যুগান্তর মিত্র - মায়াজম

Breaking

৩১ মার্চ, ২০১৭

যুগান্তর মিত্র


অসময়ের বৃষ্টি






নার্সিংহোমের যে কেবিনে সুরেন শুয়ে আছে, সেখান থেকে লম্বা করিডরটা স্পষ্ট দেখা যায়। দূর থেকে দিদিকে আসতে দেখেই চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। একটা সময় ছিল দিদিকে দেখলে ঘৃণায় চোখ ফিরিয়ে নিত। আর এখন চোখ বন্ধ করে আছে লজ্জায়। দিদিকে মুখ দেখাবে কী করে !

যেদিন দীপেন ঘটনাটা জানাল এবং সাক্ষী হিসাবে রমেনও যখন জোর দিয়ে বলল, তখন ব্যাপারটা বিশ্বাস না-করে উপায় ছিল না। তাছাড়া দিদির ইদানিংকার সাজগোজ বা চালচলনও বলে দিচ্ছিল ওদের বলা কথায় ভুল নেই কোনো। পরদিন সকালেই দিদির সঙ্গে প্রবল ঝগড়াঝাঁটি। শেষপর্যন্ত তো দশ বছরের বড়ো দিদিকে ধাক্কা মেরে ফেলেও দিয়েছিল মেঝেতে। সেদিন থেকে দিদির সঙ্গে কথাও বন্ধ করে দিয়েছে সুরেন। এমনকি রমা এ বাড়িতে থাকলে সেও থাকবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিল জোর গলায়। সুরেনের মনে পড়ে, দিদি শব্দটাও উচ্চারণ করেনি সেদিন।

দিদি অবশ্য নিজেই আলাদা বাসা ভাড়া করে চলে গেছে। তবে টাকাটা নিয়মিতই পাঠাত। সেকথা অবশ্য এতদিন জানত না। কালই জেনেছে বাবার কাছ থেকে। আজ সেসব ভাবলেই কেমন যেন অপরাধবোধ চেপে ধরে সুরেনকে। তাই চোখ মেলতেও ইচ্ছে করে না দিদির সামনে।
রমা নিশ্চুপে কেবিনে ঢুকে নার্সকে জিজ্ঞাসা করল, আজ কেমন আছে ভাই ?

~ মোটামুটি ভালোই। ওষুধে রেসপন্স করছে পেশেন্ট। ব্যথাটা কমেছে। দুপুরে হালকা খাবারও দেওয়া হয়েছে। আরও দু-একটা টুকিটাকি জিজ্ঞাসা করে নিল। সবই চাপা গলায়।
ছোট্ট টুলটা মাথার কাছে টেনে এনে বসে পড়ল রমা। প্রথমে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর একটা আঙুল দিয়ে বিলি কেটে দিচ্ছিল চুলে। খুব ভালো লাগছিল সুরেনের।

~ আপনি ডাকুন না ভাইকে। উনি এইমাত্র জেগেই ছিলেন। তাছাড়া অসময়ে ঘুমানোও ঠিক নয়।
নার্সের কথায় রমা একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, থাক না। দুর্বল শরীর। ডাকার দরকার কি ? আমি একটু বাদেই চলে যাব। আমার কাজ আছে। বাবা আসবেন এখানে কিছুক্ষণ বাদেই।

পরশু এখানে ভর্তি হওয়ার সময় দিদিকে দেখেনি কোথাও। নাকি ছিল আশেপাশে ? কালও কি এসেছিল দিদি ? কে জানে ! কাল তো সারাদিন ঘুমিয়েই কাটিয়েছে প্রায়। সকালে বাবা এসেছিল। তখন অসহ্য যন্ত্রণা। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিল সকালেই। তারপর থেকে ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। বিকেলে কেউ এসেছিল কিনা জানে না সে। এসব ভাবতে থাকে সুরেন। দিদি কি বুঝতে পারল আমি জেগেই আছি ? ভাবে সুরেন। বাবা আসবেন এটা আন্দাজে বলল। কেননা বাবার সঙ্গেও কথা বলে না দিদি। সেই যে বাড়ি ছেড়ে গেলো, তারপর একদিনও বাড়িতে আসেনি কোনোদিন। বাবার মুখোমুখি হতে চায় না বলেই হয়তো তাড়াতাড়ি চলে যাবে। বাবাও কি এইজন্যই দেরি করে আসছে ? কোনোদিন কি দিদি আর বাবা মুখোমুখি হয়েছিল এখানে? চোখ বন্ধ করেই নানা সাতপাঁচ ভাবে সুরেন।

