সোনালী মিত্র

মায়াজম
0
                      নলজাতক কথা





জীবন যখন নলজাতক


"যৌবনেতে যখন হিয়া/উঠেছিল প্রস্ফুটিয়া/তুই ছিলি সৌরভের মত মিলায়ে/আমার তরুণ অঙ্গে অঙ্গে/জড়িয়ে ছিলি সঙ্গে সঙ্গে/তোর লাবণ্য কোমলতা বিলায়ে।"(জন্মকথা ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)


লাবণ্য সেজে-গুজে দাদার নতুন ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠানে আসার পর থেকেই লক্ষ্য করছে রাঙাপিসিমা,মেজ-খুড়ি,পলাশিপাড়ার রুবিবৌদি সকলেই আড়ালে ফিসফাস করছে আর টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছে।ঠাকুর মশাই পঞ্চগব্য খুঁজে না পেলে লাবণ্য আনতে যেতেই রুমা মাসিমাতো বলেই ফেললেন ,থাক বাপু লাবু তোর আর শুভ কাজে হাত লাগিয়ে কাজ নেই।কার না কার সন্তান পেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার আবার কোন রাখঢাক নেই বাপু।কলি ঘোর কলি।সব উচ্ছন্নে গেছে।" লাবণ্যের মতো আমরাও অবাক হই ,কি দোষ করেছে লাবণ্য যে তাকে এখনো লোক সমাজে এমন নোংরা দোষারোপ শুনতে হচ্ছে!মেয়েটার আট বছরের বিবাহিত জীবনে সন্তানসম্ভবা হওয়ার সৌভাগ্য না হওয়ায় হতাশায় যখন জীবন ডুবে যেতে বসেছিল তখনই প্রতিবেশী সোমা বৌদির সাজেশনে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে সমস্যার সমাধান পেয়েছিল ম্যাজিকের মতই।বিষয়টা আর কিছুই নয় সকলের কম বেশি জানা টেস্ট টিউব বেবি।মধ্যবিত্ত পরিবারে আজকের যুগে দাঁড়িয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া অতিসহজ ছিলনা,কিন্তু ড: এর সাথে সাক্ষাত্কারের পর এবং নেট খোঁজ খবরের পরে চিন্তা যা কিছু ছিল তা দূর হয়ে গিয়েছিল।
বর্তমান আধুনিক শতাব্দীতেও আমরা মনের দিক থেকে যথেষ্ট সংকীর্ণ যে এই টেস্ট টিউব বেবি বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে না জেনেই নাক সিঁটকোনোয় বিশ্বাসী হয়ে উঠি।বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক -

পৌরাণিক যুগ :-ভারতের পৌরাণিক কাহিনীগুলি ঘাঁটাঘাঁটি করলে প্রত্যক্ষভাবে নলজাতকের বিষয়টি না থাকলেও,কোন কোন জন্ম প্রসঙ্গে কিন্তু এই বিষয়ের আভাস পাওয়া গেছে।যেমন,দ্রোণাচার্যের জন্মের কাহিনীর সাথে যে গল্প রয়েছে ,শোন যায় তার জন্ম নাকি একটি কলসীতে হয়েছিল।আবার রাজা ধ্রুপদী এক অসম্ভব শক্তিধর পুত্র সন্তানের কামনায় মুনি-দ্বয়ের শরণাপন্ন হয়েছিলেন,তারা রাজার বীর্য সংগ্রহ করে কিছু গোপন বিশেষ পদ্ধতিতে পরিস্রুত করেন এবং সেই বীর্যকে এক গাভীনীর গর্ভে স্থাপন করেন।কৌরবদের জন্মের ক্ষেত্রেও এই নলজাতক সম্ভাবনা হাল্কা হদিস মেলে।পৌরাণিক কালে ‘ নলজাতক ‘ রা পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান , তা শুধু আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাফল্যজাত সৃষ্টি নয় । কৌরব ও পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য-র জন্মবৃত্তান্ত এই তথ্যকে যথেষ্ট সমর্থন করে । গঙ্গোত্রী প্রদেশে বসবাস করতেন বিখ্যাত ভরদ্বাজ মুনি । একদিন স্বর্গের অপ্সরা ঘৃতাচীকে স্নানরতা অবস্থায় দেখে যৌন উত্তেজনার বশে তার বীর্যপাত হয় ।ঋষি সেই শুক্র কে মাটিতে পড়তে না দিয়ে একটি পাত্রের মধ্যে ধরে রাখেন ।কিছুদিন পর ঐ পাত্র বা দ্রোণি থেকে জন্ম হয় এক পুত্র সন্তানের । দ্রোণি থেকে জাত বলে এর নাম হয় দ্রোণ । দ্রোণের স্ত্রী কৃপীও কিন্তু ছিলেন নলজাতক ।কৃপীর জন্মকথায় জানা যায়, মহর্ষি গৌতমের এক অনুগামী ছিলেন যার নাম শরদ্বান । ঋষি শরদ্বান বেদে তেমন পারদর্শীতা লাভ করতে না পারলেও ধনুর্বেদে তিনি অসম্ভব দক্ষতা লাভ করেন । একবার তিনি ইন্দ্রত্ব লাভের তপস্যায় মগ্ন হন । পাছে ইন্দ্রত্ব হাতছাড়া হয়ে যায় , সেই ভয়ে দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গের অপ্সরা জ্ঞানপদীকে পাঠালেন শরদ্বানের তপস্যা ভঙ্গ করতে । জ্ঞানপদীকে দেখে মোহিত শরদ্বানের হাত থেকে ধনুর্বাণ পড়ে গেল এবং তার বীর্যপাত হয় । সেই বীর্য গিয়ে পড়ল শর-স্তম্ভ বা তূনে , অর্থাৎ যেখানে তীর রাখা হয় । সেখনে পড়ে তা দুভাগ হয় এবং দুটি যমজ সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় । এরাই হলেন যমজ ভাই-বোন কৃপ ( অস্ত্রগুরু কৃপাচার্য ) ও কৃপী ( দ্রোণের পত্নী )।
এই আলোচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে ‘ জন্ম ‘ এবং জন্মসংক্রান্ত আরও জটিল পরীক্ষা নিরীক্ষা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বহু আগে থেকেই ঋকবৈদিক সভ্যতায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল । জন্ম সম্বন্ধীয় সেই সব পর্যালোচনা আধুনিক বিজ্ঞানকেও পেছনে ফেলে দেয় । সগর রাজার ষাট হাজার সন্তানের জন্ম অথবা ধৃতরাষ্ট্র ও গন্ধারীর একশো এক সন্তান ধারণ , অস্ত্রগুরু দ্রোণ ও কৃপাচার্যের জন্ম বৃত্তান্ত বা ভগীরথ ও দৃষ্ঠদ্যুম্ন পৌরাণিক কীর্তিকলাপের বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও মননের সান্নিধ্যে। অথচ এই সব তথ্যকে শুধুমাত্র তথ্য-র খাতিরে উড়িয়ে দেয়া বা উপেক্ষা করা অসম্ভব । অশ্বিনীদ্বয়ের মতন চিকিৎসকের সফল উপস্থিতিও সেখানে প্রাসঙ্গিক ।এদের মতন বিখ্যাত কিংবদন্তীদের জন্মরহস্য – এসবই কোথাও না কোথাও অধুনিক পৃথিবীর অত্যাধুনিক বিজ্ঞানকে নানাবিধ প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায় । অধুনিক বিজ্ঞানের আস্ফালন কোথায় যেন হারিয়ে যায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও প্রসঙ্গ টেনে না এনে স্বল্প কথায় বলা যায় আজ থেকে হাজার বছর পিছনে গিয়েও এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে,তখনকার মানুষেরাও এই বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতেন।

