আপ্পি হোসেন।।

মায়াজম
0
"ডোমপর্ব"চিতার  আগুনে শব্দের জীবন্ত অঙ্গার 




যুগান্তরের আহ্নিকের সাথে সাক্ষী থাকে মহাকাল, অসীমান্তের কক্ষপথে ভ্রমণ থাকে, শব্দসঙ্গম ও তার ঔরসে জন্ম হয় কবিতার- ও সেই সাথে একজন পিতার; জীবনালেখ্য পরিসমাপ্তি ঘটলে মৃত্যু আসে, অতঃপর মানুষের সাথে নতুনকরে পরিচয় হয় ডোমের । এক্ষেত্রে দ্বিমত নেই আলোচ্য কাব্যগ্রন্থ 'ডোমপর্ব'- আত্মদর্শনে সাজানো নানা বিষয় নানা দিক গ্রথিত একটি ক্যানভাস। কবিতায় সাঙ্গিকতা নিয়ে কবি যে অধিকার অর্জন করেছেন তা স্বোপার্জিত এবং যথেষ্ট পরিণতির অভিমুখে চালিত।
তরুণ কবি 'অরিণ দেব' সময়ের গতানুগতিকতাকে উপেক্ষা করে স্বকীয় ধ্যান ধারণায় রচনা করে চলেছেন একেকটা মনুমেন্ট। 
নান্দনিকতা ও বহুমাত্রিকতায় ভর করে চলা এমন রচনা খুলে দিতে পারে বাংলা সাহিত্যের এক নতুন দিগন্ত, এই বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করে আছি।

অস্পষ্টতা, রহস্যময় জীবনবোধ থেকে মৃত্যু আন্তক্রিয়া কিভাবে শিল্প হয়ে যায়- কিভাবে 'ডোম' রূপে সপ্রতিভ দাঁড়িয়ে থেকে সয়ং কবি তার পরিণতি দিয়েছেন; পাঠক তা স্বাভাবিক ভাবেই উপলব্ধি করতে পারবেন, আর এখানেই কবির সাফল্য।
মৃত্যু, শবযাত্রা, চিতা, ও লাশঘরের সাথে ডোমের জীবনের মোড়ক গুলি এসেছে নতুন নতুন রঙে, নতুন নতুন শব্দে এবং যথেষ্ট মর্মার্থ সহযোগে। 
ডোম এখানে কেবল এক বিশেষ সম্প্রদায় বা পেশা নয়.. প্রতিটি মানুষের ভিতর একজন ডোমের অবস্থান, কবি সেই আত্মাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। তার কথায়- " ডোম একটা প্রতীক।দয়ামায়াহীন আদালত"।
ডোমপর্ব আত্মস্থ করলে পাঠকের মন পরিণত এবং সুগভীর চিন্তাশক্তির অধিকারী হতে পারবে, পাঠক নিজেকে সেই আদালতের বিচারক রূপে দেখতে পাবেন।

"লক্ষ লক্ষ দিন ধ'রে ডোম ছুঁয়ে আছেন চিতার ভগবান
দেহের ঈশ্বর লীলা শেষে কালজয়ী আগুনে শুদ্ধ হতে এসেছেন।" --
এই গ্রন্থটি এক বিশেষ শ্রেণী 'ডোম' যাদের অচ্ছুৎ ভাবা হয় অথচ অন্ত্যেষ্টির অপরিহার্য কাজে তাদের স্মরণাপন্ন হতে হয়। শবদেহ শেষক্রিয়ার সাথে জীবনের অন্তর্দর্শন ও জৈবিক উদ্দেশ্য তথা পরাভব সহ শৈল্পিক চিত্রায়নের মত কাজকে দারুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন কবি। ডোমের কর্মকলাপকে প্রতীকী এবং গভীর আবেগে গ্রহণ করেছেন, জীবন থেকে মৃত্যুযোগ এই ভ্রমণকে করেছেন দর্শণকেন্দ্রিক। -
"দেহপোড়া গন্ধ নিয়ে যিনি সঙ্গম করতে পারেন, তিনিই ডোম। যিনি আগুনের ভাষা বোঝেন তিনিই, ডোম।
--তিনি আপ্তসহায়ক পঞ্চভূতের, আগুন উসকে দেওয়া কাজ"। -এমনই গভীর বাক্যাংশ গুলি বুঝিয়ে দেয় কাব্যগ্রন্থটি কোন্ তাৎপর্য বহন করে চলেছে।
"ঠোঁটের বিড়িটি নিভিয়ে বর্ষার রাতে ভেজা শ্মশানচাতালে বসে বহুবার ভেবেছেন.., কাকে পোড়ায় সে? কে পুড়তে আসে?" 
