্টেলে ছাড়ার কথা ভাবতেও পারে না তিতিক্ষা। দাদু,নাতনি দুজনেরই ইচ্ছা যাদবপুর। তবে আজকাল সেখানে যা চলছে,শিক্ষার পরিবেশ আদৌ কতটুকু আছে-সন্দেহ আছে তিতিক্ষার। তার উপর মুনাই একেবারে নিষ্পাপ,সরল। ঐ পরিবেশে মানাতে পারবে কি না কে জানে? ইঞ্জিনিয়ারিং আসলে তিতিক্ষার অপছন্দ। ওর মনে সাধ ছিল যদি মেডিক্যালে যায়। মুনাইকে বলেনি কথাটা। বললে ও মামমামের কথা রাখতে-মেডিক্যালই পড়বে। কিন্তু থাক। ও নিজের ইচ্ছা মত যা খুশি করুক। কলেজে উঠলেই নিজের কাজ যাতে নিজে করে-এটা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ হায়ার স্টাডিজে অ্যাব্রড গেলে সব নিজেকেই করতে হবে। অ্যাব্রড পাঠাতে কষ্ট হবে তিতিক্ষার। মুনাইকে ছেড়ে একা থাকে নি তো কোনদিন। তবে মাসিমণির মত প্যানপ্যান করবে না। ভাই-এর বিদেশে যাওয়াটা মাসিমণির জন্যই স্থগিত হয়ে আছে। ভাই মনে মনে খুব করে যেতে চায়। বাবাও চান। কিন্তু মাসিমণি অসুস্থ ছেলে বাইরে ছাড়বে না। বাবা ভাই-এর ব্যাপারে মাসিমণির কথার উপর কিছু বলেন না। মা মারা যাবার পর মাসিমণি ভাইকে যেভাবে আপন করে নিয়েছিলেন-তারপর আর কথা চলে না। বাবা মাসিমণির অবদানকে সম্মান করেন। ভাই মাসিমনিকে মামণি বলে। তিতিক্ষাও মানে মাসিমণি-ই ভাই-এর মা। তবে মাসিমণি তিতিক্ষার প্রতি ছোট থেকেই ভাই-এর একাংশ স্নেহশীল নন। তিতিক্ষাকে অপরের সন্তানের মত দেখেন। দূরত্ব রাখেন। ভাই-এর সাথে পদে পদে তুলনাও করেন এমনভাবে-যেমনটা আর সবাই নিজের সন্তানের সাথে দিদির সন্তানের করে। তিতিক্ষা মাসিমণির এই মানসিকতার তল পায়নি এখনো। ভাই যেমন মাসিমণির নিজের দিদির অংশ-তিতিক্ষাও। তবুও দু’জনের প্রতি দু’রকম আচরণ কেন? নাকি মাসিমণি ভাই-এর ‘মামণি’ হতে গিয়ে-এত বেশি করেই তা হয়েছে,যে অন্য কোন ভুমিকার গুরুত্বই নেই তার কাছে? সে যাই হোক-তিতিক্ষার নিজের অমূলক আশঙ্কা,ভয় আর পজেসিভনেসের জন্য মুনাইকে আটকাবে না। ওর যদি অ্যাব্রড যাবার হয়-যাবে। আর্মিতে তো আর যাচ্ছে না! এই একটা জায়গায় বড় বাঁচা বেঁচে গেছে তিতিক্ষা। খুব করে ছেলে চেয়েছিল সবাই। দীপ্তর মা,বাবা,দিদি,তিতিক্ষার বাবা,মাসিমণি। দীপ্ত আর তিতিক্ষা মেয়ে চেয়েছিল। ওদের কথাই ভগবান শুনেছেন। ছেলে হলে তিতিক্ষা নিশ্চিত জানে ব্রিগেডিয়ার তীর্থঙ্কর মুখার্জী আর ক্যাপ্টেন দীপ্ত গাঙ্গুলীর রক্ত ওকে আর্মিতেই নিয়ে যেত। নিজের সন্তানকে আর যেখানেই পারুক আর্মিতে ছাড়তে পারবে না তিতিক্ষা। আর্মির জন্যই তিতিক্ষা বাবা পায়নি,মুনাই-ও দীপ্তকে পেল না। তাই আর্মি কোনমতেই নয়। মুনাইটার মাথায় আর্মির ভূত নেই-এটা তিতিক্ষা নিশ্চিত। ওর পথ আলাদা,রিসার্চের পথ,সাধনার পথ,পড়াশুনার পথ।
অলি দরজা ঠেলে কেবিনে ঢুকল। তিতিক্ষার কলিগ। বছর দুয়েকের ছোট। বেঁটে খাটো,মাঝারি গড়ন,খুব ফর্সা। চশমা পরে। মাথায় কোঁকড়ানো চুল, স্টেপ কাট করা। খুব হুজুগে। তিতিক্ষার শপিং-এর পার্টনার। হুটহাট করে প্ল্যান বানিয়ে ফেলে পার্টির,আউটিং-এর। মজার মজার কথা বলে। ওর বর সমীর-মানে স্যাম-ও তেমনি। দুটিতে রাজযোটক একদম। বছরে তিনবার অন্তত লম্বা ট্রিপে বেড়িয়ে পড়ে দু’জনে। এখনো ছেলেমেয়ে হয়নি-অথবা নেয়নি। স্যাম আবার ট্রেকিং, মাউন্টেনিয়ারিং-এসব কাজেও বেশ ভালোভাবে ইনভলভড। নিজে একটা বেসরকারী ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। বয়সে অলির সমানই হবে। লম্বা,ছিপছিপে চেহারা,ডার্ক কমপ্লেকশন। অলিও স্যামের পাল্লায় পড়ে এখন পাহাড়,জঙ্গল,ট্রেকিংকে আপন করে নিয়েছে। ওদের কোন পিছুটান নেই। ভবিষ্যৎ চিন্তাও নেই। বেশ আছে।
-তিতিক্ষা দি, আজকের প্ল্যান কি?
তিতিক্ষার কেবিনে ঢুকেই এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করল না অলি।
-অফিস থেকে বাড়ি। তেমন কোন প্ল্যান নেই।
তিতিক্ষা ফাইল চেক করতে করতে বলল।
-ওফ হো! তুমিও না! বোরিং হয়ে যাচ্ছ দিনে দিনে।
-অলি-মুনাইটার একসাম তো সামনে, না?
