শাঁওলি দে - মায়াজম

Breaking

২০ জানু, ২০১৮

শাঁওলি দে

                           ।। দাগ ।


“বাবু তুই নাকি আজও স্কুলে যাসনি?”পরাগের মা’এর গলায় বিষ্ময় ঝরে পড়ে, "তা স্কুল যাস না তো কোথায় যাস রোজ?” 
মা’এর কথায় প্রায় চমকেই ওঠে পরাগ। আমতা আমতা করে বলে ওঠে ,”কে বলল তোমায় আমি স্কুলে যাই না?” 
“দেখ বাবু আমায় ঠকাস না? ভুলে যাস না যে তুই আমার পেটেই হয়েছিস!” কড়া গলায় বলে ওঠেন তিনি। 
পরাগ জোর করে হাসার চেস্টা করে, বলে ওঠে ,”তার মানে তুমি বলতে চাইছ পেটে ধরলেই সব সিক্রেট জেনে ফেলা যায়? তুমি পারোও বটে মা!” 
মা পরাগের কথাকে মোটেও পাত্তা না দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে আসেন ছেলের কাছে। সস্নেহে মাথায় হাত রেখে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে ওঠেন ,"কী হয়েছে আমায় বল ! স্কুলে কিছু হয়েছে? নাকি মনীষার সঙ্গে কিছু ??” 
“না না মা কিছুই হয়নি। দু’দিন স্কুলে যাইনি ঠিকই, কিন্তু সেটা অন্য কারণে। আমার কিচ্ছু হয়নি মা। তুমি অযথা চিন্তা কোরো না। ” 
ছেলের আশ্বাসবানীতে মা’এর মন ভরে না। ছেলে ঘর থেকে চলে গেলে এক বুক চিন্তা নিয়ে তিনি দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা কালি মা'এর ছবিতে হাত জোর করে প্রনাম করে নিজের মনেই বলে ওঠেন ,”মা, তুমিই দেখো আমার ছেলেটাকে, ও বড্ড ছেলেমানুষ।”