জিজ্ঞাসা গুলি অমোঘ উপসর্গে সংস্থাপিত হয়েছে, কবি অরিণ দেব জীবন ও যাপনের উপর উপলব্ধির অন্তিমতাকে যে'রূপে পৌঁছে দিয়েছেন পাঠক হিসেবে তার একটি মৌলিক বিশ্লেষণের প্রাপ্তিযোগ ঘটে।

"নিষ্ঠুরতা আজীবন মুখচোরা। কাউকে জানান না দিয়েই
চলে আসে, অভিব্যক্তিহীন মুখে আদুরে জাতক
জরায়ুর জল ভেঙে বেরিয়ে আসছে আর পুড়তে পুড়তে অদ্য শেষ রজনীর বিবেক গাইছে মন।" 
--কঠিন ধরাধাম মানুষের জীবনান্ত সত্য এবং নীরবে আসে, কেউই তার রদ করতে পারে না। এখানে অতিথি আত্মার বিরাজ থাকে তার উপজীব্য অনুসন্ধান করাই শর্ত, কবি আমাদের শেখান জন্মবিশ্বাস যাপন বিশ্বাস নির্মল ভুবনের সে অধিকার, যেটি আমরা জন্মিক উপহার হিসেবে পেয়েছি, একটি পরম্পরা কোথায় তার মুক্তি- সেই সন্ধানে মৃত্যু অবধি যাওয়া! বারংবার পুড়ে পুড়ে আগুনের স্বাদ গ্রহন করা-- "জীবনে প্রথমবার পোড়াটা ভীষণ কঠিন। যেন পুড়তে চায় না।
তারপরে, অভ্যাস, পোড়ার যন্ত্রণা থাকেনা মনে..." 
কবি যেন নিজস্বতাকে দহন করে নিমজ্জিত হন একটি আর্তভূমিতে--
"আমি ডোমের দিক থেকে সরে যাচ্ছি ফসলের দিকে
ডোম আগুন নিয়ে আমার দিকে সরে আসছেন।
সন্তান সরে আসছে শুকনো পাঁকাটি'র দিকে
খেলার নাম দেওয়া যাক চেয়ারসিটিং"--
এই কাব্যগ্রন্থে দার্শনিক বোধ সম্পর্কে বলতে গিয়ে অবাক হয়ে যেতে হয়- লেখায় বহুত্বের মিশ্রণ দেখা যায়। একজন তরুণ কবি কিভাবে জন্ম দিয়েছেন এমন দীর্ঘ আর অনুপম আবেগ! মৃত্যু- বিষাদ নিয়ে সত্য এবং অন্তিমতার এমন দুর্দান্ত রচনা একটি ব্যক্তিগত এলিজির নিরিখে বুঝি সার্থকনামা হয়েছে।

"আকালের দেহ ধূপের ছায়ায়।
নারীর শরীর ছুঁয়ে আছি, হোমেরও
কৃষকের ধান ছুঁয়ে আছি, উদ্বেগও।"
এভাবেই ছুয়ে গেছে নারীর আগুন থেকে খোরাকী ধান, এই স্বীকারোক্তি, এই স্পর্শ কবিতার তত্ত্ব-তথ্য-জ্ঞান শব্দ-কাব্য মিশেলে মৌলিক এক ছবি একেঁছেন কবি। 
তিনি কখনো চলে গিয়েছেন মড়াকাটা টেবিলে মৃত শরীরে কাটাছেঁড়া ও মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের করতে। গোয়েন্দার চোখ নিয়ে রহস্যকেন্দ্র খুঁজে বের করতে তিনি চালিয়ে দেন ধারাল ছুরি, ত্বকের রিপু করণে খুঁজে পায় এক শৈল্পিক সত্য যা লুকিয়ে থাকে মাংসে-রক্তে; আসলে শরীর তো নয় যেন একটা জীবনের ময়না তদন্ত তুলেছে টেবিলে, রোজই তোলে সেই মহাভার; কবি কথায়--
" নিশিমাখা রাতে শব ব্যবচ্ছেদের আসরে ডাক্তার ও ডোম অভিন্ন দেহের কারবারি...