-সে তো মার্চে। বহু দেরি। চলো না গো, আজ শপিং যাই।
তিতিক্ষা এক মুহূর্ত ভাবল। কয়েকটা জিনিস ওরও কেনার ছিল। আজ বুধবার, বিগবাজারে সস্তায় পাওয়া যাবে। মুনাই-এর টিউশন শেষ হতে হতে রাত আটটা। ওকে অশোকনগর থেকে পিক আপ করতে হবে তখন,মানে পাঁচটা থেকে আটটা সময় আছে,যাওয়া যেতেই পারে।
-আচ্ছা,চল্ তাহলে।
-দ্যাটস্ লাইক আ গুড গার্ল। বলি,নীতিনদার কি খবর?
নীতিন তিতিক্ষার সাথে আগের ব্রাঞ্চে কাজ করত। এইচ.আর-এই আছে। তিতিক্ষার উপর বড় ব্যথা আছে তার। ফেসবুক,হোয়াটস্ অ্যাপে সবসময় লেগে পড়ে থাকে। ডিভোর্স হয়েছে ওর বছর দুয়েক হল। অলি ওকে আগের মাসের অফিস পার্টিতে দেখেছে। দেখেই বুঝে নিয়েছে হালচাল।
-তোর শুধু বেফালতু কথা।
-আরে,তোমার উপর লাট্টু তো একদম। আমাকে খালি বলে লেটস্ ক্যাচ আপ সামহয়ার। লেটস্ অ্যারেঞ্জ এ গেট টুগেদার। তিতিক্ষা বুঝল নীতিন এসব করছে তিতিক্ষার সাথে দেখা করার জন্য। তিতিক্ষা ওকে ইগনোর করে। বড় গায়ে পড়া। সারাদিন হাই,হ্যালো,কি করছ? খেলে কিনা-পাঠাতেই থাকে। নেহাত এক কোম্পানিতে কাজ করে, টানা তিন বছর একসাথে,এক টিমে কাজ করে এসেছে, তাই। না হলে এতদিনে ব্লক করে দিত।
-বাহ,ভালো তো। তুই ক্যাচ আপ কর।
-আমার জন্য বলে না?
-কি করে জানলি বলে না?
-ছেলেদের মতিগতি ভালোই বুঝি। আর আমার পিছনে লেগে লাভ নেই। আমার মাল্লি মস্তান মাথা ভেঙ্গে দেবে।
তিতিক্ষা হেসে ফেলল। পারেও মেয়েটা। তারপর সংযত স্বরে বলল
-নীতিনকে বেশি পাত্তা দিস না।
-দিলাম না। বাট যতীন,প্রবীন,নবীন...এরা তো আসতেই থাকবে।
-মানে?
-মানে আবার কী? তুমি একে এত সুন্দর,তায় এত সেক্সি,তার উপরে এত আর্ন কর-এই লাইন কি কমবে মনে হয়? গত একবছরেই কত যে দেখলাম-গুণতে বসলে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
অলির কথায় মজার সুর মিশে থাকলেও কথাটা বাস্তব। তিতিক্ষাও জানে সেটা। কিন্তু সন্তর্পণে এড়িয়ে যেতে চায় বিষয়টা।
-তাহলে না গুনে,নিজের কাজগুলো সেরে নে চটপট। শপিং যাবি তো।
-একটা কথা বলি?
তিতিক্ষা ফাইল থেকে মুখ তোলে
-বল্।
-এতগুলো বছরে কাউকে পছন্দ হয়নি?
তিতিক্ষা মৃদু হাসে।
-যাকে পছন্দ ছিল, সে তো কোথাও নেই আর।
-তাতে কি জীবন থেমে থাকে?
-থেমে কই? বেশ আছি তো। হই হুল্লোড়ও করছি তোদের সাথে। মুনাই বড় হয়ে গেল-আর কয়েকটা বছর-ব্যাস।
-তারপর?
-মানে?
-মানে,ব্যাসের পরে কি?
-ব্যাসের পরে, মুনাই সেটেলড্ আমি ঝাড়া হাত পা।
-অ্যাব্রড যাবে?
-হ্যাঁ। যদি ওর মনে হয় ওখানেই সেটেল করবে।
-তারপর বিয়েও হবে ওর। এসব হতে আর বছর আট-দশ, তাই তো?
অলির মুখের দিকে তাকায় তিতিক্ষা। ওর মুখে পরিচিত হাসিটা নেই। অন্যরকম লাগছে ওকে। বড্ড গম্ভীর।
-তাই তো এক্সপেক্টেড। কেন রে? এভাবে বলছিস কেন?
-তখন তো তুমি সবে ফরটি ফাইভ পেরোবে তিতিক্ষা দি। পরের লম্বা জীবনটা একা কিভাবে কাটবে ভেবেছ?
তিতিক্ষা থমকায়,এভাবে ও ভাবেনি কখনো। দীপ্ত যাবার পর মুনাই-এর বাইরেও কিছুই ভাবেনি। দূরের কথা ভেবে লাভ কি?
