সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়

মায়াজম
0

                      কঙ্কনার প্রথম বছর



“এই দাঁড়া! দাঁড়া বলচি! চলে যাবি না... সব্বাই ওঠেনি দেখচিস না খানকির বাচ্চা?”
অশ্রাব্য গালাগালি দিতে দিতে হাতে একটা ভাঙা ঝাঁটা নিয়ে নিত্যপাগল সাতসকালে বাসগুলোকে পেটায়।
কাকভোরে মর্নিং স্কুলের হলুদ বাসগুলো পর পর আসে। স্কার্ট, চুড়িদার পরা মায়েরা কিংবা উসকোখুসকো বাবারা কুট্টিকুট্টি বাচ্চাদের লাইন করে বাসে তুলে মর্নিংওয়াকে এগোয়। কেউ কেউ আসে দাদুর হাত ধরে। দাদু নাতিটিকে বাসে তুলে টুকটুক করে বাজারের দিকে হাঁটেন। এর মধ্যে নিত্যর দাপানি দেখে মায়েরা সিঁটিয়ে যায়... বাচ্চারা কেউ কেউ অবাক হয়ে দেখে, কেউ আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঢোলে। 
উফ! এই পাগলটাকে এখান থেকে কেউ তাড়ায় না কেন? মায়েরা নীচু গলায় বলাবলি করতে করতে ফেরে।
বাসের খালাসিরা হাতের অশ্লীল ভঙ্গি করে। “এই নে... পাউরুটি খাবি।” পয়সা ছুঁড়ে দেয় কেউ।
নিত্য পয়সা নেয় না। ঝাঁটা সামলে শাড়ির আঁচল দিয়ে বুক ঢাকে। পুরোনো পাড়ায় প্রচুর পুরোনো বাসিন্দা। তাদের মধ্যে কেউ হাঁক দেয় — “যা এখান থেকে... যাঃ!”
নিত্য নতুন বউটির মতো মাথা নীচু করে সরে যায়। খামচানো চুলের ওপর ছেঁড়া আঁচল টেনে নিতে গিয়ে ফাটা হাফপ্যান্টের পকেট থেকে বাসি রুটি বেরিয়ে আসে। সেটা তুলে নিয়ে কিছুটা নিজে চিবোয় আর কিছুটা সঙ্গের কুকুরটাকে দেয়। তারপর পুরোনো ছেঁড়া ময়লা একটা পুতুলকে নিয়ে খেলতে বসে।

রাস্তার ওপরেই বাড়ি। কঙ্কনার ঘরের জানলাটা খোলে গলির দিকে। ওদিকে বড়রাস্তা জমে উঠলেও ভোরের আভাসটা ঘরের মধ্যে ভাসতে থাকে কিছুক্ষণ। ডাইনিং স্পেসে জোরে চেয়ার ঠেলার আওয়াজ হয়। শাশুড়ি একটু বেশি জোরে বাথরুমের দরজা বন্ধ করেন। ঘর থেকে না বেরোনো অবধি এর’ম আওয়াজ চলতে থাকে। অথচ এ বাড়িতে একটাই বাথরুম। আগে উঠে বাথরুমে ঢুকলে শ্বশুরমশায়ের অসুবিধা হবে। উনি রোজ বাথরুম সেরে চা বানিয়ে টেবিলে এসে বসেন। কঙ্কনা সকালে চা খায় কিনা সেটা বউভাতের দুদিন পরে জানতে চেয়েছিলেন।
“খেলে ও নিজে করে খাবে ’খন, তোমাকে ভাবতে হবে না...” শাশুড়ির সোজাসাপটা কথার পিঠে কঙ্কনা হেসেছিল, “খাই, কাল থেকে আমিই করব চা-টা। আপনারা কটায় সকালের চা খান?”  
“না না, তোমাকে করতে হবে না। ও বদভ্যেস ধরিও না বাপু। তিনদিন পরে আলাদা হয়ে যাবে। মাঝখান থেকে আমাদের অভ্যেস খারাপ করে দিয়ে যাবে। আমার ভোরের চা তোমার বাবার হাতে খাওয়াই অভ্যেস।”
বোঝা গেল কর্তাগিন্নির প্রাইভেট টাইম ওটা। অথচ সেই হিসেব করে ঘরে থাকলেও বাইরে দাপাদাপি চলতে থাকে। জানলা থেকে সরে গিয়ে দরজা খোলে কঙ্কনা। এত সকালে সজল ওঠে না। পাশবালিশ জড়িয়ে আরও ঘণ্টাখানেকের মেয়াদ।

