দুপুরের শেষ রোদে ছোট্ট রিনির মুখটা প্রথমবার আলো হয় রোজই। অবশ্য ছুটির দিনগুলো একটু আধটু অন্যরকম থাকে। তিনতলার বারান্দা থেকে মরা মরা হলদেটে ঘাস বিছানো মাঠে কয়েকটা শালিক অক্লান্তচিত্তে এক্কা দোক্কা খেলে। কয়েকটা কাক একে অন্যকে ঠোকরায়। রিনি বুঝতে পারে এটাই ওদের ওদের কথা বলার ভাষা। আর ধীরে ধীরে রিনির মুখটা আলো হয়। মাঝে মাঝে একঝাঁক সবুজ টিয়া অবুঝ বাতাসের বুক চিরে আকাশের একপ্রান্ত থেকে বারান্দার অপর প্রান্তে উড়ে যায়। ওইটুকুই আকাশ দেখা যায় রিনিদের ছোট্ট বারান্দা থেকে। অপর প্রান্তের আকাশে মাথা তুলেছে অন্য বিল্ডিংয়ের জানালা-দেওয়াল। টিয়া গুলোর ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ আস্তে ধীরে মিলিয়ে গেলে রিনি আন্দাজ করে নেয় টিয়ার ঝাঁক আকাশের অন্য প্রান্তরটা পেড়িয়ে গেল। রিনির চোখ তখন গিয়ে পরে ইলেকট্রিক তারে বসে থাকা কাকটার দিকে। সারাদিনের আবর্জনার এঁটো নিজের পালকে মুছে মুছে সে ঠোঁটের চাকচিক্য ফেরাতে ব্যস্ত। এক ছুটে রিনি চলে আসে ডাইনিং টেবিলটার কাছে। ভালো করে সাবধানে দৃষ্টি বুলিয়ে নেয় চারপাশের। কাছাকাছি মায়ের অবস্থান টের না পেয়ে স্কুলের ব্যাগ থেকে টিফিনবক্সটা নিয়েই একদৌড় আবার বারান্দায়। বারান্দায় ততক্ষণে বিকেলের রোদের গন্ধ এসে পৌঁছে গেছে। বারান্দা থেকে হাত যতটা গ্রিলের বাইরে অবধি যায় ততটা হাত বাড়িয়ে টিফিনের বাঁচিয়ে রাখা খাবারটুকু ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে নীচে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যালে চোখওলা খোঁড়া সাদা কুকুরটার কাছে। কুকুরটাও তাড়াতাড়ি লেংচে লেংচে এসে কপাকপ খেয়ে ফেলে খাবারে মাখানো রিনির আদরটুকু। শুধু এই খোঁড়া সাদা কুকুরটার জন্যেই মা টিফিনে কখনো ফল দিতে চাইলে রিনি কিছুতেই রাজি হয়না। ক্রমশ পুরু হয়ে সময়টা বিকেলটুকু নিভিয়ে। রিনির মুখে ক্লান্তির রঙ আরো একটু গাঢ় হয়। কলিংবেলের শব্দের সাথে ভেসে আসে মায়ের গলা - আন্টি এসেছে রিনি। পড়ার টেবিলে এসে বসো।
#
একটা একটা করে দশ নম্বর হোমটাস্কের কপি বন্ধ করতে করতে রিনির মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। আন্টির কাছে পড়ার পর মা বলেছিল অরুণমামার সাথে মিনিট পনেরো ফোনে কথা বলতে দেবে। মায়ের সেই প্রতিশ্রুতি মনে করে ক্লান্তির ভিড়টা সাথে সাথে আলগা হয়ে যায় রিনির মন আর মুখ থেকে। এক মুহূর্তেই ভেবে নেয় প্রথমে মামার কাছে কিছুটা গল্প শুনে, সেদিন বিকেলে একটা ফিঙে নিজে থেকে এসে রিনির সাথে কেমন বন্ধু পাতিয়েছিল লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে বারান্দার একদম কাছের ইলেকট্রিক তারে চলে এসে সরাসরি রিনিকে চিনে নিচ্ছিল - সে গল্প সেরেই মামাকে রিনির কাছে আসার বায়নাটুকু গুছিয়ে সেরে ফেলতে হবে। সারাদিনের শেষ সময়টুকু প্রজাপতির মতোন নাচতে নাচতে যখন ফুরিয়ে যায় আর রিনির ঘুমের সময় এসে চোখ কজলে ওঠে বাবা তখন ফেরেন একগুচ্ছ ক্লান্তি বেঁধে পিচের আর মুখের ওপর। সারাদিনে এই একবারই বাবাকে জাপটে ধরে সে। সকালে তো বাবার ঘুমন্ত গালে চুমু দিয়েই রিনিকে স্কুলবাসের হর্ণের গতির সাথে ছুট লাগাতে হয়।
#
এই একঘেয়ে ছুটে চলা জীবন ছোট্ট রিনির। আগের বছর দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে সবচেয়ে ভালো মনে আছে ট্রয়ট্রেন, পাইন গাছ আর হাত দিয়ে ছুঁতে পারা ঠান্ডা ঠান্ডা মেঘেদের।