-যেভাবে কাটছে, সেভাবেই কেটে যাবে। আর অলি, বেশি দূরের কথা ভাবতে নেই। একটা একটা করে দিন বাঁচতে হয়।
অলি হাসে। সে হাসিতে তিতিক্ষার জন্য কষ্ট মিশে থাকে।
-স্যাম আর আমিও দূরের কথা ভাবিনা তো।
-তাহলে? যা কাজগুলো ঝটপট সেরে নে। আজ আমি ট্রিট দেব।
-দূরের কথা ভাবিনা বলেই এখনো ইস্যু নিইনি। আসলে কাউকে কেন্দ্র করে নিজেদের জীবনটা বাঁচতে চাই না যে, এটা একটা অভ্যাস-জানো তো? নিজের সবটুকু একজনকে ডেডিকেট করলে-সে যখন দূরে চলে যায়,পরের হয়ে যায়-তখন মনে হতেই পারে-আমি কি পেলাম এসব করে? আমার ইচ্ছা,আমার শখ,আমার আহ্লাদগুলোকে এভাবে অবদমন করে-নিজেকে ঠকালাম না তো? তাই নিজেদের বাঁচাগুলোকেই আগে বেঁচে নিচ্ছি পুরোদমে।
তিতিক্ষাকে চুপ করিয়ে দিয়ে চলে গেল অলি। সত্যিই তো-মুনাই একদিন না একদিন দূরে চলে যাবে। তার আলাদা ঘর হবে,সংসার হবে। সেখানে তিতিক্ষার জায়গা হবে তো? আর তিতিক্ষার পরের সংসারে যাবেই বা কেন? বাবা তো চাইলেই মুনাই আর তিতিক্ষার কাছে থাকতে পারেন। কিন্তু থাকেন না। একা থাকেন। সে বাবা না হয় একা থাকতে অভ্যস্ত। কিন্তু তিতিক্ষা তো মুনাইকে ছেড়ে থাকেইনি। যখন বাসা ফাঁকা করে উড়ে যাবে পাখি-ফাঁকা বাসায় তিতিক্ষা একা থাকবে কি করে? কাকে নিয়ে থাকবে? কার জন্য বাঁচবে? প্রশ্নগুলো এই প্রথমবারের মত ঘিরে ধরে তিতিক্ষাকে।
(পর্বঃ-৪)
অলির পাল্লায় পড়ে বেশ ভালো মতই শপিং করা হয়ে গেল। অলি তো একটা জিনিস দশ জায়গায় দেখে তারপর কেনে। দরদাম করে। বড় খুঁতখুঁতে ওর জামাকাপড়ের ব্যাপারে। সহজে পছন্দই হয় না। তিতিক্ষার বিরক্ত লাগে মাঝেমধ্যে। কিন্তু সহ্য করতে হয়। বললেই বলবে,“তোমার মত ফিগার তো আমার নয় তিতিক্ষাদি, দেখতেও অমন ফাটাফাটি নই যে যা পরব,তাই মানাবে। তাই বেছেবুছে কিনতে হয়।” কি আর উত্তর দেয় তিতিক্ষা? ওর চক্করে পড়েই লেট হয়ে গেল। মুনাইটার ছুটি হয়ে গেছে মনে হয়। আটটা পাঁচ বাজে। ইস্! স্কুল থেকে ডাইরেক্ট ওখানে পড়তে যায়। খিদেও পেয়ে গেছে ওর। রাগ করবে। অভিমান করবে। কথা-ই বলবে না প্রথম প্রথম। “আজকেও শপিং?” এভাবেও বলতে পারে। না,না-তিতিক্ষারই ভুল। ও এতটা কেয়ার লেস হল কি করে? তিতিক্ষার মাতৃসত্ত্বা ওকে তিরস্কার করে। অশোকনগরে তড়িঘড়ি অটো থেকে নামে ও। ভাড়া মেটায়। কোথায় দাঁড়িয়ে আছে মুনাইটা? বারবার করে বলা আছে লেট দেখলে যেন কল না করে একা হাঁটা না দেয়। কল তো এখনো করেনি। তাহলে কি ব্যাচ চলছে? তিতিক্ষা জোর পা চালায়। যা ভেবেছে ঠিক তাই। স্যারের বাড়ির নীচটাতে একা দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। কলটাও করেনি। আহা রে! খিদে পেয়েছে। মুখটা শুকিয়ে গেছে।
-বাবু,সরি রে। লেট হয়ে গেল। কল করবি তো? তিতিক্ষা পরিস্থিতি সামলে নিতে বলে। মুনাই সুন্দর করে হাসল।
-কল করতে ভুলেই গেছি। সরি, মামমাম।
তিতিক্ষা বোঝে মেয়ের মন খুব ভালো আজ
-ব্যাচে কি হল? ফুল মার্কস পেয়েছিস? এত খুশি যে!
-ও তো রোজই পাই।
তিতিক্ষা মেয়ের চোখে দুষ্টুমির হাসি দেখে। মেয়ের হাত ধরে
-তাহলে? কি এমন হয়েছে? মুনাই সোনা চল্, আগে বাড়ি চল্। ফ্রেশ হ। তারপর সব শুনব।
-মামমাম,একটা জিনিস চাইব?
তিতিক্ষার বিস্ময় বাঁধ মানে না। মেয়ে নিজে থেকে কিছু চাইছে? স্মার্ট ফোনটাও তো তিতিক্ষা-ই জোর করে কিনে দিয়েছে। ল্যাপটপটাও।
-কি চাই,বাবাই? বল্।
-আজ পিৎজা খেতে ইচ্ছা করছে। অর্ডার দেবে?
পিৎজা! এইটুকুই? তাও তিতিক্ষার মন ভরে যায়।
-আচ্ছা। হোম ডেলিভারির অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি। খুশি?
মুনাই মামমামকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে-
-খু-উ-ব।
তিতিক্ষা মেয়ের মাথায় আদরের হাত রাখে
-তাহলেই আমি খুশি।
তিতিক্ষার অলির কথাগুলো মনে পড়ে যায়। মনে মনে হেসে ওঠে ও। কাউকে কেন্দ্র করে বাঁচায় যে আনন্দ আছে-তা অলি এখন বুঝবে না। আর সেই কেউটা যদি সন্তান হয়,তাহলে সে যে কত বড় মোহ,কত বড় মায়া-তার পরিমাপ তিতিক্ষা করতে পারে না। কিন্তু এই মায়া ওর জীবনের সবটুকুকে ঘিরে রেখেছে। আর রাখবেও।
মা মেয়েতে মুখোমুখি বসে ডাইনিং টেবিলে। পিৎজা ডেলিভারি বয় পিৎজা দিয়ে গেছে। তিতিক্ষা খোলে প্যাকেটটা। স্লট,পিপার,চিলি ফ্লেকস্ ছড়ায়। এক্সট্রা চিজ দেওয়া পিৎজা অর্ডার করেছিল তিতিক্ষা। মেয়ে ভালোবাসে।
-তাহলে এবার বল্, কেন ঐ দুষ্টু হাসিটা ঝুলিয়ে রেখেছিস?
-সিক্রেট।
-বাব্বাঃ! এত সিক্রেট,যে মামমামকেও বলা যাবে না?