রমেনের বাইকের পেছনে বসেছিল সুরেন। মাঝে ছিল বিপুল। গাড়িটা হাইওয়ে ধরে বেশ জোরেই ছুটছিল। বাঁদিকে টার্ন নিয়ে কিছুটা এগোনোর পরই মাথাটা টলে উঠল। তারপর একটা ঝটকা লাগল। আর পড়ে গেল ছিটকে। আর কিছু মনে নেই তার। জ্ঞান ফেরার পর দেখল হাসপাতালে শুয়ে আছে। মাথার পেছনে লেগেছে মনে হয়। অসহ্য যন্ত্রণা। হাতে-পায়েও খানিকটা ছড়ে গেছে। ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতে, পায়ে। মাথাতেও ব্যান্ডেজ। এসব ভাবতে ভাবতেই দিদির উপস্থিতিও বুঝতে পারে সুরেন। দিদি খানিকক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে নার্সকে নীচু গলায় কিছু-একটা বলেই চলে গেল। আন্দাজে বুঝে নেয় সে।

দিদি যাওয়ার একটু বাদেই বাবা আসে। টুলে বসেই ভারী গলায় ডাকে, হ্যাঁ রে বাবু, এইসময় কেউ ঘুমায়? ওঠ ওঠ। রাইতে জাগবি নাকি তুই ? নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে ওঠে।
~ এখানে এত জোরে কথা বলবেন না কাকাবাবু। নার্স সতর্ক করে বাবাকে।
~ সরি সরি। ভুল হইয়া গেছে। আইচ্ছা আস্তেই কথা কমু।
~ আমি একটু আসছি। আপনারা কথা বলুন। বলেই নার্স চলে যায়।
অমরেশ বসু মাঝারি গলায় বলেন, আইচ্ছা আসেন। এহন তো ভিজিটিং আওয়ার। আপনে সমায় ফুরানোর আগেই আইস্যা পইড়েন। 
নার্স কিছু না-বলেই চলে যায়।


(২ )
"চল একটু বিয়ার টেনে আসি।" রমেনের প্রস্তাবে রাজি হয় সুরেন। সবসময় অবশ্য রাজি হয় না। রমেন প্রায় প্রতিদিনই বিয়ার বা মদ খায়। সঙ্গে কখনো বিপুল, কখনো শিবু থাকে। দীপেনও থাকে মাঝে মাঝে। আসলে রমেনের মা ডাক্তার আর বাবার প্রোমোটিংয়ের। ও যখন যেমন চায় টাকা পেয়ে যায় হাতে।
একবার শ্যামাপ্রসাদ স্যার সুরেনকে ডেকে বললেন, শোন বাবা, বন্ধু নির্বাচনে যেন ভুল না হয়। তুই তোর সমকক্ষ বুঝে বন্ধু করিস। বেশি ধনী বন্ধু হলে তাল মেলাতে পারবি না। আর গরিব হলে আবার করুণা করে বসবি। তাই ভেবেচিন্তে বন্ধু নির্বাচন করবি।
পড়াশুনায় রমেন বেশ ভালো। তাই আলাদা করে নজর রাখেন শ্যামাপ্রসাদবাবু। অন্য শিক্ষকরাও খেয়াল রাখেন। পাড়ার শিক্ষক বলে শ্যামাবাবু বেশিই খেয়াল রাখেন। উনি বোধহয় রমেনের সঙ্গে মেলামেশা বেশি পছন্দ করেন না। বোঝে সুরেন। স্যারের কথাটা মনে ধরে তার। তাই রমেনের সঙ্গে সবদিন তাল মেলাতে যায় না। তবে মাঝে মাঝে উপেক্ষাও করতে পারে না। বিয়ার খেতে ইচ্ছে করে খুব। মদ সে খায় না।
সেদিন রমেনের বাইকের পিছনে বসে বিয়ার খেতে গেলো ইউনিক বারে। ফেরার পথে আচমকা দিদিকে দেখতে পেলো। তখন অবশ্য দিদি ভাড়াবাড়িতে থাকে। দিদির সঙ্গে একজন লোকও ছিল। বেশ কালো মোটা লোকটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল                                                                                                                                                                                                                                  ।
~ ঐ দ্যাখ তোর দিদির ভাতার।
~ এই রমেন। এভাবে বলছিস কেন ? ওর দিদি তো নাকি ? শিবু রমেনের পিঠে চাপড় মেরে বলে।
~ চুপ করত বাঞ্চোৎ। বেশ্যা মেয়েছেলে একটা। ভাতার নিয়ে মারিয়ে রোজকার করবে, আর বলা যাবে না ?
কথাটা চড়াৎ করে মাথায় এসে লাগে সুরেনের। সপাটে লাথি কষায় রমেনের পেছনে। তারপর রাস্তার পাশেই মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেলে সুরেন।
কিছুক্ষণ পরে রমেন এগিয়ে এসে সুরেনের পিঠে হাত রাখে। চল সুরেন। বাড়ি চল। বিশ্বাস কর, আমি অত ভেবে বলিনি। সরি ভাই। এবারের মতো মাফ করে দে। আর কোনোদিন বলব না।
শিবু আর রমেন অনেক বুঝিয়ে ওকে গাড়ির পিছনে বসায়। আর সেদিনই ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে। তারপরই হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেখান থেকেই এই নার্সিংহোমে আনা হয় ওকে।


