ইলা কারকাট্টা - মায়াজম

Breaking

২০ জানু, ২০১৮

ইলা কারকাট্টা

   সমকামী





কাল থেকেই আকাশের মুখ ভার । শীতের মুখে আবার নিম্নচাপ । সন্ধ্যার দিকে হাল্কা বৃষ্টি হয়ে, এখন মেঘের গর্জন শুধু । এক‌ই বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল সোমা আর তানিয়া। বাইরে মেঘের গর্জন আর এই দুই যুবতীর মনে বয়ে চলছে তীব্র ঝড় । কাল সকালেই তাদের চলে যেতে হবে এই ফ্লাট ছেড়ে । কারণ সকলের তাই মত । সোমার বাবা আগেই মারা গিয়েছেন । আর বছর খানেক আগে তার মাও স্টোকতে মারা গিয়েছেন । সোমা থাইরয়েড আর হারের রোগে আক্রান্ত । তানিয়া তার ছোটবেলার বান্ধবী । অজয় নগরতে পাশাপাশি বাড়ি ছিল তাদের । এক সাথেই স্কুল--কলেজ করেছে তারা । আত্মীয় এবং প্রতিবেশীরা অনেক সময় মজা করে বলত " এদের একজন ছেলে হলে ভালো হত । ওদের বিয়ে দেওয়া যেত ।" ওদের মধ্যে সেই ছোটবেলা থেকেই বড়ো ভাব।
দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতে পারে না। দুজন দুজনকে কথাও দিয়ে ছিল একসাথে থাকার । তানিয়া একটু বড়ো ছিল তাই সে বলত "সোমা আমি তোকে সব সময় দেখে রাখব ।" আর সোমা বলত " আমরা সব সময় এক সাথেই থাকব ।" কলেজ যাওয়ার পর‌ও তাদের সেই কথা এক‌ই থেকেছে । এমনকি এক‌ই স্কুল--কলেজতে পড়াশুনা করেছে তারা । কমার্স  নিয়ে পড়া করেছে দুজনেই । আর তার পর মার্কেটিং নিয়ে MBA , আর ছোটবেলার সেই কথা আরো দৃঢ় হয়েছে । একসাথে থাকার স্বপ্ন আরো জোরালো হয়েছে । এমনকি এক‌ই বাড়িতে বিয়ে করবে ঠিক করেছিল তারা । কিন্তু সোমার বাবা মারা যাবার পর সোমার মা তাদের দোতলা বাড়িটি বিক্রি করে গড়িয়াতে এসে দু'কামরার ফ্লাট কেনে । বাকি পয়সা ফিক্সড করে দেয় , যাতে তাদের মা--মেয়ের খরচা ঠিক মত চলে । কিন্তু সোমার মা হঠাৎ মারা যাওয়ার পর সোমা বড়ো একা হয়ে পরে । আর সেই থেকে এই এক বছর ধরে তানিয়া সোমার সঙ্গ দিচ্ছে । আগে মাঝে--মাঝে তানিয়া এক--আধ দিনের জন্য বাড়ি যেত। কিন্তু সোমাকে নিয়ে তানিয়ার বাবা--মার সাথে তানিয়ার ঝগড়া বারতে থাকে । আর শেষে একদিন  তানিয়া রেগে গিয়ে বাড়ি ছেড়ে দেয় । সে আসার আগে স্পষ্ট বলে দেয় যে যদি তারা সোমাকে তাদের  সাথে রাখতে রাজি হয় তবেই সে বাড়ি ফিরবে , না হলে ফিরবে না । এই এক বছরে তানিয়ার বাবা--মা অনেক চেষ্টা করেছেন মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যাবার । বিয়ের ব্যবস্থাও করেছিল তারা । কিন্তু বান্ধবী একা ফেলে তানিয়া কিছুতেই যাবে না । তানিয়ার বাবা--মাও সোমাকে তাদের সাথে রাখতে রাজি নয় । বার দু'য়েক পুলিশ নিয়ে এসেও প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছেন তারা । কিন্তু এই সমাজে একা দুটি মেয়ের এক সঙ্গে থাকা কি গ্ৰহণ যোগ্য ?তারা আবার বিবাহিত‌ও নয় । মানুষের আর কি দোষ ।