দু রকমের বাজার হয়। একটা তাড়ার বাজার। অন্যটা দিনের বাজার। তাড়ার বাজারের থলেতে আলু পেঁয়াজ পটল রুই বা কাতলার পিস, শসা। আর দিনের বাজারের থলেতে শাক, লাউ, চালকুমড়ো, ঝিঙে, ট্যাংরা, কুচো চিংড়ি — মানে যেগুলো সারাদিন ধরে রান্না করা হবে। বাজার নামলেই কঙ্কনা ঝটপট মাছ ভাজে। একটু উচ্ছেভাজা, ডাল, একটা মাছভাজা বা আলু দিয়ে মাছের ঝোল নামাতে হবে সাড়ে নটার মধ্যে। সজলের মেনু। তারপর সারাদিন ধরে লাউ চিংড়ি কী কুমড়ো ছেঁচকি, ট্যাংরার ঝাল, ঝিঙে পোস্ত — এসব শাশুড়ির হাতে। সজল রাতে ফিরে মায়ের রান্না খায়। 
রান্নাঘরের জানলার শিকে তেল ধরে গেছে। খুলতে গেলে কব্জিতে চিটচিটে তেল আটকে যায়। আঁচলে হাত মুছে কঙ্কনা চটপট রান্না গোছাতে গোছাতে বাইরে তাকায়। রাস্তায় বসে আছে নিত্য।বুকের আঁচল সরিয়ে পুতুলটাকে চেপে এমন ধরেছে যেন দুধ খাওয়াচ্ছে।  
“ও কি নিজেকে মেয়ে ভাবে, মা?” 
“কার কথা বলছ?”
“ওই যে রাস্তার ওই পাগলটা... সামনের লাল বারান্দাটায় থাকে যে...”
“কে জানে কী ভাবে। হিজড়েদের মতো রকম সকম। তুমি রান্নায় মন দাও। এক তরকারি নুনে পোড়া হলে ছেলেটার খাওয়া হবে না।” 
ওর নাম যে নিত্য সেটাই বা লোকে জানল কী করে! ও কি এখানকারই ছেলে? জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে যায় কঙ্কনা।

দুপুরে গলিটা একটু কম ব্যস্ত থাকে, তবে থেমে থাকে না। কঙ্কনা মফস্বলের মেয়ে। সেখানে দুপুর নামে ধীর পায়ে। সারা পাড়া নিঝুম হয়ে আসে। শুধু ফেরিওয়ালারা মাঝে মাঝে ছায়া ফেলে হেঁটে চলে যায়। কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা, যাদের প্রেম হতে হতে হচ্ছে না, অথবা বাড়ি থেকে পাত্র দেখা চলছে, তারা কারুর না কারুর বাড়িতে বসে পড়াশুনোর অছিলায় নদীর মতো বইতে থাকে। হাসতে থাকে অকারণে এ-ওর গায়ে ধাক্কা দিয়ে। নেহাত সামান্য কথাকেও এমন গলা নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে যে মনে হয় পৃথিবীর গোপনতম কথাটা এই মাত্র বন্ধুদের বলল। অমন দুপুর কলকাতার কোনও পাড়ায় আসে কি? কঙ্কনা জানলায় এসে দাঁড়ায়। পড়াশুনো নেই, গল্পের বইও নেই তেমন এ বাড়িতে। সজলের শরীর যতটা চিনেছে, ততটা মন চেনা হয়ে ওঠেনি। শরীরটা রোজ রাতে আসে, মন তো আসে না। সজল কি কঙ্কনার মন বুঝতে চায়? এসব প্রশ্ন করাই যায় সদ্য বিয়ের পর। কিন্তু সময় কই? দরজা বন্ধ হলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সজল আর কাজ শেষ হলেই ঘুমিয়েও যায় তাড়াতাড়ি।

