পত্রপাঠ
আজকাল ডাকবাক্স ব্যাপারটা
উঠেই গেছে বোধহয়। দ্বিজর পরিষ্কার মনে আছে, কাঁটাপুকুরের
মোড়ে একটা লাল রঙের বেঁটে মোটা থামের মত জিনিস থাকত ফুটপাথের ডান দিকে। তার মাথাটা
একটা কালো রঙের টুপির মতো দেখতে। মা বলত, “যা তো, তোর বড় মামাকে একটা পোস্টকার্ড লিখলাম, ফেলে আয় তো
ডাকবাক্সে।” দ্বিজ নাচতে নাচতে যেত। কারণ একটা অলিখিত
বোঝাপড়া ছিল তার আর মায়ের মধ্যে। মা কোনও কাজে পাঠালেই একটা টফি বা হজমি কেনার
পয়সা দিত হাতে। বাবাও মাঝে মাঝে ডাকবাক্সে চিঠি ফেলে আসতে বলত। ইয়াব্বড় খাম,
তাতে আলাদা করে ডাকটিকিট মারত বাবা। দ্বিজ দেখেছে, অনেকে যেমন চট করে ডাকটিকিটের পেছনটা জিভ দিয়ে চেটে নিয়েই খামের ওপর জোরে
চেপে ধরে, বাবা কিন্তু কক্ষনও তা করে না। গঁদের আঠার বোতল
নিয়ে এসে তাতে ডোবানো লাঠিটা দিয়ে টিকিটের পেছনে আঠা লাগিয়ে তবে বসায় খামের ওপর।
দ্বিজ বেশ কবার বলার চেষ্টা করেছে, “বাবা, টিকিটের পেছনে তো আঠা থাকেই –” বাবা থামিয়ে দিয়েছে,
“একদম চুপ।”
দ্বিজ যেমন কোনওদিনই
বোঝেনি বাবা কেন জিভ দিয়ে চেটে ডাকটিকিট লাগাত না, তেমন সে এখনও বোঝে না, ডাকবাক্সগুলো গেল কোথায়।
কাঁটাপুকুরের মোড়েরটা তো নেই-ই। চিরুনি কারখানার সামনে যেটা ছিল, সেটাও নেই। খালি পুকুরপাড়ে একটা তখনও ছিল, তবে
একদিকে হেলে। চাকরির পরীক্ষার অ্যাপ্লিকেশন ফেলতে গেছিল দ্বিজ। সে সময়ে তো
ইন্টারনেট-ফেট অত চালু ছিল না, তাই ছাপানো ফর্মেই দরখাস্ত।
প্রায় মুখের ঢাকনাটা ঠেলে গলিয়েই দিয়েছিল সে বাদামি রঙের খামটা। একজন কাজের মাসি
কলসি কাঁখে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। বলল, “ও দাদা, কোথায় ফেলতেছ, ওর কি আর কিচু আছে? তলায় যে সব ফাঁকা, দেখতে পাওনি?”
দ্বিজ দেখল, ডাকবাক্সটার নীচে মরচে ধরে অনেকটা খেয়ে গেছে, তাই
সেখানে বিশাল গর্ত। আর সেই কারণেই ওটা এক দিকে হেলে আছে। চিঠি ফেললে ওখান দিয়ে
বেরিয়ে রাস্তায় পড়ে যেতে পারে। মাসিটা বলল, “এ বাসকো তো অচল।
আজ কতকাল দেখতিছি, এখানে কেউ কিচু ফেলেনে।”
দ্বিজ পড়ল সমস্যায়। এখন
চিঠিটা ফেলি কোথায়? চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস
করতে, তারা বলল পোস্ট অফিসে গিয়ে ফেলতে। সেটা আবার কোথায়
জিজ্ঞেস করতে বলল, ওখান থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে,
তাও আবার একটু এঁকেবেঁকে যেতে হয়। মাঝরাস্তায় কাউকে ফের জিজ্ঞেস
করতে হবে। দ্বিজ ভাবল, সত্যি, কোনও
মানে হয়? একটা চিঠি ফেলার জন্য দেড় কিলোমিটার হাঁটতে হবে?
দ্বিজ মনে মনে ভাবছিল, সেই খাকি জামা পরা পিয়নদেরও তো দেখি না আজকাল। তবে কি চিঠিপত্র লেখা
একেবারে উঠেই গেল টেলিগ্রাফের মতন? পাশের বাড়িতে বিল্টু বলে
একটা ছেলে থাকে, খুব চালাক চতুর। পাড়ায় আড্ডাও মারে রেগুলার।
বিল্টুকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, পিয়ন ঠিকই আছে আজকাল,
তবে তাঁরা খাকি জামা-টামা আর পরেন না। আর ‘পিয়ন’
বললে খুব রেগে যান। তাঁদের নাকি ‘পোস্টম্যান’
বলতে হয়। কয়েকজন মহিলা চিঠি বিলিকারিনী আছেন পোস্টাপিসে। তাঁরাও
নাকি পোস্ট-‘ম্যান’। তা বেশ, মনে মনে বলল দ্বিজ। কিন্তু একবার দক্ষিণ কলকাতার একটা অভিজাত পাড়ায় যেতে
হয়েছিল দ্বিজকে। তাদের অফিসের জেনারাল ম্যানেজার অসুস্থ। রবিনদা অনেক ঠেলে গুঁতিয়ে
পাঠাল। খুব একটা ইচ্ছে না থাকলেও দ্বিজ গেছিল খুঁজে খুঁজে স্যারের বাড়ি এক কিলো
আপেল হাতে করে। সে পাড়ায় গিয়ে দ্বিজ দেখল ফুটপাথের ওপর জ্বলজ্বল করছে ডাকবাক্স।
রেগুলার রঙ করা হয় তাতে, তাও দেখা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়,
চৌকো খোপের মধ্যে ক্লিয়ারেন্সের সময়ও লেখা আছে। তার মানে রেগুলার
ডাকপিয়ন, থুড়ি পোস্টম্যান এসে খোলেন এই ডাকবাক্স, তা সেখানে চিঠি কেউ ফেলুক আর না ফেলুক। দ্বিজর একটু অবাকই লেগেছিল। তাদের
মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত পাড়ায় এখনও চিঠি লেখার লোক আছে, সে যেমন
এককালে চাকরির দরখাস্ত করেছিল, এখনও করে কেউ কেউ। বস্তিতে
থাকা বিহারিরা দেশে পোস্টকার্ডও পাঠায় মাঝে মধ্যে। কিন্তু এ পাড়ায় তো সকলেই ই-মেল
এ কাজ চালান বলে মনে হয়। রীতিমত অভিজাত পাড়া। তা সারা কলকাতায় যখন ডাকবাক্স হাপিস,
এখানে রেখে দেয়ার মানে?
মানেটা হল এই, নিজেকেই বলল দ্বিজ, যে এ তো বেশ বড় বড় মানুষদের পাড়া,
এখানে বছরে একটাও যদি চিঠি বা খাম কারো ফেলার থাকে, তিনি বা তাঁর বাড়ির চাকর ভুলেও এক দেড় কিলোমিটার হাঁটবেন না। বরং ডাকবাক্স
নেই কেন, সে প্রশ্ন বারবার ই-মেল করে ডাক বিভাগের
কর্মকর্তাদের মাথা খারাপ করে দেবেন। উত্তর না পেলেই আরও ওপরে নালিশ। তাই উপায়ান্তর
না দেখে ঝামেলা এড়াতেই এই ব্যবস্থা বোধ হয়। ‘হেরিটেজ’
হিসেবে সাজানোও থাকতে পারে, একবার ভাবল দ্বিজ,
কিন্তু তাতে ক্লিয়ারেন্সের সময় লেখা থাকবে কেন?
