নির্মাল্য বিশ্বাস - মায়াজম

Breaking

১১ আগ, ২০১৭

নির্মাল্য বিশ্বাস

শেষ দেখা
***********



- এত অপমানের পরেও তুই রঞ্জনের সাথে দেখা করতে যাবি? 

ছিঃ! তোর লজ্জা করে না?

পৃথা হাসে। গোধূলির অস্তমিত সূর্যের আলোমাখা সেই হাসি। হাসিমাখা মুখেই বলল- ভালবাসায় লজ্জা কীসের তপতী? 
তপতীর স্বর চড়ল। 
- কীসের ভালবাসা? ও তোকে ভালবাসে না। ভালবাসার প্রশ্নই নেই। ও বিবাহিত। তাহলে কেন মিছিমিছি ওর পেছনে পড়ে আছিস? একতরফা ভালবাসা হয় কখনো? 
তেমনি শান্ত স্বর পৃথার। 
- জানি রে। একতরফা কোনোকিছুই সম্ভব নয়। না ভালবাসা, না বন্ধুত্ব। তবে আমি এই শেষবারের জন্য ওর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। 
তপতী কিছুটা বিরক্ত কন্ঠে বলল, 
- যাবি যা। আমার কিছু বলার নেই। মনে রাখিস আমিই কিন্তু রঞ্জনের সাথে তোর পরিচয়টা করিয়ে দিয়েছিলাম। তখন তো যেতেই চাইছিলিস না। জোরাজুরি না করলে দেখাই হত না তোদের। 
তপতীর কাঁধে হাত রাখে পৃথা। 
- এই তোর গা ছুঁয়ে বলছি এরপর আর কখনো যাব না, কক্ষনও না। প্রমিস। 
- কিন্তু যে মানুষটা তোকে এত অপমান করল, যা নয় তাই বলল সেই মানুষটার প্রতি তোর এত ভালবাসা থাকে কী করে? 
- আমি তো রঞ্জনের থেকে কোনো কিছু প্রত্যাশা করিনি। চেয়েছি নীরবেই ওকে ভালবেসে যেতে। বিশ্বাস কর তপতী, ও আমাকে অপমান না করলেই বরং অবাক হতাম। প্রথম যেদিন রঞ্জনকে দেখলাম সেদিনই মনে মনে ওকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। আর ওই অপমানের পর মানুষটাকে আরো বেশি করে ভালবেসে ফেলেছি। 
- পাগলি তুই একটা। জাস্ট ফুল ম্যাড। তবে মনে রাখিস এই শেষবার কিন্তু তুই ওর সাথে দেখা করবি। না হলে হয় তোর লাইফে রঞ্জন থাকবে নয়তো আমি থাকব। আমাকে ছুঁয়ে বলেছিস কিন্তু। 
- সত্যি রে। বিশ্বাস কর। এই শেষবার....
(২) 
সেদিন তপতী জোরাজুরি না করলে সত্যিই যাওয়া হত না পৃথার। রবীন্দ্রসদনে রঞ্জনের গীটারের প্রোগ্রাম ছিল। তপতীর সাথে রঞ্জনের পরিচয় ফেসবুকে। গত বছর ওর একটা গীটারের প্রোগ্রামে তপতীকে ইনভাইট করে রঞ্জন। সেই থেকেই দুজনের বন্ধুত্বটা ভার্চুয়াল লাইফের বেড়া টপকে রিয়েল লাইফে প্রবেশ করল। তারপর থেকে বড় কোনো গীটারের প্রোগ্রাম হলেই পাস পাঠাত রঞ্জন। খুব বেশি অসুবিধা না থাকলে তপতীও যেত।সেবার খুব ইচ্ছা হল তপতীর, সঙ্গে করে পৃথাকেও নিয়ে যাবে।তাই দু'টো পাস পাঠাতে বলল রঞ্জনকে।পাস তো এল।কিন্তু পৃথা কিছুতেই যাবে না।গীটার শুনতে ওর ভালো লাগে না।গীটারের সুর শুনলেই ওর অনেকদিনের হারিয়ে যাওয়া এক সুরের কথা মনে পড়ে, বিশেষ করে ইলেকট্রিক গীটারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর।তবু একরকম জোরজার করেই তপতী ধরে নিয়ে গেল পৃথাকে।