কৌতূহল নেয় গুঞ্জনের রূপ, আর গুঞ্জন নেয় বিদ্রোহের রূপ । দুটি মেয়ে এক সঙ্গে আছে নিশ্চয় কোনো ব্যাপার আছে । এতদিন শুধু তাদের দেখে সকলে হাসা--হাসি আর বিদ্রূপ করে কথা বলতো । কিন্তু অসামাজিক বস--বাস আর অসামাজিক চলন তো আর মেনে নেওয়া যায় না । তাই বিচার সভা বসে ,আর বিধান হয় তাদের এই ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যেতে হবে। এ সব কথা ভাবতে--ভাবতে তানিয়ার চোখ দুটো জ্বালা করে ওঠে । দুফোটা জল‌ও হয়তো গড়িয়ে পরে গালের উপর । তানিয়া সোমার দিকে ফিরে শোয় । সোমা তখনও চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে । মাঝে--মাঝে আলোর ঝলকানি আর মেঘের গর্জন । সোমার মনে পরে যায় কলেজের সেই দিনটার কথা । এমনই মেঘলা একটি বিকেলে তারা কলেজ থেকে ফেরার পথে ইচ্ছে করে ভিজে ছিল । সেদিনের বৃষ্টি ভেজা বিকেল আর সন্ধ্যা ছিল অন্য রকম । সেদিন তারা কত খুশি ছিল । তানিয়া মজা করে বলেছিল"কি হুকুম মালিকা , বান্দা তা এখন‌ই হাজির করবে ।"আর সোমাও বলেছিল "বৃষ্টিতে ভিজে ফুচকা খেতে চাই ।" খুব হেসে ছিল তারা । সেই বৃষ্টিতে ভিজে--ভিজে তারা ফুচকা খেয়ে ছিলো । বৃষ্টি থেকে  বাচতে যারা আস--পাসের দোকানে দাঁড়িয়েছিল , তারা এই মেয়ে দুটির কান্ড দেখে হাসতে থাকে । মাথায় রুমাল দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে--ভিজে ফুচকা খাওয়া । সে ছিল বড়ো খুশির দিন । কিন্তু আজ সব কিছু অন্য রকম ,সব কিছু বদলে গেছে। তাদের শুধু একটাই অপরাধ যে তারা একসাথে থাকতে চায়। জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে সোমা তানিয়ার দিকে ফেরে । হঠাৎ সোমা জড়িয়ে ধরে তানিয়াকে । তানিয়ার শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে যায় । সে আরও ঘনিষ্ঠ হয় । দুহাতে সোমার মুখটা কাছে টেনে নিয়ে চুম্বন করে তার গালে । আর কানে ফিসফিস করে বলে "আমরা দুজন দুজনের জন্য আছি । আমরা একসাথে ছিলাম , একসাথেই থাকব । আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না ।" সোমা আরও জোরে জড়িয়ে ধরে তানিয়াকে আর বলে"আমরা দুজন একসাথেই বাঁচব ।" সোমার চোখে ও জল টলমল করে। সামলে নিয়ে সোমা ঠোঁট দুটি চেপে ধরে তানিয়ার ঠোঁটের উপর । এই এক বছর এক বিছানায় শুয়েও তারা এমন আচরণ কোনোদিন‌ও করেনি । আজ যেন তাদের শরীরে--মনে কোনো অপদেবতা ভর করেছে । আত্মীয়--পরিজন বন্ধু--বান্ধব থেকে শুরু করে পরিচিত--অপরিচিত সবার কাছেই তারা অসামাজিক । তাদের সম্পর্কের তাদের মানবিকতার এবং বন্ধুত্বের একটাই নাম , একটাই ব্যাখ্যা সবাই দিয়েছে । তা হল সমকামী । তবে তাই হোক । এক--এক করে তাদের সকল বস্ত্র খুলে পরতে থাকে । নগ্ন শরীর দুটি একে--অপরের সাথে মিশে যেতে থাকে । বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। সে বৃষ্টি ওদের চার চোখেও নামে । দুঃখ-যন্ত্রণা-অপমান সব মিশে গিয়ে এক অদ্ভুত সুখের অনুভূতি জেগে উঠতে থাকে দুজনের শরীরে ও মনে । তারা যেন আজ নতুন করে নিজেদের চিনতে পারে । যে পরিচয় সমাজ তাদের দিয়েছে আজ সেই পরিচয়কেই তারা স্বীকার করে নিয়েছে । আজ তারা সত্যি করেই সমকামী হয়েছে ।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র