নির্মাল্য সেনগুপ্ত

মায়াজম
0
                                 আদর








তার চোখের সামনে এখন দুটো গোলাপ ফুল ফুটে আছে। গোলাপ যখন কাঁটা থাকবেই। হঠাৎ করে হাত দিলে ফুটে যাবে আঙুলে। ঠিক যেভাবে ফুল দুটো ফুটেআছে ডালটায়। বৃন্ত থেকে চুঁইয়ে পড়ছে শিশির জল। আজলা করে মুখে মাখলে অবিকল বাজারের এসেন্সের গন্ধ আসে গাল থেকে। লোকটা হাত দিল ফুলে।‘উহ!’ করে চেঁচিয়ে উঠল।
অন্তরা শাড়ির আঁচলটা দিয়ে ঢেকে নিল বুক। পুরুষ মানুষের সীৎকার শুনতে সে অভ্যস্ত নয়। বিশেষ করে এই লোকটার মাথায় কোনও গন্ডগোল আছে। আরপাঁচটা খদ্দের থেকে অনেক আলাদা। অন্যদের মতো ঘরে ঢুকেই মদের গ্লাস বের করে না ড্রয়ার থেকে। জামার আগে প্যান্ট খোলে না। দুরন্ত হাতে নগ্ন করে না অন্তরাকে। শরীর ছিলে দিয়ে সঙ্গম করে না। নিরোধ ব্যবহারের কথা বললে ঘৃণার চোখে তাকায় না। এগুলোর কিছুই করে না এই ঘোলাটে চোখের লোকটা। শুধু অপ্রস্তুত চোখে তার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হাত বাড়ায়। কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
আজ ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল লোকটা। অপমানিত বোধ করল অন্তরা। এর থেকে ওই রাক্ষসগুলো বেশি ভালো। ছিঁড়ে খেয়ে নেয় তার শরীর। আদর করে। ব্যথা পায় না তারা। ব্যথা দেয়।
“আপনার মুশকিলটা কোথায় বলুন তো? আর কিছু পারেন না যখন, গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে বেশ্যাবাড়ি আসেন কেন?”
চুপ করে রয়েছে লোকটা। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে অন্তরার।
“বউয়ের বুক নেই নাকি? বিয়ের আগে দেখে নেননি?” তবুও জ্বলন কমে না তার শরীরের।
“মায়ের দুধ খাননি?” লোকটা এবার চোখ তুলে তাকাল। মৃত মাছের মতন চাউনি। আবার হাত বাড়াল লোকটা। ব্লাউজে টান পড়ল অন্তরার। এগিয়ে এল তারদিকে। মুখ রাখল বুকে। অন্তরা লোকটার চুল ধরে চেপে ধরল মুখ। অন্য হাত দিয়ে হাতড়াচ্ছে অন্তরার নাভির নীচে। কষ দিয়ে গড়াচ্ছে লালা। হঠাৎ ছিটকে সরে গেল লোকটা। বাঁ হাতের পিছন দিয়ে গোঁফের উপর লেগে থাকা থুতু পরিষ্কার করে বলল, “দুধ আসেনি। তোমার সন্তান নেই?”
অন্তরা চুপ করে রইল। কিছু বলাই বৃথা। লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বিছানার উপর ফেলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

দরজার একটা পাল্লা মেঝের সঙ্গে ঘষা খেতে খেতে ক্ষয়ে অন্য পাল্লাটার থেকে সামান্য ছোট হয়ে গিয়েছে। তবু অনায়াসে নীচু হয়ে ঘরের ভিতরটা দেখা যায়।অমল তার বাঁ গালটা মেঝেয় ঠেকাল। সাদা রঙের একটা পা দেখা যাচ্ছে খাটের থেকে ঝুলন্ত অবস্থায়। মা জেগে আছেন। অমল কড়া নাড়ল। প্রথমবার আস্তে,দ্বিতীয়বার সশব্দে।
কিছুক্ষণ পর খুলে গেল দরজা। ইন্দিরা দরজা খুলে দিল। ইন্দিরা অমলের মাসতুতো দিদি।
ছাতাটা ঘরের কোণে মেলে রেখে অমল নীচু গলায় জিজ্ঞেস করল “আজ কেমন আছে?”