দক্ষ শিল্পীর মতো ইলেকট্রিক গীটারের তারে আঙুলের ছোঁয়ায় একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর বাজিয়ে চলেছে রঞ্জন।মোহাবিষ্টের মতো সেই মীড় শুনতে শুনতে প্রায় বিশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া কোনো এক বিস্মৃতির রাজ্যে হারিয়ে গেল পৃথা।
.......শোভাবাজারের পুরনো পলেস্তারা খসা বাড়িটার একতলার ঘরে একটা সতেরো-আঠারো বছরের ছেলে এইভাবে আপনমনে সুরের মূর্ছনা তুলত গীটারের তারে। সেটা শুনতে শুনতে এক পনেরো বছরের মেয়ে একছুটে নীচে নেমে আসত।তবে বেশিরভাগ সময়ই সেই ঘরে বসে গীটার শোনার সৌভাগ্য হত না মেয়েটার।ঘরে সেই ছেলেটার বন্ধুবান্ধবরাও থাকত। বন্ধুবান্ধবদের সামনে তার ভালবাসার মানুষ আসুক এটা ছেলেটার একদমই না- পসন্দ। তাই মেয়েটা ঘরে আসলেই বলে দিত, ' এখানে কী আছে? যাও নিজের ঘরে'। 
অভিমানে মেয়েটার দু-গাল বেয়ে জলের ধারা নামত।দুদ্দাড় করে দোতলার ঘরে ছুটত। তবু, কান পেতে থাকত নীচের ঘরটার দিকে। সেই মেয়েই পৃথা আর ছেলেটি তার ভালবাসার মানুষ, প্রথম প্রেম অনুপ।
সেসব যেন অনেক পুরানো দিনের আবছা মনে পড়া কোনো এক রূপকথার গল্প আর পৃথা সেই রূপকথার রাজকুমারী। পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চড়ে তার স্বপ্নের অভিসার স্বপ্নপুরুষের সাথে। তারপর সেই রাজপুত্র একদিন পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চেপে ভিনদেশে চলে গেল। এ দেশে যখন সূর্য ওঠে সেদেশে তখন সূর্য ঢলে পড়ে অস্তাচলে। ভূগোলের পাতায় পড়া সুদূর উত্তর আমেরিকার টেক্সাসে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে গেল অনুপ। আর পৃথা বন্দিনী রাজকন্যার মতো একাকী পড়ে রইল ভাড়াবাড়ির ওই ছোট্ট ঘরটাতে। 
অনেক অনেক চিঠি লিখল পৃথা। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সেই চিঠি অনুপের হাতে পৌঁছল না। অনেক কাঁদল পৃথা। সেই কান্নার খবর শুধু ওর রাতের বালিশই জানল। তারপর একদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে অনুপ সত্যি সত্যিই দেশে ফিরল। সঙ্গে নিয়ে এল মেমবউ। এইরকম কিছু একটা ঘটনা যে ঘটেছে সে খবরটা আগাম আঁচ করেই ফেলেছিল পৃথা। তাই অনুপরা এলে স্বাভাবিক আচরণ করারই চেষ্টা করল।যদিও বুকের ভিতর সাহারা মরুভূমিতে তখন মরুঝড় উঠেছে।

