অব্যক্ত
======
======
-------------------
নিঃস্তব্ধ ঘরটায় যেন হাতুড়ি পড়ল! পুরোনো ঘড়িটার দিকে আচ্ছন্নের মত তাকিয়েই ছিল কিংশুক। তবু ঢং করে বাজতেই চমকে উঠল। চোখটা চলে গেল নড়বড়ে টেবিলের ওপর রাখা কালো ফোনটায়। এক..দুই..তিন …. দশে পৌঁছনোর আগেই পুরো বাড়িটা কাঁপিয়ে বেজে উঠল ফোনটা। আজ নিয়ে পরপর পাঁচদিন।
একটু একটু করে শরীরটা টেনে নিয়ে গেল ফোনের কাছে, কাঁপা হাতে রিসিভারটা কানে ধরতেই সেই এক নৈঃশব্দ্য! কাল হ্যালো হ্যালো করে চেঁচিয়ে গলা ভেঙে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। আজ গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ বেরোলো শুধু। ওপারে সেই অদ্ভুত শূন্যতা, চোখ বুজলে মনে হয় তলিয়ে যাচ্ছে একটা নিকষ দমবন্ধকরা অন্ধকারে।
প্রায় মিনিটখানেক সব চুপচাপ, তারপর শরীরের সব শক্তি এক করে হ্যালো বলতেই একটা হাড় হিম করা দীর্ঘশ্বাস। গত চারদিন এই দীর্ঘশ্বাসের শব্দে চমকে গিয়ে ফোন রেখে দিয়েছে কিংশুক। আজ আরেকটু অপেক্ষা করল, কোনোভাবে যদি পাওয়া যায় অন্য কোনো শব্দ!
পিনাকীমামা নেই। শেষবার যখন এসেছিল কিংশুক, দোতলার’এই ঘরেই বিছানা করে দিয়েছিল হরিকাকা। মফঃস্বল শহরটায় এখনও গ্রামের ছোঁয়া, ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাড়িঘর। আপন মামা নয়, মায়ের পাড়াতুতো ভাই। তবু ঐ যে হয় না! দুজন অনাত্মীয় মানুষ চেনাজানা হতেই পছন্দের হয়ে গেল একে অপরের। টানটা বেশী ছিল ভবঘুরে মামারই। দোকান ব্যবসা সংসার সামলে কিংশুক যতটা পারতো যোগাযোগ রাখতো। মারা যাওয়ার খবরটা দিয়েছিল হরিকাকা।
- মানুষটা তুমারে খুব দ্যাখতে চাইতিছিল গো দাদাবাবু! মুখে আগুনডা যদি দিতি পারো!
- অহন আমার কি হবি বলতি পারো? উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার ডুকরে উঠেছিল হরিকাকা।
মুখাগ্নি করেছে কিংশুক। সারাজীবন টইটই করা পিনাকী মাস্টারের সুঠাম শরীরটা বিছানায় মিশে গিয়েছিল প্রায়। তেমনিই আচমকা শুকিয়ে গেছে হরিকাকা। ছত্রিশ বছর ধরে ছায়ার মত আছে। কায়াটা সরে গেল এবার।
- এখন কি করবে তুমি? তোমার নিজের ঘরদোর, পরিবার ….
কথাটা শেষ করেনি কিংশুক তবে ইঙ্গিতটা স্পষ্ট করেছে। শূন্য দৃষ্টিতে কোনো উত্তর খুঁজেও পায়নি অবশ্য। মনে মনে ভেবে রেখেছে, কাজকর্ম সেরে ফিরে যাওয়ার সময় বুড়োর হাতে কিছু গুঁজে বিদেয় করে দেবে নাহয়।
এরই মধ্যে এই বিচিত্র উপদ্রব। রোজ রাত সাড়ে দশটায় বেজে ওঠে ল্যান্ডফোনটা। তিনবছর আগে শেষ যখন এসেছিল, জোর করেই একটা মোবাইল ফোন দিয়ে গেছিল কিংশুক।
- সারাক্ষণ কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াও! এটা সঙ্গে রাখবে।
খুব খুশী হয়েছিল পিনাকীমামা। সস্তার মোবাইলটা অন করলেই লাল-নীল আলো জ্বলতে থাকে।
তবু ল্যান্ডলাইনটা ছাড়তে পারেনি প্রাণেধরে। আদ্যিকালের কুচকুচে কালো সেটটা বেজে উঠলেই চমকে ওঠে কিংশুক। দৌড়ে গিয়ে তোলে অথচ অন্যপারে সব নিশ্চুপ। অনেকক্ষণ পর একটা জীর্ণ দীর্ঘশ্বাস, ভেতর অবধি কাঁপিয়ে দেওয়া। আজ সকালেই হরিকাকাকে বলেছে। ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে ছিল বুড়ো কিছুক্ষণ।
- তুমারে কিছু বলতি চায় গো দাদা। বুঝবার চেষ্টা কইরো তো! আত্মার শান্তি হবে নে নাইলে।
- কি বলতে চায়? ধুর! এমন হয় নাকি?
- আমি টের পাই। বাড়িময় ঘুরঘুর করতিছে, ছটফট করতিছে।
নিজের ভিতরে একটা অস্বস্তি টের পায় কিংশুক। শ্রাদ্ধশান্তিটা সেরেই কেটে পড়তে হবে এসব ঝামেলা থেকে।
এই মুহূর্তে ভয় না পেলেও অস্বস্তিটা ফিরে আসছে। মনে হচ্ছে এই ঘরেই যেন রয়েছে কেউ। সত্যিই কি কিছু বলতে চায় পিনাকীমামা? সব মানুষেরই যদিও কিছু শেষ ইচ্ছে থাকে! কিন্তু, এভাবে তো ঘুমও আসবে না! হঠাৎ একটা ভরসা পায় কিংশুক। শেষের কয়েকদিন তো হরিকাকা এঘরেই শুয়েছে, পিনাকীমামার সঙ্গে। তাহলে, এই বাকী কয়েকটা দিনও বুড়োকে এনে শোয়ালে হয় না! টর্চটা জ্বেলে সিঁড়ির দিকে দৌড়োল। একতলার কোণার দিকের একফালি ঘরটায় নাইটল্যাম্পের ঘোলাটে আলো, দরজাটা ভেজানো। একটু ঠেলতেই মাটিতে পা আটকে গেল কিংশুকের।
সুচিন্তিত মতামত দিন