“ভালো। তুই খেয়ে নে তাড়াতাড়ি। আমি বাসনগুলো মেজে দিয়ে বেরোব।”
আড়চোখে মায়ের দিকে তাকাল অমল। মাস ছয়েক আগে পক্ষাঘাত হয়েছে বসুন্ধরা দেবীর। এখন শরীর অনেক উন্নতির পথে। ডাক্তারির ভাষায় ‘ইন প্রগ্রেস’। তবে কথা বলার সময় এখনও বাঁ গাল নাড়াতে পারেন না বসুন্ধরা দেবী। অমলের বাবা গিরীশ নন্দী মারা গিয়েছিলেন অমলের জন্মের তিনদিন পরে। নকশাল আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলি খেয়ে। গিরীশবাবু মোটেই নকশাল ছিলেন না। তিন আনার আলুর চপ কিনতে গিয়েছিলেন হরিদার দোকানে। সেই সময় একদল-পুলিশ ছুটছিল কিছু বাচ্চা ছেলেকে কব্জা করতে। ঠিক তখনই গিরীশবাবু চপের শেষ টুকরোটা গালে ফেলে হাতের লাগা সর্ষের তেলটা ঠোঙায় মুছে ছুঁড়েছেন। আরএক ঝাঁক গুলি সোজা এসে তাঁর বুকে গেঁথে যায়। কোনও এক ন সিকিয়া পুলিশ বোধ হয় কাগজের ঠোঙাটাকে পেটো ভেবেছিল। তখনই গিরীশবাবু রক্ত মাখামাখি করে দেহত্যাগ করেন। গালের চপ গালেই থেকে যায়।
সেই সময় বসুন্ধরা দেবীকে আধ চুপসানো পেট হাতে নিয়ে কাজে বেরোতে বাধ্য হতে হয়। তখন তাঁর বোনঝি ইন্দিরার বয়স সাত। এদিকে আবার ইন্দিরার মাতথা বসুন্ধরাদেবীর বোন কাজলী ইন্দিরার জন্মের পরেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছিলেন। জামাইবাবু নবীন পোস্ট অফিসে চাকরি করেন। ইন্দিরা বড় হয় বসুন্ধরাদেবীর বাড়িতেই। ঘরের সব কাজ সেই সামলায়, মায় অমলকেও। বসুন্ধরাদেবীও যখন জামাইবাবুর অফিসে চাকরি নিয়ে সকাল দশটায় বেরিয়ে যান,ইন্দিরা তখন অমলকে বুকে নিয়ে গুঁড়ো দুধ জলে গুলে মুখে দিচ্ছে।
সময় কেটে গেছে প্রায় বত্রিশ বছর। বসুন্ধরাদেবী এবং নবীনবাবু দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত। ইন্দিরার বিয়ে হয়নি। সে বাবার সাথে থাকে। তবে এখনও বিয়ের চেষ্টা চলছে। অমল সেলস্ম্যানের চাকরি করে একটা বিলিতি শ্যাম্পুর কোম্পানিতে। মায়ের পেনশনের টাকা আর তার উপার্জনে কেটে যাচ্ছে মোটামুটি।
অমল জানে তার মা সন্তান বলতে বোঝে ইন্দিরাকেই। কোনওদিনই সে মায়ের সোহাগ উপলব্ধি করেনি। ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখেছে বসুন্ধরাদেবীর কোলে আঠারো বছরের ধিঙ্গি মেয়ে বসে গল্প শুনছে। পুজোর সময় তাকে পঞ্চাশ টাকার ছিটের কাপড়ের শার্ট জুটেছে, ইন্দিরার গায়ে উঠেছে দেড়শ টাকার শাড়ি।প্রথম প্রথম এমন পক্ষপাতিত্ব দেখলে অমল অভিমান করত। ঠোঁট ফুলিয়ে বসে থাকত। এখন কিছু বলে না। চেষ্টা করে মেনে নেওয়ার। দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে।
দরজায় আওয়াজ হল। চায়ের দোকানের ছেলেটা চেঁচিয়ে বলল, “অমলদা জগাদা তোমায় ডাকছে।”
অমল উঠল। আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার দিকে এগোল।

রোড ডিভাইডারটার উপরে জগা বসে ছিল। অমল দুদিক দেখে রাস্তা পার করে জগার পাশে গিয়ে বসল। একটা সিগারেট ধরাল।
“জগাদা বঙ্কিমদাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?”
