প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

১১ আগ, ২০১৭

প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়

                                  হারজিৎ




হাসপাতালে এক রুগী দেখতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাঁ দিকের সুলভ শৌচালয়ের পাশে কাঁচের ছোটো ঘরটায় জ্বলজ্বল করছে এসটিডি লোকাল। এখনো আছে? টেলিফোন বুথের টিকে থাকা নিয়ে বেশ আশ্চর্য লাগল। এই মোবাইলের যুগেও! 
নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম। কলেজে পড়ার সময় এই বুথের ভেতরেই কত ঘেমেছি। কাঁচে বাষ্প জমেছে। কথা বলতে বলতে তাতে প্রেমিকার নাম লিখেছি। বাষ্পের মিলিয়ে যাওয়ার মতই সেসব নামও মিলিয়ে গেছে। যেখানেই বুথ পেতাম একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করতাম, কি রে, কি করছিস? 
এত ফোনের কারণ জানতে প্রেমিকার মা ফোনে কলার আইডি বসালেন। কখনো নিজেই কল ধরে বলতেন, বাড়ি নেই। পরে কল কোরো।
এই ফোনে ফোনেই একদিন সম্পর্ক ভেঙে গেল। শ'দুয়েক টাকা বিল উঠেছে দেখে বুথ মালিক দারুণ খুশি। একের পর এক কাস্টমারকে ভাগিয়ে দিচ্ছেন। এক সময়, বুথের দরজায় বার বার টোকা পড়তে লাগল। আমি সব সম্পর্ক শেষ করে যখন দরজা খুলে বেরিয়ে আসছি, তখন দেখলাম এক অল্পবয়সী বউ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই বলল, স্যরি। আসলে আমার স্বামী অসুস্থ। ভেলোরে ভর্তি।প্রতিদিন এই সময় তাকে ফোন না করলে...
অনেকদিন পর তার প্রোফাইল দেখলাম। মানে তাকেই দেখলাম। গোল মুখটা লম্বাটে হয়ে গেছে। চোখের কোলটা ভারী। চুলের পাক বোধহয় আমার ছোট্ট ফোনটায় ধরা যাচ্ছে না। "
"তারপর?"
"তারপর..প্রথমে ভাবলাম ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই। কিন্তু তারপর মনে হল কি দরকার! যে যেমন আছি থাকি। এতদিন পর.."
"তারপর কি করলেন?"
"সারারাত ঘুম এলো না। বউ মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝরাতে টুক করে উঠে ফেসবুকটা খুললাম। তারপর তার প্রোফাইল পিকচারটা কিছুক্ষণ দেখলাম। এক সময় এই মেয়েটার জন্য পাগল ছিলাম! কত রাত ঘুম হয়নি, কত চিঠি লিখেছি। কত পাগলের মত ঘুরেছি। অথচ.."
"অথচ কি?"
" অথচ, আজ তার ফটো দেখে একটুও অন্য অনুভূতি হল না। আগেকার দিনে মোবাইল ছিল না, টুক করে প্রেমিকার ফটো তোলার হুজুকও ছিল না। অনেক কষ্ট করে কলেজের গ্রুপ ফটো জোগাড় করেছিলাম। কিন্তু এখন প্রোফাইল ঘেঁটে অজস্র ছবি দেখে মেলাতে পারলাম না তাকে। একই মানুষ তবু সেই অমোঘ টান নেই যাকে নিয়ে এতকাল এত কবিতা লিখেছি, যাকে এতকাল বহন করে এসেছি।"
" আসল কথায় আসুন। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেন?"
"হ্যাঁ।"
"একসেপ্ট করল?"
"পরদিন সকালে একসেপ্ট করেই মেসেজ পাঠাল 'গুড মর্নিং'। আমিও রিপ্লাই দিলাম। কিন্তু আর উত্তর এলো না। সারাদিন অপেক্ষা করলাম। এবার যেন মনটা কেমন করে উঠল। বার বার অফিসের কাজের মাঝে ফোনটা খুলে দেখতে লাগলাম।"
"আর মেসেজ এলো?"
"হ্যাঁ। পরদিন সকালে মেসেজ এল,'তোমার নম্বরটা দেবে?’ আমি চমকে উঠলাম। আমি কতবার তাকে বলেছি, তোমার জেঠুর ঘরের ফোন নম্বরটা দাও না! বুথ থেকে ফোন করব। দেয়নি। "
"আপনি কি করলেন?"
"আমিও সারাদিন চুপ মেরে থাকলাম। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনের মধ্যে ফেসবুক খুলে দেখি তার অসংখ্য মেসেজে ইনবক্স ভরা। কেন জানি না পড়তে ইচ্ছে হল না।সোজা তাকে ব্লক করে দিলাম। খোলা জানলার হাওয়ায় বেশ মজা লাগল। একদিন যাকে ভালোবেসে ছিলাম, যাকে নিয়ে আমার এত লেখালেখি, যাকে না পাওয়ার বিষাদকে আমি সম্পদ করেছি, সে এত সহজলভ্য হয়ে যাবে? আমি বোধহয় তাকে নয়, তাকে না পাওয়ার বেদনাকেই ভালবেসেছি এতকাল। আমি ভালোবাসার পরাজিত সৈনিক। এবার কিন্তু জিতে গেলাম। কি বলো?"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র