অশোক তাঁতী - মায়াজম

Breaking

১৮ মার্চ, ২০১৬

অশোক তাঁতী

                       প্রসঙ্গ ঃ-অনুগল্প 













ইতিহাস

ছোটগল্প বা উপন্যাসের সর্বজনগ্রাহ্য কোনও সংজ্ঞা না থাকলেও নানান সংজ্ঞার সংমিশ্রণে একটা ধারণা গড়ে নেওয়া সম্ভব। তেমন কোনও সংজ্ঞা অনুগল্পের ক্ষেত্রে প্রচলিত নেই। ছোটগল্প ও উপন্যাসের বাইরে ‘অণু’, এই নতুন নামকরণ পরিষ্কার সীমারেখা আর নির্ভুল গঠনের বৈশিষ্ট নির্ধারণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। বিভিন্ন সময়ে অণুগল্পের নানারকম নাম পাওয়া গেছে – মুহূর্তগল্প, ছোটমাপের গল্প, চকিত গল্প, মিনিগল্প, মাইক্রোগল্প, ঝুরোগল্প।
বিশ্বসাহিত্যে প্রথম অণুপত্রিকা হল অমিয় চট্টোপাধ্যায় ও আশিসতরু মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পত্রানু’। যার জন্ম ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে। যদিও কয়েকটা সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর সম্পাদক হিসেবে শুধুমাত্র অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের নামই পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে মানব পাল সম্পাদিত ‘মুহূর্ত’ (১৯৭০), প্রদীপ ভট্টাচার্য, জগদীশ বসাক, কুমারেশ চক্রবর্তী সম্পাদিত দ্বিভাষিক (বাংলা ও ইংরেজি) ‘মিনি পত্রিকা’ / ‘এক্স’, (১৯৭০), তারাপদ দে ও বিবেকজ্যোতি মৈত্র সম্পাদিত ‘মাটি’ (১৯৭০), নির্ঝর চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘নক্ষত্র’ (১৯৭১), সব্যসাচী বিশ্বাস ও সনৎ ঘোষ সম্পাদিত ‘চলেছি’ (১৯৭০), শিবাজি শঙ্কর সান্যাল ও সোনম ওয়াঙ্গিয়াল সম্পাদিত বানলা-ইংরেজি দ্বিভাষিক ‘মাইক্র’(১৯৭০) ইত্যাদি নানান পত্রপত্রিকা প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ ১৯৭০ সাল নাগাদ অণুগল্প নিয়ে এক আন্দোলন গড়ে ওঠে। অথচ ওই সময় থেকে বর্তমানেও অণুগল্পের সঙ্গায়নের চেষ্টা বিশেষ চোখে পড়ে না।
শুদ্ধসত্ব বসুর মতে ‘অতিশয় স্বল্প পরিসরে রচিত যথার্থ ছোটগল্পকে অণুগল্প বলা হয়’ (বাংলা সাহিত্যের নানারূপ)। অর্থাৎ ছোটগল্প ও অণুগল্পের পার্থক্য শুধুমাত্র পরিসরের। অণুগল্প বলতে সাধারণত সম্পাদকরা এই পরিসরের কথাই মাথায় রাখেন। মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, যে গল্পের শব্দসীমা ৫০ – ৪০০ শব্দের মধ্যে তাই অণুগল্প। অর্থাৎ গল্পগুলোকে হতে হবে সীমিত কিছু শব্দ বা কয়েকটা বাক্যের। অন্যকোনো নিজস্ব বৈশিষ্ট ছেড়ে শুধুমাত্র শব্দসংখ্যার বিচারে সংজ্ঞা নির্ধারণ অণুগল্প নামক সাহিত্যকৃ্তির প্রতি অবিচার। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ বা রামকৃষ্ণ কথামৃতের গল্পগুলোও অণুগল্পের পর্যায়ভুক্ত। বা যেকোনো ছোটগল্প উপন্যাসের সারসংক্ষেপও অণুগল্প।
