শ্রীময়ী চক্রবর্তী

মায়াজম
0

অকাল বসন্ত




মি শ্রীমতী ননীবালা দাসী পঞ্চাশটি বসন্ত অবলীলায় পার করিয়া অকস্মাৎ প্রেমে পড়িয়া গেলাম। আমি সরকার বাড়ির কন্যা দত্ত বাড়ির বধূ,কায়েৎ বাড়ির মেয়ে আমার কিনা এরূপ দৈব দুর্দশা? পোড়া কপাল আমার সে হতচ্ছাড়া প্রেম ও কিনা ঘটিল আমার পঁয়ত্রিশ বছরের পুরনো পতি শ্রীযুক্ত বাবু ধরণীধর দত্তের প্রতি ? অকস্মাৎ আমার হৃদয় তোলপাড় হইতে লাগিল, চারিপাশে যেন অকাল বসন্তের হোরিখেলা। তাঁহাকে আমি চক্ষে হারাইতে লাগিলাম। প্রথমে লুকাইয়া দেখিলাম ,তারপর আড়চোখে দেখিলাম। মন ভরিল না মনে হইল জীবনে প্রথম বার দেখিতেছি। দর্শনাকাঙ্খা আরো বাড়িয়া গেল।তারপর হাস্যবিম্বিত মুখে পূর্ণ দৃষ্টি তে তাঁর রূপসুধা পান করিতে লাগিলাম। অনুভবে বুঝিলাম যে আর যাই হোক রূপবান তাঁকে বলা যায়না। রঙটি বড়ই ঘোর,বিরলকেশ মস্তক,হস্তি চক্ষু নিকেলের পুরু চশমায় প্রায় অদৃশ্য, নস্য নেওয়ার ফলে কিঞ্চিত সানুনাসিক স্বর। লক্ষ্য করিতেছিলাম আমার প্রানপ্রিয় পতি আমার এরূপ আচরণে মোটেই মুগ্ধ হইতেছেন না। তিনি প্রথমে ভাবিয়াছিলেন তাঁহার মস্তকে বুঝি বায়স কোষ্ঠ পরিষ্কার করিয়াছে বা তদ্রূপ কিছু ঘটিয়াছে। কিন্তু আমার মনোভাব বুঝিয়া নিরতিশয় ভীত হইয়া উঠিলেন। তবু প্রণয়ের ধর্ম এই যে অপরের চক্ষে নিজেকে সুন্দর দেখিবার প্রবল বাসনা অনিবার্য।আমি তাঁহার চক্ষে বিভ্রম সৃষ্টি করিবার নিমিত্ত কাজল আঁকিলাম,তম্বুলের রসে ওষ্ঠ সিক্ত করিলাম , তাহার পর ঢাকাই মসলিন শাড়িটি পড়িয়া তাঁহার পাশে গিয়া মৃদু মৃদু স্বরে রাধা কৃষ্ণের রসকীর্তন শুরু করিলাম। রাত্রি প্রথম প্রহরে তখন প্রিয়তম সিকি রতি আফিম খাইয়া ঝিমাইতেছিলেন। হঠাৎ আমার এ হেন আচরণে চমকিত হইয়া পুলিশ পুলিশ করিয়া চিৎকার করিয়া উঠিলেন। পুত্র , পুত্রবধূ, পৌত্র পৌত্রী গন এবং গুচ্ছের দাস দাসী যে যেখানে ছিল পড়িতে মরিতে আসিয়া উপস্থিত হইল। এবং লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। বুঝিলাম তিনি আমায় প্রীতি করেন না এবং ভালোবাসিয়া কেউ কখনো সুখী হয় নাই। পরিজনেরা বুঝিল গিন্নির মাথাটি পুরোপুরি বিগড়াইয়া গিয়াছে। বড় বৌমা কবরেজ মশাই কে অব্দি ডাকিয়া পাঠাইলেন।তিনি আসিয়া দেখিয়া শুনিয়া বলিলেন প্রেম রোগের কোনো ওষুধ তাঁহার জানা নাই। এবং স্বামী স্ত্রী র প্রেমে বাধা দেওয়া ঈশ্বরের ইচ্ছা র বিরুদ্ধাচরণ করা মাত্র। 
মধ্যম পুত্রবধূ র পিত্রালয় এবং আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা র শ্বশুরালয় অভিন্ন। অতএব এ সংবাদ অচিরাৎ তাহার কর্ণেও পৌঁছিল। এইরূপ অপূর্ব সংবাদ শ্রবণ মাত্র সে উতলা হইয়া তড়িঘড়ি ব্যাপার দেখিতে আসিয়া উপস্থিত হইল। আমার এরূপ বিচলিত দশা দেখিয়া জ্যেষ্ঠা নিদান দিল ওঝা ডাকাইয়া প্রেমের ভুত ঝাড়াইতে হইবে। বাকীরাও নিজেদের বিচার বুদ্ধি মতো জল পড়া , তেল পড়ার প্রভৃতি নানাবিধ ব্যবস্থা করিবার পরামর্শ দিতে লাগিল। এমন সময় আমার ছোট পুত্রবধূ পিত্রালয় থেকে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার সহিত সদ্যজাত তাহার প্রথম সন্তান , আমার পৌত্র। সে আসিয়া সেই তিন মাসের শিশুকে আমার কোলে স্থাপিত করিল। অকস্মাৎ আমার সকল প্রেম পতিকে ছাড়িয়া ধাবিত হইল পৌত্রটির প্রতি।দেখিলাম সে তাহার ক্ষুদ্র মুঠিটিতে আমার আঙ্গুল টি ধরিয়া তাহার মুখে পুরিবার উপক্রম করিতেছে। আমি ফিরিয়া পাইলাম আমার লুপ্তপ্রায় ব্যক্তিত্ব কে ।গলা তুলিয়া বলিলাম " এতত্ বেলা অব্দি একেনে কি রঙ্গ হচ্চে শুনি,যাও সব নিজের নিজের কাজ দেকো।"তারপর কর্তার দিকে চাহিয়া বলিলাম " আজ কি গদিতে বসতে হবেনা , কাজকর্ম কি সব লাটে উঠেছে নাকি?"। আমার এরূপ চিরপরিচিত বাক্য বিন্যাসে কর্তা যারপরনাই আহ্লাদিত হইলেন বুঝিতে পারিলাম। পরিবার পরিজনদের ও যেন ঘাম দিয়া জ্বর ছাড়িল। আমি ক্ষুদ্র মানবকটিকে বুকে জড়াইয়া গলা হইতে গোট চেন খানি খুলিয়া পরাইয়া দিলাম। দেখিলাম কর্তা আমার দিকে তাকাইয়া মিটি মিটি হাসিতেছেন .... জানিলাম প্রণয়ে সুখ হয় বৈকি 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)