“তোরা তো পেলেই খুশি। একগোছা ফুল, দুটো চিঠি, তিনটে শাড়ি, বছরে একটা কমলহিরে, বিয়ে হলে একটা ছেলে বা মেয়ে... ব্যস, এতেই মেয়েরা খুশি বুঝলি... মেয়েদের ভোলানো খুব সহজ...”
“কমলহিরে?” হাসিতে ভেঙে পড়ত কঙ্কনা। “কমলহিরে দেখেছ নাকি তুমি অত্রিদা?”
“কমলহিরে দেখলে কি চুঁচড়োর গলিতে আঁকার স্কুল করি?”
“কেন? দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে? আর আঁকতে পারবে না?”
“তুই সাবজেক্টের আলোটা ঠিক কর। বারবার বলি ছবি জীবন্ত করতে আগে কোন অ্যাঙ্গেল থেকে আলো পড়ছে সেটা বুঝে রং লাগাবি, তাও ভুল হয় কেন!”
“ভুল হয়, কারণ মন দিই না...” মাথা ঝাঁকায় কঙ্কনা। “রোজ আঁকায় মন দিতে ভালো লাগে না।”
“ভালো লাগে না তো বাড়ি যা, জুওলজি বা বটানি বা ইতিহাস বা অঙ্ক — যা খুশি পড়। এখানে কেন আসিস?” অত্রি তেড়ে ওঠে।
চোখে জল এসে যায় কঙ্কনার। আমি কমলহিরে চাই না। আমি তোমাকে চাই, তোমাকে চাই-ই-ই... চিৎকার করে বলতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু খোলা দরজার ওপাশে উঠোনে পাশাপাশি বউদির শায়া-ব্লাউজ, রিন্টুর হাফপ্যান্ট আর অত্রিদার শার্ট আর গামছা ঝুলছে। ছবিটায় আলো পড়ছে নৈঋতকোণের কার্নিশ ঘেঁষে। বড় জীবন্ত ওই ছবিটার দিকে চোখ চলে যায়। 
দিনের পর দিন মন দিয়ে তেলে রং মেশায়, ক্যানভাসে তুলির টানে মাপমতো বিষণ্ণতার ছায়া এঁকে বোঝাতে চায় মনে মন নেই।
বিয়েতে খুব ভালো একটা তুলির সেট আর ইজেল দিয়েছিল অত্রিদা। দ্বিরাগমন থেকে ফেরার সময় নিয়েও এসেছে সেটা। সঙ্গে পুরোনো ক্যানভাস পেপার রং সব এনেছে। 
সজলের মন সময় মতো বুঝেই যাবে। এখন তো অভ্যেসই বুঝেছে শুধু। রাতে বউ জড়ানোর অভ্যেস, খাবার পাতে কাঁচা লঙ্কা খাওয়ার অভ্যেস, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বসে মুখ খারাপের অভ্যেস, বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় দুবার কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করার অভ্যেস — এসব দেখতে দেখতে মনটাও বুঝবে নিশ্চয়। 

দরজা ভেজিয়ে জানলার নীচের কপাটটাও খুলে পর্দা সরিয়ে দেয় কঙ্কনা। মোড়ের কাছে একটা ভাতের হোটেল। হোটেল মালকিন কোমরে কাপড় জড়িয়ে বড় ঝুড়িতে ভাত ঢালে, ফ্যান গালে। একটা মোটা ল্যাজের বেড়াল শুয়ে থাকে দোকানের বেঞ্চে। মাসি আর দুটো বাচ্চা ছেলে ঘষঘষ করে সবজি কাটে, পিঁড়ের ওপর প্রতি মিনিটে দশটার স্পিডে পেঁয়াজ কুচোয়... দেখতে দেখতে বেলা নেমে আসে। কঙ্কনার কাগজের স্কেচে থমকে থাকে দুপুরের গলি, মুখোমুখি দোতলাবাড়িটার নীচে শাটার নামানো বসুধারা স্টেশনার্স, নেড়ি কুকুরের অলস গতি আর বাঁদিকের হলুদ বাড়ির ঝুলবারান্দার তুলসীর টব। 
বাইরে চেয়ারর শব্দ, রান্নাঘরের দরজার আওয়াজে সরঞ্জাম গোটায় কঙ্কনা। চা বানাবে এবার। ওঁরা খেলে খাবেন, নইলে একাই খাবে। শুরু থেকেই শাশুড়ি প্রায় সব কথাতেই ‘দুদিন গেলেই তো আলাদা হবে, কাজ করে অভ্যেস খারাপ করে দিও না’ শোনাচ্ছেন। তবে বিকেলে এই সময়ে জি বাংলার রান্নাঘর আর দিদি নাম্বার ওয়ান ছেড়ে উঠবেন না। শ্বশুরমশাই হাতে চা পেলে খুশিই হন। তবে কথা একদমই বলেন না। বলতে গেলেও গিন্নির ধমকানিতে চুপ হয়ে যান। কেন যে এরা ভাবেন আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা! কঙ্কনা আলাদা হতে চাইবেই না। এই বাড়িটা তো দিব্যি লাগে। কত রাত অবধি রাস্তায় লোকজন, সামনের দোকানগুলোতে আলো জ্বলে। টিভি দেখতে একদম ভালো লাগে না। রাস্তায় চোখ রেখে অনেকটা সময় কাটছে এখন। শুধু বাড়ির মাত্র তিনটে লোক যদি তিন মেরুর না হত, তো ভালো লাগত।