যাই হোক, এই সব ডাক সংক্রান্ত ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে মোটেই চিন্তিত ছিল না দ্বিজ।
সেসব নিয়ে খুব একটা আলোচনাও হয়নি কারও সঙ্গে। কিন্তু আজ হঠাৎ এত সব পুরোনো ভাবনা
মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার কারণ একটা চিঠি। চিঠিটা একটা পোস্টকার্ড, কীরকম অদ্ভুত কালিতে লেখা। ছোটোবেলায় দ্বিজ বাবাকে কালির কলম দিয়ে লিখতে
দেখেছে, এ
তো সেই রকম কালিই মনে হচ্ছে, বলপেন বা
জেলপেনের কালি তো এমন হয় না। এত মোটা আঁচড়ও পড়ে না লেখাতে। হয়তো গ্রামের দিকে এখনও
চালু আছে, কারণ প্রেরকের ঠিকানা তো কোনও এক গ্রামেরই,
‘লক্ষ্মীশোল’।
কী রে বাবা, লক্ষ্মীশোল? এমন নাম তো জীবনে প্রথম শুনছে দ্বিজ।
প্রেরকের নাম, শ্রীগঙ্গাধর বন্দ্যোপাধ্যায়, লক্ষ্মীশোল। দ্বিজ বেশ ঘাবড়ে গেছে। কারণ চিঠিতে লেখা আছে,
কল্যাণবরেষু ,
দ্বিজ,
পত্রপাঠ চলিয়া আইস।
ঘটনার গুরুত্ব পত্রে
বিবৃত করা সম্ভব নহে।
ইতি
আঃ, গঙ্গাধর বন্দ্যোপাধ্যায়,
লক্ষ্মীশোল।
দ্বিজ তো পড়ল বেজায়
মুশকিলে। চিঠি তাকেই লেখা, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ
নেই। কিন্তু প্রথম কথা এটা কেউ ইয়ার্কি মেরে লিখল নাকি? এমন
কেতাবি শুদ্ধ ভাষায় কেউ কাউকে চিঠি লেখে, দ্বিজ প্রথম দেখল
জীবনে। তাকে কোথাও যেতে বললে, সোজা মোবাইলটা তুলে তার
নম্বরের বোতামগুলো টেপাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর যে বা যিনি চিঠিটি লিখেছেন, তাঁর কাছে মোবাইল নেই, এটা ভাবাও যায় না একবিংশ
শতাব্দীতে। অবশ্য দ্বিজ কাগজে পড়েছে, কিছু কিছু মানুষ মোবাইল
ব্যবহার করেন না এ যুগেও। টালিগঞ্জের এক নামকরা চিত্রাভিনেতার কথা পড়েছে দ্বিজ,
তাঁর নাকি মোবাইল নেই। কারও খুব দরকার পড়লে তাঁর গিন্নিকে ফোন করেন।
এ রাজ্যের এক বড় রাজনৈতিক নেতাও নাকি মোবাইল ব্যবহার করেন না, শুনেছে সে। কিন্তু এই গঙ্গাধরবাবু তো তেমন কেউকেটা নন বলেই ধারণা হচ্ছে।
তবে লোকটি একটি স্যাম্পল বিশেষ। নিজের নামের সঙ্গে ‘শ্রী’
লেখা লোক প্রথম দেখল দ্বিজ। মানে, লোকটিকে
এখনও দেখা হয়নি, তার হাতের লেখা দেখা গেল অবশ্য।
তবে সমস্যা আছে। এই লোক
তাকে চিঠি লিখবে কেন? এমন কোনও লোকের নাম তো
দ্বিজ বাপের জন্মে শোনেনি। তিনি যেখানে যেতে বলছেন, মানে
নিশ্চয়ই তাঁর নামের তলায় যে জায়গার কথা লেখা আছে, সেখানেই
যেতে বলছেন, সেটা রাশিয়ায় না নিকারাগুয়ায়, তাও তো জানা নেই দ্বিজর। আর সবচেয়ে বড় কথা, কোনও
কারণ ছাড়া, এক অপরিচিত লোক দুম করে যেতে বললে যাওয়াও কি যায়
নাকি? দ্বিজ লেটার বক্স থেকে চিঠিটা বের করেছে ঠিকই, আর এটা নিয়ে সময় নষ্ট না করে পাঁচিলের কোনায় ফেলে দিল পোস্টকার্ডটা।
এক লাইনের চিঠি তো, ওটা ফেলে দিলেও লাইনটা মাথায় ঢুকে গেছে। ‘পত্রপাঠ
চলিয়া আইস।’ দ্বিজ খানিক ভাবল, ‘পত্রপাঠ’
শব্দটা খুব বেশি ব্যবহার হয় না বটে আজকাল, তবে
দ্বিজ শুনেছে এটা, ‘অমুককে পত্রপাঠ বিদায় করে দেয়া হল’,
এইরকম। গল্পে উপন্যাসে তো পড়া যায়ই। তার মানে বোধ হয়, শিগগির, ভেরি সুন, এইরকম কিছু।
দাঁড়াও, দাঁড়াও, নিজেকেই বলল দ্বিজ। ‘পত্র–পাঠ’, তার মানে তো চিঠি-পড়া। তাহলে পত্রপাঠ মানেটা
যা জানতাম এতদিন, তা নয়। ‘পত্রপাঠ
চলিয়া আইস’ কথাটার মানে হচ্ছে, চিঠিটা
পড়ামাত্র চলে এস। বেশ, তা যেন হল। কিন্তু যাবটা কেন? একটা কে কোথাকার গঙ্গাধর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছে বলেই ছুটতে হবে? তাও জায়গাটা কোথায় কিছুই জানি না, পিন কোড ফিন কোড
নেই, ধুস। দ্বিজ অফিস যাওয়ার তোড়জোড় আরম্ভ করল।
অফিসে গিয়েও শান্তি নেই। কাজকর্মের ফাঁকে একটু
অবসর পেলেই মাথায় ঘুরছে, ‘পত্রপাঠ চলিয়া আইস’। কেউ কি মশকরা করল? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এমন বিকট বাংলা লিখে মশকরা
করবেই বা কেন, বন্ধুবান্ধবরা ছাড়া কেউ তো ঠাট্টা ইয়ার্কি করে
না এমন। তারা করলে তো সামনেই করে। তার ওপর কিছু কথার মানে দ্বিজ এখনও বোঝেনি। সে
গিয়ে রবিনদাকে ধরল, “ও রবিনদা, আঃ মানে
কী গো?”
রবিনদা বলল, “বোলতা। মানে বোলতা টোলতা কামড়ালে লোকে আঃ করে।”
দ্বিজ বলল, “না গো, সিরিয়াস। ‘ইতি’ লেখা, তারপর ‘আঃ’।”
রবিনদা বেশ কিছুক্ষণ চোখ
সরু করে ভাবল। তারপর বলল, “কোথায় পেলি?”
দ্বিজ বলল, “একটা চিঠিতে।”
রবিনদা বলল, “কার, দাদুর? মানে দাদুকে লেখা
কোনও চিঠিতে?”