পরে, অনেক পরে অনুপ একদিন পৃথাকে একান্তে বলেছিল ঠিক কোন পরিস্থিতিতে ও বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছিল; মনে মনে ও এখনও পৃথাকেই ভালবাসে। পৃথা ওই প্রসঙ্গের ওখানেই সমাপ্তি টেনেছে। যে মানুষ একবার অন্যের হয়ে যায় তাকে আর নিজের করা যায় না কখনও। পৃথা সে চেষ্টাও করেনি। বিদেশে গিয়ে মানুষটাও কেমন যেন বদলে গেছে। সেই সরল, নিষ্পাপ চাহনিটাও আর নেই। এক মাথা ঝাঁকড়া চুলের যে ছেলেটাকে দেখেছিল পৃথা, সেই মানুষটার বদলে আজ একজন গম্ভীর, রাশভারি মানুষকে দেখছে। নামটাই যা শুধু এক আছে। বদল ভিতরে ও বাইরে দু' জায়গাতেই হয়েছে। সব থেকে বদল যেটা হয়েছে সেটাতেই পৃথার সব চাইতে বেশি দুঃখ।যে গীটারটা ছেলেটার প্রাণপ্রিয় ছিল, আজ সেই গীটারের সুরটাই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।অনভ্যাসে সেই গীটারের তারে মরচে ধরেছে। অনেক চেষ্টা করেও সেই তারে আঙুলের ছোঁয়ায় আর ' পুরানো সেই দিনের কথা' বের হল না।
তারপর অনুপ ফিরে গেছে বিদেশে। ওখানেই পাকাপাকিভাবে থেকে যাবে মনস্থির করে নিয়েছে। একটা গ্রহ আচমকাই কক্ষচ্যুত হয়ে অন্য গ্রহের কাছাকাছি চলে এসেছিল।তারপর জাগতিক নিয়মে আবার ফিরে গেছে আপন কক্ষপথে। 
পড়াশোনার পাট শেষ করে শহরতলিতে স্কুল মাস্টারের চাকরি নিয়েছে পৃথা। ওদের বাড়ি থেকে স্কুল প্রায় আড়াই ঘন্টার রাস্তা। ওই স্কুলের কাছাকাছি একটা হস্টেলে তপতীর সাথে রুম শেয়ার করে থাকে। সপ্তাহে একদিন বাড়ি আসে। নতুন কোনো মানুষ আসেনি পৃথার জীবনে যে নতুন করে পৃথার জীবনটাকে আবার সুরের দোলায় দুলিয়ে দিতে পারে। বলা ভালো পৃথাই চায়নি ওর জীবনে কেউ আসুক। 
তারপর যেদিন রবীন্দ্রসদনে রঞ্জনের ইলেকট্রিক গীটারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর শুনল, সেদিন ওর জীবনটা আবার কেউ যেন এক ধাক্কায় এলোমেলো করে দিল। তন্ময় হয়ে গীটারের তারে আঙুলের জাদুতে সুর তুলেছিল রঞ্জন- " যে রাতে মোর দুয়ারগুলি.. ", " জাগরণে যায় বিভাবরী", " তুমি রবে নীরবে"। শেষে যখন " মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে" বাজাল, তখন পৃথার দু'গাল বেয়ে শ্রাবণের ধারার মতো বারিধারা ঝরছে। যন্ত্রে সুর তো অনেকেই বাজায় কিন্তু এমনভাবে গীটার বাজাচ্ছিল রঞ্জন মনে হচ্ছিল যেন কেউ গানই গাইছে। হৃদয়ের কোন গোপন গভীরতম স্থানে কেউ যেন অজান্তে মাটি খুঁড়ে চলেছে পৃথার।
(৩) 
পৃথার দিকে চেয়ে তপতী অবাক। 
- কীরে কাঁদছিস কেন? 
- কিছু নয় রে। অনেকদিন পর এমন সুর শুনলাম যেটা একেবারে মর্মে গিয়ে লেগেছে। তাই চোখ দিয়ে ওগুলো বেরিয়ে এসেছে।তুই একবার আমাকে ওনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি? 
- সে না হয় দেব। কিন্তু তোর হল কী? প্রেমে-ট্রেমে পড়ে গেলি না তো আবার? দেখিস বাবা ও কিন্তু ম্যারেড মনে রাখিস।
হাসতে হাসতেই চোখ টিপল তপতী।
- ধুর! আমি এমনিই আলাপ করে ওনাকে
ধন্যবাদ জানাব।

রঞ্জনকে সামনাসামনি দেখার পর পৃথার মন এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে গেল। কী সহজ সরল ব্যবহার! কী অমায়িক কথাবার্তা। ওর পাশে দাঁড়িয়ে তিনজনে মিলে একসাথে অনেকগুলো সেলফি তুলল। বাড়ি গিয়েই ফেসবুকে পোস্ট করতে হবে।এমন অসাধারণ একটা মুহূর্তের সঙ্গী থেকেছে ফেসবুকের বন্ধুদের না জানালে রাতে ঘুমই আসবে না। যদিও ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেও রাতে ঘুম এল না। গানের সুরগুলো মনের মধ্যে অনুরণন তুলতেই থাকল। 
রঞ্জনের বেশ কিছু গীটারে বাজানো রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম আছে। তপতীর থেকে সেই অ্যালবামের ইউটিউবের লিঙ্ক নিল। সেগুলো মোবাইলে ডাউনলোড করে কানে হেডফোন গুঁজে চলল " জাগরণে যায় বিভাবরী"।