“হ্যাঁ রে, ওখানে সবাই তোকে নিয়ে খুশি তো মা? দেখিস, কাউকে অখুশি হতে দিস না...” মায়ের গলার ওপর দিয়ে রিক্সার প্যাঁকপ্যাঁক শোনা যায়। 
“তুমি একবার ছাদে যাবে মা? ছাদ থেকে কথা বলবে?”
“কেন রে? ছাদে কেন?”
“যাও না। রাত্তিরবেলা বড়বাগানের মাঠের দিকটা কেমন হাওয়া দেয় আর নিস্তব্ধ থাকে। তুমি ওদিকের পাঁচিলের কাছে গিয়ে কথা বলবে একটু? হাওয়ার শব্দ পাব তাহলে।”
“ধুত পাগল। তোর বাবা আসবে এখুনি। টুকাই ফিরবে টিউশনি থেকে। মঙ্গলা আসছে না দুদিন। হাতে হাতে আলু ভেজে মুড়ি দিয়ে মেখে দেব দুজনকেই। এখন কি ছাদে যাওয়ার সময়?”
“কিন্তু আমার যে খুব ওই হাওয়াটার শব্দ শুনতে ইচ্ছে করছিল...”
“কাল দুপুরে বরং হাত খালি করে তোকে ফোন করে গল্প করব ছাদ থেকে। কেমন?”
সন্ধে আর দুপুরের তফাত করতে পারছে না মা। আর কথা বাড়ায় না কঙ্কনা। গোছানো বিছানাই আবার গোছায়। বাইরে তিন নম্বরের রোয়াকে নিত্য প্লাস্টিক আর ছেঁড়া চাদরের বিছানায় কুকুরটাকে শুইয়ে নিজে পা ছড়িয়ে পুতুলটাকে বুকে নিয়ে চোখ বুজে ঝিমোতে থাকে। সজলের আসার সময় হবে এবার।

“এই, আমাকে তোমাদের এখানে বাজারে নিয়ে যাবে? এদিকে নাকি সন্ধেবেলায় বড় বাজার বসে...”
“বাজার যাবে! হায় রে! আমার বন্ধুদের বউরা সব কাশ্মীর, সিমলা, উটি, মরিশাস বেড়াতে যাওয়ার বায়না করে। আর তুমি বাজার যাওয়ার বায়না করছ?”
“যেও না একদিন নিয়ে! আমি আমাদের ওখানেও বাবার সাথে বাজার করতে যেতাম। ঝকঝকে সবুজ সবজি, ডাঁটা, মাখন মাখন হলুদ কুমড়ো, রুপোলি মাছ দেখতে খুব ভালো লাগে আমার...”
“আর কি ভালো লাগে আমার খুকির?”
“যাও... খুকি আবার কী?” 
“আচ্ছা বুড়ি। শুনি বুড়ির আর কী ভালো লাগে...”
খুনসুটিতে রাত কেটে যায়। কদিন পর সত্যিই সজল নিয়ে যায় বাজারে একদিন। চারদিক দেখতে দেখতে খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে কঙ্কনা। সবুজের কত শেড। ঝকঝকে কমলা রঙের কুমড়োর ফালি,টুকটুকে লাল টমেটো দেখতে দেখতে অত্রিদার কথা মনে পড়ে।
“প্রত্যেক সাবজেক্টের একটা হাইলাইটিং পয়েন্ট আছে কঙ্কনা... আগে সেটা স্থির কর...” 
সংসারের হাইলাইটিং পয়েন্ট শাশুড়ি মা ভরসন্ধেবেলায় এক ব্যাগ বাজার দেখে অবাক কম, ব্যাজার বেশি হলেন। “ওরা সবাই তোকে নিয়ে খুশি তো?” মা জিজ্ঞেস করছিল কদিন আগেই...
সজল অবশ্য বেশ খুশি। সন্ধেবেলা এলোমেলো বাজার করে ফিরে কঙ্কনা মাছটা রান্না করে নেয়।কাল সকালে আর সজলকে শুধু ডাল মাছভাজা খেয়ে যেতে হবে না। রান্নাঘর গোছাতে গোছাতে আবছা আবছা মায়ের গন্ধ আসে নাকে।