চিন্ময় বিশ্বাস সম্পাদিত ‘মিনিট তিনেক গল্প’ নামক সংকলন গ্রন্থের ভূমিকাতে অমিয় চট্টোপাধ্যায় লিখছেন ‘আসলে আমাদের জীবনে এমন অনেক চকিত ঘটনা হঠাৎই উদ্দিপিত হয়ে আমাদের চেতনায় গভীরভাবে নাড়া দেয়, যেগুলো প্রকাশের জন্য পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখার দরকার হয় না। এইসব উদ্দীপিত অনুভব থেকেই অণুগল্প রচনার ক্ষেত্র তৈরি হয়। যেখানে বিস্তৃতির অবকাশ নেই। অণুগল্প মানেই বিন্দুতে সিন্ধু।‘ অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের এই সংজ্ঞা কিছুটা হলেও পরস্পরবিরোধী। তাঁর সংজ্ঞাতে আছে চারটে মানক – ১) চকিত ঘটনা ২) ক্ষণদীপিত অনুভব ৩) বিস্তৃতির অবকাশহীনতা ৪) বিন্ধুতে সিন্ধু। প্রথম তিনটে নিয়ে কোনও বিরোধ না থাকলেও চতুর্থ মানক নিয়ে বিরোধ বাঁধতেই পারে। বিশাল কোনও উপন্যাস বা ছোটগল্পের সারসংক্ষেপ ক্ষুদ্র আকারে প্রকাশ করলেই কি তা অণুগল্পের পর্যায়ভুক্ত হতে পারে? বা ঠিক উল্টো করে , অণুগল্পের সেই বিস্তৃতি কি সম্ভব যে অণুগল্প পরিণত হল ছোটগল্পে বা উপন্যাসে? তাঁর তৃতীয় মানক বলছে সম্ভব নয়, কারণ অণুগল্পে বিস্তৃতির অবকাশ নেই। চকিত ঘটনা বা ক্ষণদীপিত অনুভব সার্থক ছোটগল্পের জন্মও দিতে পারে। আলাদা করে ছোটগল্প ও অণুগল্প বোঝা সম্ভব কিভাবে?
অণুগল্পের মধ্যে সচেতনভাবে একটা গণ্ডি ভাঙার প্রয়াস ছিল। যা কখনই পূর্ণাঙ্গ ছোটগল্প নয়, তা চকিত ঘটনা বা ক্ষণদীপিত অনুভবের এক নতুনতর কথনভঙ্গি। ‘ছোটমাপের গল্প’গুলোকে ‘নূতন গল্প’ নাম দিয়ে ১৯৭৬ সালে প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন বনফুল (১৮৯৯ - ১৯৭৯)। বলফুল বিশ্বাস করতেন ‘প্রথম শ্রেণীর গল্প বিদ্যুৎচমকের মতো’ (গল্প লেখার গল্প)। ছোটগল্প ও অণুগল্পের আলাদা গঠনশৈলীতে তিনি বিশ্বাসী নন। ‘বিদ্যুৎচমকের’ বিশ্বাস থেকে তিনি যে ছোটমাপের গল্পগুলো লেখেন তার শেষের মোচড়টা পূর্ব নির্ধারিত বলে মনে হয়। যদিও তিনি লিখছেন ‘কৌশল করে প্লট ভেবে ছক কষে প্রথম শ্রেণীর গল্প লেখা যায় না’। এই ‘বিদ্যুৎচমক’ আর ‘ক্ষণদীপিত অনুভব’ –এর পার্থক্য কোথায়? উভয়ক্ষেত্রে একটা অমোঘ শেষ বাক্য। বনফুল স্বীকার না করলেও এই শেষ বাক্যের অমোঘতাই হদিস দেয় প্লট বা ছকের। সমস্ত ন্যারেটিভের গঠন এই শেষ বাক্যটাকে সার্থক করে তুলতে। বনফুলের সংজ্ঞার সাথে অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের সংজ্ঞার মৌলিক কোনও পার্থক্য নেই।