মুনাই মামমামকে রাগাবার জন্য এসব করছে। মামমামকে তো ও সব বলে। সবই বলবে। কিন্তু একটু নখড়া করবে আগে।
-উঁহু,পার্সোনাল।
তিতিক্ষাও মুনাই-এর দুষ্টুমিটা বোঝে। কপট রাগে মুখ ফোলায়
-থাক্, তাহলে শুনে কাজ নেই। মামমাম্ তো পর। বন্ধু না তো। মামমাম-ও কিছু বলবে না আর।
মুনাই খুশি হয়। ওর প্ল্যান সাকসেসফুল হেয়েছে। এই রেগে নাক মুখ ফোলানোটাই দেখতে চেয়েছিল ও। লেট করে এসেছিল না? একটু বুঝুক।
-তুমি না বললেও আমি সব সব জানি। তুমি অলি আন্টির সাথে আবার হাবিজাবি শপিং করে এসেছ-তাই লেট হয়েছে।
তিতিক্ষা হেসে ফেলে
-হ্যাঁ রে। জোর করল আবার।
-যাও,যাও। আমার কথা তো মনেই থাকে না তখন।
-মনে না থাকলে কি করে দু’টো থ্রি কোয়ার্টার আনলাম?
-ও তো অফারে পেয়েছিলে বলে!
-ওহ! মামমাম কি তাহলে অফারের জিনিস-ই আনে?
-তাই তো।
--ফেরৎ দিয়ে দেব কাল,যা।
-মুনাই এবার চেয়ার থেকে উঠে মামমামকে জড়িয়ে ধরল।
-রাগ করলে?
-করলাম।
-রাগ করে থাকতে পারবে তোমার মুনাই-এর উপর?
-পারব।
তিতিক্ষা একটু রেগেও গিয়েছিল। খুব পার্সোনাল দেখানো হচ্ছে না?
-যদি বলি, একটা ছেলেকে ভালো লেগেছে,তাহলে?
এই কথাটার জন্য প্রস্তুত ছিল না তিতিক্ষা। দুনিয়ার বিস্ময় ভিড় করল ওর চোখে।
-কাকে? ব্যাচমেট? কি নাম? আমি চিনি?
এক নিঃশ্বাসে এতগুলো প্রশ্ন করে ফেলল তিতিক্ষা।
-কে তাই-ই তো জানি না।
-মানে? ফেসবুক ফ্রেন্ড?
-আরে, না মামমাম! পড়তে ঢোকার সময় দেখলাম, অশোকনগর মোড়ে বাইকের উপর বসেছিল। যেমন টল,তেমন ফেয়ার,তেমন স্মার্ট-আর সিগারেট ধরানোর স্টাইলটা...উফ্!
তিতিক্ষার মাথা ঘুরে গেল। পাড়ার মোড়ের ছেলে? বাইকে বসে সিগারেট ফুঁকছে? লোফার হবে তো একটা?
-পাড়ার ছেলে? রকের ঐ ছেলেদের কেউ?
-না গো মামমাম! ওরা অমন স্টাইলিশ নাকি? তুমি ব্ল না প্রিন্স চার্মিং-আমি বুঝতাম না। আজ দেখে বুঝলাম-প্রিন্স চার্মিং কেমন হতে পারে।
বাব্বাঃ! মুনাই মা? এক দেখাতেই এত?
-ইয়েস। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।
তিতিক্ষা মেয়ের সাথে ছেলেমানুষি করতে চাইল।
-লাভ? তোর মত বুক ওয়ার্মের? দেখি, একবার কপালটা দেখি।
-কেন?
-আরে,জ্বর-টর এল কি না দেখি। জ্বরের ঘোরে এসব বকছিস কিনা দেখতে হবে তো!
-নো,নো,নো,নো জ্বর নেই। বলেছিলাম না, যখন আসবে,তখন দেখবে? বান্দে মে কুছ তো বাত হ্যায়।
-তাহলে তো দেখতে হয় তাকে।
-কি আজব! কোথায় পাবে? পথ চলতি ছিল। সিগারেট কিনতে থেমেছিল-আবার চলে গেছে।
তিতিক্ষা মুষড়ে পড়ল
-তাহলে?
-তাহলে আর কি মামমাম? প্রিন্স চার্মিং এল-চলেও গেল।
-আমি যে ভাবলাম...
-তুমি অ-নেক দূরের ভেবে ফেলেছ আমি জানি,মা জননী। এবার থেমে যাও। তোমার ছোট্ট মেয়েটার সামনে মস্ত কয়েকটা এক্সাম,জানো তো? ক-ত পড়তে হবে তাকে এই কয়েকমাস। এসব নিয়ে ভাবলে চলবে?
যাঃ! আমি তো ভাবলাম তুই সত্যিই সত্যিই...
-সত্যিই তো। ভালো লেগেছে। জাস্ট একটা আনন্দ। ক্রাশ একটা। আর তো কোনদিন দেখাও হবে না-তাও থাক্...
-সত্যি যদি কেউ কাউকে ভালোবাসে,তাহলে আবার দেখা হয়।
মুনাই হেসে ফেলে
-মামমাম-তোমার ফিল্মি ডায়ালগ থামাও। ওসব ফিল্মেই হয়।
-কেন? তোর বাবিকেও তো আমি...
বলেই থেমে গেল তিতিক্ষা। কথা গিলে নিল। এই প্রসঙ্গে কথা বললে মুনাই-এর চোখে জল আসে। যেটা তিতিক্ষা চায় না।
-হাজারবার শুনেছি। বাবিকে একবার দেখেই ভালোলেগে গিয়েছিল। তখন জানতেই না দাদুভাই-এর রেজিমেন্টেরই। পরে যখন জানলে,তখন খুব খুশি হয়েছিলে।
তিতিক্ষা ম্লান হাসে। মুনাই মামমামের গালে চুমু খায়।
-আমি কাঁদব না,মামমাম। বাবি তো আমার মধ্যেই আছে। এই-দেখ আমি হাসছি। তুমি শুধু কেঁদো না।
তিতিক্ষা চোখ মোছে। কিছু কষ্ট লুকান যায় না। মুনাই মায়ের কোলে বসে। এটা ওর খুব আদুরেপনার সময়কার একটা অভ্যাস।
-তবে, গ্রিনি,বাবির থেকে একটু হ্যান্ডসাম।
-গ্রিনি কে?