ঘুম ভাঙল যখন অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মনটা ভরে উঠেছে।ভোররাতের দিকে কখন দু' চোখ বুজে এসেছে বুঝতে পারেনি পৃথা।ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই রঞ্জনের স্বপ্ন দেখছিল। একটা সুন্দর ম্যাপল গাছের পাতা বিছানো রাস্তা।সেই রাস্তাটার শেষ প্রান্ত বোধহয় স্বর্গে গিয়ে মিশেছে। একটা গাছের নীচে বসে আপনমনেই গীটার বাজিয়ে চলেছে রঞ্জন। ম্যাপল গাছের পাতাগুলো টুপটাপ করে ঝ'রে পড়ছে মাথার ওপর আর সেই গাছের ফাঁক দিয়ে ভোরের প্রথম সূর্যের জবাকুসুম আলো রঞ্জনের চোখেমুখে এসে পড়েছে। রঞ্জনের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে পৃথা শুনছে, " বঁধু কোন আলো লাগল চোখে"...
ঘুম ভাঙতে নিজের মনেই হাসল খানিক। কী যা-তা স্বপ্ন রে বাবা! রঞ্জন বিবাহিত জেনেও ও এইসব স্বপ্ন দেখছে?তপতীকে বললে জোর ধমক লাগাবে। তবে স্বপ্নের ওপর মানুষের মনের নিয়ন্ত্রণ থাকে কি? কত কিছুই তো স্বপ্নে দেখে পৃথা। সমুদ্রের নীল তিমির সাথে খেলা করছে কিংবা মরুভূমির মধ্যে দিয়ে একা হেঁটে যাচ্ছে, তবু কারোর দেখা নেই- এইরকম আজগুবি স্বপ্ন। বাস্তবের সাথে কোনো মিল নেই। তবে এটা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই যে স্বপ্নটা দেখার পর পৃথার মনটা সত্যিই কেমন এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে গেছে। মনে হচ্ছিল ঘুমটা আজ না ভাঙলেই বোধহয় ভালো হত। তাহলে স্বপ্নটা আরো অনেক বড় হত। 
(৪) 
আজ স্কুল ছুটি। সারাদিন ফেলে ছড়িয়ে সময় কাটাবার অখন্ড অবসর। ছুটির দিনগুলোয় গল্পের বইয়ে মুখ গুঁজেই কাটিয়ে দেয় পৃথা।আজ মনটা কেমন প্রজাপতির মতো উড়তে ইচ্ছা করছে। সারাটা সকাল রঞ্জনের গীটার শুনেই কাটল।বেলার দিকে ইচ্ছা হল রঞ্জনকে একবার ফোন করার। কেন জানি খুব কথা বলতে ইচ্ছা করছে।কিন্তু রঞ্জন আবার যদি কিছু মনে করে? দূর! বেশি কিছু তো বলবে না। অ্যালবামের গানগুলো ভালো লেগেছে শুধু সেটুকুই জানাবে। কিন্তু ফোনটা যদি ওর বউ ধরে? তখন কী বলবে মনে মনে ঠিক করে নিল পৃথা। তারপর করব কী করব না করতে করতে ফোনটা করেই ফেলল। রিং হচ্ছে। বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে।ফোন ধরেছে। অন্য কেউ নয়, যাকে ফোনটা করা সেই-ই। ফোন ধরে বলল, 
- কী ব্যাপার? এত সকালে কী মনে করে? 
- ডিস্টার্ব করলাম বুঝি? জানি আপনি খুব ব্যস্ত মানুষ।
- না না ডিসটার্বের কী আছে? আমার গীটারের ক্লাস তো এখন শেষ হয়েই গেছে। ছুটির দিনে তো এরপর কোনো কাজও নেই। 
পৃথা মনে মনে বলল, ছুটির দিনে কাজ নেই যখন চলেই এসো না আমার হস্টেলে। সারাদিন গীটার শুনব, আড্ডা মারব আর হোটেল থেকে বিরিয়ানি আনিয়ে একসাথে খাব। 
ধুর! কী আবোল-তাবোল ভাবনা! রঞ্জনের বউ নিশ্চয়ই ছুটির দিনে রঞ্জনকে খাওয়াবে বলে বাড়িতে ভালো ভালো রান্না করেছে।সেসব ছেড়ে রঞ্জন এখন পৃথার কাছে আসতে যাবে কোন দুঃখে? মুখে বলল, 
- কাজ নেই যখন বউদিকে রান্নায় হেল্প করুন।
- দূর, তোমার বউদি রান্নাবান্না অত পারে না। কাজের লোকই রান্না করে। তাছাড়া ও খুব অসুস্থ। 
- কী হয়েছে বউদির? 
- ওর অনেক সমস্যা। বহুদিন থেকেই ভুগছে।যাক, তুমি আমায় কী মনে করে ফোন করলে বলো। 
- কেন ফোন করতে পারি না বুঝি? ঠিক আছে আর করব না। 
ছদ্ম কোপে কথাটা বলে মনে মনে হাসল পৃথা। 
- আরে, না না তা কেন? আমি ভাবলাম কোনো দরকার আছে বুঝি? 
- না এমনিই করলাম।আসলে গতকাল আপনার গীটার শুনে এত ভালো লাগল যে তপতীকে বলছিলাম- আপনি এত ভালো বাজান আগে বলেনি কেন। ওই আমাকে আপনার গীটারের অ্যালবামগুলোর ইউটিউব লিংক দিল। কাল থেকে শুধু ওগুলোই শুনে যাচ্ছি।