(৩)
~ তোকে একটা ঘটনা বলি শোন। খানিকটা গম্ভীর গলায় বলল দীপেন। সুরেন অবাক হয়ে জানতে চায়, কী হয়েছে রে? কী ঘটনা?
~ আজ আমরা একটা জায়গায় গেছিলাম। নতুন জায়গায়। হাসি হাসি মুখে বলল রমেন।
~ কোথায়?
~ মাগী বাড়ি।
সুরেনের চোখ জ্বলে ওঠে আচমকা। বেশ রসালো বিষয় বলে ঘটনাটা শোনার আগ্রহ বেড়ে যায়। তবে খুব বেশি আগ্রহ দেখাতেও লজ্জা লজ্জা করে। তাই নীচু গলায় জানতে চায়, কোথায় জায়গাটা?
~ নতুন পল্লীর পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে সেটা দিয়ে যেতে হয়। অনেকটা দূরে। সেখানে কাকে দেখলাম জানিস?
~ কাকে ?
~ এক মাসীর সাথে কথা বলে একটা ডাগর মেয়ের ঘরে গেলাম। লালটুস মাল। কাজ সেরে ফেরার সময় পাশের ঘরে একজনকে দেখে আমাদের ইয়ে মাথায় উঠে গেলো।
~ কে সে? আমাদের চেনা কেউ?
মুখ নীচু করে দীপেন বলল, তোর দিদি।
চড়াৎচড় করে বাজ পড়ল যেন। পৃথিবীটা যেন টলে উঠল। এরপর ওরা দুজন বেশিক্ষণ ছিল না। যতক্ষণ ছিল কী কী কথা বলেছে কিচ্ছু মনে নেই সুরেনের।
সেদিন দিদি রাত করেই ফিরেছিল। সুরেনের তখন তীব্র মাথার যন্ত্রণা। তাই শুয়েছিল। পরদিন সকালেই দিদির সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হল। তারপর দিদি চলেই গেলো একদিন পরেই।
সুরেন জানত বাবার টেলারিংয়ের দোকানের আয়ে ওদের সংসার, ওর পড়াশুনার খরচ চলে। নার্সিংহোমে আসার পর বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল খরচের কথাটা। বাবা কিছু না-বলে মুখ নিচু করে নেয়। পরে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় দিদিই এতদিন সংসার টেনেছে। দিদিই খবর পেয়ে ছুটে আসে আর হাসপাতাল থেকে এই নার্সিংহোমে নিয়ে আসে। বাবার টেলারিংয়ের দোকান চলে না সেভাবে। আসলে জামাকাপড়ের আধুনিক কায়দাকানুন বাবা রপ্ত করতে পারেনি। তাছাড়া এখন রেডিমেডের যুগ। অথচ প্রায় তাড়িয়ে দেওয়া দিদিই এখন ওদের সংসারের একমাত্র ভরসা। এসব ভেবেই দিদির কথা মনে হলে লজ্জা পায় সুরেন, আত্মগ্লানি ঘিরে ধরে।
প্রায় সাতদিনের মাথায় নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পেল। ছাড়া পাওয়ার দিন সকালে একজন বয়স্কা নার্স একটা চিরকুট হাতে দিল সুরেনের। এটা একজন দিয়ে গেছে সকালে। বলল তোমাকে দিতে।
চিরকুট খুলে সুরেন দেখে মাত্রই কয়েক লাইনের চিঠি।
"স্নেহের ভাই, 
আমার শরীর-বেচা টাকায় চলতে তোর লজ্জা করে জানি। কিন্তু কী করব বল, মা যখন মারা গেছে তুই তখন ছোটো। তোকে মানুষ করে তুলব কথা দিয়েছিলাম মায়ের মৃত্যুশয্যায়। কেউ তো আমাকে একটা চাকরিও জুটিয়ে দেয়নি। সেই যোগ্যতাও হয়তো আমার ছিল না। বুবাইদাকে ভরসা করেছিলাম কাজ জুটিয়ে দেবে বলে। সে আমাকে এই কাজ জুটিয়ে দিল। বাবার টেলারিং এখন আর চলে না রে। আমিই তাই সংসার টানার দায়িত্ব নিলাম। এছাড়া আর তো কোনো উপায় ছিল না।
তুই মানুষ হ ভাই। অনেক বড় হ। আমি তোদের সামনে থেকে চিরকালের মতো সরে গেলাম।
ইতি রমা।"
হাসপাতালের বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। অসময়ের বৃষ্টি।

২টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র