১৯৭০ কেন?

সংজ্ঞা ছাড়া যে বিষয় আমাদের ভাবতে বাধ্য করে তা হল, ঠিক এই সত্তর দশক থেকেই কেন অণুগল্প নিয়ে এতো আন্দোলন গড়ে উঠল? এমনকি পত্রানু প্রকাশের ঠিক আগে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ‘মিনিবুক’ নামে ছোট আকৃতির কবিতার বই প্রকাশ করেন। অর্থাৎ ছোটর প্রতি আকর্ষণ এই সময়ে গড়ে ওঠে। এই আকর্ষণের মূল কারণ সাহিত্য থেকে আনন্দ পাওয়া । আনন্দের মূলে আছে সাহিত্যের সেই ক্ষমতা যা ঘটনার প্রচলিত প্রকরণকে পরিবর্তিত রূপ দেয়। ১৯৪৭সালের পর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ পরিবর্তনের আশা করেছিল। ষাটের দশকে এসেও সেই আশা বাস্তবায়িত হয় না। ষাট ও সত্তর দশক দেখে বাংলা তথা উপমহাদেশ জুড়ে এক সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খল অবস্থা। এই সময়েই চীনের সাথে যুদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। এই সময়ে বেকার সমস্যা তীব্রভাবে বাড়তে থাকে। ব্যাপক জাতীয়করণ শুরু হয়। অর্থাৎ এই সময়ে প্রচলিত পরিচিতির অবলুপ্তি ঘটেছিল। সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল অবস্থা। এই বিশৃঙ্খলার জন্য de-familiarization বা পরিচিতির অবলুপ্তিকরণের মধ্যে সাধারণ সমাজজীবনে চরম যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার উপায় হল শৃঙ্খলার প্রবর্তন বা ভয় থেকে মুক্তির আশা। সমাজজীবনে ভিন্নতর শৃঙ্খলার সন্ধানে এই সময়ে নকশাল আন্দোলনের সূত্রপাত। ভয় থেকে মুক্তির আশ্বাস দিতে সরকারিভাবে ব্যাংক, বিমা, খনি ও ইস্পাত শিল্পের জাতীয়করণ। সাহিত্যও এই বিশৃঙ্খল সময়ে এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সাহিত্য থেকে আনন্দ খুঁজে নেবার জন্য পৌনপৌনিকতার অবসান দরকার, দরকার ভিন্নতর এক সাহিত্য শৃঙ্খলার। তাই এই সময়ে জন্ম বিভিন্ন সাহিত্য আন্দোলনের। যার একটা অণুগল্প নিয়ে আন্দোলন। যে জন্য ১৯৭০ এর আশপাশে একাধিক ভাষাতে একাধিক অণুপত্রিকার প্রকাশ।

বিজ্ঞান ও সাহিত্য

বিজ্ঞানের সাথে কল্পনার কোনও বিরোধ থাকার কথা নয়। পদার্থের লুকোনো ধর্ম, বিশ্বব্রম্ভান্ডের অজানা নিয়ম সমূহ জানার জন্য কল্পনার প্রয়োজন। নিউটন একটা আপেলের পতন থেকে কল্পনায় পৌঁছে যান চাঁদের পতন না হবার কারণে। পরিশীলিত কল্পনার এই উল্লম্ফন ছাড়া প্রকৃ্তি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আদিম অবস্থাতে থেকে যেত, যখন জ্ঞান শুধুমাত্র শুধুমাত্র কিছু ঘটনার সহাবস্থান ও অণুক্রমের তালিকা।
বিজ্ঞানকে অনুকরণের প্রথা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও দর্শনে দীর্ঘদিন ধরেই স্বীকৃত। অভ্যস্ত চোখ যা দেখে তার বাইরের গভীর বাস্তবকে দেখার জন্য শিল্প সব যুগে সাহাজ্য নিয়েছে বিজ্ঞানের। তাই ইপ্রেশনিষ্টরা উৎসাহ পান আলোকবিজ্ঞান থেকে, কিউবিষ্টরা আপেক্ষিকতাবাদ থেকে, সুরিয়ালিষ্টরা সাইক-আনালিসিস থেকে। লিওতার বা দেরিদা বিজ্ঞানকে সামনে রেখে নির্মাণ করেন তাঁদের দর্শন। তাই বিজ্ঞান অণুগল্পের ব্যাখ্যাতে অপ্রাসঙ্গিক নয়। বরং বিজ্ঞানের দিকে চোখ ফেরানোই সুবিধাজনক।
হ্যান্স স্ল্যাবেকুর্ন ও তাঁর সহযোগীরা শহর, গ্রাম ও বনে পাখিদের গান রেকর্ড করে তা বিশ্লেষণ করেন। এই বিশ্লেষণের ফল বেশ চমকপ্রদ। তাঁরা দেখেন বনের মধ্যে পাখি যেভাবে গান গায় শহরে সেই একইভাবে গান গায় না। দুটো গানের সুর একই কিন্তু বনের মধ্যে গানের যে বিস্তার শহরে সেই বিস্তার থাকে না। শহরের পরিবেশে প্রচণ্ড আওয়াজ। শহরে তার গানের সুর লয় ও বিস্তার অন্য যে কোনও আওয়াজে হারিয়ে যেতে পারে, তাই শহুরে পাখির গান দ্রুত লয়ে ও চড়া পর্দার। পাখির কাছে তখন একটাই চিন্তা, তার গান যেন দ্রুত তার প্রার্থিত সঙ্গিনীর কানে পৌঁছে যায়। শহুরে এই অভিযোজন পাখির প্রজনন ও অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
পাখির গানের মতই গল্প থেকে যাত্রা শুরু অণুগল্পের। ১৯৭০ এর মতো সমাজ পরিবর্তন হয়েছে ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহারের সাথেসাথে, বিশেষ করে ২০০৩ সালে ব্লগস্পট আবিষ্কারের সাথেসাথে। এখন মোবাইল ফোনের স্ক্রিন গল্পপাঠের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। সেখানে প্রার্থিত পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে গল্পকে, অল্প সময়ে, সংক্ষিপ্ত আকারে এবং অনুভুতিতে তীব্রভাবে। গ্লোবাল পাঠকের সময়ের স্বল্পতা, নানারকম চাপ ও মানসিক অভাববোধের কারণে অনুভূতির বধিরতা। এজন্য গল্পকে অভিযোজিত হতে হয় অণুগল্পে এবং বদলে যায় গল্পের চরিত্র।

