ঈপ্সিতা চক্রবর্তী - মায়াজম

Breaking

৩১ মার্চ, ২০১৭

ঈপ্সিতা চক্রবর্তী


মোহনা





মি পারবো না অনুপম|
পারবে না মানে? প্লিজ পর্ণা আমি এমন কিছু চাইনি যেটা তুমি দিতে না পারো| 
তুমি যেটা চাইছো সেটা অত্যন্ত অনৈতিক|
হয়তো তাই পর্ণা কিন্তু কোনও উপায় তো নেই| তুমি শুধু নিজের কথা ভাবছো কেন একবার ওর কথাটা ভাবো| 
ওর কথা ভেবেই তো বলছি অনুপম এ আমি কিছুতেই পারবো না|
পর্ণা এখনো তেমন কষ্ট হবে না বিশ্বাস করো আর তাছাড়া আমাদের কাছে সুযোগ তো আছেই| কিছুদিন পর নাহয় আবার
আর তখনও যদি এইরকম হয়! তখন কি আবার এই একই জিনিস হবে?
তখনেরটা তখন দেখা যাবে পর্ণা| এখন রেডি হয়ে নাও ডঃ মিত্রের সাথে কথা বলা আছি বেশিক্ষণ সময়ও লাগবে না| জানো পর্ণা ভাবছি নেক্সট উইক তোমাকে নিয়ে কাশ্মীর ঘুরে আসবো দেখবে ফিরে এসে এক্কেবারে ফিট হয়ে গেছ| তারপর নতুন করে জীবন শুরু করবো দু'জনে|
অ্যাপয়েন্টমেন্টটাও করে রেখেছ? তার মানে আমার মতামতের কোনও মূল্য নেই?
এই শোনো অনেক হয়েছে| পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে এসো| পর্ণা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি সেই আগের মতোই আর তাই তোমাকে বোঝাতে চাইছি এই লড়াইটা সহজ হবে না| আর আমি এর জন্য প্রস্তুত নই মোটেই| তাই তোমাকে যে কোনো একটা বেছে নিতে হবে হয় আমাকে নয়তো ওকে|
আচ্ছা অনুপম এই বাচ্চাটা যদি এমন না হয়ে সুস্থ হত তবুও কি তুমি এইভাবেই বলতে?
কখনোই না পর্ণা| আমরা তো বাচ্চাই চেয়েছিলাম কিন্তু এ তো সুস্থ নয় তাহলে কেন একে পৃথিবীতে এনে কষ্ট দেওয়া? তুমিই ভাবো ও যখন আর দশজন সুস্থ বাচ্চাকে ছুটতে দেখবে, খেলতে দেখবে অথচ নিজের অথর্ব শরীরটাকে নিয়ে নড়তে পারবে না তখন কি ওর কষ্ট হবে না!
অনুপম আমি যদি রাজি না হই? আমি যদি এই লড়াইটা লড়তে চাই তখন?
তাহলে তোমাকে নিজের আর তোমার বাচ্চার সব দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে| আমাকে পেতে গেলে তোমাকে ওকে ছাড়তে হবে তাহলে তুমি যা চাইবে আমি তাই দেব তোমাকে| লক্ষ্মীটি এবারে যাও রেডি হয়ে নাও|
আমি দায়িত্ব নিতে রাজি|
মানে?
আমি নিজের আর অর্কর দায়িত্ব নিতে রাজি|
অর্ক কে?
আমার ছেলে| আমি জানি ও ছেলেই, ও আমার অর্ক| আমি ওকে মারতে পারবো না| আমি লড়বো ওর সাথে, ওর জন্য| তুমি পিতৃত্ব অস্বীকার করতে পারো কিন্তু আমি মা আমি নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারবো না|
ও তাই নাকি! তাহলে আজ এক্ষুণি তোমাকে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে পর্ণা|
বেশ তাই হবে|
যাবে কোথায়? তোমার দাদা তোমায় আশ্রয় দেবে ভেবেছ?
দেবে না জানি| কোথায় থাকবো জানি না| কি করবো, কোথায় যাবো কিছুই জানি না| কিন্তু অর্ককে ছাড়তে পারবো না|
আর আমি? আমার ভালোবাসা? পর্ণা আমার থেকে বেশী আপন হয়ে গেল ও তোমার? এতগুলো বছর একসাথে কাটানোর পরও তুমি আমার একটা ছোট্ট অনুরোধ মানতে পারলে না!
অনুপম আমি সারাজীবন তোমাকে ভালোবাসবো কিন্তু তোমায় অন্যায় জেদ মানতে পারবো না| যেমনই হোক তবু আমার সন্তান, আমার অংশ আমি ওকে মারতে পারবো না|
পর্ণা তুমি লড়তে প্রস্তুত তাহলে?
সে তো কবে থেকেই| যেদিন ডঃ মিত্র প্রথম আমাকে বলেছিলেন যে ওর মধ্যে ডাউন সিনড্রোম আছে আমি সেই মূহুর্ত থেকেই একটু একটু করে নিজেকে শক্ত করেছি| 
পর্ণা আরেকবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ| এই রাস্তায় একবার এগোলে আর পেছন ফিরে তাকানোর উপায় থাকবে না| আজ যেটা সহজ মনে হচ্ছে সেটাই কাল কঠিন বাস্তব হয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে|
আমার আর ভাবার নেই কিছু অনুপম|
ঠিক আছে| তুমি যদি এটাই চাও তাহলে তাই হোক| আমরা কালই আলিপুরের ফ্ল্যাটে সিফট করে যাব| 
আমরা?
হ্যাঁ কেন!
আমি তো চলে যাচ্ছি অনুপম|
সে যাবে যাও| ডেলিভারির পর অর্ককে আমার কাছে দিয়ে তারপর যেও|
অনুপম?
পর্ণা ষোল বছরের সম্পর্ক আমাদের| এগারো বছরের প্রেম, পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে এই চিনলে তুমি আমাকে? আমি শুধু দেখতে চাইছিলাম তুমি ওর জন্য কত দূর যেতে পারো| পর্ণা সামনের রাস্তাটা খুব কঠিন| সেই কঠিন রাস্তায় পা দেওয়ার আগে আমি দেখতে চাইছিলাম তুমি কতখানি প্রস্তুত| এই লড়াইটা আমাদের লড়াই পর্ণা আর আমরা তিনজনে শুধু লড়বো না জিতবোও দেখে নিও|
এই ঘটনার পাঁচ বছর কেটে গেছে| অর্কর জন্মের দু'বছর পর এক অ্যাক্সিডেন্টে অনুপম আর অর্ক দুজনেই চলে গেছে| একা পর্ণা রয়ে গেছে শুধু| প্রথম প্রথম অনেক চেষ্টা করেছে নিজেকে শেষ করার কিন্তু যতবারই চেষ্টা করেছে ততবারই অর্ক আর অনুপম সামনে এসে দাঁড়িয়েছে| তারপর একদিন সব বিক্রি করে দিয়ে পর্ণা এই হোম তৈরী করেছে| "মোহনা"তে প্রায় তিরিশজন ডাউন সিনড্রোমের বাচ্চাদের নিয়ে আজ তিনবছর পর্ণার সংসার| অর্কর ভাগের মাতৃত্ব এই তিরিশজনকে বিলিয়ে দিয়ে পর্ণা ওদের সবার মামনি হয়ে উঠেছে| মাঝে মাঝে আজও অনুপমের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মনেই বলে "হ্যাঁ অনুপম আমি এই লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত"|

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র