স্কুলের ছুটির দিন। তাই নিত্যর তাণ্ডব নেই ভোরের রাস্তায়। চুপচাপ বসে বসে মুড়ি খাওয়াচ্ছে কুকুরটাকে। যেখান থেকে যা খাবার জোটে তার অর্ধেক সারমেয়র পেটেই যায়। পুতুলটাকে একটা খবরের কাগজ চাপা দিয়ে শুইয়ে রেখেছে। ওর জীবনের হাইলাইটিং পয়েন্টটা কী অত্রিদা?পুতুলটাকে বুকে নিয়ে দুধ খাওয়ানোর সখ কেন এত?
“এই শোনো, শোনো না! ওঠো একটু...”
সজল পাশ ফেরে... “কী হয়েছে? কটা বাজে?”
“বাজে সাড়ে ছটা। আচ্ছা, ওই পাগলটার কি এখানেই বাড়ি? তোমরা যে বলো তোমাদের এখানে সবাই পুরোনো বাসিন্দা। ও-ও কি তাই? ওর নাম কী করে জানলে তোমরা?”
“আঃ, ছুটির দিনে ভোরবেলায় কী পাগলামি শুরু করেছ! ঘুমোতে দাও না! মা ঠিকই বলে দেখি…”
সজল পাশ ফিরে বালিশ টেনে নেয়... 
কী বলেন তোমার মা? জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছেও করে না কঙ্কনার।

শ্বশুর-শাশুড়ি মাঝে মধ্যেই আত্মীয়দের বাড়িতে যান। কখনোই যেতে বলেন না সঙ্গে। সবাই মিলে বেরোলে বাড়ি পাহারা দেবে কে? এতদিন ছেলে অফিস যেত, ওঁরা বাড়ি আগলাতেন। এখন সবে একটু হাত-পা মেলছেন। আবার কবে বউ ছেলেকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে। আটকা পড়ে যেতে হবে তখন আগের মতোই ... এসব কঙ্কনা শুনে শুনে শিখেছে। বিবেকানন্দ রোড থেকে মাসিশাশুড়িরা এসেছিলেন। তাঁরাও মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঝাড়া হাত-পা। তবে তাঁদের বাড়ি খালি রেখে বেরোনো হয় না। শাশুড়ি হাসি-হাসি মুখে বোনকে এসব ব্যখ্যা দিচ্ছিলেন।
“বউমা, এখানে এসে কেমন লাগছে?” মেসোমশাই জিজ্ঞেস করলেন।
“কেমন আর লাগবে? বাড়িতে ননদ-দেওর নেই, বাবু সকালে বেরিয়ে যায়, আমরাও কমই থাকি আজকাল। এত বড় বাড়িতে একার রাজত্ব তো ভালোই লাগবে জামাইবাবু।” শাশুড়িই উত্তর দিয়ে কাজ কমিয়ে দেন।  