দ্বিজ বলল, “নাগো, আমাকেই লেখা।”
রবিনদা বলল, “ধুস্শালা, এ তো ভিন্টেজ বাংলা, দাদুদের আমলে লেখা হত। তখন সব মজার মজার বাংলা চলত চিঠিতে, ‘বার২’ মানে কী বলত?”
দ্বিজ বলল, “কী?”
- বার২ মানে হচ্ছে ‘বার বার’। যেতে২ মানে হচ্ছে ‘যেতে যেতে’। তখন নানারকম শর্ট হ্যান্ড
তৈরি হয়েছিল। মানে, মানুষের হাতে অঢেল সময়
থাকলেও, কত আর লেখে, তাই এইসব চালু
হয়েছিল। ‘ইতি আঃ’ মানে যতদূর মনে পড়ছে,
‘ইতি আশীর্বাদক’। মানে, যিনি লিখছেন, তিনি, যাকে লেখা হচ্ছে, বয়সে
কিংবা সম্পর্কে তার গুরুজন।
দ্বিজ বলল, “বয়সে কিংবা সম্পর্কে মানে?”
রবিনদা বলল, “বয়সে বড় না হলেও গুরুজন হতে পারে। ধর তোর সম্বন্ধী, মানে
বৌয়ের দাদা এমনকী বৌদিও। এবার ধর বৌ তোর চেয়ে দশ বারো বছরের ছোট। তার দাদা তোর
চেয়ে আট বছরের ছোট, কিন্তু সে সম্পর্কে বড়। আবার ধর সেই
দাদার বৌ, তার বরের চেয়ে দশ বছরের ছোট, সেও কিন্তু তোর চেয়ে সম্পর্কে বড়। মানে তোর চেয়ে, আট
প্লাস দশ, মানে, আঠেরো বছরের ছোট একটা
বাচ্চা গোছের মেয়েও তোর চেয়ে সম্পর্কে বড়, তুই তাকে বাড়িতে
কোনও অনুষ্ঠানে এলেই প্রণাম করবি।”
দ্বিজ বলল, “শালা, এই সব চলত নাকি সেকালে?”
রবিনদা বলল, “চলত তো বটেই, কিছু রিমোট গ্রামে-টামে শুনেছি এখনও
চলে।”
দ্বিজ বলল, “হুম, রিমোট গ্রাম বলেই তো মনে হচ্ছে। একটা চিঠি
এসেছে আমার কাছে, যে জায়গা থেকে এসেছে, সেটা ভারতের ম্যাপে আছে কিনা জানি না। তাও আবার বিটকেল শুদ্ধ ভাষায় লেখা।”
রবিনদা বলল, “তোর কাছে? কই দেখি?”
দ্বিজ বলল, “ধুস, টান মেরে ফেলে দিয়েছি।”
বাড়ি ফেরার সময়ে গেট খুলে
ঢুকেই প্রথমে লেটার বক্সটা একবার খুলে দেখা অভ্যেস দ্বিজর। ইলেক্ট্রিকের বিল আসে, মিউচুয়াল ফান্ডের ইনটিমেশন আসে, মাঝে মাঝে লিট্ল
ম্যাগাজিন আসে বুকপোস্টে। দ্বিজ আবার অধিকাংশ বাঙালির মতো সুযোগ পেলেই কবিতা লেখে।
এখন কবিতা লেখার বেশ কিছু সুবিধেও হয়েছে, খুব একটা বিধিনিষেধ
নেই কোনও ব্যাপারেই। কিছু কিছু লিট্ল ম্যাগ ছাপেও তার কবিতা, হয়তো বেশি লেখা পায়নি বলে পাতা ভরানোর জন্যই। তা সে যাই হোক, দ্বিজ খুলল লেটার বক্সের সামনের পাল্লাটা। এখানে, সদর
দরজার বাইরে, আলো একটা আছে বটে, কিন্তু
জ্বেলে রাখা হয় না। যা ইলেকট্রিকের বিলের বহর। রাস্তার আলো ভালোই আসে, ওতেই চলে যায়। দ্বিজর হাতে কী একটা ঠেকল যেন। কাগজটা বার করে এনে দ্বিজ
দেখল, একটা পোস্ট কার্ড। আবার পোস্ট কার্ড? শালা চ্যাংড়ামি হচ্ছে? রাস্তার আলোতেই দিব্যি পড়া
যাচ্ছে।
কল্যাণবরেষু,
দ্বিজ,
পত্রপাঠ......
দ্বিজ ধাঁ করে একবার
তাকাল পাঁচিলের ধারে নীচের দিকে। নাঃ চিঠিটা নেই তো সেখানে! আমি বাড়ির বাইরে
ফেলেছিলাম না ভেতরে? তবে কি এটাই সেটা?
তুলে আবার লেটার বক্সে ঢুকিয়ে দিল কে? এটা সেই
চিঠিটাই তো? নাকি আবার লেখা হয়েছে? খুব
ভালো করে উলটে পালটে দেখল সে। সেটাই তো মনে হচ্ছে। তাছাড়া পাঁচিলের গায়ে যে চিঠিটা
দ্বিজ ছুঁড়ে ফেলেছিল, সেটাও তো নেই সেখানে। কেউ কি তুলে রাখল?
নিশ্চয় মাধবীর মায়ের কাজ। মাধবীর মা সকালে বাসন মাজতে এসে চিঠি পড়ে
আছে দেখে যত্ন করে তুলে রেখেছে বোধ হয়। দ্বিজ ভাবল, এবারে
কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিই চিঠিটা। তারপর ভাবল, থাক,
আগে কে তুলে রেখেছে, সেটার খবর নিই। বাড়ির
কেউও তো হতে পারে।
অফিসে গিয়ে কাজে মন বসছে
না আজকেও। আসলে কোনও একটা ব্যাপার, তা যতই
তুচ্ছ হোক, একবার মনের মধ্যে গেড়ে বসলে খুব জ্বালিয়ে মারে।
একবার ভাইফোঁটার সময়ে দিদির জন্য একটা সিল্কের শাড়ি কিনে এনেছিল দ্বিজ। ওরা একটা
সুন্দর ক্যারিব্যাগে ভরে দিয়েছিল শাড়িটা। দ্বিজ খুব যত্ন করে রেখেছিল ব্যাগটা।
তারপর হঠাৎ একদিন সেটা উধাও। সারা বাড়ি তোলপাড় করে খুঁজল দ্বিজ, সেদিন অফিসই যাওয়া হল না। শেষে চূর্ণী জানতে পেরে বলল, “তুমি কি পাগল হলে? সামান্য একটা ক্যারিব্যাগের জন্য
অফিস কামাই? আরে আমিই তো ওটা মাধবীর মাকে দিলাম, কটা পরোটা বেঁচে গেছিল, সেগুলো নিয়ে যাবার জন্য।”
সব জেনে তবে শান্তি। আজও দ্বিজ বেজায় ভাবনায় পড়েছে। মাধবীর মায়ের
সঙ্গে কাল সকালের আগে দেখা হবে না। সে যদি বলে আমি তুলে রাখিনি? তাহলে আর কী কী অপশন? ধরা যাক চূর্ণী, সে দেখতে পেলে কী করত? সে কি লেটার বক্সে তুলে রাখত?
