মৃন্ময় চক্রবর্তী - মায়াজম

Breaking

২০ জানু, ২০১৮

মৃন্ময় চক্রবর্তী

            ভক্তকাহিনী(পালাকীর্তনের গল্প)


নারদ গোবিন্দনিবাসে এসে দেখলেন শ্রীকৃষ্ণ শয্যাগত। বিবর্ণ পান্ডুর তার মুখবরণ। নারদ সম্ভাষণ করে জিজ্ঞাসা করলেন, প্রভু কেমন আছ? শ্রীকৃষ্ণ শয্যা থেকেই বললেন, নারদ আমার মস্তিস্কে ভীষণ যন্ত্রণা, এবার বিদায়ের দিন সমাগত হল। নারদ শুনে অস্থির হয়ে উঠলেন, কী বলছ প্রভু, তোমার অসুখ? মৃদু মাথা নাড়লেন শ্রীকৃষ্ণ। নারদ কান্নাজড়িত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, প্রভু এর কি কোনো নিরাময় নেই? শ্রীকৃষ্ণ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, আছে নারদ, কিন্তু কোথায় পাব সে মহৌষধী? নারদ বললেন, প্রভু তুমি আমায় বলো আমি ত্রিভুবন তন্নতন্ন করে খুঁজে আনি! শ্রীকৃষ্ণ মৃদু হাসলেন, তারপর বললেন, কোনো ভক্ত যদি তার পদরজ দিতে পারে তবে তা মাথায় মাখলে আমি সুস্থ হতে পারি।
শোনামাত্র নারদ ঢেঁকিতে চড়ে চললেন স্বর্গালোকে। প্রথমে পিতামহ ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখে ব্রহ্মা সম্ভাষণ করে বললেন কি খবর নারদ সব কুশল তো? নারদ ব্রহ্মাকে প্রণাম করে বললেন, না মহর্ষি, বড় দুশ্চিন্তায় আছি। আমার প্রাণগোবিন্দের মস্তিস্কে অসুখ হয়েছে, তাঁর কোনো ভক্তের পদরজ চাই। তা মাথায় মাখলে তিনি আরোগ্য হবেন। আপনি যদি কৃপা করেন প্রভু, তবে তিনি সুস্থ হন। 
ব্রহ্মা একথা শুনেই যারপরনাই বিস্মিত এবং ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, বিনাযন্ত্রে গান গেয়ে গেয়ে তোমার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে নারদ। যার পদরজ পাবার জন্য আমরা সকলে ব্যকুল, আর তুমি কিনা আমার পদরজ তাঁর মাথায় মাখাবার কথা বলছ, তোমার সাহস তো কম নয়, এখনি বিদায় হও!
নারদ গেলেন বিষ্ণুলোকে, সেখানেও পেলেন একইরকম ভর্ৎসনা। তারপর চললেন শিবলোকের উদ্দেশ্যে। সেখানে এসে শুনলেন দেবাদিদেব সেখানে নেই, তিনি মর্তলোকের শ্মশানে সাধনায় মগ্ন আছেন। নারদ তাঁর খোঁজে পুনরায় মর্তে অবতরণ করলেন।
শ্মাশানসাধক শিবের কাছে এসে নারদ তাঁকে প্রণাম করে জানালেন সবিস্থার। শিব শোনামাত্র বিস্ময়ে শিবনেত্র হয়ে বললেন কি বলছ ভাগিনেয়, যার পদরজ পাবার জন্য আমি সোনার কৈলাশ ছেড়ে মাটির মর্তের শ্মশানের ছাই মেখে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আর তুমি কিনা আমাকে বলছ.... ছি ছি এ যে শোনাও পাপ! বিনা তারযন্ত্রে গান গেয়ে গেয়ে তোমার কি মাথায় কোনো গোলমাল হল? 
হতাশ নারদ এবার কী করবেন? তিনি ভাবলেন যাই তবে বৃন্দাবনের পথ ধরে।