শরীরটা কাল রাত থেকেই ভালো নেই। ওঁরা একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে নেন। কঙ্কনা নিজের খাবারটা বেড়ে ঘরে আসে। সামনের রোয়াকে বসে দুলে দুলে কাঁদছে নিত্য। বহমান রাস্তায় কোনও কৌতূহল নেই। সবাই পাশ দিয়ে যাচ্ছে আসছে। দরজা খুলে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় কঙ্কনা...
“এই, তুমি কাঁদছ কেন? এই নিত্য... কাঁদছ কেন তুমি?”
“ওমা বৌদি! তুমি এই পাগলের সঙ্গে কতা কইতে এয়েচ?” পাশের ঝুপড়ি ভাতের হোটেলের বয়স্ক মাসি বালতিতে এঁটো থালা বাটি চুবিয়ে ধুতে ধুতে গলা তোলে।
থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে যায় কঙ্কনা। “না, মানে, জানলা দিয়ে দেখলাম কাঁদছে অনেকক্ষণ, তাই...”
“আহা গো! মায়ার প্রাণ... পাগল-ছাগলের হাসি-কান্নার আবার মানে খুঁজতে গেচে দেক... একুনি দেকবে চাট্টি এঁটো ভাত-চচ্চড়ি কাগজে করে দিলেই হাসিমুখে মেয়েকে খাওয়াতে বসবে...”
“মেয়ে? ওই পুতুলটা?”
“হ্যাঁ গো... ওটাই... লোকে তো বলে ওর হয়তো নিজের বাচ্চা ছেল... হারিয়ে পুড়িয়ে এখন পুতুল খেলে সারাদিন... ওই দেকো, কেমন বুকের জামা তুলে মেয়েকে দুদ দিতে বসেচে আবার... পাগলের কিত্তি গো মা...”
দোকানে খদ্দের এসেছে। কঙ্কনা বাড়ির দিকে ফেরে। খেতে তো ইচ্ছেও করছে না একদম। নিজের ভাতের থালাটায় একটা কাগজ চাপা দিয়ে রোয়াকে রেখে সরে আসে। নিত্য একটা অবহেলার দৃষ্টি দিয়ে দেখে একবার।  
বাড়ি ঢুকতেই শাশুড়ি ফেটে পড়েন। “এসব কী শুরু করেছ তুমি? বাড়ির খাবারের থালা পাগলকে দিয়ে এলে? এতক্ষণ ওই রাস্তার দোকানদার বউটার সঙ্গে কথা বলছিলে। তোমার শশুরমশাইয়ের মানসম্মানের খেয়াল রাখলে না একটা?”
“কিন্তু মা, এতে মানসম্মান হানি কী করে হল? ভিখিরিকেও তো খাবার দিই আমরা!” 
“দিই, তারা দরজায় এলে। বস্তিবাসী হোটেলওয়ালির সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে ভিখিরির দরজায় খাবার পৌঁছে না। তাছাড়া ঘরের বাসন তো তোমার বাপের বাড়ি থেকে আসেনি বাপু!”
“কিন্তু ও তো ভিখিরি না মা... ও পাগল। ওকে দিলে খায়, না দিলে খায় না...”
“তাই নাকি? তোমাকে কে বলল যে খায় না?”
“আমি জানলা দিয়ে দেখতে পাই তো...”
“বাহ বাহ... এখন সারাদিন জানলা দিয়ে পাগলটাকে দেখ? ছি ছি! আজই বাবু এলে বলব তার বউয়ের কীর্তি। সারাদিন কাজ নেই কম্ম নেই, ল্যাংটো পাগলের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তোর বউ...”
হ্যাঁ রে! ওঁরা কেউ তোকে নিয়ে অখুশি নয় তো? — মায়ের প্রশ্নটা বড্ড কঠিন ছিল।