কক্ষণও না। সে তো তুলে প্রথমে দেখত বাড়ির কাউকে লেখা কিনা। দ্বিজর
নাম দেখতে পেলে তো সে সোজা বাড়ির ভেতরেই নিয়ে আসত, লেটার
বক্সে তো ভরে রাখত না? মা সচরাচর বাড়ির বাইরে যায় না,
একমাত্র ফেরিওয়ালার থেকে ফল কিনতে নামে তাও হয়তো মাসে দু-এক দিন।
মাও তো এমন কাণ্ড করবে না। আর পুত্র বুবকা? সে সোজা চলে যাবে
পাশ দিয়ে, হাজার টাকার নোট পড়ে থাকলেও উপেক্ষা করে। তুলে
ফুলে রাখা তার হিসেবের বাইরে। তবে?
রবিনদা এসে একবার খুঁচিয়ে
গেল, “কী রে, কালকের সেই চিঠি নিয়ে
চিন্তায় আছিস এখনও? আমি ঠিক ধরেছি। বাদ দে না ওসব, পচা কেস।”
দ্বিজ বলল, “না গো দাদা, পচা কেস আবার ফ্রেশ হয়ে উঠলল কিনা,
তাই ভাবছি।”
রাত্তিরে ঘুম হয় না, খাটে এপাশ ওপাশ। চূর্ণী টের পেয়ে বলল, “কী ব্যাপার,
চোখে ঘুম নেই? আজ আবার বিরিয়ানি খেয়েছ?
বারণ করেছি না। নিশ্চয় পেট গরম হয়েছে।” কোনও
মতে রাত কাটিয়ে দ্বিজ গেটের কাছে পায়চারি করে। মাধবীর মা ঢুকতেই দ্বিজ লাফিয়ে পড়ল,
“ও মাসিমা, কাল তুমি এইখান থেকে একটা চিঠি
কুড়িয়ে লেটার বক্সে তুলে রেখেছ, না?”
মাধবীর মা বলল, “না গো বাবা, আমি কিছু তুলিনি। তাছাড়া ওখানে কিছু
ছিলও না।”
দ্বিজ বলল, “কিছু ছিল না তুমি জানলে কী করে?”
মাধবীর মা একগাল কালো
দাঁত বের করে বলল, “কাল আমার দোক্তার
কৌটো আঁচল থেকে পড়ে গেছিল তো, ঐখেনেই পড়েছিল।”
দ্বিজ গজ গজ করতে লাগল, “কেন খাও ওসব দোক্তা ফোক্তা, বাজে জিনিস?”
একটা ব্যাপার, ধরা যাক তুচ্ছই ব্যাপার। কিন্তু যতই তুচ্ছ হোক, তা
নিয়ে ভাবতে শুরু করলে কিন্তু অনেক সূত্র বেরোতে থাকে। দ্বিজ ভাবল, মাধবীর মা তোলেনি। আর কেউ যে তুলেছে, এমন সম্ভাবনাও
কম। কিন্তু প্রথম বার যখন চিঠিটা পেলাম, তখনই বা লেটের বক্সে
সেটা ফেলেছিল কে?
পেলাম তো সোমবার, অফিসে বেরোবার সময়ে। এখানেও একটা প্রশ্ন আছে, আমি
লেটার বক্স চেক করি অফিস থেকে ফেরার সময়ে, যাওয়ার সময়ে নয়।
সেদিন ওদিকে তাকালাম কেন?
আচ্ছা ধরে নিচ্ছি
কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু অত সকালে তো ডাকপিয়নরা বেরোন না। আর পিয়ন ছাড়া
পোস্টকার্ড তো কোনও ক্যুরিয়রের ছেলেরাও ফেলবে না। তা হলে আগের দিন পড়েছে। আগের দিন
তো রবিবার, পোস্টাপিসের ছুটি। তবে?
শনিবার অফিস থেকে ফেরার সময়ে বাক্স খালি ছিল, একথা
দ্বিজ হলফ করে বলতে পারে।
অফিসে একটা ফোন করে দিল
দ্বিজ। গোস্বামীকে বলল, “ভাই আজ মাকে একটু
হসপিটাল ঘুরিয়ে আনতে হবে, একটু লেট হবে বস। গুরু একটু
ম্যানেজ করে দিও আজকে? ইউ আর সো সুইট।” বাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্বিজ চলল, বসন্তর চায়ের দোকানে।
বিল্টুকে দরকার।
বিল্টুকে জায়গা মতোই
পাওয়া গেল। “হ্যাঁ রে, আমাদের পাড়ায় চিঠি বিলি করে কে? কোনও ব্যাটাছেলে
পিয়ন, না মহিলা?”
বিল্টু বলল, “ওই তো কাত্তিকদা, কালোমতন, বেঁটে
করে –”
দ্বিজ বলল, “ওসব কালো-ফরসা বললে আমি কী করে বুঝব ভাইটি? লোকটাকে
একটু চিনিয়ে দে না।”
বিল্টু বলল, “সে ওরা তো সব এগারোটার পরে বেরোয়। তাইলে তো তুমি আর অফিস যেতে পারবে না।
আজ ডুব দেবে বুঝি?”
দ্বিজ বলল, “নাঃ! ছুটি নেয়া যাবে না। অফিস যাব, কিন্তু লেটে।
হ্যাঁ রে, এগারোটায় সিওর পাওয়া যাবে?”
বিল্টু বলল, “ওদের কি আর ঠিক আছে, কোন এরিয়ায় কবে ঘুরবে? তবে বেশিরভাগ দিনই দেখা যায়। তবে দাদা তুমি কিন্তু পিয়ন ফিয়ন বলে ফেলো না
আলটপকা। যা খচে যাবে না, দেখবে তখন।”
দ্বিজ বলল, “ঠিক আছে, আমি এগারোটা অবধি আছি।”
এগারোটা দশ হবে, বিল্টু বলল, “ওই তো ওই যে তিনি যাচ্ছেন, ধরতে হলে দৌড় মারো।” দ্বিজ পাঁই পাঁই করে ছুট লাগাল,
“ও ডাক্তারবাবু, ও ডাক্তারবাবু –”
সেই কার্তিকবাবু যদিও
বোঝেননি তাঁকেই ডাকা হচ্ছে, তবু তিনি সাইকেল
থামিয়ে রাস্তার আর সকলের মতো পেছনে তাকালেন। তাকিয়ে বুঝলেন, ডাকটা তাঁকেই।
তিনি বললেন, “কী আজেবাজে বকছেন মশাই? কে ডাক্তার?”
দ্বিজ বলল, “আরে ডাক ও তার বিভাগ তো, তাই ‘ডাক-তার’বাবু বললাম।”
লোকটি খুব রেগে গেলেন, “মশকরা করছেন? তার তো উঠে গেছে, খবর রাখেন না? আর ডাকবাবু কাদের বলে, জানেন না? পোস্টম্যান বলতে কী হয়? আমি যদি আপনাকে ডাবল বামনাদা বলে ডাকি কেমন লাগবে আপনার?”
দ্বিজ বলল, “ডাবল বামনাদাটা কী কেস?”
কাত্তিকবাবু বললেন, “ঐ তো, আপনারা তো মুখার্জী, মানে
বামনা। আবার দ্বিজ, মানে আবার বামনা, তো
ডাবল হল না?”