পরিভ্রমণ :-আজ বর্তমান পৃথিবীর প্রতিটি একশ জন দম্পতির মধ্যে পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ,তিরিশজন সন্তানহীনতার ডিপ্রেশনে ভুগছেন।বর্তমানে দুনিয়ার সমস্ত সদ্যজাতের মধ্যে এক শতাংশ আই ভি এফ পদ্ধতির মাধ্যমে জন্মাচ্ছে।বলে রাখ ভাল,বহুদিন আগেই সংখ্যার বিচারে আই ভি এফ পদ্ধতিজাত জাতকের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়েছে।

বিজ্ঞানের গল্প :-স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিক স্টেপটো ও বিজ্ঞানী রবার্ট এডওয়ার্ডস পৃথিবীতে সর্বপ্রথম এই কৌশলের সূচনা ঘটান।১৯৭৮ সালের ২৫ শে জুলাই ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ারের বৃহত্তম ম্যাঞ্চেস্টারের ওল্ডহ্যামে পৃথিবীর প্রথম নলজাতক বা টেস্ট টিউব বেবি লুইস ব্রাউন জন্মগ্রহণ করেন।বলাই বাহুল্য এই সময়ে সুরক্ষা ও নৈতিকতা বিষয়ে প্রচুর বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল।
গর্বের বিষয় ঠিক ওই বছরেরই আড়াই মাস পরে ৩ অক্টোবর আমাদের মহানগরী কলকাতায় আরও একটি নলজাতক জন্ম নেয়।কলকাতার ডাক্তার 'সুভাষ মুখোপাধ্যায়' ভারতে প্রথম এবং সারাবিশ্বে দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি আই ভি পদ্ধতি ব্যবহার করে দুর্গা ওরফে কানুপ্রিয়া আগরওয়াল নামে দ্বিতীয় নলজাতকের জন্ম দানে সক্ষম হয়েছিলেন।অথচ এমনই দুর্ভাগ্যের দেশ আমাদের স্বীকৃতি সন্মানের পরিবর্তে তার ভাগ্যে সামাজিক বয়কট,অবমাননা, ও উপেক্ষা জুটিছিল।এমনকি সমকালীন চিকিৎসকেরা তাকে উত্সাহ দানের পরিবর্তে নিরস্ত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।তৎকালীন রাজ্যসরকারের ভূমিকাও ছিল নীরব দর্শকের মতো।ভারত সরকার তাকে কৃত্রিম প্রজনন সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ থেকে বিরত করে।তার চাকরিজীবনে নানারকম বিড়ম্বনার সৃষ্টি করা হয়।তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল,তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করেছেন এবং পরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য যথাযথ ভাবে লিপিবদ্ধ রাখেননি।ড:মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ আনা হয় এই ধরণের গবেষণা করতে গেলে এথিক্যাল কমিটির অনুমতি নিতে হয় তা তার ছিলনা।শুধু বাঙালি বলেই নয় বিশ্বের যেকোনো দেশেই সাধারণ মানুষ চান না তাদের মধ্যে কেউ তাদের থেকে এগিয়ে যাক।ড:মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও ঠিক একই অবস্থা ঘটেছিল।আসলে এথিক্যাল কমিটি যে তাকে কিছুতেই অনুমতি দিচ্ছিল না সেই প্রসঙ্গটা সম্পূর্ণ আড়ালেই রয়ে গিয়েছিল।বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বেসরকারি গবেষণাগারে তার গবেষণা শুরু করেছিলেন।আশ্চর্যের ব্যাপারও এই যে এই নিয়ে কেউ মুখ পর্যন্ত খোলেননি।লাগাতার অপমান সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ১৯৮১ সালে ড:মুখোপাধ্যায় আত্মহত্যা করেন।

সত্য কোনদিন চাপা থাকেনা।একদিন না একদিন প্রকাশিত হয়।জীবৎকালে সম্মানিত না হলেও মৃত্যুর পরে ড:সুভাষ কিছুটা স্বীকৃতি পেয়েছেন।এই ব্যাপারে ড:টি সি আনন্দ কুমারের নাম উল্লেখযোগ্য ,মূলত তারই প্রচেষ্টায় ড:মুখার্জ্জীর নাম বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে।তবে সুখের খবর এটাই যে বেশকিছু আগে 'ডিকশনারি অফ মেডিক্যাল বায়োগ্রাফি'(সম্পাদনা করেছেন W.F.Bynum এবং Helen Bynum )নামে ১০০ টি ১১০০ জন চিকিৎসা বিজ্ঞানীর জীবনসহ একটি বই প্রকাশিত করেন।সেই বইতে কলকাতাবাসী তিনজন চিকিৎসকের নাম স্থান পায়।তারা হলেন -রোনাল্ড রস ,ইউ এন ব্রহ্মচারী এবং সুভাষ মুখার্জী।পরে তারই বন্ধু ও সহকর্মী ডঃ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী ১৯ শে নভেম্বর , ১৯৮৬ তে কলকাতায় ভারতের প্রথম টেস্ট-টিউব পুত্র সন্তানের জন্ম দেন । যদিও তার আগেই ৬ই অগস্ট , ১৯৮৬ তে মুম্বাই - এর কিং এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল হসপিটাল (King Edward Memorial Hospital) – এ
বিকেল ৩ টে ৪৫ মিঃ এ ভারতের প্রথম ‘ স্বীকৃত ‘ টেস্ট-টিউব বেবি (কন্যা সন্তান) জন্ম নেয়


আই এফ ভি ( ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন ) বা নলজাতক (test tube baby)আজকের যুগে একটি অত্যন্ত পরিচিত শব্দবন্ধ।সম্ভবত প্রতিটি বন্ধ্যা দম্পতির কাছে যেন অনিবার্য শব্দ।সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুসংস্কারের প্রভাবে আমাদের দেশের বহু দম্পতি এই চিকিৎসাটি থেকে বিরত থাকেন।


স্বাভাবিক নিষিক্ত-করণ ঘটানো: - আলোচনাটি সাধারণ গ্রাহ্য হওয়ার সুবিধের জন্য স্বাভাবিক নিষিক্ত-করণ পদ্ধতি ঠিক কি বলে নিলে সুবিধা হবে।আমরা জীবনবিজ্ঞানে বইয়ে পড়েছি নারী শরীরের জরায়ুর দুইপাশে আয়তকার,চ্যাপ্টা ও নালিবিহীন দুটি অঙ্গ রয়েছে।একে ডিম্বাশয় (ovary)বলে।এই ডিম্বাশয়ের কর্টিক্যাল অংশে অসংখ্য থলের(follicle) মধ্যে ডিম্বাণু (ovum) থাকে।জন্মের সময়ে প্রতিটি নারীর এক একটি ডিম্বাশয়ে প্রায় দশলক্ষ পরিমাণ ডিম্বাণু থাকে।একটি নির্দিষ্ট বয়েসের পর থেকে ডিম্বাণু দুটির যে কোন একটি থেকে প্রতিমাসে সাধারণত একটি করে ডিম্বাণু নি:সৃত হয়ে ডিম্বনালিতে(Fallopian tube)এ চলে আসে।প্রথম ঋতুচক্রে (first menustrual cycle )থেকে রজ:নিবৃত্তি(menopause )অবধি মোটামুটি চল্লিশ বছরে সর্বাধিক পাঁচশো ডিম্বাণু এইভাবে নি:সৃত হয়।শারীরিক মিলনের পর ডিম্বনালিতে অবস্থানকারী ডিম্বাণুর সাথে পুরুষের শুক্রাণু মিলিত হয়।মিলিত বা নিষিক্ত হওয়ার পর সৃষ্টি হয় ভ্রূণ(embryo ) আর তা জরায়ুতে (uterus ) গিয়ে বাসা বাঁধে।এই প্রসঙ্গে বলা যায়,কোন মহিলার বয়স পঁচিশ মানে তার ডিম্বাণুর বয়সও পঁচিশ,কারণ নারী তার ডিম্বাশয় সাথে নিয়েই জন্মায়।তাই সন্তানধারণে অযথা দেরী মানে বেশি বয়সের ডিম্বাণুর নিষিক্তকরণ।