আজকাল একদম স্কুল যেতে ইচ্ছে করে না পরাগের। অথচ বাড়িতেও কি থাকতে তেমন মন চায়? বিয়ের মাত্র সাত দিন যেতে না যেতেই একরকম হাঁপিয়ে উঠেছে সে। সবসময় বুকের ভেতর একটা চাপ।অসহ্য এই চাপের উৎস রাগ না দুঃখ নাকি অন্য কিছু তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না ও।স্কুলের নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাড়ি দেয় অজানা অচেনা রাস্তায়।নিজেকে খুঁড়তে খুঁড়তে খোঁজে আর ডুব দেয় মনের অতলে।সে যা করেছে তা কি ভুল না ভবিতব্য এই প্রশ্নটাই বারবার তাড়া করে বেড়ায় আজকাল।নিজের স্বপক্ষে যুক্তি সাজায় অথচ নিজেরই তা অযৌক্তিক বলে মনে হয়।নিজেকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজেই সওয়াল জবাবে মেতে ওঠে।বাড়ি ফিরতেও আজকাল খুব দেরি করে ও।মনীষা হয়তবা অবাক হয়। কিন্তু স্বভাব লাজুক পরাগের বউ মুখে কিছুই বলে না। বউভাতের পর দিন থেকেই পরাগের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সে।অথচ এই পরাগই তো বিয়ে করার জন্য রীতিমতো পাগল হয়ে উঠেছিল।পরাগের জোড়াজুড়িতেই দেখতে যাওয়ার মাত্র এক মাসের মাথায় ওদের বিয়েটা হয়ে যায়।কী উন্মাদনা তখন!দিন রাত মনীষাকে ফোন করে করে পাগল করে দিত ও।মনীষার এত তাড়াতাড়ি বিয়েতে কিছুটা আপত্তি ছিল।কিন্তু সেও শেষে এমন নাছোড় প্রেমিকের কাতর ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারে নি।বিয়েটা অবশেষে হয়েই গিয়েছিল নির্বিঘ্নে। 
মানুষ অনেক সময়ই খুব চিন্তা ভাবনা করে কোনো কাজ করে,যাতে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা না হয়।মগজ খাটিয়ে বুদ্ধি বের করে। অথচ মন? মনের কথা কারো মনে থাকে? 
পরাগও তো সব জেনে বুঝেই বিয়েটা করেছিল।কিন্তু তার মনের কি আদৌ সায় ছিল তাতে?এ প্রশ্নটাই বার বার কুরে কুরে খাচ্ছে পরাগকে।ও বুঝতে পারছে মুঠো থেকে বালি আস্তে আস্তে ফুরিয়ে যাচ্ছে।যত বেশি মুঠো শক্ত করতে চাইছে আলগা হচ্ছে ততটাই বেশি।পরাগ দিশেহারা হয়ে যায়।আজকাল নিজেকেও তো চিনতে পারে না সে। 
এস. এস. সি. পরিক্ষায় বেশ পেছন দিকেই র‍্যাঙ্ক ছিল পরাগের।তবু বরাতজোরে শহরের ওপরেই একটা ভালো কো-এড স্কুলে চাকরী পেয়ে গিয়েছিল।তারপর কেটে গেছে দুটো বছর।স্বভাবমতোই পরাগ মিশে গেছে অন্য সব কলিগদের সঙ্গে। সারাদিন হইহুল্লোর,একসাথে সিনেমা দেখা,পিকনিক কীইনা করেছে ওরা সদলবলে। ও স্কুলে ঢোকার মাসখানেক পরই পর্ণাও জয়েন করেছিল। দুজনেই সায়েন্স, একজন ফিজিক্স আর অন্যজন কেমিস্ট্রি। খাতির হতে সময় লাগেনি বেশি। একসঙ্গে যাতায়াত ,বাসে একে অন্যের জন্য জায়গা রাখা , টিফিন সেয়ার করা এরই মাঝে কখন যে পর্ণাকে অল্প অল্প করে ভালো লাগতে শুরু করে তা নিজেই বুঝতে পারে নি পরাগ।অন্যান্য কলিগদের চোখ এড়ায় নি কিছুই। পর্ণাও কি বেশি পশ্রয় দিয়ে ফেলে নি ওকে? আজকাল কোন কিছুরই হিসেব ঠিক মতো মেলাতে পারে না পরাগ।ইশ্‌ সেদিন যদি পর্ণার থেকে নিজেকে দূরে সরাতে পারত তাহলে হয়ত আজ ওকে এভাবে অতীত কুঁড়ে কুঁড়ে খেত না।ভালো করে চোখ বুজতে পারে না পরাগ।চোখ বন্ধ করলেই ফেলে আসা স্মৃতিগুলো হু হু করে মনের মধ্যে সুনামির মত তোলপাড় করতে থাকে।পরাগ জানে এ সুনামীর থেকে ওর নিস্তার নেই।