- কী এত ভালোলাগার আছে ওগুলোর মধ্যে?
- সে আপনি বুঝবেন না। 
- তাহলে একটু রয়েসয়ে শুনো। একই জিনিস বার বার শুনলে কান পচে যাবে। তখন আর ভালো লাগবে না।

মুখে বলল বটে কথাটা, কিন্তু তৃপ্তিটুকু দু'কান ভরে শুনল।
- ভালো লাগার জিনিস ভালোই লাগে চিরদিন। সেটা পুরনো হয় না কখনও। 
- বাহ তুমি খুব সুন্দর কথা বলো তো। কথায় তোমার সাথে পারা খুব মুশকিল।

তা এই সুন্দর কথা বলার জন্যই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, পৃথার মার্জিত, পরিশীলিত কথাবার্তা রঞ্জনের মনকে এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরিয়ে দিল। রঞ্জন অনুভব করে, কোনো একটা 
জায়গায় ও একা। ভীষণভাবেই একা। পরিবারের সকলের মাঝে থেকেও ও ভীষণরকম নিঃসঙ্গ। এই নিঃসঙ্গ হৃদয়ের অস্তিত্ব কেউ জানে না। সেটা শুধু রঞ্জন দত্ত একাই জানে। 
(৫) 
নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্যই রঞ্জন মাঝে মাঝে ফোন করে পৃথাকে।আর পৃথা তো রঞ্জনের ফোনের অপেক্ষাতেই থাকে সারাক্ষণ। চার পাঁচ দিন হয়ে গেলে রঞ্জনের ফোন না এলে নিজেই ফোন করে। ফোন করা ছাড়াও হোয়্যাটস অ্যাপে প্রচুর কথা হয়। সম্পর্কটা এখন দু' তরফেই তুমিতে এসে ঠেকেছে।