স্বাভাবিক নিষিক্ত না হলে!:-সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর প্রতি তিনটি দম্পতির মধ্যে মাত্র একটি দম্পতির প্রতিমাসে গর্ভাধান হতে পারে।অর্থাৎ ইচ্ছে করলেও কোন দম্পতি প্রতিমাসে সন্তানধারণ করতে পারবেননা।এক্ষেত্রে সমান্তরাল ভাবে যে বিষয়টি উঠে আসে তাহলো বায়স বৃদ্ধির সাথেসাথে নারীর প্রজনন ক্ষমতাও কমতে থাকে।স্বাভাবিক নিষিক্ত না ঘটলে বন্ধ্যত্ব হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে।বন্ধ্যত্বের সংজ্ঞায় বলা হয়,বিয়ের একবছরের মধ্যে অসুরক্ষিত যৌনজীবন যাপন করেও সুস্থ স্বাভাবিক দম্পতি যদি গর্ভধারণ না করতে পারেন তাকে বন্ধ্যত্ব বলা হয়।স্ত্রী বয়স পঁয়ত্রিশ হলে কিন্তু সময়টাও হাফ মানে একবছরের জায়গায় ওটা ছয়মাস হয়ে যাবে।এই ব্যাখ্যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (world Helth Organization )এর্।


অস্বাভাবিকতার কারণ?:-পৌরাণিক যুগ থেকে বর্তমানে হেঁটে আধুনিকতা পেলেও এখনো পর্যন্ত বন্ধ্যত্বের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নারীকেই দায়ী করা হয়ে থাকে।এক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা কতখানি অবশ্যই জেনে রাখা দরকার।শুক্রাণু -ডিম্বাণুর মিলন ছাড়া একটি প্রাণ তৈরি হতে পারেনা।অর্থাৎ পুরুষের শুক্রাণুর সমস্যা থাকলেও কিন্তু গর্ভধারণ সম্ভব নয়।এছাড়ার নারীর নানা রকম সমস্যা থাকতে পারে সেই আলোচনায় বিস্তারিত না গিয়ে সোজাসুজি আই ভই এপথ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নেওয়া যাক।

আই ভি এফ পদ্ধতি:- ভিক্টরও কথাটির অর্থ শরীরের বাইরে।এই পদ্ধতি যেহেতু শরীরের বাইরে জীবন সৃষ্টি করা হচ্ছে তাই এটি ইন -ভিক্টরও -ফার্টিলাইজেশন বলা হয়। যার প্রচলিত নাম টেস্ট টিউব বেবি।সামগ্রিকভাবে এই গোটা বিষয়টিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ইন -ভিক্ট্রো ফার্টিলাইজেশন এমব্রায়ো টান্সফার (IVF ET)
এই পদ্ধতিতে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং একজন বৈজ্ঞানিক যৌথভাবে কাজ করেন।প্রথম পদক্ষেপ হল -

ফলিকিউলার স্টাডি -সাধারণ ভাবে যা ডিম্বাণু তৈরি হয় তার থেকে বেশী পরিমাণে ওষুধের দ্বারা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মায়ের শরীরে প্রথমে ডিম্বাণু তৈরি করেন।এরপর খুব সতর্কভাবে ডিম্বাণুগুলির ক্রমিক বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করা হয়।ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণে সিদ্ধান্তে আসা যায় ঠিক কোনদিন ওই ডিম্বাণু শরীরের বাইরে আনা যায়।

ডিম্বাণু সংগ্রহ:-ফলিকিউলার স্টাডির সাহায্যে ডিম্বাণুর প্রস্তুতি সম্পর্কে সবুজ সংকেত মিলতেই একটি ইনজেকশন (HCG /Human Chorionic Gonadotropin) প্রয়োগ করা হয় ,এবং এর সাহায্যে যে কক্ষে ডিম্বাণু তৈরি হচ্ছে সেই কক্ষটিকে ফাটিয়ে ফেলা হয় যাতে ডিম্বাণুকে সহজেই বাইরে আনা যেতে পারে।HCG ইনজেকশন প্রয়োগের পরে ঠিক বত্রিশ থেকে ছত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে মা কে ঘুম পাড়িয়ে তার প্রসবের পথ দিয়ে আলট্রাসনোগ্রাফির সাহায্য নিয়ে ডিম্বাণুকে বাইরে বের করে আনা হয়।এবারে এই ডিম্বাণুগুলিকে খুব সন্তর্পণে গবেষণাগারে রেখে দেওয়া হয়।


শুক্রাণু সংগ্রহ :-যেদিন ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয় সেই দিনই মহিলার স্বামীর থেকে বীর্য সংগ্রহ করা হয়।তার হস্তমৈথুনের মাধ্যমে সংগ্রহ বীর্যের মধ্যে থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষার মাধ্যমে কিছু বাছাই করা সুস্থ শুক্রাণু সংগ্রহ করে রাখা হয়।


ভ্রূণ প্রস্তুতি: - এবারে একজন বৈজ্ঞানিক কাজে নামেন।সংগ্রহ করা ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুকে ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে দেখে কিছু ভাল ডিম ও সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর কিছু শুক্রাণুকে শরীরের বাইরে গবেষণাগারে নিষিক্ত ঘটানো হয়।ঠিক চব্বিশ থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় ভ্রূণ।নিষিক্তকরণের সময় শরীরের অভ্যন্তরে যে ধরণের তাপমাত্রা এবং তরলের উপস্থিতি দরকার সেই রকম একটি আদর্শ পরিবেশ গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত করা হয়।

ভ্রূণ স্থাপন :-আট চল্লিশ থেকে বাহাত্তর ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই বোঝা যায় কোন ভ্রূণগুলোর কোষ বিভাজিত অর্থাৎ কারা নিষিক্ত হয়েছে।এরপর দুটি বা তিনটি ভ্রূণকে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মায়ের জরায়ুতে স্থাপন করে দেন।ভ্রূণ স্থাপনের এই পদ্ধতিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়ে থাকে (embryo transfer )

প্রতিস্থাপনের পরে: - জরায়ুতে ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের পরে এমন কিছু ওষুধ দেওয়া হয় যাতে জরায়ু ভ্রূণটি ধরে রাখতে সক্ষম হয়।এক্ষেত্রে ৩০%-৪০% দেখে যায় কাঙ্খিত গর্ভধারণ ঘটিয়ে থাকে।মনে রাখতে হবে বাকিদের কিন্তু গর্ভধারণ ঘটেনা।যাদের ঠিকঠাক ভ্রূণ স্থাপিত হল তাদের ক্ষেত্রে কখনো দুটো বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনটেই ঠিকমতো স্থাপিত হয়ে যায়,তখন শেষ পর্যন্ত একটি বা দুটি ভ্রূণকে বড় হতে দেওয়া হয়।বর্তমান যুগে যমজ বাচ্চা মানুষ করা গেলেও তিনটি বাচ্চা মানুষ করা বেশ কষ্টসাধ্য বিষয় এই ধারণাটাকেই মাথায় রেখে।

আইভিএফ পদ্ধতির প্রকারভেদের বিষদ আলোচনায় যাওয়ার আগে এটিকে ঘিরে কুসংস্কারের বিষয়ে একটু জেনে নেওয়া যাক।চিকিৎসকেরা মনে করেন আজ ২১শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে যতখানি সফলতা পাওয়া উচিৎ ছিল এই পদ্ধতির ততখানি জনপ্রিয়তা না পাওয়ার মূলে রয়েছে একে ঘিরে প্রচলিত কিছু কুসংস্কার।নলজাতকে ঘিরে এই কুসংস্কারগুলি ভাঙা দরকার নাহলে নি:সন্তান দম্পতি কিছুতেই এগিয়ে আসতে পারবেন না।