দ্বিজ বলল, “সব্বোনাশ, এমন তো ভেবে দেখিনি? কিন্তু আমার নাম দ্বিজ আপনি কী করে –”
কার্তিক বললেন, “আমি একমাত্র বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো বাদ দিলে আমার চিঠি বিলির এলাকায় প্রায়
সক্কলের নাম জানি। এইট্টি পারসেন্ট ধরেন। ঐ যে, দুমাস অন্তর
আপনার নামে বুক পোস্ট আসে না? কী লেখা থাকে ওপরে? দ্বিজ মুখার্জী না?”
দ্বিজ বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, সরি বলছি তিন বার। মাফ করে দিন। এবার
কাত্তিকবাবু বলুন তো, আপনি কি আমার লেটার বক্সে কোনও
পোস্টকার্ড ফেলেছেন, দু-তিনদিনের মধ্যে? মনে আছে?”
কার্তিক বললেন, “দু-তিনদিন কেন, যবে থেকে এলাকার চার্জে এসেছি,
একমাত্র বিহারিদের বস্তিতে ছাড়া, কারও বাড়িতে কোনও
পোস্টকার্ড অন্তত এ পাড়ায় ফেলিনি।”
দ্বিজ বলল, “আপনি সিওর?”
কার্তিকবাবু বললেন, “আপনাদের এই কাত্তিক হাঁসদার স্মরণশক্তি নিয়ে অনেক গল্প আছে, জানেন তো? না বিশ্বেস হলে মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞেস
করতে পারেন। আমি কোনও পোস্টকার্ড ফেলিনি, ফেলিনি, ফেলিনি। হয়েছে? নিন, এবার যেতে
দিন।”
দ্বিজ চিন্তায় ছিল আগে
থেকেই, এবার গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। ডাকবিভাগের লোক ছাড়া তো
পোস্টকার্ড অন্য কেউ ফেলবে না। দ্বিজ আবার বাড়ি ফিরে এল। পোস্টকার্ডটা অফিসেই নিয়ে
যাই। রবিনদার এই সব রহস্য সলভ্ করায় নাম আছে, তাকেই জিজ্ঞেস
করব কী হতে পারে।
রবিনদা প্রথমেই বলল, “চিঠিটা যে তোকেই লেখা, বুঝলি কী করে? এই নামের অন্য কেউও তো হতে পারে। নিজের অ্যাড্রেসটা দেখেছিলি ভালো করে?”
দ্বিজ বলল, “হ্যাঁ, অনেকটাই ঠিক।”
রবিনদা বলল, “অনেকটাই মানে? ঠিকানা আবার অনেকটা ঠিক লেখা যায় নাকি?
হয় ঠিক, নয়তো ভুল।”
দ্বিজ বলল, “এই দেখো না, লেখা আছে, দ্বিজনাথ
মুখোপাধ্যায়, ৩৪ নং, বাদামতলা লেন।
সমস্যা হল, আমার নামে ‘নাথ’ নেই, ‘পদ’ ছিল, ওটা বাদ গেছে অনেক কাল আগে। আমার গ্র্যাজুয়েশন সার্টিফিকেট, অফিসের রেকর্ড, সব জায়গাতেই শুধু ‘দ্বিজ’। এছাড়া আমরা কেউ ‘মুখোপাধ্যায়’ লিখি না, বাড়িশুদ্ধু সবাই মুখার্জি-ই ব্যবহার করি।
অবশ্য বাইরের লোক তো তা জানবে না, তারা যদি মুখোপাধ্যায় লিখে
ফেলে তো কী করা যাবে।”
রবিনদা বলল, “বাইরের লোক? সে ‘ইতি আঃ’
লিখবে চিঠির শেষে? নাঃ! জমল না ব্যাপারটা।
আচ্ছা, নাম তো হল, অ্যাড্রেস? তোদের অ্যাড্রেস ঠিক আছে?”
দ্বিজ বলল, “ওই তো, প্রায় ঠিক বললাম যে। লেখা আছে ৩৪নং বাদামতলা
লেন। আসলে আমাদের রাস্তাটার নাম এককালে ছিল বাদামতলা লেন। যদিও বেশ চওড়া রাস্তা,
তবু ‘লেন’। তবে অনেক আগে, মানে বাবাদের আমলেই এটা ‘কে সি বসু সরণি’ হয়ে গেছে। আরও একটা ব্যাপার, বাড়ির নম্বর ৩৪ বাই বি,
শুধু ৩৪ নয়। এই তো তফাত, সামান্যই।”
রবিনদা অনেকক্ষণ চিন্তা
করল। তারপর বলল, “খানিকটা আন্দাজ করতে
পারছি মনে হয়। এই যে তোদের ঠিকানা ৩৪ এর বি। তার মানে ৩৪ নম্বর দাগে যে জমিটা ছিল,
সেটা বেশ কয়েক টুকরো হয়েছে পরের দিকে। এক সময়ে নিশ্চয়ই ৩৪ নম্বরে
একটাই জমি ছিল। আচ্ছা এইরকম বাই এ, বাই বি, করে কটা ভাগ আছে ৩৪ নম্বরের জানিস?”
দ্বিজ বলল, “তা দশ বারোটা তো হবেই, এ, বি , সি, ডি করে ‘কে’ অবধি আছে যতদূর জানি।”
রবিনদা বলল, “সবই এক মাপের?”
দ্বিজ বলল, “না, না, কোনওটা চার কাঠা,
আবার কোনওটা আড়াই। মাঝখান দিয়ে গলিও তো বেরিয়েছে, সেটা এখন বুঝছি সেই ৩৪ নম্বরের জমির ভেতর থেকেই।”
রবিনদা বলল, “হুম, শুধু বিঘে দুই, ছিল মোর
ভুঁই – মনে হচ্ছে সেই ৩৪ নম্বরটা দু বিঘে মতন ছিল। আর তুই
বলছিলি না, যে রাস্তার নাম আগে ছিল বাদামতলা লেন? নিশ্চয় তোদের রাস্তাটার তখন সেই নাম ছিল, যখন জমিটাও
এক লপ্তে দু বিঘে ছিল। সেই অখণ্ড জমিটার মালিক কে ছিল জানিস?”
দ্বিজ বলল, “না, তা কী করে জানব? আমাদের তো
এই ৩৪ এর বি প্লটটাই বাবা কিনেছিল।”
রবিনদা বলল, “কার কাছ থেকে তোর বাবা কিনেছিলেন, দলিলটা দেখে আমায়
বলিস তো। অরিজিনাল পুরো চৌত্রিশের মালিকের নাম পেলি কিনা তাও বলিস। আমার মাথায়
একটা ব্যাপার খেলছে। আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট সিওর ব্যাপারটা তা-ই।”
দ্বিজ বলল, “সাসপেন্সে রাখছ কেন, কী তোমার মাথায় খেলছে বলেই ফেল
না।”
রবিনদা বলল, “তোর নামের সঙ্গে নাথ ফাথ নেই বলছিলি না? যার আছে বা
ছিল, চিঠিটা আসলে তার।”
দ্বিজ বলল, “তার মানে?”