ব্যক্তিগত জীবনের সব কথাই বলে পৃথা ; এমনকী অনুপের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলোর কথাও।যত দিন যায় অনুপের ছায়াটা দীর্ঘতর হতে থাকে, হতেই থাকে। সে ছায়ায় বসে পৃথা দু'দন্ড জিরোতে চায়। তপতীর সাথে রঞ্জনের অনুষ্ঠানে যাওয়া ছাড়াও দু- একবার একাই সিসিডিতে দেখা করেছে রঞ্জনের সাথে।রঞ্জন তো চাকরি-বাকরি কিছু করে না।সপ্তাহে একদিন গীটারের টিউশন, মাসে গোটা কুড়ি প্রোগ্রাম আর মাঝে মাঝে রেকর্ডিং এর কাজ।এই হল রঞ্জনের শিডিউল।রোজগারপাতি যা হয় তাতে মধ্যবিত্ত পরিবারে চলে যায়। ফলে হেসেখেলে সময় কাটানোর মতো অনেকটা সময় পড়ে থাকে। তবু দেখা করার জন্য একরকম জোরাজুরিই করতে হয় ওকে। সারাদিন বাড়িতে কী এত কাজের মধ্যে ডুবে থাকে কে জানে? সারাক্ষণ গীটারেই আত্মমগ্ন থাকে? নাকি বাড়ির অন্য কাজও সামলাতে হয় রঞ্জনকে? ও বলেছিল, ওর বউ অসুস্থ। তাহলে কি বাড়ির রান্নাবান্না, বাজার হাট সব একা হাতেই করে? বউয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে একরকম এড়িয়েই যায় কিংবা দায়সারা জবাব দেয়, বিশেষ করে ওর অসুস্থতার খবর।
দু- একবার ডেটিংয়ে বেরনোর পরই রঞ্জনের আচরণে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে পৃথা। ফোন করলে ধরে না। ধরলেও বিরক্তিভরে উত্তর দেয়। এমন রুক্ষ কাঠকাঠ জবাব রঞ্জনের থেকে কখনো প্রত্যাশা করেনি পৃথা। রঞ্জনের কী হল হঠাৎ করে? সম্ভাব্য কারণগুলো ভেবেই চলে পৃথা। এই অল্পদিনেই ওর প্রতি আগ্রহ কি হারিয়ে ফেলল রঞ্জন? নাকি কথাবার্তা যা কিছু জানার কিংবা শোনার ছিল সব ফুরিয়ে গেল? যদিও ভালোলাগাটা শুধু পৃথার দিক থেকেই একতরফা ছিল। তবু প্রথম প্রথম তো পৃথার সাথে যথেষ্ট আগ্রহ নিয়েই কথা বলত রঞ্জন।কথা বলায় এমন অনীহা চলে এল কি করে? পৃথা ভেবেই চলে। ভাবতে ভাবতেই মনে হয়, ইদানীং নিজের ভালবাসাটা বড্ড বেশি প্রকাশ করে ফেলছে রঞ্জনের কাছে আর এটাই হয়তো রঞ্জনের মনে বিরক্তি উৎপন্ন করছে। কত বার ভেবেছে নিজের ভালোলাগাটা এভাবে প্রকাশ করবে না।কিন্তু মন মানে না।রঞ্জন সামনে এলেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। ভালোলাগায় মন ভেজাতে ইচ্ছে করে।
সেদিন অনেক জোরাজুরির পর রঞ্জন এসেছিল সিটি সেন্টারে। তাও এক ঘন্টার জন্য থাকবে বলে দিয়েছিল আগেই। কেন তার বেশি থাকবে না সেটা প্রশ্ন করা যাবে না। করলেই বিরক্ত হয়ে জবাব দেবে কিংবা হয়ত আসবেই না। পৃথা চায়নি সেটা। চেয়েছিল জন্মদিনের দিনটা অন্তত একটু ভালোভাবে কাটাতে। রঞ্জনের সাথে কিছু মুহূর্ত একা কাটাতে চেয়েছে শুধু। তাই জন্মদিনে তপতীকেও বলেনি। রাতে ওর জন্য কিছু খাবার নিয়ে যাবে। তখন আবার ওর সাথে খেতে হবে খানিকটা। না হলে তপতী খাবে না। তাই এখন হালকা-ফুলকাই কিছু খাবে।
ফুডকোর্টে একটা মকটেল নিয়ে বসে আছে পৃথা। নির্দিষ্ট সময়ের আধঘণ্টা পরে রঞ্জন এল। বিরক্তি কাড়ছিল। তবু ঠিক করেই নিয়েছে প্রশ্ন করবে না কেন দেরি হয়েছে।জবাব যেটা আসবে সেটা যে মধুর কিছু হবে না সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে জবাব পৃথার বিরক্তিকে দশগুণ বাড়িয়ে দেবে।