১নং কুসংস্কার :-কিছু চিকিৎসকেরই নেতিবাচক ভূমিকার অনেকখানি অবদান জনমানসে এই কুসংস্কার তৈরি করার ক্ষেত্রে।কিছু চিকিৎসক বিষয়টি সম্পর্কে ভয় ধরিয়ে দেন রোগিণীকে।রোগিণীর পরিবারের সামনে এমন একটি ছবি পেশ করেন যাতে অনেকবেশী খরচ ,খুব কঠিন একটি অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাত্রা এবং সাফল্যের হার খুব কম।
২নং কুসংস্কার :-অনেকের ধারণা এই পদ্ধতিতে গর্ভধারণের পর স্বাভাবিক জীবনযাপনে প্রচণ্ড বিঘ্ন ঘটে।এই পদ্ধতি চিকিৎসার ফলে নয়মাস বাধ্যতামূলক ভাবেই বিছানায় শুয়ে কাটাতে হয় ,এক্ষেত্রে চিকিৎসকরা বলে থাকেন যেকোনো মহিলার পক্ষেই এতদিন শুয়ে থাকা সম্ভব নয়।অনেকেই চাকরিজীবী মহিলা।চিকিৎসকদের মতে এই পদ্ধতিতে যে মুহূর্তে গর্ভধারণ হয়ে গেল তখন স্বাভাবিক গর্ভবতী এবং আই ভি এফ গর্ভবতীর কোন বিশেষ পার্থক্য থাকেনা।নয়মাস বিশ্রাম নিলে গর্ভধারণ অক্ষত থাকবে আর কাজকর্ম করলে সেটি থাকবেনা এই ধারণা ভ্রান্ত।চিকিৎসকদের মতে,গর্ভধারণ বিষয়টি এতই সহজ বিষয় নয় যে,হাঁটাচলা করলেই পেটের সন্তান ঝুপ করে খসে যাবে।গোটা ব্যাপারটা একটা জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।ভ্রূণের গা খুবই আঠালো বা চটচটে হয় বলে সেটি যদি গাঁথার হয় জরায়ুর দেয়ালে আটকে যায়।দিন পনেরো পরে পরীক্ষা করলেই জানা ভ্রূণটি গেঁথে গেলো কিনা।গেঁথে যাওয়া মানেই গর্ভধারণ।এক্ষেত্রে একটা কথা বলে রাখা উচিৎ ,ভ্রূণ স্থাপনের পর ঘণ্টা কয়েক ডাক্তারের চেম্বারেই বিশ্রাম করেই রোগিণী বাড়ি গিয়ে স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারেন।বিছানায় শুয়ে কাটাবার দরকার নেই শুধু খেয়াল রাখতে হবে ঝাঁকুনি জাতীয় ধাক্কা যেন না লাগে।বিশেষত এই সময় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।অবশ্য আজকাল বিদেশে গবেষকরা বলছেন,স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হলেও গর্ভের কোন ক্ষতি বা সমস্যা হয়না।

৩ নং কুসংস্কার :-বহুমানুষের ধারণা আই ভি এফ পদ্ধতি প্রচন্ড কষ্টদায়ক কারণ এটি অজ্ঞান না করে জাগ্রত অবস্থায় করা হয়।প্রকৃত তথ্য হল,শরীর থেকে যখন ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয় তখন কাটাছেঁড়ার দরকার হয়না বলে মাকে অজ্ঞান করার দরকারই পড়েনা।এই সময় মহিলাকে সাময়িকভাবে ঘুম পাড়িয়ে প্রসবের পথ দিয়ে ডিম্বাণু বের করে আনা হয় এমনভাবে যে মহিলা জানতেও পারেননা।জরায়ুতে ভ্রূণটি স্থাপনের সময় নরম ক্যাথিডারের সাহায্যে এমন ভাবে কাজটি সম্পন্ন করা হয় যে এই সময় অজ্ঞান তো দূরের কথা ঘুমও পড়াবার দরকার পড়েনা,কারণ কোন ব্যথাই মা অনুভব করেননা।

৪নং কুসংস্কার :-এটি একটি বিশেষ ধারণাও বটে ,জনসমাজে অসংখ্য মানুষ এক অদ্ভুত ভাবনায় আছেন যে টেস্ট টিউবের বেবিরা সাধারণ সুস্থ সন্তান হতে পারেনা।মানুষ মনে করেন,শরীরের বাইরে গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে ভ্রূণ তৈরি করা হয় যেহেতু সেহেতু সেটি অস্বাভাবিক হতে বাধ্য।অস্বাভাবিক সন্তান কেউ চান না, তার থেকে মনে করেন নি:সন্তান থাকা অনেক বেশি ভাল।কিন্তু এই ভাবনার গোঁড়ায় গলদ রয়েছে। চিকিৎসকেরা বলে থাকেন,গবেষণাগারে তৈরি ভ্রূণ একবিন্দুও অস্বাভাবিক হয়না।সুস্থ ও স্বাভাবিক আর পাঁচটা বাচ্চার মতই হয়ে থাকে বরং দেখতে গেলে এদের বংশগত কিছু রোগ না থাকার সম্ভাবনা থাকে প্রবল।

৫নং কুসংস্কার :-বহু সংখ্যক মানুষের ধারণা এই পদ্ধতিতে সন্তান জন্মালে নবজাতককে বহুদিন কাঁচের ঘরে তুলোর মধ্যে রাখতে হয় এবং বিশেষ ট্রিটমেন্ট বা যত্নের প্রয়োজন পরে।যে সব দম্পতি চাকরি করেন তারা এই পদ্ধতি অবলম্বন থেকে পিছিয়ে আসেন কারণ তাদের হাতে এত সময় নেই,শিশুর ওই রকমভাবে যত্ন করতে পারেন।চিকিৎসকদের মতে,একেবারে স্বাভাবিক ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশু যেভাবে মানুষ করে তোলা হয় ঠিক একইভাবে আই ভি এফ বেবিকেও বড় করে তুলতে হয়।একবিন্দুও বিশেষ ধরণের দেখাশোনার প্রয়োজন হয়না।

৬নং কুসংস্কার :-অধিকাংশ দম্পতি মনে করেন সব চিকিৎসার শেষ চিকিৎসা হল এই আই ভি এফ পদ্ধতি অবলম্বন করা।তারা ডাক্তার বাবুদের প্রায়শই বলে থাকেন,না না ডাক্তারবাবু আগে অন্য চিকিৎসা করে দেখুন,আই ভি এফ নিয়ে পরে ভাবা যাবে কারণ ওটাই তো সর্বশেষ চেষ্টা।এই ক্ষেত্রে একটি গল্প বলা যায়,একজন খুব পাহাড় ঘুরতে ভালবাসেন কিন্তু তার আর্থিক সামর্থ্য নেই সেভাবে।এরপর তিনি স্থির করলেন অল্প অল্প করে সঞ্চয় করে যথেষ্ট পরিমাণ জমলে তিনি পাহাড়ে ঘুরতে যাবেন।তিনি সঞ্চয় করে চলতে থাকলেন,তার ৬৫ বছর বয়সে যথেষ্ট টাকার মালিক হয়ে পাহাড়ে চড়তে চাইলেন।তার আর্থিক সামর্থ্য থাকলেও শরীরের অসমর্থতা তাকে যেতে দিলনা।বন্ধ্যত্বের চিকিৎসাটিও ঠিক এই রকমই বলে থাকেন চিকিৎসকগণ।