-ঐ যে ছেলেটা। ছেলে, না লোকই হবে। গ্রিন শার্ট পরেছিল। তাই ওর নাম গ্রিনি।
-গ্রিনি! বাঃ। বেশ নাম তো। তা বলে বাবির থেকে হ্যান্ডসাম,তা নয়-মাই দীপ্ত ইজ দ্যা বেস্ট।
-নাহ মাই গ্রিনি। তবে ঐ সময় যদি বাবি তোমাকে আমাকে দুজনকে একসাথে দেখত-আই ক্যান বেট ইউ-তোমাকে পাত্তাই দিত না। আমার বয়ফ্রেন্ড হয়ে যেত।
তিতিক্ষা মেয়ের কথায় হেসে ফেলল।
-তুই তো অনেক সুন্দর আমার থেকে। তোকে দেখলে কি আর আমাকে মনে ধরত নাকি?
-দেখলে,কেমন মিথ্যা বলতে শিখেছ? তোমার থেকে কেউ সুন্দর হয় নাকি? বাবি আমার দিকে তাকাতই না।
তিতিক্ষা অস্বস্তিতে পড়ল। কথা ঘোরাল তাই
-একটা সেলফি হবে না কি,কোলে বসে?
-একদম। হাগ করে।
আজ মেয়ের মন খুবই ভাল। অন্যদিন তিতিক্ষার সেলফি তোলার কথায় পালিয়ে যায় আজ নিজেই রাজি। তাও আবার ঠোঁট দুটো পাউট করে মামমামকে জড়িয়ে ধরে সেলফি। তুলল মুনাই।
-পোস্ট করে দাও মামমাম।
-ওকে।
-যদি। গ্রিনি নোটিশ করে, কি বলো?
দুষ্টু হাসল মুনাই।
-নোটিশ করলে তো খুব ভালো। তাই না বাবাই?
নাহ। তার থেকে যেমন আছে থাক। মনে মনে ভাবব,তাহলেই হবে।
নিজের কিশোরী মেয়ের প্রথম ভালোবাসার অনুভূতিকে মন থেকে অনুভব করল তিতিক্ষা। কোন চাওয়া পাওয়া নেই তার মধ্যে। মন ভরে গেল যেন।
-এবার পড়তে বসি? হ্যাঁ,মামমাম?
আচ্ছা।
-তুমি ডিনার রেডি করেই আমার ঘরে চলে আসবে কিন্তু। আজ মামমামকে খুব কাছে চায় মুনাই মামমামের মত করে ওর যে আর কেউ নেই।
(পর্বঃ-৫)
তন্ময় কয়েকদিনের জন্য কলকাতা এসেছিল। মামণির শরীরটা ভালো না। অন্তরার সাতমাস চলছে। ওকে ওর মা-বাবার কাছে রেখে যাবে। ব্যাঙ্গালোরে দুজনে থাকে। প্রথম বেবি। অন্তরার বাবা চান না অচেনা জায়গায় হোক। কলকাতায় ওনাদের চেনাশোনা গাইনোকোলজিস্ট আছে। তার আন্ডারেই রাখতে চান মেয়েকে। এতে তন্ময় যে অখুশি, তা নয়। অন্তরা এখানে সেটল করে গেলেই বরং ভালো। ও ক্যালিফোর্নিয়া যেতে চাইলে অন্তরা বা ওর বাড়ির লোকেদের থেকে খুব বেশি আপত্তি আসবে না। তারা তখন নিজেদের নিয়ে নিজেরাই ব্যস্ত থাকবে। সমস্যাটা মামণিকে নিয়ে। মামণি কিছুতেই তার প্রাণের গুবলুকে একা একা বিদেশ বিভুঁই-এ ছাড়তে রাজি নন। অথচ তন্ময়ের কেরিয়ারের জন্য এটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা অপারচুনিটি। বাবার মত আছে। মেসোমণিরও। কিন্তু মামণিকে কে বোঝাবে? এই অসাধ্যসাধনটা করতে তন্ময়-ই পারে। তাই ওর এখানে আসা। আরো একটা উদ্দেশ্য আছে-মুনাইটাকে একটু দেখা। সব ঠিক থাকলে তন্ময় মাস খানেকের মধ্যেই চলে যাবে। বছর খানেকের আগে লিভ নিয়ে ফেরা যায় না। মানে ফিরতে ফিরতে মুনাইএর এক্সাম নির্ঘাত পার হয়ে যাবে। আদরের ভাগনিটাকে এক্সামের আগে সামনাসামনি উইশ করতে চায় তন্ময়। ওকে একদম নিজের মত বানাবে। তন্ময়ের অনেক স্বপ্ন ভাগনিকে নিয়ে। ওর মধ্যে বিজ্ঞান চর্চার একটা আগুন আছে। সেই আগুনকে সযত্নে প্রতিদিন উস্কে যায় তন্ময়। সময় দেয় ওকে। ফোনে,টেক্স্ট,স্কাইপে-যেভাবেই হোক ওকে গাইড করে। আইআইটি ক্র্যাক করে ফেলবে মুনাই। ব্যাস! তন্ময় ওকে নিজের স্ট্রিমেই পড়াবে,মেকানিক্যাল। দিদিভাই,দীপ্ত দা,বাবা-কারোর মত না। মুনাই হবে মামার মত। তন্ময় মুনাই-এর সামনে গম্ভীর গম্ভীর হয়ে থাকে। রাশভারী একদম। মামাকে বেশ ভয় পায় মুনাই। তা পাওয়া ভালো। বাবা,দিদিভাই-এই দু’জনের একজনও শাসনে করেনি কোনদিন। তাই তাদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। মামার দিক থেকে ভয়টা থাকুক।
-তোমার দিদিভাই-এর বয়স কি দিনকে দিন কমছে?
তন্ময় মন দিয়ে একটা আর্টিকেল পড়ছিল। ড্রয়িংরুমে সবাই ছিল। মামণি,মেসমণি,তন্ময়। এমন সময় অন্তরার এই অকস্মাৎ বাক্যবাণ তন্ময়কে অবাক তো করলই,সাথে সাথে মামণি,মেসোমণির মনসংযোগ আকর্ষণও করল।
-কেন? কি হয়েছে?