তবু বলব না বলব না করেও একটা কথা বলেই ফেলল পৃথা, 
- একটা ভালো জামা-কাপড় জোটে না তোমার? একটা পুরনো ময়লা শার্ট পড়েছ। আয়রন করা নেই। আজকের দিনেও কি একটু ভালো কাপড় পরে আসতে নেই? 
- কেন ভালো জামা- কাপড় পরব কেন? আমি কি তোমার সাথে প্রেম করতে এসেছি যে ফিটফাট হয়ে, ফুলবাবু সেজে আসতে হবে? আর আজকের দিনটা কী? তোমার জন্মদিন তুমি পরবে। আমি পরতে যাব কোন দুঃখে? 
- জানি আমার ভালোলাগায় তোমার কিছুই এসে যায় না। তবু আমার ভালোলাগার জন্যই অন্তত আজকের দিনটায় একটু ভালো জামা- কাপড় পরে আসতে। 
- তোমার এই বোকাবোকা ভালোলাগাগুলো আমাকে ভীষণ টন্ট করে পৃথা। আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি শুধুমাত্র বন্ধুত্ব ছাড়া আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারব না। তাহলে মনের মধ্যে এরকম ভালবাসা পুষে রেখে কী লাভ তোমার? 
- আমার ভালবাসা আমি নিজের মনের মধ্যেই আটকে রেখেছি। তোমার কাছে কোনো কিছুর প্রত্যাশাও করি না কখনও। আমি চাই তুমি তোমার জীবনে সুখী থাকো। 
- তাহলে সবসময় কেন বলো- এটা পরেছ কেন? এখনও খাওনি কেন? সারাদিনে একটাও কথা বলনি কেন? এত কন্ডিশন থাকলে ফ্রেন্ডশিপ হয় কখনো? 
- তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? একে তো আধঘণ্টা দেরি করে এলে।আমি একটা মেয়ে একা একা বসে রইলাম।তাও সেটা নিয়ে একটা প্রশ্নও করিনি। আর হ্যাঁ, আসার জন্য আমি জোর করেছিলাম ঠিকই, সেটা জন্মদিন বলেই। তোমার আসার এত অনীহা জানলে বলতাম না। 
- তোমার এই নাটুকে কথাবার্তাগুলো বন্ধ করো। দেরি করে আসার কথা তো ঠারেঠোরে ঠিক শুনিয়েই ছাড়লে। কেন দেরি হয় সেটা জানার চেষ্টা করেছ? আমার বউ ক্যান্সার পেশেন্ট। অ্যাকিউট লিউকিমিয়া হয়েছে। ওর বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন করতে হবে বলে দিয়েছে ডক্টর। কয়েক লাখ টাকা খরচ।আমি চাকরি-বাকরি করি না। গীটারের প্রোগ্রাম আর টিউশন করে যেটুকু ইনকাম হয়, সেটাতে দুজনের চলে যায়।এখন এই ট্রিটমেন্ট কীভাবে হবে সেই চিন্তাতেই রাতদিন মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর তুমি সেখানে আসার সাথে সাথে এই ড্রেস পরনি কেন করে যাচ্ছ।
- আমাকে কোনোদিন বলেছ তোমার বউয়ের এই কন্ডিশন? 
- জানলে কী করতে তুমি? 
-জানলে তোমাকে আসতে বলতাম না। 
- তাহলে আসতে যখন বলেইছ তখন এরকম সিন ক্রিয়েট করার কোনো মানে ছিল কি? 
- সিন আমি করছি না রঞ্জন। চেয়েছিলাম জন্মদিনের দিনটা তোমার সাথে কাটাব শুধু তোমার একটু হাসিমুখ দেখব বলে। তুমি সেটাও দিতে পারলে না। 
- তোমার এই প্রেম প্রেম কথাবার্তাগুলো দিন দিন আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছে। তুমি জেনে রাখো, আমি আমার স্ত্রীকে ভালবাসি, তোমাকে নয়। 
- আমি জানি রঞ্জন। আমাকে ভালবাসতে বলিওনি কখনও। তোমার স্ত্রীর এই অবস্থা শুনলে আমি তোমাকে আসতে বলতাম না। কক্ষনো বলতাম না। আজকের দিনের জন্যও না।