অনুক্তের অনুরণন

কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা ক্ষুদ্রতম পদার্থের অবস্থান ও গতি মাপার কথা বলে। বলে, সমস্ত কিছুই এক সম্ভবনা। সেখানে নির্দিষ্ট করে কোনও কিছু বলা যায় না। ক্ষুদ্রতম পদার্থ কখনো পদার্থের রূপ ধরে কখনো তরঙ্গ। একটা তরঙ্গ মানে সেটা কোনও নির্দিষ্ট বিন্দুতে সীমাবদ্ধ থাকে না। তরঙ্গের ব্যাপ্তি বরাবর দর্শক যেখানে বস্তুকে দেখতে চায় বস্তুকে সেখানেই দেখতে পায়। হাইজেনবার্গের মতে অবস্থান জানা গেলেও অন্যসব তথ্য বেঠিক হবে। নিউটনিয় বলবিদ্যার নিয়ম অনুসারে পূর্ববর্তী বা প্রাথমিক অবস্থা সথিকভাবে জানা থাকলে পরবর্তী অবস্থা অর্থাৎ ভবিষ্যৎ পুরোপুরি নিয়ম নির্ধারিত। তা পদার্থের এই ক্ষুদ্রদশার ব্যবহারের সঠিক দিশা দেখাতে পারে না।
কাজ, আনন্দ, সমস্যা লোকের ভিড় ইত্যাদি জীবনের নানান প্রসঙ্গকে আমরা তরঙ্গের সাথে তুলনা করি। বিভিন্ন বস্তুগত ও মানসিক বিষয়কে তরঙ্গের সাথে তুলনা একটা সচেতন প্রক্রিয়া। বিশিষ্ট কোয়ান্টাম পদার্থবিদ শ্রোয়েডিঙ্গার মনে করেন “Conscious awareness as something emerging in individuals like tips of waves from deep and common ocean”।
কোয়ান্টাম ফিজিক্সের এমন ভাবনাকে অণুগল্প ব্যখ্যার কাজে লাগানো যেতে পারে। অণু ভাবনার চারপাশে থাকে তরঙ্গ। মানুষের ভাবনা চিন্তা, কর্মকাণ্ড এবং বস্তুজগতের অবস্থান পরস্পর সম্পর্কযুক্ত না হলেও উভয়কে ঘিরে থাকে তরঙ্গ। নানা কারণে সৃষ্ট তরঙ্গ থেকে কোনও নির্দিষ্ট কারণ তুলে নিয়ে তার তরঙ্গ অবলোকন যে ক্ষুদ্রাকার গল্পে সম্ভব তাই অণুগল্প। লেখক কখনই সেইসব তরঙ্গ সৃষ্টি করবেন না। কারণ অতিরিক্ত শব্দের ব্যবহার তাঁর গল্পকে নির্দিষ্টতার দিকে নিয়ে যাবে। তিনি শুধু পদার্থকে ভেঙে টুকরো করবেন। সেই টুকরো ঘটনাকে ঘিরে যে অনুক্ত স্বর তা তরঙ্গের মতো অনুরণন সৃষ্টি করবে। এর ফলে ঘটনার নির্দিষ্টতা এবং অনুক্তের অনুরণন – এই দ্বৈততার মধ্যে পাঠক চলাফেরা করবেন। অর্থাৎ Wave – particle duality-র মতো, একটা মাত্র ঘটনা বা ক্ষণদীপিত অনুভব ও অনুক্তের অনুরণনের ডুয়ালিটি তৈরি হলে তাকে অণুগল্প বলা যাবে।
ন্যারেটিভ হল এক বা একাধিক event অর্থাৎ ঘটনার বর্ণনা। ন্যারেটিভের মধ্যে থাকে ঘটনা ও যেভাবে ঘটনার ঘটনার বর্ণনা করা হয় অর্থাৎ ন্যারেটিভ ডিসকোর্স। অণুগল্পের ন্যারেটিভে থাকবে একটা মাত্র ঘটনা। অনুক্তের অনুরণন হবে ন্যারেটিভ ডিসকোর্সের মাধ্যমে।