“যে কাজটা করছিস কর না। তোদের মুশকিল কী জানিস তো? বেশি লোভ। আজ ছ হাজারের কাজ ছেড়ে আট হাজারের কাজ করতে চাইছিস। দুদিন পর বারোহাজারের দিকে ছুটবি। চারদিন পর পনেরোর দিকে হাতড়াবি। এই খোঁজ কোনওদিন শেষ হবে না। লিখে দিচ্ছি। দে বিড়ি দে একটা।”
অমল জগার দিকে একটা সস্তা সিগারেট এগিয়ে দিল। এই সিগারেটগুলো থাকে তার বাঁ পকেটে। অসময়ে খাওয়ার জন্য আর বিলানোর জন্য এগুলো। নিজের একটু দামী ব্র্যান্ড ডান পকেটে থাকে।
“তুমি মাইরি বড় খিচখিচে হয়ে গেছ। মলিনাদি কেমন আছে?”
“সে আমি কী জানি!” জগা সিগারেট জ্বালিয়ে একটা থান ইঁটের উপর বসে থাকা আরশোলার দিকে তাক করে ধোঁয়া ছাড়ল। “মলিনাদিকেই জিজ্ঞেস করে নেগিয়ে।”
অমল আড় চোখে তাকাল। মলিনাদির নামে খুব একটা ভালো খবর ছড়িয়ে নেই। খারাপ মেয়ে নামে পরিচিত ছিল মলিনাদি। টাকা নিয়ে ছেলেদের সাথে ঘুরত।ইংরেজিতে যাকে বলে এস্কর্ট। বছর চারেক আগে জগাদা ধপাস করে পড়ে যায় মলিনাদির প্রেমে। মাস দুয়েক ট্যাঁকের পয়সা খরচ করে ঘুরে তারপর বিয়ে করে নেয়। সেই তখন থেকেই জগাদা এমন খিটকেল হয়ে গেছে।
“আচ্ছা তুমি একটা কথা বলো। যদি মলিনাদির প্রতি তোমার এত রাগ, এত ক্ষোভ, তবে তুমি বিয়ে করলে কেন?”
জগা কিছু বলে না। সিগারেটের কোম্পানিতে আগুন লেগে গেছে। সেটা দিয়ে জগা একটা বিড়ি ধরাল।
“তোর চাকরিটার এত দরকার কেন বলবি?”
অমল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “বাড়ির অবস্থা ভালো নয় জগাদা। মা এখন আর প্রায় কথাই বলতে পারছে না। ভালো দেখে একটা ডাক্তার দেখাতে হবে।আর একটা কাজের লোক রাখা দরকার। ইন্দুদি একা আর পারছে না।
জগা ফিক করে হেসে বলল, “এই ইন্দু মেয়েটা কিন্তু অদ্ভুত। কী প্রেম তোদের দুজনের ওপর ওর কে জানে। বেগার খেটে মরল চিরকাল। বিয়ে-টিয়েও দিলি না আর।”
অমল খচে গেল। মুখে বলল না কিছু। জগার হাত থেকে বিড়িটা কেড়ে নিল।
“তবে তোর মা ইন্দুকে খুব ভালোবাসে। তোকে দু চোক্ষে দেখতে পারে না। এক কাজ কর, তুই গিয়ে ইন্দুর বাড়িতে থাক।”
“মাথা খেও না তো। চাকরিটা হবে কি?”