পর পর দু'দিন পর্ণা স্কুলে আসেনি। পরাগের খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। রাগও হচ্ছিল পর্ণার ওপর। একটা খবর তো দেবে? ফোন করে খোঁজ নিতেও কেমন বাধো বাধো ঠেকছে। তাও করবে না করবে না করে সন্ধ্যের দিকে ফোনটা করেই ফেলল ও। 
ডায়াল করার পরও একটু দ্বিধা ছিলই। কিন্তু কাটার আগেই রিং শুরু হয়ে যাওয়াতে আর ফোনের লাল বাটনটা টিপে দিতে পারল না পরাগ। তিনচার বার রিং হতেই ওপাশে সেই পরিচিত পর্ণার গলা, "কী ব্যাপার হঠাৎ আমায় ফোন?"
'কেন করতে পারিনা বুঝি?'পরাগ জানতে চায়। 
'না করো না তো তাই', পর্ণার গলায় কৌতুক।
'তুমি যেন খুব করো। তা যাই হোক দু'দিন স্কুল আসছ না কেন বলো তো?'পরাগ জানতে চায়।
'এমনি',পর্ণার ছোট্ট উত্তর। 
'বাহ ভালোই। আর শুধু শুধু উলটো পালটা চিন্তায় ', কথাটা শেষ করে ন। পরাগ।
'আমি স্কুলে আসছি না বলে তোমার চিন্তা হচ্ছে? অবাক কান্ড তো!' পর্ণা হেসে হেসে বলে।
রাগ হয়ে যায় পরাগের, বলে 'হবে না? খবর টবর নেই শুধু হেড মাস্টারকে ফোনে বলে দিলে আসতে পারবে না ক'দিন। এ আবার কী?'
'বুঝতে পারিনি আমি না গেলে তোমার এত খারাপ লাগবে',আস্তে আস্তে কথাগুলো বলে পর্ণা।
পরাগ যুতসই কথা হাতড়াতে থাকে। পর্ণা বলেই চলে,'বাড়িতে গেস্ট এসেছেন দূর থেকে,জানোই তো মা একা,অসুস্থ। সব কিছু সামলাতে হয় আমাকেই।'
'সাহায্য চাইলেই হয়।কিছু না বললে জানবে কী করে মানুষ',রাগী গলায় কথাগুলো বলে পরাগ।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে পর্ণার। পরাগ শুনতে পায়। দুজনের কেউ কোনো কথা বলে না কিছুক্ষণ। তারপর নীরবতা ভেঙে পরাগই দৃঢ় গলায় বলে ওঠে, 'আমি যদি সবসময় পাশে থাকতে চাই!'
'পারবে তুমি? আমার অনেক সমস্যা পরাগ। তুমি অনেক কিছুই জানো না।'ধীরে ধীরে বলে ওঠে পর্ণা।'
'ইচ্ছে হলে বোলো, কিন্তু তার আগে গেস্ট সামলাও বুঝলে।আর কিছু দরকার হলে আমায় জানিও।'সস্নেহে বলে পরাগ। 
ফোন কেটে যায়। কিন্তু পরাগ আর পর্ণার মনে এক অনুরণন বাজতে থাকে।

(২)
স্কুলে গিয়ে বেশ চুপচাপই থাকে পরাগ।আগের মত হইহুল্লোর,একে অন্যের পেছনে লাগা কোনকিছুই আর ভালো লাগে না।কলিগরাও কেমন যেন পালটে গেছে!অবাক হয় পরাগ।এই দুবছরে যারা ওর সব সুখ-দুঃখের সঙ্গী তারাই এই বিয়েটার পরই ওর সাথে একটা দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে। অভিমান হয় পরাগের। অপরাধবোধটা আরও জাঁকিয়ে বসে ওর মনে। 
কথায় বলে সময় ও ঢেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে না।হু হু করে দিন কাটতে থাকে পরাগেরও।মনীষার সাথে কোন সম্পর্কই গড়ে তুলতে পারে না সে।ঘরে বাইরে একঘরে জীবন কাটাতে থাকে।এইভাবে আর কতদিন কতরাত ও থাকতে পারবে নিজেই কি তার হিসাব করতে পারছে ?মনীষাও আজকাল মোটে পাত্তা দেয় না পরাগকে।বিয়ের পর পর রাতে পরাগের জন্য অপেক্ষা করত সব উপেক্ষা করেও;এখন নিদ্ধির্ধায় আগেই খেয়ে নেয়...তারপর চলতে থাকে রাতভোর হোয়্যাটস আপ চ্যাটিং।কার সাথে কে জানে!জিজ্ঞেস করতে মন চায় না পরাগের,অবশ্য সাহসও যে নেই সেটা মনে মনে স্বীকার করে নেয় ও।আয়নায় নিজের মুখও দেখতে ইচ্ছে করে না।আয়নাটাও যেন আজকাল ওর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।যেন জানতে চায় কেন?কেন?কেন? 
এই একটা কেন!এর উত্তর পরাগের কাছে নেই।ও শুধু জানে বিরাট একটা ভুল হয়ে গেছে।সে ভুলের আর প্রায়শ্চিত্ত নেই।