তন্ময় বিরক্তির সুরে বলল।
-দেখো তো মামণি। এরকম সেলফি,কেউ দেয়? আর তোমার আদরের ভাগনিটিকেও দেখো। পাউচ করে-টরে। ইস্! ছবিটা দেখেই তন্ময়ের মাথা গরম হয়ে গেল। সামনে এক্সাম। এত আনন্দ কিসের কে জানে! সামনে পেলে থাবড়ে দিত।
-মায়ের থেকে শিখছে। এর বেশি আর কি হবে? গুবলু নাকি ভাগনিকে সায়েন্টিস্ট বানাবে। যেমন গাছ তার তেমন ফল-ই তো হবে, নাকি?
মেসোমণি মামণিকে থামাল
-আঃ! স্নিগ্ধা! ওরা মা মেয়েতে থাকে। ওদের জগৎ ওটা। আর দীপ্ত না থাকায়,ওদের একটা বড় অভাব আছে। নিজেদের মধ্যে আনন্দ করে যদি খুশি থাকে,থাক না।
-মেসোমণি,আনন্দটা স্যোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে না দিলেই কি নয়? তোমার ছেলের,আমার সব বন্ধুরাও দেখে। কেউ কেউ তো বলেই বসে অন্তরা তোর ননদ বড্ড বেশিই ইয়ং আর স্মার্ট দেখাতে চায় নিজেকে।
অন্তরা নিজের মুল পয়েন্টে আসে। তিতিক্ষাকে নিয়ে ওর শুরু থেকেই সমস্যা। বিয়ে বাড়িতে তিতিক্ষার রুপের কাছে নতুন বৌ-এর সাজেও দশগোল খেয়েছিল অন্তরা। এখন তাই সুযোগ পেলেই তিতিক্ষার নামে সবার কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে বলে। তুমি বিধবা,অত বড় মেয়ের মা। তাহলে সেরকমই থাকতে হবে তো! এত সাজগোজ কোথা থেকে আসে বোঝে না অন্তরা। মা ঠিকই বলে। হয়তো কতজনের সাথে চক্কর চালিয়ে বেড়াচ্ছে। নাহলে বিদ্যার দৌড় তো বেশি নয়। ঐ বিদ্যা দিয়ে এত বড় পোস্ট হজম হয় না ঠিক।
-বৌমা, তুমি কি আমার মেয়েকে নিয়ে কিছু বললে?
স্নিগ্ধা,মৃণাল চমকে ওঠেন। তন্ময়ের মাথা লজ্জায় নীচু হয়ে যায়। আর অন্তরা ভাবে,“মা ধরণী দ্বিধা হও।” তীর্থঙ্কর কখন দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন-কেউ টের পায়নি।
-জামাইবাবু,আসুন না, বৌমা-চা কর মা।
-স্নিগ্ধা,কথা ঘুরিয়ো না, বৌমা, মামণিকে নিয়ে তুমি আর কি কি ভাবো-নির্দ্বিধায় বলো। গো অ্যাহেড।
-কিছুই তো না বাবা...
কোনক্রমে বলে অন্তরা। তন্ময় হাল ধরে
-আসলে দিদিভাই-এর এই সেলফিটা আমাদের সবার চোখে লেগেছে তাই...
তীর্থঙ্কর দেখলেন একবার। এক অদ্ভুত হাসি তার মুখে খেলে গেল
-সুন্দর ছবি। মা,মেয়েতে দারুণ লাগছে। মামণিকে বলতে হবে,মুনাইটা যে দিনে দিনে ওপেন আপ করছে,স্মার্ট হচ্ছে-এটা আমার বেশ লাগছে।
-কিন্তু মুনাই-এর তো সামনে এক্সাম। এখন কি এসবের সময়?
তীর্থঙ্কর তন্ময়ের রাগের কারণ বোঝেন। ভাগনির লেখাপড়া নিয়ে সে বড্ড সিরিয়াস।
ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার নাতনি তো। প্রপারলি ডিসিপ্লিনড। যেমন ভালো রেজাল্ট করেছে,তেমন-ই করবে।
সোফায় বসতে বসতে বললেন তীর্থঙ্কর।
-জামাইবাবু,আপনি মুনাইকে বড্ড বেশি প্রশ্রয় দেন।
স্নিগ্ধা না বলে পারে না।
-দিই তো। তুমিও তো তোমার গুবলুকে প্রশ্রয়ই দিয়ে এসেছ। স্নিগ্ধা। তন্ময় তা বলে বখে গেছে কি? মুনাই-ও বখবে না।
-গুবলুর মত কি আর কেউ হয়?
তীর্থঙ্কর হাসলেন
-তোমার কাছে হয় না। আসলে সন্তান সবার কাছেই সবচেয়ে প্রিয় হয়। তোমার যেমন গুবলু। আমার তেমন মামণি।
তীর্থঙ্কর এত স্পষ্ট ভাবে বিভাজনটা কখনো করেননি। আজ করলেন। স্নিগ্ধা,অন্তরাকে এর আগেও বহুবার,বহু অছিলায় মামণিকে নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য করতে শুনেছেন তীর্থঙ্কর। কিছু বলেননি। আজ অন্তরার ইঙ্গিতটা বড্ড কানে বেজেছে। তাই নিজের মনোভাব স্পষ্ট করে দিতে চান। মামণি তার প্রাণের থেকে প্রিয়। যেমন মামণি,তেমনি মুনাই। আর এটা বাড়ির অন্যদের বোঝা উচিৎ।
-গুবলুও তো আপনার...
স্নিগ্ধাকে হাত তুলে নিরস্ত করলেন তীর্থঙ্কর
-হ্যাঁ। কিন্তু ওর আপব্রিংগিংটা পুরোপুরি তোমার। আর মামণি বোর্ডিং-এ মানুষ। আমার পদ্ধতিতে। সিভিলিয়ানদের সাথে আমাদের বড় একটা মেলেনা স্নিগ্ধা। আমরা ফিটনেস,ডিসিপ্লিন-এগুলোকে গুরুত্ব দিই। ওয়ার্ক আউট করি। মৃণাল আমার থেকে তিনবছরের ছোট। দেখে কেউ বলবে? মামণিও আমার ধাত পেয়েছে আমার জিন বলতে পার। আমার অভ্যাসগুলোও তাই ওকে বয়সের আন্দাজে ইয়ং লাগে। আর কনভেন্টে পড়লে তো গড়পড়তার থেকে স্মার্টই হবে, তাই না বৌমা?