জগা আপন মনে বলে চলল, “ইন্দুর বুকটা দেখেছিস কখনও? কত বড়। কত স্নেহ, মমতা যে ভরে আছে ওর বুকে কে জানে। ও মা হলে…”
“জগাদা মুখ সামলে কথা বলবে কিন্তু…”
জগা থামল না। বলেই চলল। “ইন্দুর ভালোবাসা পাওয়ার লোক মেলা দুষ্কর। অমন বুকের মালিক হতে গেলে শুদ্ধ হতে হবে। তোর আমার মতো হলে চলবে না।ভুলভাল লোকের পাল্লায় পড়লে সবটুকু চুষে ছিবড়েটা ফেলে দেবে খালি। এমন লোক চাই যে ওর দাম বোঝে, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ব্যথার ফোঁড়া ভেবেহাত বুলায়, আঙুল দিয়ে ছবি আঁকে আর চুমু…”
অমল জগার কলার চেপে ধরল। জগা জুলজুল চোখে অমলের দিকে তাকিয়ে বলল, “জিজ্ঞেস করছিলি না আমি তোর মলিনাদিকে কেন বিয়ে করলাম? ওর বুকটা দেখেছিস কখনও? অমন ইন্দুর মতো। তার থেকেও বড়। কিন্তু ভুলভাল লোকের হাতে লাগছিল। আমি সেই রাস্তা বন্ধ করলাম। মলিনাকে ভালোবাসি বলে নয়,যাতে ওর বুকে আর কেউ কোনওদিন হাত দিতে না পারে। মরার আগে অবধি অমন ফোলাফাঁপা হয়ে থাকে। স্নেহে টইটম্বুর, আহ বড় আদরের। চিন্তা করিস না,তোর চাকরিটা হয়ে যাবে। ইন্দুর বুকটা সামলে রাখিস খালি…”

অমল ঘরে ঢুকল আজ অনেকটা রাত করে। ইন্দিরাকে দরজা খুলতে দেখে অবাক হয়ে গেল।
“এ কী! বাড়ি যাওনি?”
“সে চিন্তা তোর আছে? মাসির শরীরের অবস্থা দেখেছিস তুই? আজ আর বাড়ি যাওয়া হবে না আমার।”
“মেসো?”
“উহ! মা-র কথা ভাবে না ছেলে, মেসোর ওপর দরদ দেখাচ্ছে। খেয়ে উদ্ধার কর। আমি শোবো।”
“দূর করে দে, ভাত দিবি না। অলুক্ষুনে একটা।” বসুন্ধরা দেবী হঠাৎ জড়ানো গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন। অমল রাগ করল না। অবাক হয়ে গেল।
খাওয়া শেষ হতে অমল দেখল ইন্দিরা শুয়ে পড়েছে। থালাটা টিপকলের জলে নিজেই মেজে নিল অমল। আজ রাতে তাকে মাটিতে চাদর পেতে শুতে হবে।
ময়লা চাদরটা ডানা ঝাপটিয়ে মেঝেতে পাতার সময় অমলের চোখে পড়ল জগাদা ঠিকই বলেছে, ইন্দিরার বুকটা সত্যিই বেশ বড়। অমল চোখ সরিয়ে নিতে চাইল।পারল না। হঠাৎ তাকে চমকে দিয়ে ইন্দিরা ‘উঁহ’ করে চেঁচিয়ে বুকে হাত দিল। ঘুমের ঘোরে কাতরাচ্ছে ইন্দিরা। বুকের ভারে বোধ হয়। অথবা গ্যাস হয়েছে হয়তো।
শুয়ে পড়ল অমল। চাকরিটা হয়ে গেছে। পরশু থেকে শুরু। মাকে ডাক্তার দেখাতে হবে। ইন্দিরাকে ছুটি দিতে হবে। নিজের বাড়িতেই এই অত্যাধিক অত্যাচার আর পোষাচ্ছে না।
জগাদার কথা মনে পড়ল আবার। অমন বুকের আদর করার লোক চাই। খুঁজতে হবে। অমলকেই সেই লোক খুঁজে আনতে হবে।
ঘুমানোর চেষ্টা করল অমল। কিন্তু সে জো কোথায়। ইন্দিরা মিনিটে মিনিটে কাতরে উঠছে। অমল আড় চোখে দেখল ইন্দিরা বুকে হাত ঘষছে। গ্যাস নয়, আদরের অভাবেই হয়তো…

অন্তরা নড়ে চড়ে বসল। আবার এসেছে সেই পাগল লোকটা। আবার ঝাঁপিয়ে পড়বে তার বুকের ওপর। অতিষ্ঠ করে তুলবে আঁচড়ে কামড়ে।
লোকটা এসে বসল অন্তরার সামনে। কিছুক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল ফ্যালফ্যাল করে। তারপর হাত বাড়াল।