রবিনদা বলল, “আগে যখন জমিটা এক সঙ্গে ছিল, তখনকার মালিকদের মধ্যে
কারও নাম ছিল দ্বিজনাথ মুখোপাধ্যায়। তোরও ওই একই নাম, মানে
প্রায় একই নাম ব্যাপারটা কাকতালীয়। এবার অনেক সময়ে কাগজেও এমন খবর পড়েছি, যে বহুযুগ আগের কোনও চিঠি, আনডেলিভার্ড হয়ে
পোস্টাপিসে পড়ে ছিল। হঠাৎ তার হদিশ পেয়ে এখন সে ঠিকানায় যে বাড়ি আছে, সেখানেই দিয়ে গেছে। সেই ঠিকানায় এখন অনেক বাড়ি। তাই নামটা যার সঙ্গে খানিক
মিলছে, তার বাড়িতেই ফেলেছে। একদম ক্লিয়ার কেস।”
দ্বিজ সিনেমায় যেমন দেখা
যায়, তেমন করে আস্তে আস্তে হাততালি দিল। দিয়ে বলল, “মিস্টার রবিন গুপ্ত, ইয়োর স্ক্রিপ্ট ইজ অ্যাপ্রুভড।”
তারপর বলল, “মাইরি রবিনদা, গপ্পোটা দারুণ। কিন্তু একটা সমস্যা থেকে গেল যে!”
রবিনদা বলল, “কী সেটা?”
দ্বিজ বলল, “আমি ডাবল ভেরিফিকেশন করেছি, পোস্টাপিসের কোনও লোক
চিঠিটা আমার লেটার বক্সে ফেলেনি।”
রবিনদাকে দ্বিজ যাই বলে
থাক, ব্যাপারটা খচখচ করছিল মনের মধ্যে ঠিকই। সেদিন বাড়ি ফিরে
মাকে বলল, “আমাদের জমির দলিল কোথায় গো মা?”
মা বলল, “কেন রে, এখনই ওটা নিজের নামে লিখিয়ে নিয়ে আমায়
বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবি?”
দ্বিজ বলল, “হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি দাও।”
বাক্সপ্যাঁটরা ঘেঁটে অনেক
হাতড়ে বেরোল দলিল।
দ্বিজ বলল, “এগুলো আলমারির লকারে টকারে রাখতে পারো না? এইসব
জায়গায় কখন পোকায় কেটে দেবে, তখন মহা বিপদ হবে।”
যাই হোক সেই দলিলের ভাঁজ
খুলে, ‘এতমিব কার্য্যাঞ্চাগে...ইত্যাদি বিদিকিচ্ছিরি ‘বাংস্কৃত’ ভাষায় শুরু করে তার পর আরও বিচিত্র বাংলায়
লেখা কোবালা পড়ে দেখা গেল ৩৪-এর বি প্লটের মালিকদের নামই পাওয়া যাচ্ছে, গোটা চৌত্রিশ নং জমির মালিক একজনেরই নাম আছে, ভবানীপুরের
সুবোধ পাল। এবার এর আগের দলিল দেখতে গেলে তাঁর কাছে যেতে হবে, কিন্তু সে সুযোগ নেই। তাঁর
কয়েক প্রজন্মের পরের কাউকে খুঁজে বের করাও প্র্যাক্টিকালি অসম্ভব। তার চেয়ে
রেজিস্ট্রি অফিসের কেরানিদের মোটা ঘুষ দিয়ে চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু সেও তো
অনেক সময়ের ব্যপার। মাথা চুলকাতে চুলকাতে সুরপতি বাবুর কথা মনে পড়ল দ্বিজর।
ভদ্রলোকের ১০৩ বছর বয়স। এলাকার সবচেয়ে প্রাচীন মানুষ। শরীর ভেঙে, কুঁজো হয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে, হাতের
আঙুলগুলোও বেঁকে গেছে, কিন্তু স্মৃতিশক্তি এখনও তাজা। তাঁকে
একবার জিজ্ঞেস করলে হয় না?
পুকুরপাড়ের সরু রাস্তাটা
ধরে বাঁদিকে খানিক গেলেই সুরপতিবাবুর বাড়ি। ছেলেদের কেউ আর বেঁচে নেই, নাতিদেরও একজন টপকে গেছে, সুরপতি মিদ্যে স্টিল
ব্যাটিং। একতলা পুরোনো ধাঁচের খিলেন দেয়া দরজা জানলার বাড়ি, চুনের
সঙ্গে গেরিমাটি মিশিয়ে রঙ করা হয়েছে হালে। আশেপাশে সব বাড়ি ভেঙে বহুতল উঠে গেছে। এ
বাড়িটা তেমনই আছে। সুরপতিবাবু একটা প্রায় চেপটে যাওয়া আদ্যিকালের মোড়ায় বসা। তাঁর
একেবারে কচি নাতবৌটা বাচ্চাদের তেল মাখানোর মতো করেই তেল মাখাচ্ছে তাঁকে। অবশ্য
কিছুটা সংশোধনের প্রয়োজন এখানে। সুরপতিবাবুর নাতবৌদের সবারই বয়স পঞ্চাশের ওপর। এটি
এক নাতির নাতবৌ। তাদের পরিবারই এঁর দেখাশোনা করে। বাকিরা ছড়িয়ে গেছে বিভিন্ন
জায়গায়। দ্বিজকে দেখে মেয়েটি ঘোমটা তুলে দিল। এসব বাড়িতে এখনও ঘোমটার চল আছে।
সুরপতিবাবুর চোখে ছানি পড়েনি আশ্চর্যজনক ভাবে। তবে লালচে রঙের মোটা বাইফোকাল
কাঁচের চশমা পরে থাকেন সবসময়ে। উনি আবার নীচেরটা দিয়েই দূরে দেখার অভ্যাস করে
ফেলছেন। মুখটা অনেকখানি তুলে বললেন, “কে?”
দ্বিজ বলল, “দাদু আমি, কৃষ্ণপদ মুখার্জির ছেলে দ্বিজ।”
সুরপতি বললেন, “কে? আমাদের কেষ্টার ব্যাটা? ভালো।
তা কেষ্টাকে তো অনেকদিন দেখি না?”
দ্বিজ বলল, “বাবা বছর দশেক আগে মারা গেছেন দাদু।”
বলে সে মনে মনে হাসল, তার বাবাও এঁকে ‘দাদু’-ই
বলতেন।
সুরপতি বললেন, “অ, সেও চলে গেছে? আচ্ছা আমাকে
একটা কতা বলবি বাবা? শালার ব্যাটা শালা যম আমাকে নেয় না কেন?”
এ কথার উত্তর দ্বিজর জানা
ছিল না। খানিক চুপ থেকে সে আসল কথায় এল। সুরপতি বাবুকে জিজ্ঞেস করেই দেখা যাক না, ৩৪ দাগের জমির পুরোনো মালিকদের নাম জানা আছে নাকি? শোনা
যায় অতিবৃদ্ধ বয়সে মানুষের নিকটের স্মৃতি ম্লান হয়ে গেলেও অনেক আগের স্মৃতি আবার
চাঙ্গা হয়ে যায়।
সুরপতি বললেন, “হ্যাঁ ছিল তো, মুখুজ্জ্যে বলে একজনেরই ছিল জমিটা। তাতে সে বেশ খেলানো বাড়িও তুলেছিল।
একতলা বটে, তবে অনেক ঘর। আমরা কি
কম উৎপাত করিচি, আম খেতে যেতুম না? ঢিল
মেরে কাঁচও ভেঙিচি কবার। তবে মিথ্যে কতা বলব না, মুখুজ্জ্যেবাবু
লোক ভালো ছিল। এই যে এত অত্যেচার করিচি, একবারও রা কাড়েনি।
বড় ভালো লোক ছিল গো –”
দ্বিজ বলল, “আচ্ছা দাদু, সেই মুখুজ্জ্যে বা মুখোপাধ্যায় মশাইয়ের
নাম কি দ্বিজনাথ ছিল?”