সেদিনের সেই সন্ধ্যেবেলার স্মৃতিটা মনে পড়লেই বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে পরাগের! 
এক কলিগের বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন ছিল সেদিন।গান বাজনা হই-হুল্লোর আরও কত কিছু! এরই মাঝে সকলের চোখ এড়িয়ে পরাগ পর্ণাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল ছাদে।আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে চেয়েছিল ওর পর্ণাকে।বাঁধা দেয়নি পর্ণাও।সবাই জানত ওদের সম্পর্কটা শুধু সময়ের অপেক্ষা!নিষেধ ছিল না কোনো তরফেই।কপাল বেয়ে ক্রমশ নিচের দিকে নামছিল পরাগের অবাধ্য ঠোঁট।আর ঠিক তখনই বুকের কাছে পরাগ আবিষ্কার করেছিল সাদা দাগটি।মুহুর্তে সরিয়ে নিয়েছিল ঠোঁট।ছিটকে এসেছিল পর্ণার কাছ থেকে।মুখ দিয়ে একটাই শব্দ বের হয়েছিল ‘ছিঃ!’ চোখ জুড়ে তখন শুধুই ঘেন্না। অবিশ্বাস ভরা চোখে জানতে চেয়েছিল, “আর কোথায়?” 
অবাক হয়ে গিয়েছিল পর্ণা। আজ যা যা গড়ার কথা বলবে ভেবেছিল,তা গড়ার আগেই ভেঙে খান খান হয়ে যেতে থাকে চোখের সামনে।পরাগ পর্ণাকে কিছু মাত্র বলার সুযোগ না দিয়ে হন হন করে নীচে নেমে গিয়েছিল।পর্ণার কিচ্ছু বলা হল না।পর্ণারা কিছু বলতে পারেও না। 
যে দাগের জন্য পরাগের এই ভাঙচুর তার চেয়েও গভীর দাগ ওর জীবনে লেগে থাকে,চিরকাল।এই দাগ মুছে ফেলার সাধ্য পরাগের অন্তত নেই।


                                                                      সমাপ্ত

||পরিচিতি|| জন্ম ১৯৮২ সালে কোচবিহার জেলার প্রান্তিক শহর হলদিবাড়িতে। বর্তমানে বৈবাহিক সূত্রে জলপাইগুড়ির বাসিন্দা ইংরেজি সাহিত্যের এই ছাত্রীর লেখালিখি শুরু ছোটবেলাতেই। ইংরাজির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশবিদ্যায় স্নাতকোত্তরও করেছে সে। কবিতা দিয়ে শুরু, পরবর্তীতে ছোটগল্প, অণুগল্প প্রকাশিত হয়েছে বহু পত্র পত্রিকায়। ফিচার লেখাতেও সমান স্বচ্ছন্দ। যৌথভাবে অণুগল্প সংকলন ছাড়াও আরও অনেক সংকলনে লেখা প্রকাশিত হয়েছে।কলকাতা বইমেলা ২০১৮-য় প্রকাশিত হচ্ছে 'গল্প, বৃষ্টিফোঁটার মতো', শাঁওলির প্রথম একক গল্প গ্রন্থ। নির্বাচিত গল্পের সবগুলোই কোনো না কোনো বাণিজ্যিক কিংবা ছোট পত্রিকায় প্রকাশিত। উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি বই পড়ে , গান শুনে এবং ঘোরাঘুরি করেই লেখিকার অবসর কাটে। বই আর কলম যেন আজীবন সঙ্গে থাকে এইটাই ভবিষ্যতের চাওয়া।

৭টি মন্তব্য:

  1. কৌতূহলের পারদ বাড়তে বাড়তে যখন আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে ঠিক তখনই এল ক্লাইম্যাক্স। গল্পের একেবারে শেষে এসে কৌতূহল নিবৃত্ত হল পাঠকের। নিপুণ মুনসিয়ানায় গোটা কাহিনিটি বুনে গেছেন গল্পকার। কোথাও একটুও শ্লথ হয়নি গল্পের গতি। অনেক অভিনন্দন রইল গল্পকারের জন্য।

    মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য

    উত্তরমুছুন
  2. কৌতূহলের পারদ বাড়তে বাড়তে যখন আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে ঠিক তখনই এল ক্লাইম্যাক্স। গল্পের একেবারে শেষে এসে কৌতূহল নিবৃত্ত হল পাঠকের। নিপুণ মুনসিয়ানায় গোটা কাহিনিটি বুনে গেছেন গল্পকার। কোথাও একটুও শ্লথ হয়নি গল্পের গতি। অনেক অভিনন্দন রইল গল্পকারের জন্য।

    মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য

    উত্তরমুছুন
  3. দারুন লিখেছেন। অনেক অভিনন্দন। ভাল থাকুন। আরো দারুন লিখুন।

    উত্তরমুছুন

Featured post

সোনালী মিত্র