অন্তরা পিছিয়ে গেল। আর নয়, আজই শেষ। সনাতনকে বলে দিতে হবে এই পাগলটাকে আর না ঢুকতে দিতে। ভয় পায় অন্তরা। পয়সা চাই না তার। শরীর বেচে খেলেও তার শরীরের প্রতি অগাধ ভালোবাসা।
লোকটা হঠাৎ তার সেমিজের কাপড় ধরে টান মারল। ভয়ে গলা শুকিয়ে এল অন্তরার। এই ধরনের লোকেরা খুনীও হয়। কিছুদিন আগে বিজলি মাসির কাছে শুনেছিল এমন একটা গল্প। একটা পাগল এভাবে বেশ্যাদের কাছে এসে কিছু না করে শুধু মেরে ফেলে রেখে চলে যেত।
লোকটা যদিও তেমন কিছু চেষ্টা করল না। আলতো করে হাত রাখল তার বুকের ওপর। আস্তে আস্তে উপর থেকে নীচে হাত বোলাতে লাগল। অন্তরার হাসি পেল।
“এই অ্যাই কী করছেন কী? সুড়সুড়ি লাগছে তো?”
লোকটা চুপ করে রইল। অসভ্যের মতন তাকিয়ে রইল তার বুকের দিকে।
অন্তরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। খুনী হলে বোধ হয় এতক্ষণে মেরে ফেলত। মাথায় গন্ডগোল। এ ব্যামো সারবার নয়।
অন্তরা তার বুড়ো আঙুলের উপরটা দিয়ে লোকটার থুতনিটা একটু তুলে বলল, “কী চাই? খাবে? দুদু খাবে? আর কিছু করবে না? চেষ্টা করো, পারবে। আমি একটু আদর করে দেব?” অন্তরা লোকটার প্যান্টের চেনে হাত রাখল।
এবারও কিছু বলল না লোকটা। গলা দিয়ে অল্প গোঙানির আওয়াজ বেরল। অন্তরার কষ্ট হল বুকে। লোকটা দুঃখী। ভালোবাসা পায়নি।
অন্তরা লোকটার গলা জড়িয়ে কাছে টেনে নিল। সে কোনও প্রতিবাদ জানাল না। চুপচাপ শুয়ে পড়ল অন্তরার বুকে।
“কী চাও তুমি? বলো আমাকে? যা চাইবে সব দিচ্ছি। আমাকে বলো কী দুঃখ? মদ খাবে?”
তবু চুপ করে রইল সে।
অন্তরা হেসে ফেলল। কথাই বলে না পাগল এমন। অন্তরা মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে চলল “মদে অরুচি নাকি তোমার? তো কী খাবে? লজেন্স খাবে?এইখানে লজেন্স আছে। খাবে?”
শ্রোতা তখনও চুপ।
“ওমা আমার সোনা লজেন্সও খাবে না? আম খাবে আম? দুধ দিয়ে মেখে? দুধ খাবে? দুধ…”
চুলে টান পড়ল অন্তরার। চমকে সে তাকিয়ে দেখল লোকটা তার বুক থেকে মাথা তুলে তাকাচ্ছে তার দিকে। এক হাতে শক্ত করে ধরে আছে তার চুল। লোকটার মুখে এখন আর দুঃখী ভাব নেই। হিংস্রতায় থিকথিক করছে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় লোকটা বলে উঠল, “ছোট বুক। একটুও স্নেহ আদর নেই এই বুকে…” এই বলে খিঁমচে ধরল অন্তরাকে। অন্তরার চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসল। মৃত্যু যন্ত্রণা হচ্ছে তার। লোকটা থাবা বসাচ্ছে তার বুকে। গেঁথে দিচ্ছে নখ। ব্লাউজের তলা দিয়ে গড়াচ্ছে রক্ত। বিজলীমাসির গল্পের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে।
ঘাড় ঘুড়িয়ে অন্তরা দেখল খাটের মাথার কাছে একটা খালি মদের বোতল পড়া। হাতের নাগালেই। দ্বিতীয়বার ভাবল না অন্তরা। নিমেষে বোতলটা নিয়ে বসিয়ে দিল লোকটার মাথার উপর। কাঁচের শব্দ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ল।

আজকেও ফিরতে রাত হয়ে গেল অমলের। কপালে দুঃখ আছে তার।
ঘরে ঢুকতে পারল না। পিন্টু ডাকল।
“অমলদা, তোমার মেসো আইচিল। তোমারে খুঁজতে। ইন্দুদিকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।”
অমল হতভম্ব হয়ে গেল। “কী হয়েছে ইন্দুদির?”