#
নয় বছরের রিনির জীবনের চারধারে সেই পাইন গাছের উঁচু উঁচু ব্যস্ততা। মা যখন আদর করে দেয় রিনিকে ঘুম পারানোর সময় যখন কপালে আদর করে মায়ের হাতটা তখন অবিকল সেই মেঘগুলোর মতোন হয়ে যায়। এতো নরম আর এতো ঠান্ডা। আর অরুণমামা হলো সেই ট্রয়ট্রেনটা। অল্পসময়ের জন্য এসে যে একরাশ আনন্দ রিনির মনে এঁকে দিতে পারে। গল্পের বই না পড়লেই মামা আড়ি করে দেয় যিনি তাই মোবাইলে গেম কম খন খেলে গল্পের বইগুলো একটু একটু করে শেষ করে। বাবার অফিসে ছুটি ভীষণ কম তাইতো সে যেতে পারে না কলকাতাতে অরুণমামার বাড়ি। মামা আসে আসে। সাথে রামধনুর মতো অনেক রঙ আনে রিনির জীবনে। গেলবার মামা এলে সাদা খোঁড়া কুকুরটা খুব যত্ন পেয়েছিল। তাকে ছাদে উঠিয়ে শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করানো হয়েছিল। ওর গায়ের পোকা মারার শ্যাম্পু। ভীষণ আনন্দ করে ছাদে রিনির স্কুলের কয়েকজন বন্ধুদের নিয়ে নুন-ঝাল কম খাসির মাংস, সাদা ভাত, ডাল, পোস্তর বড়া, চাটনি দিয়ে পিকনিক করা হয়েছিল। কাকগুলোকে সেদিন আবর্জনা খেয়ে পেট ভরাতে হয়নি। ওদেরও পাতা খেতে দেওয়া হয়েছিল। তা আবার এমনি তেমনি পাতা না কলাপাতা। কলাপাতাতে ভাত আর মাটির গ্লাসে জল এসব ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছিল শুধু অরুণমামার জন্যেই।
#
যেন সবুজ রঙের মনোরম স্পর্শ। যেন সাদা রঙের আরো আলো উজালা। যেন লাল রঙের দীপ্তি।
#
শীতের ভোরের কুয়াশা ফর্সা হতে না হতেই দুদিন ধরে একা একা গোটা পিকনিকের ব্যবস্থা করতে গিয়ে মামার হয়েছিল ভীষণ গলা ভারী। ঠান্ডা লেগে গলার স্বর কিছুটা গেছিল ভেঙে আর কিছুটা গেছিল বসে। রিনির মা তখন তেজপাতার বিড়ি বানিয়ে মামাকে সেই বিড়ির ধোঁয়া খেতে দিয়েছিল। এ এক মজার দৃশ্য। মামা তেজপাতার বিড়ি খেতে খেতে নেশারত হবার অভিনয় করছিল। আর রিনি হাততালি দিয়ে তুবড়ির মতো হেসে হেসে উঠছিল।
#
এবার অরুণমামা এলে অন্য প্ল্যান। মামা ফোনেই সব প্ল্যান রিনিকে গুছিয়ে বলে দিয়েছে। দামোদরের চড়াতে বসে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা হবে। আর সেই মাছ চড়াতেই আগুন জ্বালিয়ে তন্দুর করে খাওয়া হবে। মায়ের রাঁধা মাছের ঝোলের থেকে মাছ তন্দুর ঢের মজাদার যে হবেই রিনি সেটা বেশ আন্দাজ করে ফেলেছে। বেশ খুশি খুশি গন্ধ। সেই খুশির গন্ধে ওম দিতে দিতে রিনি রাতে যখন রোজ ঘুমিয়ে পড়ে, রিনির মা দেখতে পায় রিনির মুখটা নাইট ল্যাম্পের হালকা আলোতেও কেমন উজ্জ্বল আলো হয়ে আছে।
#
আসলে ভালো স্মৃতির সাথে নতুন স্মৃতির অপেক্ষা মিশে গেলে আলো না যেন জ্যোতি সৃষ্টি হয়।
নাম - সঙ্গীতা সরকার । জন্ম চূঁচূড়াতে ১৯৮২ সালের ৪ ঠা জুলাই। ছোট থেকে মেয়েবেলা বড় হওয়া ও পড়াশোনা দুর্গাপুরে। বর্তমানে বিবাহসূত্রে কল্যাণী শহরে। সম্পূর্ণ গৃহবধূ , জীবনসঙ্গী, শাশুড়ি, দুই ছেলে ও বাবাকে নিয়ে সংসার। সংসার পরিধির মধ্যে দীর্ঘ ছ'বছর কবিতা লেখা হয়ে ওঠেনি। ২০১৪-১৫ সাল থেকে আবার শুরু করেছেন কবিতা লেখা । কবিতা অল্প কয়েকটা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৮ এর বইমেলায় দুটো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। জীবনে বড় কবি হওয়ার ইঁদুরদৌড়ে কবি নেই। নিজের ভালো লাগা খারাপ লাগা প্রকাশের একটা মাধ্যম দরকার। কবিতা লেখা নিজেকে প্রকাশের একটা মাধ্যম। তাই কবিতা লেখেন
সুচিন্তিত মতামত দিন