একছুটে ওখান থেকে বেরিয়ে এল পৃথা।।ভিতরের আবেগটাকে প্রাণপণে চাপা দেওয়ার চেষ্টা যেন। নাহলে এখনই বিচ্ছিরি একটা কান্ড করে ফেলবে সবার সামনে।
(৬)

- তুই এখনও কাঁদছিস? 
- কোথায়?
- আমার কাছে লুকোবি? আমি তোর মুখের সব এক্সপ্রেশন বুঝি। তুই আমায় রঞ্জনের প্রতি তোর ফিলিংসটা আগে বুঝতে দিসনি। কিন্তু তুই না বললেও আমি বুঝেছিলাম।তোকে কম দিন তো দেখছি না। 
- তুই এত বুঝিস আমায়? আচ্ছা বল তো, এই চোখের জলটা কার জন্য? 
- কার জন্য আবার? রঞ্জনের জন্য। 
- না। এটা তোর জন্য। আমি জন্মদিনে তোকে না বলেই রঞ্জনের সাথে দেখা করতে গেছি রে। তোর কাছে লুকিয়ে গেছিলাম এই ভেবে তুই যদি আমার সাথে যেতে চাস। আমি চাইনি তুই আমাদের মাঝে থাক। চেয়েছিলাম ওইটুকু সময় ওর সাথে একাই কাটাই। আমি খারাপ, খুব খারাপ রে। ঈশ্বর তার শাস্তি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। 
- আমি জানতাম রে তুই রঞ্জনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিস। রঞ্জনের সাথে দেখা করতে গেলেই তোর মুখ-চোখের এক্সপ্রেশন বদলে যায়। তখন অনেকটা সময় নিয়ে সুন্দর করে সাজগোজ করিস। না হলে তুই নিজের ওপর যা ক্যাজুয়াল! 
- তুই আমায় কত বুঝিস! আমার সব কিছুর কত খেয়াল রাখিস, কেয়ার করিস আর আমি দ্যাখ তোর বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে পারলাম না কখনও। 
- তোর মতো মানুষ হয় না পৃথা। মাঝে মাঝে ঈশ্বরেরও মানুষ হয়ে পৃথিবী দেখার শখ হয়। তুই সেইরকমই এক মানুষ। তখন তার খেয়াল রাখার জন্য একজন মানুষকে থাকতে হয়। আমি না হয় সেই কাজটাই করি। 
- পৃথার দু'গাল বেয়ে জলের ধারা নামছে। গতকালই নার্সিংহোম থেকে বাড়ি ফিরেছে পৃথা। ওর অবশ্য প্রাণ সংশয়ের ভয় ছিল না। প্রাণ সংশয়ের ভয় যার ছিল সেও সুস্থ এখন। পৃথার বোন ম্যারো থেকে স্টেমসেল নিয়ে রঞ্জনের বউয়ের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। মাস দেড়েক আগে তপতীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পৃথা- শেষবারের জন্য রঞ্জনের সাথে দেখা করতে যাবে। সেদিনের সাক্ষাতের শেষে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছে পৃথা। নিজে ডোনার হতে চেয়ে রঞ্জনকে রাজি করিয়েছে ওর বউয়ের বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনে। আশ্চর্যের বিষয় দুজনের ব্লাডগ্রুপ থেকে এইচ.এল. এ সব মিলেও গেছে অদ্ভুতভাবে। নিজের জমানো যেটুকু টাকা ছিল সেটার বেশিরভাগটাই দিয়ে দিয়েছে পৃথা। ওই টাকা নিয়ে পৃথা কী করবে? ওটা না দিলে রঞ্জনের বউয়ের অপারেশন হবে না যে। রঞ্জন ওর বউকে ভালবাসে। ওর শরীর মনের সবটুকুই ভালবাসে। তার শরীর ছুঁয়ে রয়েছে পৃথার অস্থি, মজ্জার মধ্যে দিয়ে বইছে পৃথার রক্ত। সেগুলোকেও ভালবাসবে কি রঞ্জন?

গতকাল নার্সিংহোম থেকে পৃথাকে নিয়ে আসার সময় করিডোরে রঞ্জনের সাথে দেখা। হয়তো শেষ দেখাই। চোখাচোখি হতেই পৃথার চোখ দিয়ে জলের ফোঁটাগুলো টুপটুপ করে শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে দিচ্ছিল। 
পৃথা সম্ভবত বলার চেষ্টা করল- চললাম।ভালো থেকো আর বউকেও ভালো রেখো। কিন্তু গোঙানির মতো একটা শব্দ বের হল শুধু গলা দিয়ে। সেই আওয়াজ কারো বোধগম্য হল না।

কিছুটা এগিয়ে যেতে অস্ফুটে রঞ্জনও একবার ডাকল বুঝি, ' পৃথা.....'
পৃথা ফিরে তাকাল না। ধীর পায়ে সামনে এগিয়েই চলল। স্বগতোক্তির মতো অস্ফুটে কী যেন বলেই চলেছে রঞ্জন।সেই কন্ঠস্বর পৃথার কানে পৌঁছবে কিনা জানা নেই। তবু তপতী স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে রঞ্জন বলছে, 
- পৃথা কেঁদো না। ঈশ্বর কাঁদে না। ঈশ্বরকে কাঁদতে নেই কখনও।

২টি মন্তব্য:

  1. অসাধারণ গল্প। মন ভালো লাগায় ভরে গেল। নির্মাল্যদা, ধন্যবাদ এত ভালো একটা গল্প উপহার দেওয়ার জন্য।

    উত্তরমুছুন

Featured post

সোনালী মিত্র