বিশেষ মনে রাখার বিষয়:নারীর বয়স: -আই ভি এফ পদ্ধতিতে বিশেষ মনে রাখার বিষয় হল চিকিৎসার নারীর বয়স।সবচেয়ে ভাল সময় হল,মায়ের বয়স যেন ২৯ বছরের মধ্যে চিকিৎসা যেন সীমাবদ্ধ হয়।কারণ হিসাবে ডাক্তারবাবুরা বলছেন,নারীর সন্তানধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল সময় হল কুড়ি থেকে পঁয়ত্রিশ।এই সময়টিতেই চিকিৎসা করানো বুদ্ধিমানের কাজ।আই ভি এফ এ পঁয়ত্রিশ বছরে সাফল্যের হার যতটা এই বয়সের ঊর্ধ্বে হয়ে গেলে সাফল্যের হার অনেকখানি কম হয়ে যায়।এই চিকিৎসা পদ্ধতিটি শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে না দেখে ডাক্তারেরা বলেন একে সাধারণ পদ্ধতি হিসাবে দেখাই শ্রেয়।প্রথম কিছুদিন যদি সাধারণ চিকিৎসায় গর্ভধারণ না হয় তবে সময় না করে এই চিকিৎসা করিয়ে দেখা ভাল।সারা পৃথিবীতে চিকিৎসক এবং গবেষকরা বলছেন,যত কম বয়সে আই ভি এফ করানো হবে সাফল্যের হার তত বেশি হবে।কারণ বয়স যত বাড়বে নারী ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতা ও উৎকৃষ্ট ডিম্বাণু সৃষ্টির মাত্রাও কমতে থাকবে।তাই বয়স ও গর্ভধারণের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ২৫ বছর বয়সী মহিলার সাফল্যের হার যেমন ৮০%-৯০% আবার ৩০ বছর বয়সে সেটা কমে ৬০%-৭০% হয়ে যায়।৩৫ শে আরও কম মানে ৪০%-৫০% চলে যাবে আর ৪০ বছরের মহিলার ক্ষেত্রে সেই সাফল্যের হার কমে ৬%-১০% এ এসে দাঁড়াবে।

আই ভি এফ পদ্ধতির প্রকারভেদ :- স্বাভাবিক আই ভি এফ পদ্ধতি সম্পর্কে শুরুতেই আলোচনা করা হয়েছে।এছাড়াও ৬ টি উপায় রয়েছে।প্রত্যেকটির সাফল্যের হার যথেষ্ট ভাল।
ICSI (Intra cytoplasmic Sperm Injection )
পুরুষ বন্ধ্যত্ব ও ব্যাখাহীন বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় আই ভি এফ কে একটি সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি বলে মনে করা হয়।১৯৯২সালে আবিষ্কৃত ICSI এর অগ্রগতিকে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।অতি বেশি মাত্রায় পুরুষ বন্ধ্যাত্বে আক্রান্ত কোন ব্যক্তি এর দ্বারা পিতৃত্বের স্বাদ আস্বাদন করতে পারেন।
পদ্ধতির সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করার আগে জেনে নেওয়া প্রয়োজন গর্ভধারণের ক্ষেত্রে শুক্রাণুর ভূমিকা কি!

স্বাভাবিক গর্ভধারণে শুক্রাণুর ভূমিকা: -সাধারণ গর্ভধারণের সময় পুরুষ শরীর থেকে নির্গত হওয়া বীর্যের লক্ষাধিক শুক্রাণুর মধ্যে মাত্র হাজার দশেক ডিম্বাণুর পাশে এসে জমা হয়।এই সময় শুক্রাণুর মাথায় থাকা উৎসেচক ডিম্বাণুর বাইরের খোসাটি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ভাঙনের কাজটি চালায়।এই ভাঙার খেলা খেলতে গিয়ে কয়েক হাজার শুক্রাণুর মৃত্যু ঘটে।পড়ে থাকে মাত্র কয়েকশত শুক্রাণু এরাই ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছতে পারে।কিন্তু বিজয়মাল্য অপেক্ষা করে একটি মাত্র শুক্রাণুর জন্যেই অর্থাৎ একটিমাত্র শুক্রাণুর প্রবেশাধিকার মেলে ডিম্বাণুর অন্দরমহলে।তাই পুরুষের শুক্রাণু সংখ্যায় কম হলে স্বাভাবিক গর্ভধারণ সম্ভব নয়।

কেন নয়?-অনেক পুরুষের শুক্রাণুর পরিমাণ এত কম হয় যে ওই সংখ্যক শুক্রাণুর দ্বারা গর্ভধারণ সম্ভবই নয়।এমন কি ডাক্তারদের মতে আই ভি এফের কৃত্রিম পদ্ধতি প্রয়োগ করে গবেষণাগারে ভ্রূণ তৈরি করতে গেলেও সফলতা আসেনা।কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুকে পাশাপাশি রাখার পরেও দেখা যায় শুক্রাণুগুলি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে অসামর্থ্য হচ্ছে।আসলে গবেষণায় দেখা গেছে সংখ্যায় কম পরিমাণ হলেই নয়,শুক্রাণু যদি ঠিকমতো নড়াচড়া না করতে পারে সেক্ষেত্রেও গর্ভধারণ হয়না।শুক্রাণু হল শরীরের একমাত্র কোষ যারা লেজের সাহায্যের নড়াচড়া করতে পারে।অণ্ডকোষে অবস্থানের কালে শুক্রাণুর এই সক্রিয়তা থাকেনা ,কারণ এই সময় এদের লেজ নড়াচড়া করেনা। অণ্ডকোষ থেকে বেরিয়ে আসার পর এদের নড়াচড়া করার ক্ষমতা সৃষ্টি হয়।শুক্রাণুর মধ্যে ক্ষমতা না থাকলে ডিম্বাণু ডিম্বাণুর মত আর শুক্রাণু শুক্রাণুর মত পড়ে থাকে ,নিষেক ঘটেনা।এক্ষেত্রে ICSI পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো হয়।

প্রয়োগ :-ICSI পদ্ধতিটি হল একটি শুক্রাণুর গতিপথকে ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে নিষেকের উদ্দেশ্যে ডিম্বাণুর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া।শুক্রাণু সংগ্রহের সময় Pesa কিম্বা Tesa পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়।এই ICSI পদ্ধতির প্রথম-পর্ব সাধারণ আই ভি এফের মতোই।মহিলার ডিম্বাণু বের করে এনে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে তাদের বড় বড় লেবুর আকারে দেখায়।এরপর গবেষণাগারে বিশেষ ইনজেকশনের মাধ্যমে মাত্র একটি শুক্রাণুকে ডিম্বাণুর মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয়।

আবিষ্কারের গল্প: - ICSI এই পদ্ধতির প্রথম ব্যবহার শুরু হয়েছিল বেলজিয়ামে।অবশ্য এই পদ্ধতি আবিষ্কারের পিছনেও একটি মজার গল্প রয়েছে।ICSI পদ্ধতির প্রথমদিকে শুক্রাণুকে ডিম্বাণুর ভিতরে ইঞ্জেক্ট করা হত না ,মনে করা হত এতে ডিমটি বিকৃত হয়ে যাবে এবং সন্তান আসবেনা।তাই সে সময় ডিমর খোসায় খালি ফুটো করে দেওয়া হত যাতে শুক্রাণু সাঁতার কেটে নিজেই অন্দরে প্রবেশ করতে পারে এবং ভিতরে গিয়ে বাসা বাধতে পারে।তখনকার এই পদ্ধতির নাম ছিল ,"জোনা ড্রিলিং",ডিম্বাণুর বহিরাবরণ বা খোসাকে জোনা বলা হয়।এই রকমই এক ICSI গবেষণাগারে একদিন এক কনিষ্ঠ এমব্রায়োলজিস্ট তার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ড্রিলিংএর কাজ করছিলেন।ভুল করে হঠাৎ ডিম্বাণুর খোসায় ফুটো করার বদলে ডিম্বাণুর ভিতরে ফুটো করে ফেলেন।দুর্ঘটনার জন্য তিনি নিজে মোটেই প্রস্তুত ছিলেননা ,স্বাভাবিকভাবেই দারুণ ভয় পেয়ে যান।বসের কাছে বকুনি খাবার ভয়ে তিনি ডিম্বাণুটি আলাদা করে রেখে দেন যাতে বসের চোখে না পড়ে।পরদিন এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন তিনি।যেসকল ডিম্বাণুতে ড্রিলিং করা হয়েছিল তার একটাতেও নিষিক্ত হয়নি বরং যেটি ভুলবশত ফুটো হয়েছিল সেটিতেই নিষেক ঘটেছে।ঘটনার আকস্মিকতায় উত্তেজিত হয়ে তিনি বসকে খবরটা দেন এবং অতি দ্রুত ভ্রূণটি জরায়ুতে স্থাপন করেন।কিছুদিন বাদে কাঙ্খিত ফল ফলে।দেখা যায় গর্ভধারণ হয়েছে।এর সঙ্গে সঙ্গে দুর্ঘটনার ফলে আবিষ্কারের তালিকায় ICSI পদ্ধতির নামটি জুড়ে যায়।