তন্ময়ের মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল। বাবা দিদিভাইকে বেশি ভালবাসেন, এটা সবাই জানে। তা বলে তন্ময় আর দিদিভাই-এর মধ্যে এতটা পার্থক্য করেন জানত না। তীর্থঙ্কর কথা বলতে শুরু করেন আবার
-তা বলে তন্ময়ের অ্যাচিভমেন্ট কি কম? একদম না। ওকে তুমি খুব ভালো করে মানুষ করেছ। আমি মানুষ করলে আর্মিই হত ওর ডেস্টিনেশন। তবে যদি বল মামণি না তন্ময় কার অ্যাচিভমেন্ট আমাকে বেশি গর্বিত করে-আমি সবসময় বলব মামণির। একজন অফিসারের, একজন মার্টিয়ারের উইডো বলে না। দীপ্তর মৃত্যুতে চোখের জল ফেলেনি বলে না। শি নোজ হাউ টু স্যাক্রিফাইস। শি অ্যান্ড থাউজ্যান্ডস্ অফ লেডিজ লাইক হার স্যাক্রিফাইসেস ইচ অ্যান্ড এভরি ডে-এন্ড দ্যাটস হোয়াই উই আর সেফ। একটা বাইশ বছরের বাচ্চা মেয়ে তার কোলে একটা বছর খানেকের বাচ্চা-অন্য কেউ হলে হেরে যেত,ভেঙ্গে পড়ত। আপোষ করে নিত। কিন্তু ও নিজের চেষ্টায় আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নিজের আর মুনাই-এর ভবিষ্যৎ গড়েছে। আমাদের আশ্রিতা হয়ে নেই কিন্তু। এটাই ওর অ্যাচিভমেন্ট। তাই আমি চাইব না-মামণিদের নিয়ে কেউ কোন খারাপ কথা আজকের পর থেকে বলুক।
অন্তরা কিছু বলতে যাচ্ছিল। স্নিগ্ধা ইশারায় চুপ করিয়ে দিলেন। তীর্থঙ্করকে চল্লিশ বছর ধরে চেনেন স্নিগ্ধা। ওর কথার উপর কথা বলা যায় না। সেটা না করা-ই ভালো।
(পর্বঃ-৬)
তিতিক্ষা মেয়ের মন খারাপ বুঝে মুনাই-এর ঘরে শুতে এসেছিল। এসে দেখে মুনাই পড়ছে না। শুয়ে পড়েছে। সবে সাড়ে এগারোটা বাজে। এখন শোয়া মানে ঠিক শোওয়া নয়। শুয়ে শুয়ে ফোঁপানো। তিতিক্ষা মেয়ের পাশে আস্তে করে শুল। মেয়েটার মনমেজাজ আজ খুব ভাল ছিল। রাস্তায় ঐ হ্যান্ডসাম ছেলেটাকে দেখে রঙিন প্রজাপতির মত উড়ছিল যেন। গ্রিনি। ভালো নাম দিয়েছিল তার। অথচ আজকেই এমনটা হতে হল। সব কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। এত চাপা যে মুখে বলবে না। চুপ করে থাকবে। আর ফোঁপাবে। তিতিক্ষা মুনাই-এর গায়ে হাত রাখল
-আয়,
এই একটা কথারই অপেক্ষা ছিল যেন। মুনাই পাশ ফিরে প্রবল আবেগে মামমামদের জড়িয়ে ধরল। বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে থাকল তারপর। তিতিক্ষা ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল
-কাঁদে না। জানিস-ই তো মামা ওরকমই। বকেই।
তন্ময় আজ ফোন করে খুব বকেছে মুনাইকে। পড়াশোনায় মন না দিয়ে সেলফি তোলার জন্য। এমন করলে রেজাল্ট ঘোড়ার ডিম হবে-তাও বলে দিয়েছে। পড়াশোনাটা একটা সাধনা আর মুনাইকে দেখে সেই সাধনার অযোগ্য মনে হচ্ছে এটা তন্ময় স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। এতে খুব সম্মানে লেগেছে মেয়ের। পড়াশোনাটা নিয়ে ও খুব সিরিয়াস। তা নিয়ে এত কড়া কথা শুনে অভ্যস্ত নয়। তাই কষ্ট পাচ্ছে খুব।
-আমি,বাজে মেয়ে,তাই না মামমাম?
তিতিক্ষা মেয়ের চোখ মোছায়। কপালে চুমু খায় একটা।
-কে বলেছে? দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো মেয়ে এটা।
-পড়ায় ফাঁকি দিচ্ছি না তো,বলো?
-ধুর বোকা! একটা সেলফি তুললে পড়ায় ফাঁকি হয়?
-নাহ। আমি আর সেলফি তুলবই না। ওসব আনন্দ আমার জন্য না।
তিতিক্ষা কষ্ট পেল। মেয়েটা এমনিতেই খুব শাই। নিজেকে লুকিয়ে রাখে। আজকালকার দিনে ভালো কিছু করতে গেলে স্মার্টনেসটা আবশ্যক। ভাই-এর মত বুকওয়ার্ম হলে কোথাও কলকে পাওয়া মুশকিল। এটা তিতিক্ষা বোঝে। বাবা বোঝেন। কিন্তু ভাইটা কিছুতেই বুঝবে না। মুনাই-এর উপর ওর অনেক এক্সপেকটেশন। তাই শাসনটাও কড়া। তিতিক্ষা ভাইকে শাসন করতে না করেনি জীবনেও। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে করতে হবে। মেয়ের কষ্টের থেকে বড় কিছু হয় না ওর কাছে।
-কে বলল নয়? তুই কি বুড়ি হয়ে গেছিস্, নাকি?
-রেজাল্ট খারাপ হলে সবাই কথা শোনাবে,দেখো।
-খারাপ হবে কেন? আই নো ইউ আর দ্যা বেস্ট।
-ইউ ট্রাস্ট মি না,মামমাম?