মড়ার আশাহত চোখ থেকে জীবনের অতৃপ্তিগুলি খুঁজতে খুঁজতে ডাক্তারবাবু ডোমের কাঁধে হাত রাখেন। কতকাল যেন দুই বন্ধু আজ খুঁজে পেয়েছেন একে-অপরকে।" 
এইসব সামাজিক বিষয় ও গুরুকার্য গুলি অনায়াস দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন কবি।এরকম আরো কিছু দিনদৈনিক ছবি আধুনিক সময়ের মর্জি ও যুগলক্ষণ নিয়ে হাজির হয়েছে - "মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে বিজ্ঞান এগিয়ে যায়।
অথচ ডোমের হাত কোনদিন স্থিরতা পায়না"
আরো ভালো ভাবে যখন বলেন-
"পরিবর্তিত সময়ে কাঠের চুল্লির পরিবর্তে
বৈদ্যুতিক চুল্লির রূপরেখায় ডোমের পোশাক বদলে গেলেও শব কিন্তু অপরিবর্তিত থাকে।" 
এই কাব্যগ্রন্থটিতে প্রবেশ করলে পাওয়া যায় কিছু অমোঘ দর্শন, যেগুলি বুঝতে হলে পাঠককে সামান্য হলেও পরিণত বোধের অধিকারী হতে হবে এখানে এসে পাঠক আত্মদর্শন ও বিযুক্তির স্বেদজলে অবগাহন করতে পারবেন । উল্লেখ্য কবির কাব্যভাবের সাথে পাঠকও যেন নিজেকে শিক্ষিত করে তুলতে পারে। আধুনিক সাহিত্যে বর্তমানে কিছুটা জটিলতা লক্ষিত হচ্ছে মানুষের বোধের সাথে কাব্যভাবের একটা জটিল ঘূর্ণাবর্ত, সেই আবর্তের সাথে নৈরাশ্য ও হতাশা ও ভেতরের যে জমায়িত ক্ষোভ, কবি ডোমের নামে নিজের সেই কথাগুলিই বলে গিয়েছেন নিজের মত করে। ধর্মীয় আচার ও মার্কসীয় দর্শনের মিশ্রণ সুচারু ভাবে লক্ষ করা যায় এই কাব্যগ্রন্থে। এছাড়া ধর্মিয় সংস্কারের সাথে জ্ঞানদর্শনও প্রাপ্তব্য। 
"নতুন ফসল যেমন ভুলে যায় পুরনো ফসলের ঘ্রাণ, তেমনই নতুন জীবন ভূলে যায় পূর্বপুরুষের ঋণ। দুঃখের অলীকগড়ে সব্বাই আনন্দ চায়
ডোম হাসে, মদ খান, বারবার হিসু করে দুঃখকে ভাগান!" মানুষ অভিজ্ঞার ঘাত প্রতিঘাতে বিবর্তন বোঝে, দারিদ্রের সাথে সহবাস, ছিন্নমূল হওয়ার যন্ত্রণা এসব থেকে পাওয়া না-পাওয়ায় অস্থিরতা কোন সংস্কারে বাঁধা ডোমের জীবন কী তার নিয়তি, জীবনের উদ্দেশ্য কী? চিতায় শুয়ে থাকা লাশ আর আগুনের কারুকার্য স্বজনের আর্তনাদ এসবে তার জীবন কোথায়? এমন সব প্রশ্নের জন্ম দিতে পেরেছে এই কাব্যগ্রন্থ। কিছু বাক্য চমকে দেয় তার তাত্ত্বিক ভাবার্থে, যেমন- 'মৃত্যুকে গুপ্তরোগের মত আড়ালে রাখতে চান মানুষেরা।' এমন আরো কিছু কথা- 'প্রত্যেক মনের মধ্যে প্রেম ও ডোমের কুস্তির আখড়া' একেকটা লেখনী অন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। উপলব্ধির গণ্ডি ছাড়িয়ে কবিতা পাড়ি দিয়েছে সমাজ, দেশ, জাতির আত্মউন্মোচনে। সমাজ ও সময়ের সাথে সম্পৃক্ত করে দেখার নিদারুণ এই প্রয়াস অবশ্যই প্রশংসনীয়। 