সুরপতি বললেন, “হতে পারে বাবা, আমরা কি আর তখন অতশত জানি? মুখুজ্জ্যে তা জানতাম।”
দ্বিজ বলল, “তারপর তিনি ওই সুবোধ পাল মশায়কে বাড়ি, জমি, সব বিক্রি করে দিলেন?”
সুরপতি বললেন, “সে কি আর নিজে করেচে? কোত্থেকে করবে? সে রাতারাতি গায়েব হয়ে গেল না? তার ব্যাটারাই তো
বারো বছর পরে, অনেক মোক্তার উকিল ডেকে বাড়ির মালিকানা পায়।
তারপর বাড়ি বিক্কিরি করে গোড়ের দিকে উঠে গেল তারা। ওই সুবোধের আগে একজন ডাক্তার
কিনেছিল। সেই জমিটা সুবোধকে বেচে।”
দ্বিজ বলল, “গায়েব? মানে?”
সুরপতি বললেন, “কী জানি বাবা, শুনলাম তো বাঁকড়োর দিকে কী একটা কাজে
গেছিল, আর ফেরেনি।”
দ্বিজ থম মেরে গেল
কিছুক্ষণ, ‘বাঁকড়ো’ মানে তো বাঁকুড়া। এই লক্ষ্মীশোল কি সেখানেই ?
চূর্ণী বলল, “আচ্ছা, সারা রাত্তির এপাশ ওপাশ করলে পাশের মানুষটা
ঘুমোতে পারে? কী হয়েছে তোমার? ইনসমনিয়া
হলে ডাক্তার দেখাও।”
দ্বিজ বলল, “হুম।”
চূর্ণী বলল, “হুম মানেটা কী? গত চার-পাঁচ দিন তো এরকমই চলছে। কী
হয়েছে জিজ্ঞেস করলে ভেঙেও বলবে না। বৌকেও খুলে বলতে পারছ না, এমনই গোপন কথা? প্রেম করছ নাকি কারও সঙ্গে? করো গে যাও, আমি বাধা-টাধা দেব না।”
দ্বিজ বলল, “বলছি না তার কারণ হল, বললে তোমার মাথায় ঢুকবে না।
কাল থেকে সোফায় শোব আমি, হয়েছে?”
চূর্ণীর মাথায় ঢুকবে না, ঢোকার কথাও না, কারণ দ্বিজ আবার চিঠিটা ফেলে দিয়েছিল,
এবার পাঁচিলের বাইরে রাস্তায়। ভেবেছিল কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলবে।
কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। ছিঁড়ে ফেলার পরে যদি আবার সেটা গোটা হয়ে গিয়ে লেটার বক্সে
উঠে আসে, তখন? সেই শকটা হজম করার মতো
মনের জোর দ্বিজর নেই। তার চেয়ে যদি আবার সেটাকে চিঠির বাক্সে পাওয়া যায়, কেউ তুলে রেখেছে ভাবলেই মনকে প্রবোধ দেয়া যাবে।
হলও তাই, চিঠিটা পরের দিন লেটার বক্সেই পাওয়া গেল।
অফিসে গিয়ে সব চেয়ে কাছের
মানুষ রবিনদাকেই ধরল দ্বিজ, “আচ্ছা লক্ষ্মীশোল
জায়গাটা কোথায় বলতে পার? বাঁকুড়ায় কি?”
রবিনদা বলল, “আজকাল এসব কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করে নাকি? নেটে কানেক্ট
করে গুগ্ল বা উইকি সার্চ কর। শুধু বানানটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখবি। ইংরিজিতে লক্ষ্মী
বানান অনেক ভাবে লেখা যায় জানিস তো?”
মনিটরের সামনে থেকেই
দ্বিজ মুঠো করে হাত ঝাঁকাল, “ইয়েস্ - পেয়েছি।”
রবিনদা উঠে এল, “পেয়েছিস? জায়গাটা বাঁকুড়াতেই তো? ব্যস হয়ে গেল, শান্তি। এবার মন দিয়ে কাজ কর। কদিন
ধরে মাথাটা খারাপ করে দিচ্ছে রে!”
দ্বিজ বলল, “মাথা খারাপ তো সবে শুরু হল। আচ্ছা রবিনদা, ওখানে যায়
কী করে বলতে পার? নেটে অনেক খুঁজেও পেলাম না।”
রবিনদা বলল, “এটা একটা প্রবলেম হল? বিপ্লববাবুকে জিজ্ঞেস কর। ওঁর
তো দেশ বাঁকুড়ায়, নির্ঘাত চেনেন জায়গাটা।”
বিপ্লববাবু বললেন, “হ্যাঁ, জায়গাটা চিনি। ওই তো ছাতনা থেকে যেতে হয়,
পনেরো ষোলো কিলোমিটার মতন। দ্বারকেশ্বর নদী পেরিয়ে যেতে হবে। আসলে
গ্রামটার দুদিকেই নদী। দ্বারকেশ্বরকে ‘বড় নদী’ বলে ওখানে।”
দ্বিজ বলল, “বেশ অনেক বছর আগে, ওখানে গঙ্গাধর বন্দ্যোপাধায় নামে
একজন থাকতেন হয়তো। গ্রামের লোকেরা গেলে তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলতে পারবেন?”
বিপ্লববাবু বললেন, “বন্দ্যোপাধ্যায়? ব্রাহ্মণ? ও
গ্রামে তো বৈদ্যরাই সম্পন্ন পরিবার। বামুন থাকতে পারে দু-এক ঘর। আপনি সিওর ওটা
লক্ষ্মীশোল? ক্ষীরপাই নয় তো? ওই দুই
গ্রামের মাঝামাঝি একটা জংলা মতন জায়গা আছে। অনেকদিন আগেকার একটা পোড়ো ভিটেও আছে
শুনেছি। দেখুন গিয়ে কিছু হদিশ করতে পারেন কিনা। সেই ভদ্রলোকের পরিবারের কাউকে পেলে
হয়তো কিছু জানা যাবে।”
দ্বিজ বলল, “কীভাবে যাব ওখানে?”
বিপ্লববাবু বললেন, “একগাদা ট্রেন যায় হাওড়া আর সাঁতরাগাছি থেকে। আপনি ‘রূপসী
বাংলা’ কিংবা ‘আরণ্যক’ ধরুন। ভোরে রওনা হলে প্রথমটায় সাড়ে দশটা নাগাদ আর দ্বিতীয়টায় সাড়ে
এগারোটায় পৌঁছে যাবেন ছাতনা। সেখান থেকে বাস আছে।”
দ্বিজ বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ।”
কচি নাতবৌটা, মানে নাতবৌয়ের নাতবৌটা আবার ঘোমটা তুলল দ্বিজকে দেখে। দ্বিজ বলল, “দাদু আছেন?”