তিতিক্ষা হাসে
-ইয়া,তুই মামার থেকেও বেটার করবি,আমি জানি তো।
মুনাই অবাক হয়ে মামমামের দিকে তাকায়। মামমাম কি করে জানল যে ও মামার থেকে বেটার করতে চায়? ও তো বলেইনি কখনো। তাহলে মামমাম কি ওর মন পড়তে পারে? পারবেই। মামমাম তো ওর ভগবান।
-পারব তো?
-একদম,তুই তো আমার মেয়ে। তোর বাবির মেয়ে। তোর দাদুভাই-এর নাতনি। পারবি না?
মুনাই হাসে। বহুক্ষণ পর একটু হাসে। চোখ মোছে তারপর
-ইউপ। পারব। বাট্ মামা-টা খুব আছে। শুধু বকে!
তিতিক্ষা মেয়ের নাকটায় চুমু খায়
-মামা-টার অনেক স্বপ্ন যে তোকে নিয়ে অনেক ভালোবাসে যে।
-আগে এতটাও বকত না। মামি এসে থেকে খালি বকে।
কথাটা যে সত্যি তিতিক্ষা জানে। অন্তরা কেবল তিতিক্ষাকে হিংসা করে তা নয়। ভাই-এর ভাগ্নির প্রতি এত স্নেহকেও ভালো চোখে দেখে না। আর সেটা উত্তরোত্তর আরো বাড়বে। অন্তরার নিজের সন্তান এলে পদে পদে তুলনাও চলে আসবে। মাসিমণির এসবে প্রত্যক্ষ পরোক্ষ মদত আছে। না হলে অন্তরার এত সাহস হত না।
-আচ্ছা, আমি মামাকে বকে দেব,হবে?
মুনাই মামমামের কথায় মজা পায়। ঠিক তো। মামমাম তো মামার দিদি। বকতেই পারে মামাকে। আগে কখনো বকেনি,কিন্তু বেশি রুড হলে তো বকবেই। মুনাই-এর কষ্ট মামমাম দেখতে পারবে নাকি? মুনাই মামমামকে জড়িয়ে ধরে। এটা সম্মতির লক্ষণ,তিতিক্ষা জানে।
-খুব করে বকব,হবে?
-না,অল্প বকে দিও। নাহলে কষ্ট পাবে।
তিতিক্ষা মনে মনে হেসে ফেলে। মামার উপর রাগে বকতে বলছে মেয়ে,অথচ বেশি বকতেও মানা। যাতে মামা কষ্ট না পায়,সেদিকেও নজর আছে। ষোলআনা।
-বেশ। অল্প-ই বকব।
-আমি শুনব কিন্তু। দেখব,তুমি কেমন বকতে পারো।
তিতিক্ষা বোঝে মামমামকে কখনো রাগতে বা বকতে দেখেনি মুনাই। তাই ভাবতেই অবাক হয়ে যাচ্ছে যে মামমাম আদৌ বকতে পারে,না কি মুখেই বলছে।
-আচ্ছা। তোর সামনেই বকব।
-দাদুভাইকে বলে দিতে হয়, যা বকা খাবে!
মুনাই-এর কথা একশোভাগ সত্যি। বাবা যদি জানেন তন্ময়ের জন্য মুনিয়া কেঁদেছে-তন্ময়ের কপালে দুর্ভোগ আছে। মুনাই হল বাবার প্রাণ।
-দাদুভাইকে বললে বেচারা মামাটার খুব কষ্ট হবে যে!
-নাহ। বলব না। তুমিই বকবে। দাদুভাই খুব রাগি, না মামমাম?
-আগে খুব রাগি ছিল। তোর উপর তো রাগ করেই না। আমাদের,বিশেষ করে আমাকে তো খুব শাসন করত। আর্মির লোকেরা এমন কড়া ধাতেরই হয়,
-বাবিও...
কথাটা বলেই থেমে গেল দীক্ষা। বাবিকে নিয়ে ওর কৌতূহলের অন্ত নেই। বাবি থাকলে কেমন হত, সেটাই বুঝতে চায় হয়ত।
-বাবিও রাগী ছিল।
-তাহলে বকত আমাকে?
তিতিক্ষা ভাবতে চেষ্টা করে। দীপ্ত কি মেয়েকে কখনো বকতে পারত? মেয়েটা তো ওর প্রাণ ছিল। মেয়ে হোক,এটা দীপ্তর ইচ্ছা ছিল। তিতিক্ষার যে শ্বশুরবাড়ি,মাসিমণি এদের কথায় ছেলের ইচ্ছা হয়নি,তা নয়। কিন্তু দীপ্ত সবসময় একটা পরীর মত মেয়েই চেয়েছিল। যখন পেয়েছিল,তখন ওর থেকে খুশি এই দুনিয়াতে আর কেউ ছিল না। সেই মেয়েকে বকে ওঠা দীপ্তর পক্ষে সম্ভব ছিল না বোধ হয়।
-বাবি কি তার পরীকে বকতে পারে?
তিতিক্ষা মেয়ের চোখে চোখ রেখে বলে। মুনাই-এর মুখটা অদ্ভুত আলোতে ভরে যায়। খুব খুশি হয় ও। এটাই শুনতে চেয়েছিল। তিতিক্ষা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে
-মামমাম যাও বা বকে, বাবি তাও বকত না।
-কই বকো তুমি?
-বকি তো! মুনাই ওঠ,জুস খা,ওয়ার্কআউট কর,বই রাখ,ঘুমা...
-ওটাকে বকা বলে বুঝি?
-বলে না? তাহলে?
-টিকটিক করা বলে।
-ওহ।
তিতিক্ষা হেসে ফেলে
-তাহলে বাবি থাকলে আরো বকত না,আর আমি আরো লাই পেতাম।
-লাই কোথায়? তোকে বকতে হয় না, তাই বকি না। তুই ভালো তো।
-বাব্বাঃ! তোমার মাসিমণিকে জিজ্ঞাসা করে দেখো। বলবে মামণির লাই-এই মুনাইটা উচ্ছন্নে গেছে!
মেয়ের কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল তিতিক্ষা। হো হো করে।
-মাসিমণি অমনই।
-খালি গুবলু আর গুবলু।
-করবে না? তার ছেলে যে। আমিও তো মুনাই,মুনাই করি,তার বেলা?
মুনাই চুপ করে যায়।
(ক্রমশ)
সুচিন্তিত মতামত দিন