"মৃত্যুর পরম মিত্ররা বিষদাঁত ভাঙা সাপের ফণার মতো
ফোঁসফোঁস করতে করতে ঈশ্বর, শয়তান ও যমকে
একই আসনে বসিয়ে যতখানি নিন্দামন্দ করে
তার আধুলি পর্যন্ত জীবনকে ভালবাসলে মৃত্যুও
সুগন্ধ ফুলের মত দেখা দিত জীবনে।"--
কোন কবিতা কিভাবে বেঁচে থাকে তা জানা নেই তবে পাঠকের মনে দীর্ঘ কবিতার বেঁচে থাকার যে শর্ত যে ঝংকার এবং রাগ ভঙ্গিমার দরকার 'ডোমপর্ব' তার যোগ্য অধিকার নিতে পেরেছে বলেই আমি মনে করি। একথা মানতেই হবে আধুনিক সাহিত্য বিশ্লেষণমুখী এবং নিরপেক্ষ নয় বরং প্রচার, নাম ও জৌলুসে ভাসার প্রবনতা তার। কবি এসব উপেক্ষা করে গেছেন শুধু-
গোটা কাব্যগ্রন্থ জুড়ে একটি জীবনচরিত কে তুলে ধরতে চেয়েছেন, সমাজের নিচুতলার একটি অবহেলিত উপেক্ষিত শ্রেণী ডোম এখানে রূপক; কবি তারই চোখে সমাজ ও সময়কে ধরতে চেয়েছেন।
গতানুগতিক মিথ ও বাস্তবের সাথে কাব্যদেহের সুনির্মাণ ঘটেছে দক্ষ কারিগরের কলমে। কবিতার বাক্য গঠনের অভিনবত্ব ও তার ভাঙচুরের খেলা ঈর্ষণীয়। পুরো কাব্যগ্রন্থে জীবনদর্শনের কোলাজ যে অপরূপ ধ্বনিমাধুর্যে ফুটে উঠেছে তা স্বচেতন পাঠককে স্পর্শ করবেই। এই কাব্যগ্রন্থে শিরোনামহীন কবিতাগুলিতে যদিও বিশেষ কিছু শব্দ এবং বাক্যের বারংবার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, কিন্তু তাতে কোন ছন্দপাত নেই। তাই গতানুগতিক বিচারবোধে না ফেলে আধুনিক দৃষ্টিতে কবির নিজস্ব চিন্তাশীল চেতনার জগৎকে উপলব্ধি করতে পারলে সেটি হবে দারুণ সার্থকতা। এর মধ্যে একপ্রকার নেশা আছে। বিমোহিত হওয়ার নেশা। এখানেই পাওয়া যাবে কাব্যবোধের গভীর উপলব্ধি। কখনো কখনো আমরা বিষাদে আক্রান্ত হই কিংবা অবসাদে,আমাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে এমন কিছু শব্দ এমন কিছু উপলব্ধি যা আমাদের চেতনায় মননে স্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। আর একজন একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে ঠিক তখনই আমি খুঁজে নেব, আপন হাতে তুলে নেব কবি অরিণ দেবের এই অসামান্য কাব্যগ্রন্থ 'ডোমপর্ব'।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)