সে কোনও কথা না বলে হাতের
ইঙ্গিত করল। উঠোনে সেই চ্যাপটা মোড়াটাতেই বসে আছেন সুরপতিবাবু, গায়ে একটা বিশাল ওভারসাইজ লাল সোয়েটার, মাথা আর গলা
জুড়ে একটা মাঙ্কি টুপি। আগে তিনি এখানেই রোদে বসতেন। এখন পাশে ছ তলা বিল্ডিং উঠেছে,
রোদ এলেও মিনিট দশেক তার সেবা পান। তিনি হাত নেড়ে ডাকলেন দ্বিজকে।
হাতের আঙুলগুলো সব ভেতর দিকে বেঁকে আছে, সম্ভবত সোজা করা যায়
না। সুরপতি চশমার নীচের অংশটা দিয়ে দেখার জন্য মুখ তুলে বললেন, “কে বাবা তুমি? সমরের নাতি?”
দ্বিজ বলল, “না দাদু, আমি কৃষ্ণপদ মুখার্জির ছেলে দ্বিজ।”
- অ, কেষ্টার ব্যাটা। তা কেষ্টাকে দেখি না আজকাল!
দ্বিজ এ কথার উত্তর না
দিয়ে সুরপতি বাবুর চ্যাপটা মোড়াটার পাশে উবু হয়ে বসে পড়ল, “আচ্ছা দাদু, সেই ৩৪ নম্বর জমিটার কথা বলছিলাম। যেটার
ওপর সেই মুখার্জিবাবুর বাড়ি ছিল, আপনারা আম পাড়তেন আর জানলার
কাঁচ ভাঙলেও তিনি বকতেন না, মনে পড়ছে?”
সুরপতি বললেন, “মনে পড়বে না? ওই রকম আম বাজারে কিনতে পাবি? সেই মুখুজ্জ্যে মশাই তো বাঁকড়োর দিকে কোথায় যেন গেছিল। আর ফেরেনিকো।”
দ্বিজ বলল, “কেন গেছিলেন?”
সুরপতি বললেন, “হ্যাঁ বাবা?”
দ্বিজ একটু জোরে বলল, “কেন গেছিলেন তিনি তা জানেন আপনি? তিনি ওই বাঁকুড়ায়
কেন গেছিলেন?”
সুরপতি বললেন, “সে বাবা তখন আমাদের কচি বয়স, অত কী আর বুঝি? তবে এই বড় হয়ে শুনেছিলুম –”
দ্বিজ বলল, “কী শুনেছিলেন দাদু? একটু বলুন না।”
সুরপতি বললেন, “সে যাই করুক, লোক বড় ভালো ছিল। আমরা কত অত্যাচার
করিচি, কোনওদিন কিছুই বলেনিকো।”
দ্বিজ বলল, “হ্যাঁ ভালো লোক ছিলেন তো, তবে বাঁকুড়া কেন গেছিলেন?
বলুন দাদু?”
সুরপতিবাবু বললেন, “সে বাবা লোকের মুখে শোনা কথা। তিনি নাকি শ্বশুরের সব সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে
– তাতেই নাকি ওই বাড়ি, জমি – তা বাবা সে যাই করুক, আমাদের কোনওদিন কিচ্ছু বলত না।”
দ্বিজ বলল, “আচ্ছা না হয় শ্বশুরের –” বলতে গিয়ে একটু গলাটা কেঁপে
গেল তার। সামলে নিয়ে বলল, “তা তিনি বাঁকুড়া গেলেন কেন?”
সুরপতি বললেন, “তেনার শালা সম্বন্ধী কেউ একটা হবে, নাকি খেতে না
পেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছিল।”
গুম হয়ে গেল দ্বিজ।
হাতিয়ে নেয়া মানে কী? পার্থর সুইসাইডের জন্য
চূর্ণী তো কোনওদিন তাকে দায়ী করেনি। নাকি করেছিল, মুখ ফুটে
বলেনি? সে কি নিজে কখনও ভেবেছিল, পার্থকে
বঞ্চিত করাটা উচিত হচ্ছে না? চূর্ণী কি সত্যিই তার কোনও দোষ
দেখেছে এ ব্যাপারে? দোষ দেখবেই বা কেন, কাগজপত্র দ্বিজ তৈরি করে দিলেও চূর্ণীই তো বাবাকে দিয়ে সই করিয়ে আনত
সেগুলো। তাদের সেই ছোট্ট দু কামরার একতলাটা ভেঙে যে এতবড় দোতলা বাড়িটা বানানো হল,
তাতে কি দ্বিজ একলা থাকে? না না, বঞ্চিত করা হয়নি মোটেই। বাবার পছন্দ করা পাত্রীকে বিয়ে করেনি বলে তিনি তো
বলেইছিলেন পার্থকে ত্যাজ্যপুত্র করবেন। সেই সুযোগটাই তো নিয়েছিল দ্বিজ। অবশ্য তিনি
উইল না করে মারা গেলে সম্পত্তি সমান দুই ভাগই হত। কিন্তু সে প্রশ্ন উঠছে কেন এখন?
তাছাড়া পার্থর অত ভালো চাকরিটা যে চলে যাবে, তা
কি দ্বিজ জানত আগে?
খুব ভোরবেলা উঠে মুখ ধুয়ে
দ্বিজ চা বানাচ্ছিল। রান্নাঘরের আওয়াজ পেয়ে ঘুম জড়ানো গলায় চূর্ণী জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার, এত ভোরে?”
দ্বিজ বলল, “আমি একটু বেরোব, হাওড়া যেতে হবে।”
চূর্ণীর ঘুম ভেঙে গেছে।
সে উঠে বসে বলল, “এত ভোরে হাওড়ায়?
ট্রেন ধরবে নাকি?”
দ্বিজ বলল, “হ্যাঁ, একটু ছাতনা যাবার ছিল।”
‘ছাতনা’ নামটা শুনেই চূর্ণীর বুকটা কেমন ছাঁৎ করে উঠল। চাকরিটা চলে যাবার পর দাদা কোনও কাজ যোগাড় করতে না পেরে পুরোহিত দর্পণ কিনে
যজমানি শুরু করেছিল। কলকাতায় তেমন সুবিধে হচ্ছিল না। কেউ একজন বলেছিল ওদিকে
ব্যবস্থা করে দেবে। চূর্ণীদের পূর্বপুরুষরা এককালে ওদিকেরই বাসিন্দা ছিলেন। দাদা
তো ছাতনার দিকেই কোথায় একটা থাকত মারা যাবার আগে। চূর্ণী ছাড়া কারও সঙ্গে যোগাযোগ
রাখত না, আর কেউ জানেও না সে
কথা। সে বারণ করেছিল জানাতে। তার আত্মহত্যার খবরও পাওয়া গেল বেশ কয়েকমাস বাদে।
সাড়ে নটা নাগাদ চূর্ণী
একটা ফোন করল দ্বিজকে, “কী ব্যাপার, কোথায় এখন?”
দ্বিজ বলল, “ঠিকই আছি, চিন্তা কোরো না। সাঁতরাগাছি থেকে ট্রেন
ধরেছি, এখন বিষ্ণুপুরে।”
বারোটা নাগাদ আবার ফোন
করেছিল চূর্ণী, ফোন বেজেছিল কিন্তু
কেউ ধরেনি।
তারপর থেকে ফোন করলেও
ওদিকের ফোন নীরব।
দ্বিজর আর কোনও সংবাদ
পাওয়া যায়নি।
সে ফিরেও আসেনি আর।
(গল্পটি সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিতব্য রূপঙ্কর সরকারের গল্পের
বই ‘অপ্রাকৃত ২’-এর অঙ্গ)
সুচিন্তিত মতামত দিন