“তুমি এম-এ তে ভর্তি হতে চাইলে হয়ে যাও। বাড়িতে বোর হচ্ছ বুঝতে পারছি। কিছু করার না থাকলে আমার বন্ধুর বউদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করো, মলে যাও, ঘুরে বেড়াও, এন জি ও-তে নাম লেখাও। কিন্তু প্লিজ, পাগল নিয়ে পাগলামো কোরো না... মা দুপুরে অফিসে ফোন করে তোমার নামে নালিশ করছে বুঝলে খুকি?”
সজলের বুকের মধ্যে একটা ওম আছে। 
“তুমি দিনে কটা সিগারেট খাও গো?” কথা ঘোরায় কঙ্কনা।
“কটা আর... সাত-আটটা খাই... তার থেকে বেশি চুমু খাই তোমাকে রোজ।”
জানলার পর্দাটা উড়ছে। সজল বউকে কাছে টেনে মুখ নামায়... পিছনে কঙ্কনার দিয়ে আসা থালায় জল ঢেলে চুমুক দিয়ে খায় নিত্য। 
বিয়ের পাঁচমাস কেটে গেছে। এ মাসে মিস করল কঙ্কনা। শাশুড়ি হাসিহাসি মুখে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। টেস্ট হল। নাঃ, ডাক্তার বললেন স্ট্রেস এবং অ্যানিমিয়া। স্ট্রেস কীসের, সেই নিয়ে শাশুড়ি ও তাঁর বান্ধবীদের যথেষ্ট পরিমাণে পর্যালোচনার পরে বোঝা গেল এটা আজকালকার মেয়েদের ফ্যাশন। আর অ্যানিমিয়া তো হবেই। লুকিয়ে লুকিয়ে পাগল ছাগলকে নিজের খাবার খাওয়ালে অ্যানিমিয়া কেন, থাইরয়েড হলেই বা জানছে কে! ডাক্তার অবশ্য বলেছেন ভালো ঘুম, খাওয়া আর হেলদি সেক্স লাইফই এর ওষুধ। সঙ্গে সকাল বিকেল আয়রন পিল চলতে থাকুক।‘সেক্স লাইফ’টা শুনে শাশুড়ি এমন একটা ঘেন্না ঘেন্না মুখ করলেন যেন নিজে কখনও ওসব করেননি। সজলকে কোনও মন্দিরের বেলগাছ থেকে পেড়ে এনেছেন।

বোলপুরের মামিমা এসেছেন। বাতে, হাঁপানিতে, অর্শে জেরবার। মামাও এসেছেন। রিটায়ার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট মামা খুব জোরে হাসেন। হইহই করে কথা বলেন। সন্দেশখালির এক ‘ব্যাঘ্র বাঁচাও প্রকল্প’-এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য খুব বোঝাচ্ছেন জামাইবাবুকে।
“তুমি নিশ্চই ভুলে গেছো আমাদের। বিয়ের পর আর দেখাও তো হয়নি...”
“না না, ছবি দেখি তো আপনাদের সবার। বিয়ের অ্যালবামে অনেক ছবি আছে যে। ওর গায়ে হলুদের সময় তোলা আপনার বেশ কটা ভালো ভালো ছবিও আছে...”
“তাই? নিয়ে এসো তো, দেখি!” মামিমা সোফায় আর একটু ছড়িয়ে বসেন।
“মেয়ের গুণের ঘাট নেই... চুপচাপ হলে কী হবে। বড্ড বারমুখো। যখন দেখো, জানলায় দাঁড়িয়ে আছে...” অ্যালবাম নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই কানে আসে শাশুড়ির কথাগুলো।
“এই যে, এনেছ? দাও... আমি বৌদিকে বলছিলাম তোমার কেমন দয়ার শরীর। রাস্তার পাগল ছাগলদেরও মুখের ভাত ধরে দাও...”
একদিনই দিয়েছিল। সে থালা আজও নিত্যর সামনেই পড়ে থাকে। ভাতের হোটেলের মাসি মাঝে মাঝে খদ্দেরদের এঁটো ভাত-তরকারি ওই থালার ওপর ঢেলে দিয়ে যায়। পুতুলকে বুকে নিয়ে নিত্য আর কুকুরটা মিলে মিশে খায় দেখা যায় জানলা দিয়ে।