সাফল্যের হার- কোন পুরুষের মাত্র একটি শুক্রাণু থাকলেও এই পদ্ধতির প্রয়োগে গর্ভধারণ করানো সম্ভব।
PESA (Percutenous Epididymal Sperm Aspiration)অথবা TESA (Testicular Sperm Aspiration) শল্যচিকিৎসায় অনেকে এদেরকে 'সার্জিক্যাল স্প্যাম রিট্রিভাল' বলে।কথাটির অর্থ হল অস্ত্রোপচারের সাহায্যে শুক্রাণু সংগ্রহ।
কিছু কিছু পুরুষের ক্ষেত্রে অণ্ডকোষে পর্যন্ত পরিমাণ শুক্রাণু থাকা সত্ত্বেও তা শরীর থেকে নি:সৃত হতে পারেনা।কারণ এই পুরুষের ক্ষেত্রে যে নলবাহিত হয়ে অণ্ডকোষ থেকে শুক্রাণু বেরিয়ে আসার কথা সেটিতে জন্মগত প্রতিবন্ধকতা থাকে নয়ত কোন সংক্রমণের ফলে সেটি বন্ধ হয়ে যায়।আবার এমন হতে পারে হার্নিয়া বা হাইড্রোসিল অস্ত্রোপচারের ফলে ওই নালিটি কাটা পড়তে পারে অথবা যাদের মেরুদণ্ডে চোট লেগেছে তাদের ক্ষেত্রে তো বীর্য স্খলন তো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।সে কারণে শুক্রাণুর অভাবে স্বাভাবিক গর্ভধারণ হতে পারেনা।
এর সমাধান খুবই সহজ বলছেন ডাক্তারেরা।এই পদ্ধতিতে পুরুষটিকে অজ্ঞান করে ছুঁচ ফুটিয়ে অণ্ডকোষ থেকে প্রয়োজনীয় শুক্রাণু বের করে আনা হয়।এই পদ্ধতিকে বলা হয় PESA /TESA .এই শুক্রাণুদের সাথে আই ভি এফ পদ্ধতির মাধ্যমে ডিম্বাণুর সাথে নিষিক্ত ঘটানো হয়।
এই TESA. আবিষ্কারের আগে যেসব মানুষের স্খলিত বীর্যে খুব কম পরিমাণ শুক্রাণু থাকত বা একেবারেই থাকতনা তাদের অণ্ডকোষ থেকে শুক্রাণু বের করার জন্য বেশ বড়সড় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হত।সেরে উঠতেও যেমন সময় লাগতো তেমনি বিষয়টি ছিল বেশ খরচ-সাপেক্ষ।তুলনামূলক-ভাবে আজকের প্রচলিত Tesa পদ্ধতি খুবই দ্রুত এবং কম খরচের পদ্ধতি হিসাবে গণ্য করা যায়।
এমব্রায়ো হ্যাচিং
পাখির ডিম চারিদিকে থাকা খোলা ভেঙে যখন বাচ্চা বেরিয়ে এসে পৃথিবীর আলো দেখে তখন তাকে হ্যাচিং বলা হয়।এই রকম ভ্রূণের চারিদিকে থাকা খোলা ভেঙে বেরিয়ে আসে তাকে এমব্রায়ো হ্যাচিং বলা হয়।এই বেরিয়ে আসা ভ্রূণকে জরায়ুতে স্থাপন করে দেওয়া হয়।এটি কিন্তু শরীরের প্রক্রিয়া।
কিন্তু অনেক মহিলা আছেন যাদের ভ্রূণ খোসা ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেনা।এদের ভ্রূণের খোসা এতটাই মোটা হয় যে ভ্রূণের পক্ষে সেটি ভেঙে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়না।
এক্ষেত্রে খোসা ভেঙে দিতে পারলেই সমস্যা মিটে যায়।এই খোসা ভেঙার কাজটি কৃত্রিমভাবে সারতে হয় ,রাসায়নিক বা যান্ত্রিক পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়।একবার ভ্রূণটি ভেঙে বাইরে আনতে পারলেই সহজেই সেটি জরায়ুতে স্থাপিত হয়ে যায়।তখন গর্ভধারণের কোন সমস্যাই থাকেনা।
প্রি -ইমপ্লান্টেশন জেনেটিক ডায়াগনোসিস
এই ব্যবস্থায় জরায়ুতে ভ্রূণ স্থাপনের আগে ভ্রূণের মধ্যেকার কিছু বংশগত রোগ নির্ধারণ করে প্রথমে তার আরোগ্যের ব্যবস্থা করা হয়।এর ফলে জন্মের পর শিশুর সেই রোগটি হবার সম্ভাবনা থাকেনা।
অনেক পরিবারেই কিছু বংশগত অসুস্থতা থেকে থাকে।যেমন থ্যালাসেমিয়া বা সিস্টিক ফাইব্রোসিস ইত্যাদি।এছাড়াও কিছু ছেলেদের অসুখ বা মেয়েদের অসুখ থাকে ,বংশগত হলে এই রোগগুলো এমনিই শরীরের মধ্যে ঢুকে যায়।অনেক ক্ষেত্রে সন্তান জন্মানোর পরে বা গর্ভাবস্থায় থাকার সময় রোগটির সন্ধান পাওয়া তখন গর্ভপাত করানো ছাড়া আর উপায় থাকেনা।প্রি -ইমপ্লান্টেশন জিনেটিক ডায়াগনোসিস পদ্ধতির সাহায্যে এই ধরনের সমস্যার থেকে সমাধান পাওয়া সম্ভব।
কি করা হয়?-জরায়ুতে স্থাপনের আগে গবেষণাগারে বায়োপ্সি করে বুঝে নেওয়া সম্ভব ভ্রূণটির মধ্যে এই ধরনের কোন অস্বাভাবিক রোগ রয়েছে কিনা।জেনেটিক প্রোবের সাহায্যে এই ক্রুটিগুলি ধরা হয়।যদি দেখা যায় এই রোগগুলো রয়েছে তবে ভ্রূণটিকে স্থাপন করা হয়না।এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার বলা যায়।বিশেষ করে সেই সব পরিবারের ক্ষেত্রে যেখানে আগে জন্মানো সন্তানের ক্ষেত্রে কারও কারও জন্মগত অসঙ্গতি দেখা গেছে।