বৃন্দাবনের পদ্মবনে এসে নারদ দেখলেন রাধিকা তাঁর সখিবৃন্দ পরিবৃত হয়ে কমলচয়নে মগ্ন। তিনি তাঁকে সম্ভাষণ করলেন। রাধিকা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, নারদ তোমার প্রভু আমার প্রাণগোবিন্দ কেমন আছেন?
নারদ বিষণ্ণবদনে জানালেন পূর্বাপর। তখন রাধিকা বললেন ঠিক আছে নারদ, তাঁর সুস্থতার জন্য আমি পদরজ দেব। অন্য গোপিনীরাও একই কথা জানালেন তাঁকে। তারপর সকলে মিলে নারদকে পাকড়াও করে তাঁর সর্বাঙ্গে এবং তাঁর হরেকৃষ্ণ নামখচিত উত্তরীয়তে তাঁদের পদধূলি মাখিয়ে তাঁকে ছেড়ে দিলেন। 
অত্যন্ত বিরক্ত ক্রুদ্ধ নারদ গোবিন্দনিবাসে উপস্থিত হয়ে পদরজ চর্চিত উত্তরীয়টি কৃষ্ণশয্যা পাশে নামিয়ে বললেন, প্রভু এই নাও। শ্রীকৃষ্ণ মৃদু হেসে বললেন, নারদ এই ভক্তপদরজ কোথায় তুমি পেলে?
পূর্বাপর জানিয়ে নারদ বললেন, যেখানে দেবতারা দিতে বিমুখ হলেন সেখানে এঁরা কিকান্ডটাই না করলেন প্রভু, তুমিই তাদের আস্কারা দিয়ে এমন করেছ, দেখ আমায় কি করেছে!
কৃষ্ণ হাসতে হাসতে বললেন, নারদ তুমি তাদের গিয়ে জিজ্ঞাসা করো, যেখানে দেবতারা পদরজ দিতে অপারগ হলেন সেখানে তারা কি করে তা দিতে পারল, তাদের কি নরকগমনের ভয় নেই?
নারদ আবার ঢেঁকিতে চড়ে এলেন বৃন্দাবনে, সখি পরিবৃত রাধিকার কাছে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে দেবী, গোবিন্দের জন্য পদরজ দিতে যখন দেবতারা ব্যর্থ, তখন আপনারা কোন সাহসে তা দিলেন, আপনাদের কি নরকগমনের ভয় নেই?
কথা শুনে রাধিকা বললেন, না ভয় নেই নারদ, কারণ গোবিন্দ যে আমার প্রাণ, সে সুস্থ না হলে আমি স্বর্গে গিয়েও যে সুখী হব না? আমার নরকবাসের বিনিময়ে সে সেরে উঠুক। এ পৃথিবীতে সে তো আমার মতই সাধারণ, আমার মতই ভক্তের প্রেমিক। আমি যে তাকে বড় ভালবাসি নারদ!

নারদ কৃষ্ণের কাছে ফিরে এলেন। সব কথা শুনে গোবিন্দ মিটিমিটি হাসলেন শুধু!




কবি পরিচিতি-মৃন্ময় চক্রবর্তী : জন্ম- ৩ অক্টোবর ১৯৭৬ দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন চারুচন্দ্র কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : বেঁচে থাকার স্বপ্নগুলি ( ২০০৪), এই মৃগয়া এই মানচিত্র ( ২০০৮)। পাঁচালি কাব্য: ভুখা মানুষের পাঁচালি ( ২০০৯), ছিন্নপদগ্রাম (২০১৭)। প্রথম গল্পগ্রন্থ 'অপারেশন ড্রিম হান্ট ও অন্যান্য গল্প' প্রকাশিতব্য। সম্পাদিত গ্রন্থ পুস্তিকা : রাত্রির কঠোর বৃন্ত থেকে, মানিক শতবর্ষপূর্তি শমীবৃক্ষ, নির্মোহ রবীন্দ্রনাথ ( শমীবৃক্ষ)। সম্পাদিত পত্রিকা: মাটির প্রদীপ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র