মনোজ এগিয়ে এল। মনোজ এই পাড়ার জোয়ান মুরুব্বিদের মধ্যে একজন।
“অমল ইটস আ ক্রিটিকাল কেস। স্যরি টু সে উ নাউ দ্যাট, তোকে এখুনি একবার চিত্তরঞ্জনে ছুটতে হবে। আই ক্যান সি দ্যাট ইউ আর অলসো নট ওয়েল, বাট...”
অমল ফ্যাকাসে মুখে বলল “কী হয়েছে কিছু জানিস তুই?”
মনোজ নিজের গাল দুটোকে হাওয়া টেনে চুপসে নিয়ে বলল, “মোস্ট প্রোবাবলি ক্যানসার। ব্রেইস্টে। তুই ছিলিস না সো আমিই গেছিলাম হসপিটালে অ্যাডমিট করতে মেসোমশাইয়ের সঙ্গে। প্যাথেটিক। লাস্ট স্টেজে পৌঁছে গেছে। অনেকদিন ধরেই লাম্পটা গ্রো করছিল। পেইন ছিল প্রচণ্ড। বলেনি কাউকে। আ বিগ ফুল।এইসব লুকাতে আছে কখনও। এনিওয়ে মাসিমা জানে না কিছু। তুই কিছু একটা বুঝিয়ে চলে যা এখনই। আমার আজ আবার নাইট ডিউটি। নইলে আমি ও যেতাম…”

দরজার নীচের ফাঁকাটা দিয়ে দেখল অমল। মা জেগে আছে। ফরসা পা দুটো দেখা যাচ্ছে। অমলের গালের চাপে পাল্লাটার নড়ে উঠল। দরজা খোলা।
মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল অমল। বসুন্ধরাদেবীর গাল নড়ে উঠল ঈষৎ। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল অমল। চোখ পড়ল মায়ের বুকের দিকে। মায়ের বুকটাও সাধারণ বুকের থেকে একটু বড়র দিকেই।
“কী হয়েছে তোর মাথায়? ফেট্টি কেন?” অনেক কষ্টে বলে উঠলেন বসুন্ধরাদেবী।
মাথার ব্যান্ডেজে হাত রাখল অমল। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।
“আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। ইন্দুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।”
বসুন্ধরা দেবী চোখ বড় বড় করলেন।
“ক্যানসার হয়েছে ইন্দুর, বুঝলে? বুকের ক্যানসার। বাঁচবে না। বাঁচে না কেউ।”
বসুন্দরা দেবী কিছু বললেন না। চোখ দিয়ে বড় বড় জলের ফোঁটা নেমে এল। অমলের হাসি পেল হঠাৎ। খুব জোরে হাসি পেল।
দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াল অমল। মাথায় হাত বুলাল একবার। এগিয়ে গেল একটা সামান্য ছোট পাল্লাওয়ালা দরজার দিকে।
“শোন…”
অমল ঘুরে দাঁড়াল। দেহের সর্বশক্তি দিয়ে গাল নাড়িয়ে বসুন্ধরা দেবী বলে উঠলেন একবার।
“বেশি কাছে যাস না। ছোঁয়াচে নয়তো রোগটা?”
অমল চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ একরাশ হাওয়া অট্টহাসি হেসে দরজাটাকে সশব্দে নাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল…
(গল্পটি নির্মাল্য সেনগুপ্তের সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিতব্য গল্পের বই “ঈশ্বর যখন নাস্তিক” বইটির অন্তর্গত) 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)