ভ্রূণের ক্ষতি না করেই -অনেকের মনে হতেই পারে সদ্য জন্মানো ভ্রূণ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলে ভবিষ্যৎ সন্তানের অন্য ধরনের খুতের আশঙ্কা থাকতে পারে।তাদের আশ্বস্ত করার জন্য ডাক্তারেরা বলে থাকেন,সেরকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই।প্রতিটি ভ্রূণের মধ্যে পরবর্তী কালের প্লাসেন্টা তৈরি করবার প্রয়োজনীয় কিছু কোষ থাকে।এই কোষগুলি থেকে পরীক্ষার প্রয়োজনে কিছু কোষ নিলেও কোন সমস্যা হয়না।তাই বংশগত রোগ নির্ধারণের জন্য ভ্রূণ থেকেই কিছু কোষ নেওয়া হয় পরীক্ষার কারণে।
সুবিধা :- বেশ কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায় গর্ভপাত নিষিদ্ধ।যেমন -ইহুদি,মুসলিম,রোমান ক্যাথলিকদের মধ্যে।এইসব সম্প্রদায় এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে অযথা ক্রটিপূর্ণ সন্তানের জন্ম দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনা।গর্ভপাতেরও প্রশ্ন ওঠেনা।কারণ ক্রটিপূর্ণ ভ্রূণকে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছেনা বলে কোনও জীবনহানিও ঘটছেনা।এছাড়াও আরও কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যেখানে গর্ভপাত না করেই এই পদ্ধতির সাহায্যে সতর্ক হবার সুযোগ থাকে।যেমন -থ্যালাসেমিয়া বাহক,একজন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত ও একজন স্বাভাবিক হয়।প্রি -ইমপ্লান্টেশন জেনেটিক ডায়াগনোসিসের মাধ্যমে এইরকম ক্ষেত্রে শুধু স্বাভাবিক ও সুস্থ সন্তান স্থাপন করা সম্ভব।তা হলে অন্য একটি সন্তানকেও এই কালান্তক রোগের বাহক হয়ে জন্মাতে হয়না।একইভাবে যেখানে কোন স্ত্রীভ্রূণ শুধু স্ত্রী -অসুখে আক্রান্ত সেখানে শুধু পুরুষ ভ্রূণ স্থাপন বা যেখানে পুরুষ ভ্রূণ শুধু পুরুষ রোগে আক্রান্ত সেখানে স্ত্রীভ্রূণ স্থাপন করে সম্ভব্য বিপদ এড়ানো যায়।তবে ভারতবর্ষের মত দেশে এই পরিকল্পনায় গর্ভধারণ করাতে গেলেও বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।অধিকাংশ দম্পতি দাবী জানান পুরুষ ভ্রূণ স্থাপনের।তবে যে বিষয়টি বিশেষভাবে জানিয়ে রাখা উচিৎ সেটি হল,বিদেশ বা যেখানে যেখানে এই ধরনের কাজ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে,প্রতি স্থানেই ইচ্ছেমত ভ্রূণ স্থাপন করা বেআইনি।একমাত্র লিঙ্গের জন্মগত ক্রটির কারণেই লিঙ্গভিত্তিক স্থাপনের অধিকার দেওয়া হয়।
ডিম্বাণু দান এবং ভ্রূণদান
অনেক মহিলা আছেন যাদের শরীরে ডিম্বাণু তৈরি হয়না। আবার অনেকের খুব অল্পবয়সে ঋতু বন্ধ হয়ে গেছে বা অস্ত্রোপচারের সময়ে ডিম্বাশয় কেটে বাদ দিতে হয়েছে,এদের শরীরে গর্ভধারণের মত পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও মা হতে পারছেন না ডিম্বাণুর অভাবে।ডিম্বাণু দান চালু হওয়ায় মা হওয়ার স্বাদ এইধরণের মহিলারা পেতে পারছেন।
ডিম্বাণু দান বিষয়টি কি রকম!-ডিম্বাণু দানের ক্ষেত্রে কোন সুস্থ সবল মহিলার দান করা ডিম্বাণু আই ভি এফ এর মাধ্যমে গ্রাহীতা মহিলার স্বামীর শুক্রাণুর সাথে নিষেক ঘটিয়ে গবেষণাগারে ভ্রূণ তৈরি করা হয়।এই ভ্রূণ গ্রাহীতা মহিলার জরায়ুতে স্থাপন করা হয়।একেই বলা হয় ডিম্বাণু দান।অনেক সুস্থ স্বাভাবিক মহিলা আছেন যারা স্বেচ্ছায় রক্তদানের মত ডিম্বাণু দান করে থাকেন।তবে মনে রাখতে হবে একমাত্র টাটকা ডিম্বাণুই দান করা যায়।

ভ্রূণ দান -দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হল ভ্রূণ দান।অনেক পুরুষ আছেন যাদের শুক্রাণু নেই বা অনেক মহিলার ডিম্বাণু নেই।

ভ্রূণ দান বিষয়টা কি?-অন্যকোন মহিলার দান করা ডিম্বাণু দিয়ে বা অন্যকোন পুরুষের দান করা শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত করা ভ্রূণ সেই দম্পতি দান হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন।সেই দান করা ভ্রূণ গ্রাহীতা মহিলার জরায়ুতে স্থাপন করা হয়।
ডিম্বাণু দান ও ভ্রূণের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি :-নারীর শরীরে ডিম্বাণু তৈরি না হলে ডিম্বাণু সৃষ্টির সময় ডিম্বাশয় থেকে প্রয়োজনীয় হরমোনের নি:সরণও হয়না।এই হরমোনগুলো জরায়ুর ভিতরে কাজ করে জরায়ুর মধ্যে একটি বিছানার মত পরিবেশ তৈরি করে.যেখানে ভ্রূণটি এসে স্থাপিত হয়।এই সময় জরায়ুর দেওয়ালেও বেশকিছু পরিবর্তন ঘটে।ডিম্বাণু বা ভ্রূণ দানের ক্ষেত্রে ভ্রূণ স্থাপনের আগে গ্রাহীতার শরীরে কিছু বিশেষ ওষুধ প্রয়োগ করে ঠিক ওই রকম পরিবেশ সৃষ্টি করে নেওয়া হয়।দাতা মহিলার জরায়ুর সাথে সঙ্গতি রেখেই গ্রাহীতা নারীর জরায়ুর মধ্যে একই ধরণের পরিবেশ গড়ে তোলা হয়।
সুবিধা :-আই ভি এফ পদ্ধতির সাহায্যে যে মহিলা মা হতে পারতেন না তিনিও মাতৃত্বের স্বাদ নিতে পারছেন।কোন মহিলার ডিম্বাশয়ে যদি ক্যান্সার ধরা পড়ে সেক্ষেত্রে একমাত্র আশু সমাধান হল ডিম্বাশয় কেটে বাদ দেওয়া।তাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা চলে গেলেও মা হবার সম্ভাবনাও সম্পূর্ণ ভাবেই থাকবেনা। আই ভি এফের সাহায্য নিলে এক্ষেত্রে ডিম্বাশয়টি কেটে বাদ দেবার আগে ডিম্বাণু বের করে নেওয়া যেতে পারে।তবে মস্ত অসুবিধা একটাই ডিম্বাণুকে হিমায়িত করে সংরক্ষণ করা যায়না কিন্তু ভ্রূণের ক্ষেত্রে সে সমস্যা নেই।ভ্রূণকে হিমায়ত করে রাখা যায় অন্তত পাঁচ বছর।তাই এই সমস্যার ক্ষেত্রে মহিলাটির স্বামীর শুক্রাণুর সাথে নিষেক ঘটিয়ে ভ্রূণ বানিয়ে ফ্রীজড করে যেতে পারে।সময় সুযোগ অনুয়ায়ি মহিলার গর্ভে স্থাপন করলেই তিনি গর্ভবতী হতে পারবেন। অবিবাহিতা মহিলাদের ক্ষেত্রে অবশ্য অসুবিধাজনক।এমন কোন মহিলার ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যাবহার করা যায় যার প্রেমিক আছে এবং অদূর ভবিষ্যতে বিয়ে হবে।কিন্তু যার এই মুহূর্তে বিবাহের সম্ভাবনা নেই,বিয়ে হতে হতে অনেক সময় লেগে যাবে সেক্ষেত্রে কিন্তু ডিম্বাণু রেখে দেবার কোন উপায় নেই।পাঁচ বছরের মধ্যে বিয়ে হলে পুরুষ সঙ্গী ঠিক করা থাকলে মহিলাটি পরবর্তীতে গর্ভধারণ করতে পারবেন।
ডোনার স্পার্ম আই ভি এফ :-
আই ভি এফ চিকিৎসা বিজ্ঞানের আর একটি প্রকার হল এই ডোনার স্পার্ম পদ্ধতি।স্বামীর শুক্রাণু যদি না থাকে অথচ স্ত্রীর ডিম্বাণু আছে এই ক্ষেত্রে অন্যপুরুষের শুক্রাণুর দ্বারা ভদ্রলোকের স্ত্রীর ডিম্বাণুর নিষেক ঘটিয়ে ভ্রূণ তৈরি করা যায়।
আই ভি এফ এর সাফল্যের হার; -সাধারণ আই ভি এফ পদ্ধতিতে সাফল্যের হার ৩০% সেখানেই ICSI এর সাফল্যের হার অনেকবেশী।যাদের সাধারণ আই ভি এফে সন্তান ধারণ সম্ভব হচ্ছেনা তাদের দেখা গেছে ICSI এ গর্ভধারণ ঘটেছে।ভ্রূণ দান বা ডিম্বাণু দানের ক্ষেত্রে এই সাফল্য প্রায় ৪০%-৬০% .মাত্র ১০ টি শুক্রাণু রয়েছে এমন ব্যক্তিও আই ভি এফের মাধ্যমে পিতৃত্বের স্বাদ নিতে পারেন।

