সুনীল তিওয়ারী - মায়াজম

Breaking

২০ জানু, ২০১৮

সুনীল তিওয়ারী

পশমীয় আদর











রেললাইনের পাশেই একতলার ছোট্ট ঘর। সকাল সন্ধে এই বাড়ীর বাসিন্দাদের অতিষ্ঠ হতে হয় ট্রেনের ছুটে যাওয়ার শব্দে।

ভোরের প্রথম ট্রেন শীতের কুয়াশা মেখে হাই তুলতে তুলতে বিশ্রী শব্দে বেরিয়ে গেল।
অনিন্দ্য বাড়ী ফিরল কাঠ হয়ে আসা অসাড় শরীরটা নিয়ে,
নীলিমা তখন বাড়ীর সামনের গাঁদা ফুলের গাছটা থেকে ফুল তুলতে ব্যস্ত, নিজের চশমার আড়াল থেকে অনিন্দ্যকে দেখে নিল একবার।

-- তোমার কি ঠান্ডা লাগেনা একটুও? সারা রাত ঠান্ডায় ওই ভাবে কাঁপতে কাঁপতে গাড়ী চালালে?
বিড়ির শেষটুকুনি চুষে টান মেরে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে অনিন্দ্য খাটে এসে বসে বলল --
এই মুহূর্তে শাল বা সোয়েটার কেনা একদমই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। জানোই তো একেকটা টাকা কিভাবে তুতুলের জন্য সঞ্চয় করছি আমি। আর তাছাড়াও তোমার মাস সয়দা ফুরিয়ে এল প্রায়।
সেটার জোগাড় এখন কিভাবে করব সেটাই ভাবছি।
লেপ মুড়ে শুতে শুতে ছাপান্ন বছরের অনিন্দ্যর কাঁপুনিটা যেন আরো বেড়ে এল।

নীলিমা খাটের একপাশে রাখা অনিন্দ্যর পুরনো ছেঁড়া শালটার ক্ষয়ে আসা ফাঁক ফোকরগুলো ছুঁয়ে অনুভব করতে থাকল।
যেন ওই শূন্য স্থানগুলো হতে সময়ের বিবর্তনে অনেক শিকড় বেরিয়ে এসেছে।
বটগাছের মত স্থির সামান্য মাস মাইনের বাস ড্রাইভার অনিন্দ্য এই শীতটাও নিজে কেঁপে সংসারকে নিজের শিকড় দিয়ে যত্নে আগলে রাখবে।

পরেরদিন সকালেই নীলিমা তমালকে নিজের বাবার জন্য একটা সোয়েটার কেনার আর্তি জানালো।
তমাল অনিন্দ্য আর নীলিমার প্রথম পুত্র সন্তান। আজ তিনবছর হল ওর বিয়ে হয়েছে, ওর বৌ পাপিয়া এই তিনবছরে অন্তত একবারও এক কাপ চা করেও খাওয়াইনি অনিন্দ্যকে।তার পক্ষে নীলিমার এই আবদার গলঃধস্থ করা সহজ ছিলনা।বরাবর ঠোট কাটা পাপিয়া প্রায় চিল্লে চিল্লে তমালকে ঘর বন্ধ করে শাসন করতে লাগল।নীলিমার কানে শুধু শূল হয়ে এসে বিঁধল পাপিয়ার একটাই কথা"বুড়ো বয়সে বুড়ীর প্রেম জেগেছে"

তুতুলের দ্বারস্থ হয়েও বিশেষ লাভ হল'না নীলিমার।
মেয়েটার সামনে তিনমাস পর বিয়ে, ও নিজের কাজের টাকা থেকে জয়ন্তর জন্য একটা দামী শার্ট কিনবে, বাকি ওর হাত খালি।জয়ন্ত, যাকে তুতুল ভালবাসে, যার সাথে কদিন পর ও বিয়ে করবে তার আবদার পুরো করাটা এখন তুতুলের কাছে বেশী জরুরি।

নীলিমা যখন নিজেকে বেশী অসহায় মনে করে তখন প্রায় দিন কলপাড়ে কাঁদতে বসে রুবির সামনে।
রুবি ওদের বাড়ীতে বাসন মাজতে আসে। একমাত্র রুবির কাজের টাকাটা তমাল হাতগুনে মাসে ভাল ভাবে বার করে দেয়, কারণটা হল পাপিয়ার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাসন নিয়ে একটা ম্যানিয়া।নিজে করে না, শাশুড়ীর হাত বাসন স্পর্শ করবে? ধোয়া ভাল হবেনা - এই একটা ম্যানিয়ার জন্য নীলিমা একটু হলেও কাজ হতে নিস্তার পায়।