বনফুলের তাজমহল

এই প্রসঙ্গে বনফুলের লেখা একটা অণুগল্পের কথা আমরা ভাবতে পারি। গল্পটার নাম তাজমহল। আগ্রার আশপাশে ভিক্ষা করে বেড়ানো ফকিরের নাম শাহজাহান হবে এটা যেন অনেকটাই পূর্ব নির্ধারিত। ভাঙা ইট আর কাদা দিয়ে গাছতলায় কী করছে দেখে ডাক্তারের কৌতূহলের জবাবে সে জানায় যে , বিবির কবর গাঁথছে। মাত্র তিনটে শব্দ এই অণুগল্পকে ধারণ করে আছে – আগ্রা, শাহজাহান এবং তাজমহল। এই তিনটি মাত্র শব্দ মানুষের স্মৃতি, প্রচলিত ও ইতিহাসের বিশাল প্রেক্ষাপটকে অনুরণিত করে। মাত্র তিনটে শব্দ গল্পের ইঙ্গিতময়তা ও ইশারার জন্য যথেষ্ট। শব্দ তিনটে পাঠকের অনুভূতি ছুঁয়ে ফেলার চাবিকাঠি। গল্প শেষ হচ্ছে ক্ষণদীপিত শব্দের ব্যবহারে। গরিব বৃদ্ধ শাহজাহানের পত্নিপ্রেম তুলনীয় হয়ে ওঠে ভারত সম্রাট শাহজাহানের পত্নিপ্রেমের সাথে। গল্পটাতে খুব সরল সাধাসিধে শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু গল্পপাঠের পর সেইসব অনুক্ত প্রেমের কথা অনুরণিত হতে থাকে।

অণুগল্প কি ছোটগল্পের সারসংক্ষেপ?

অণুগল্পের অনির্দিষ্টতা থেকে যখন আমরা ছোটগল্পের দিকে যাই তখন তা যেন ওয়েভ-পার্টিকেল ডুয়ালিটি থেকে নিউটনিয়ান পদার্থের নির্দিষ্টতায় পোঁছে যাই। এই স্থানিকতা ও নির্দিষ্টতা অনুগল্পের মতো অপরিমেয় থাকে না। অর্থাৎ বড় গল্পের সংক্ষেপকরণের ফলে অণুগল্প গড়ে ওঠে না, অণুগল্প এক ভিন্ন সাহিত্য ধারা। অনুরণিত হওয়ার ক্ষমতা ছাড়া কোনও গল্প অণুগল্প হতে পারে না। সংক্ষেপকরণের ফলে সেই গুণ আরপিত হতে পারে না। এই অনুরণিত হতে পারার ক্ষমতার জন্য তা কবিতার অনেক কাছাকাছি।

২টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র