গর্ভভারার মায়েরাঃ
কেন সেলিব্রেটিদের পছন্দের তালিকায় সারোগেট মাদার বিষয়টি? উত্তর যাই হোক না কেন, সারোগেট এখন বহুলপ্রচলিত শব্দ।অবশ্য সেই আড়ালে ধরা পড়ে এক অন্য ছবি। এই ছবি কথা বলে মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত যারা আর্থ-সামাজিক কারণে কিছু অসহায় নারীর।সারোগেট মাদার, একজন নারী যিনি মাতৃকল্প। যিনি অন্য এক নারীর মাতৃসুলভের জন্য গর্ভধারণ করেন নিজের জঠরে। যার আশ্রয়ে নয়-মাস ধরে তিলে তিলে বেড়ে ওঠা একটি ভ্রূণ। প্রজননে অক্ষম কোনো দম্পতিকে নতুন প্রাণ উপহার দেওয়াই কাজ এই সারোগেট মায়ের। ভাবতে কিছুটা অবাক লাগলেও ভারতবর্ষে সারোগেসি এক রমরমা ব্যাপার। ভারত এখন বিশ্বের সারোগেট ডেসটিনেশন। বিদেশের বহু দম্পতি যারা সন্তানসুখ থেকে বঞ্চিত তারা পাড়ি দিচ্ছেন এখানে। এখানে টাকার বিনিময় সহজেই মিলছে সারোগেট মাদার।
কেন সারোগেসি?
বহু চেষ্টাতেও যখন সন্তানলাভ সম্ভব হয়না তখন আই ভি এফের আর একটি পন্থা ভাবা যায় সারোগেসি পদ্ধতি।
সারোগেসির প্রকারভেদ
১পার্শিয়াল সারোগেসি
এই সারোগেসি-বহু যুগ ধরে এর চলে আসছে। সন্তানধারণে এক্ষেত্রে কোনও ভূমিকাই পালন করেন না মা। বাবার শুক্রাণু আর সারোগেট মায়ের ডিম্বাণু থেকে শিশুর জন্ম হয়।
২ ট্রু-সারোগেসি
আইভিএফ সারোগেসি-মায়ের ডিম্বাণু নিয়ে ল্যাবে ভ্রূণ তৈরি করা হয়। এরপর সারোগেটি মায়ের জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয় ভ্রূণটি। এটাই ভারতবর্ষে বহুল প্রচলিত পদ্ধতি।
ভারতের আনন্দের গ্রামে সারোগেসি এখন এক নতুন জীবিকা। গুজরাটের এই অঞ্চলে মায়েরা নিজের গর্ভ দিয়ে পরিবারে অর্থ যোগান। সুদূর ইউরোপ বা আমেরিকার কোনো এক দম্পতির ভ্রূণ বেড়ে ওঠে তাদের জঠরে। ‘ছেলে-মেয়ের পড়াশুনা, বাড়ি বা জমি-জায়গা কেনার জন্য মহিলারা সারোগেট মা হতে আসেন’, জানালেন আকাক্সক্ষা ইনফার্টিলিটি ক্লিনিকের কর্ণধার ডা. নয়না পাটেল। গুজরাটের এই ক্লিনিকটি দেশের সব থেকে ব্যস্ততম সারোগেট সেন্টার। বছরে প্রায় ১০০ জনের মতন সারোগেট শিশু জন্মায় আকাক্সক্ষার ক্লিনিকে। বিগত দশ বছরে ২৯টি দেশের প্রায় ৬০০ জন আইভিএফ সারোগেট শিশু জন্মেছে আকাক্সক্ষায়। ক্লিনিকে প্রতিদিন ভিড় জমান গুজরাটের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মহিলারা। মোটা অঙ্কের টাকার বদলে নিজের জঠরকে ভাড়া দিতে কোনো দ্বিধা নেই তাদের। অচেনা কোনও দম্পতির ভ্রূণকে তারা অবলীলায় জায়গা দেন নিজের শরীরে। দশমাসের এই ত্যাগস্বীকার আমাদের অবাক করলেও ওদের দেয় সারাজীবনের সুখ। সারোগেট মায়েরা এই অর্থ দিয়েই নিশ্চিত করেন ভবিষ্যতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। টাকার বিনিময়ে গর্ভ ভাড়া দেওয়াতে মোটেই সায় নেই বিশ্বের বহু দেশের। ইউরোপ এবং ব্রিটেনে কমার্শিয়াল সারোগেসি তাই মোটেই চলে না, বললেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গৌতম খাস্তগীর। আর আমেরিকাতে এর চল থাকলেও তা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। অতঃপর ভারত এবং ব্যাংককে এখন সবার কাছে পছন্দের গন্তব্য।
সারোগেট মা হতে ইচ্ছুক মহিলাদের প্রথমেই পূর্ণাঙ্গ শারীরিক এবং মানসিক চেক-আপ করানো হয়। পারিবারিক অবস্থারও বিচার করা হয়। সারোগেটদের একটি লিস্ট থেকে দম্পতিরা বেছে নেন কোন মহিলার জরায়ুতে তাদের ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করা হবে। একবার ভ্রূণ স্থাপনের পর গর্ভধারণ হলে সম্পূর্ণ আদর যত্নে রাখা হয় সারোগেটদের।
বিদেশে সারোগেসি করতে লাগে চল্লিশ লক্ষ থেকে কয়েক কোটি টাকা।

শেষ কথাঃ


টেস্ট টিউব বেবি কোন নতুন চিকিৎসা ব্যাবস্থা নয়,চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে ৩৫ বছর অনেক বেশি সময়।বর্তমানে পদ্ধতিটি অনেক সরল আর খরচ ও মধ্যবিত্তের মোটামুটি নাগালের মধ্যে। ওষুধ,ডাক্তার সব মিলিয়ে খরচ প্রায় নিরানব্বই হাজারের কম বেশি।তবে আই ভি এফের প্রকার ভেদ  খরচ ধার্য হবে।প্রথমবার আই ভি এফে বেশি খরচ হলেও দ্বিতীয় তৃতীয় বার সেই খরচ কমে যায়। ইউরোপ আমেরিকা অন্যান্য দেশগুলোতে এই খরচ অনেকবেশি।তবে আমাদের দেশে এই এই খরচ আরো কম হতে পারে।কিভাবে?যদি দুটি পরিবার যৌথভাবে এগিয়ে আসেন।একক ভাবে টাকাটা খরচ না করে দুটো পরিবার মিলেমিশে ভাগ করে নিতে পারেন।একে ডিম্বাণু ভাগাভাগি বলে।কারণ এই ডিম্বাণু তৈরির খরচটাই সবচেয়ে বেশি। খরচ আরো কমে যেতে পারে,ধরাযাক x এবং y দুটি দম্পতি বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগছেন।x এর স্বামীর শুক্রাণু তৈরি হয়না কিন্তু স্ত্রীর ডিম্বাণু তৈরি হয় প্রচুর।আবার y এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো,তার স্ত্রীর ডিম্বাণু তৈরি হয়না।এই দুই দম্পতির যৌথসম্মতির দ্বারা যৌথ চিকিৎসা সম্ভব




তথ্যসূত্র
ডঃ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর বার্ষিক প্রতিবেদন
ডঃ গৌতম খাস্তগীরের বার্ষিক প্রতিবেদন
নলজাতক তথ্যসূত্র

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)