-- রুবি একটা ভাল সোয়েটার কত টাকায় পাওয়া যায় রে?
রুবির বাসন ঘষা দেখতে দেখতে চোখের জলটা সামলে কোনোরকমে জিজ্ঞেস করল নীলিমা।
রুবি উত্তর করল..
-- তা প্রায় মজবুত সোয়েটার কিনতে গেলে হাজার টাকার উপরে তো লাগবেই গো কাকীমা।

রুবির হাত ধরে টেনে আড়ালে নিয়ে গিয়ে নীলিমা নিজের ছোট্ট সোনার নাকেরটা রুবির হাতে দিয়ে ছলছল চোখে বলল --
এটাই আমার শেষ সম্বল রে রুবি। এটা বন্ধক ধরে হাজার টাকা পেয়ে যাবি। আমায় তোর কাকুর সাইজের একটা ভাল সোয়েটার কিনে এনে দিতে পারবি?
নীলিমার বৃদ্ধ কোঁচকানো চোখের পাতায় মৃত জলের চিকনতা দেখে রুবি আর কোনো কথা বলতে পারলনা।
বৃদ্ধার শেষ দখলটি নিজের তালু বন্ধ করে শুধু ঘাড়টা দুলিয়ে সন্মতি জানাল একবার।

আজ তিনদিন হয়ে গেছে রুবি এখানে কাজে আসনি।যেঅনিন্দ্যর ছেঁড়া শালটার জড়াজীর্ণতা দেখতে দেখতে নীলিমার অন্দরে এর মধ্যে বয়ে গেছে অনেক কবার বেনামী ঝড়।পাপিয়া আর বাসন ছোঁয়নি, বরকে নিয়ে বাইরে থেকে খেয়ে আসছে।

চারদিন পর রুবি ফিরল।
ফিরল, দুই হাতের দুর্গা হয়ে..
নীলিমার হাতে একটা সুন্দর জাপানী পশমে বোনা খয়েরী সাদায় ডোরা কাটা সোয়েটার তুলে দিয়ে বলল --
কাকুকে খুব মানাবে এটায়।
আর এই নাও..
রুবির অন্য হাতে ছিল নীলিমার সোনার নাকেরটা যেটা এখন নতুন পালিশে আরো আভা ছড়াচ্ছে।
-- ঘরের বৌকে নাক খালি করতে নেই কাকীমা। টাকা জোগাড় করে সোয়েটার কিনতে আর নাকেরটা পালিশ করিয়ে উঠতে তিনদিন সময় লেগে গেল। নাও শিগগির নাকেরটা পর দেখি।নীলিমা বাকরূদ্ধ হয়ে পড়ল, নিজেকে সামলে রুবির আঙুল গুলো নিজের হাতে ধরে বলল --
আমার জন্য তুই এত করলি রুবি?
রুবি নীলিমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল --
তোমার জন্য নয় গো কাকীমা!
আমার বাবার জন্য।
সেদিন আমি তোমার চোখে যেন নিজেকে দেখেছিলাম..
যেই বছর শীতে আমি বাবাকে নিজের চোখে মরতে দেখেছিলাম, তখন আমি ছোট, বাবার জন্য করতে পারিনি। অনাথ হয়ে যাই।
আজ কাকুর সোয়েটার পরাতেই আমার বাবারো পরা হয়ে উঠবে কাকীমা। বাবা হয়ত আজও শীতে কাঁপে।

নীলিমা রুবিকে শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল,
ওদের মাঝের দূরত্বটা তখন নীলিমার হাতে ধরা পশম পরিধেয়র আদরে মোলায়েম হচ্ছে॥

(সমাপ্ত)


লেখক পরিচিতি-জন্ম ৫ই অক্টোবর ১৯৮৪ ব্যারাকপুরে, পড়াশুনো ব্যারাকপুর রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয় আর স্কুল পরবর্তী মনিরামপুর কলেজ হতে। এই মুহুর্তে একটি বেসরকারী সংস্থার অধীনে স্থায়ী একটি কাজে কর্মরত।
আপাততঃ কোনো লেখা বই হয়ে বেরোয়নি। ভবিষ্যতে ইচ্ছে অণুগল্পের একটি সংকলন পুস্তক হিসাবে প্রকাশ করবার।                         

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র