পিছনের দিকের ঘরে মামিমাদের থাকার জায়গা হল কদিন। দিব্যি ছিমছাম খাট বিছানা, আয়না, আলমারি দিয়ে সাজানো ঘরটা এমনিতে ব্যবহার হয় না। ওঁরা আসতে রোজ ঘরটা গুছিয়ে দেওয়া,বিছানা করা, অল আউট লাগানো, জল রেখে আসা — এসব টুকিটাকি কাজ কঙ্কনাই করছিল। এ ঘরটা বেশ মজার। বড় বড় জানলা আছে রাস্তার দিকেই। কিন্তু রাস্তাটাই ঘুরে গেছে একটু, তাই ছবিটা আলাদা একদম। বড় রাস্তার হৈ-হুল্লোড় সব ছেড়ে এসে একটা শান্ত গলি শুয়ে আছে জানলার ওপাশে।
মামিমারা চলে যাওয়ার পর বাড়ি আবার ফাঁকা। শ্বশুর-শাশুড়িও ‘একটু বেরোচ্ছি’ বলে বেরিয়েছেন। বাড়িতে কেউ না থাকায় কঙ্কনা এ ঘরের খাটে এসে শোয়। ফ্যানের হাওয়ায় ড্রেসিংটেবিলের ঢাকনা দুলে ওঠে।  
“চল চল... ইস্কুল যাবি না মানে? ইস্কুল না গেলে বড় হবি কী করে?” একটা খসখসে গলা শোনা যায়। ঘুম এসে গেছিল শুয়ে শুয়ে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে কঙ্কনা। নিত্য! গলির ভেতরে ঢুকে এসেছে। জানলার ওধারে বসে পুতুলটাকে হাতে নিয়ে বকছে... “ইস্কুলে না গেলে মাকে খাওয়াবি কী?”
মা কে? ও নিজে? মাথায় ছেঁড়া কাপড়ের ঘোমটা, ছেঁড়া হাফপ্যান্ট, খামচানো চুল গায়ে বোঁটকা গন্ধওয়ালা পুতুলের মাকে দেখে হেসে ফেলে কঙ্কনা।
“এই, এই... তুমি খেয়েছ?” কঙ্কনার ডাকে একবার মুখ তুলে তাকায় পাগল, তারপর হো হো করে হাসতে থাকে।
“শোনো। ভাত খাবে? ভাত দেবো?”
হাসি থামিয়ে উঠে দাঁড়ায় পাগলটা। তারপর পুতুলটাকে দেখাতে দেখাতে দৌড়ে সামনের রাস্তার দিকে চলে যায়।  

“তোরা খালি পেলেই খুশি। ফুল, চিঠি, কমলহিরে, বিয়ের পর একটা দুটো ছেলেমেয়ে...” তুমি কিছুই জানতে না অত্রিদা। আমরা বলে কিছু হয় না। সকলের নিজের নিজের খুশির কৌটো আছে।সজল আমার শরীরে খুশি, আমি তোমার রঙের আঁচড়ে খুশি, তুমি রিন্টুর আঁকার হাত দেখে খুশি,আমার মা আমার শ্বশুর-শাশুড়ির খুশিতে খুশি, হোটেলের মাসি খদ্দেরে খুশি, নিত্য পাগল নিজের মিথ্যে মাতৃত্ব আর সন্তানে খুশি...
একা বাড়িতে ঘুরে বেড়ায় কঙ্কনা। সজল প্রেগন্যান্সির কথায় একটু মুষড়ে পড়েছিল। ভুল খবর জেনে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। বলেছে, “তিন বছর নো বাচ্চা। তোমার বুকে আমি ছাড়া কারুর এনট্রি নেই। ইচ্ছে করলে নিত্যর মতো পুতুল কিনে নিও।” কঙ্কনা নিজেও এখন বাচ্চা নিয়ে ভাবে না। অত্রিদার কাছে একদিন যাওয়ার কথা ভাবে বরং। নিজেকে সাবজেক্ট বানিয়ে আলো ফেলতে গেলে আঁকার ক্লাসঘর আর ইজেলের সামনে অত্রিদার ঝুঁকে থাকা চেহারাটায় আলো পড়ে যায়।
একলা বাড়িতে দুপুর ঘন হয়। ক্যানভাস জুড়ে পেন্সিল চালাতে চালাতে একসময় থামে কঙ্কনা। অবচেতনের আঙুলে সাদা ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে নোংরা হাড় বের করা একমুখ গোঁফদাড়িওয়ালা এক পুরুষ, যার ভারী বুকের ভাঁজে আটকে আছে চুল ছেঁড়া একটা পুতুল...    
দুধে ভিজে যাওয়া জামাটার ওপর আলো ফেলার আগেই আগেই সন্ধে নেমে আসে গলির জানলায়।
(গল্পটি সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিতব্য সঙ্গীতার বই ‘সুয়োকথা দুয়োকথা’-এর অন্তর্গত!) 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)