শম্পা মাহাত - মায়াজম

Breaking

১৬ জুন, ২০১৮

শম্পা মাহাত

                প্রতিক্রিয়া এবং পুণর্পাঠ
-----------------

এভাবে বলার বিশেষ কারণ আছে। বিনয় এবং খানিক কুন্ঠার সাথে বলি, খুব বেশি পড়তে পারি না আমি। সেক্ষেত্রে বলা ভাল, যে লেখাগুলোর প্রতি আমি আকৃষ্ট হই সেগুলো নিজেরাই যেন আমাকে পড়িয়ে নেয়। ঐ সময় লেখাগুলো আমার থেকেও বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমি নড়েচড়ে বসি। হাঁটুমুড়ে বসি। বইটির সামনে। বারংবার পড়েও শেষ হয় না পড়া।
টাইমলাইনে স্ক্রল করতে করতে একদিন হঠাৎ ভেসে উঠেছিল "প্রজাপতি শুয়ে পড়ছে পোকায় পোকায়/এসবই নবান্ন, রক্তচর্চা আমাদের/গেরিলা উৎসব",তারপর বেশ খানিকটা সময় লেগেছে বইগুলো জোগাড় করতে। সেগুলো পড়তে পড়তেই খবর পেলাম কবির ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্হটি আসছে বইমেলা ২০১৮তে। স্বভাবতই বইটা নেব মনস্হির করেই গেছিলাম, বইমেলায়।
অনেকক্ষণ কেটে গেল সূচিপত্র থেকে প্রথম কবিতাটির দিকে যেতে। মাঝের পৃষ্ঠায় তিনটি লাইন "মাটিসর্বস্ব ডাকি তোমাকে/ আকাশ পর্যন্ত সহ্য করে যাই/ এ নেশা আমার কাটিয়ে দিয়ো না ঠাকুর" আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। কবির শাশ্বত উচ্চারণ, এক অপরিসীম দৈর্ঘ্য প্রস্হে টেনে দিল আমার মত এক তুচ্ছ পাঠকের চিন্তাশক্তি।
বইয়ের ৫৬টি কবিতা আমি বেশ কয়েকবার পড়েলাম। ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় কবির তাৎক্ষণিক চিন্তার প্রতিফলন প্রকাশ পায় কবিতায় এবং পাঠক সেই সূত্রটিকে ছুঁয়ে ফেলতে চান কবিতাটি পাঠ করে। কবিতা সেই সাঁকো, আমার না পৌঁছাতে পারা জায়গাগুলোয় পৌঁছতে পারার।সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এই বইয়ের ৫০টি কবিতা আমাকে নিরাশ করেনি। নিপুণ দক্ষতায় কবি তুলে ধরেছেন সাম্প্রতিক সময়। সময়ের ঘাত প্রতিঘাত।
স্বল্পদৈর্ঘ্যের কবিতাগুলির প্রতিটিতেই রাখা আছে বাস্তব দৃশ্যপট। দোদুল্যমান সময়, আশা নিরাশা সবকিছুকে জাপটে নিয়ে যে বেঁচে থাকা বা যাপন, তার কথা। একই দেখা কিছুটা অন্য দৃশ্যকোণ থেকে দেখে কবি বলেছেন "এই জন্মের কাশফুল প্রস্তুত রাখি তবে/আড়াল হোক মায়া হোক ঘন...নিরুপায়/আর সন্ন্যাস থেকে ফিরে আসুক লবণ"। বইটির প্রথম কবিতার লাইন, কবিতাটির নাম লগ্ন। এক ভীষণ বেঁচে থাকার কথা কাব্যিক আঙ্গিকে লিখে রেখেছেন কবি "আড়াল হোক মায়া হোক ঘন...নিরুপায়"। জন্মনিরোধক নামে অপর একটি কবিতায় কবি বলেছেন "রাস্তা নেই কোথাও শাড়ির নীচে শিশু ঘুমোয়, খিদে বাজারে বাজারে ঘোরে বালকভোজন..." বাংলা কবিতায় এই স্বর, সময়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার এই আঙ্গিক একেবারেই কবির নিজস্ব এবং স্বতন্ত্র।
'ফেরত' কবিতায় কবি সমুদ্র বেছে নিয়েছেন উপমায়, পাঠককে ছুড়ে দিয়েছেন একটি প্রশ্ন "তোমার সঙ্গে যে এসেছে,/সে দেখছে, তুমি আর ফেরত পাঠাচ্ছো না সমুদ্রকে,/তখন?" কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে একটা আলোড়ন হয়, কখনও আয়নার মত লাগে কবিতাগুলোকে। 'কিচিরমিচির' 'আবিষ্কার', 'ভ্রমণ নয়', 'একা সভ্যতা', ঝিঁঝি 'ধ্বনি','নরম' এরকম এক এক করে প্রায় সব কবিতার কাছেই বারবার ফিরে যেতে হয়।

তবে দু একটি একই শব্দ ঘুরেফিরে এসেছে বিভিন্ন কবিতায়, যদিওবা সেই কবিতাটির ক্ষেত্রে শব্দটি প্রাসঙ্গিক তবুও মনে হয়েছে একই অর্থের অন্য শব্দ প্রয়োগ বইটিতে আরও বৈচিত্র্য আনতে পারত। হয়ত বাংলা কবিতার প্রতি এক অসম্ভব খিদে থেকে কথাটা উঠে এল।
আশ্চর্য হতে হয় বইটির প্রচ্ছদেও। অসাধারণ প্রচ্ছদ কবি'র নিজের অঙ্কনকৃত। আপাতদৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর অথচ সুন্দর। অনুভব করতে গেলে পড়ে দেখতে পারেন।
কাব্যগ্রন্থ: চুপ
কবি: পলাশ দে
প্রকাশক: তবুও প্রয়াস
প্রচ্ছদ: পলাশ দে



 প্রত্যেকদিন আমাদের অনেকগুলো মুহূর্ত কাটাতে হয়। অনেক আবেগ, অনুভূতি ছুঁয়ে অথবা সময়বিশেষে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে হয় পরবর্তী সময়ে। এই এগোনোর পথে কখনও সখনও আটকে পড়ি আমি। কখনও আবার এমনও হয় পার হতে গিয়ে ভীষণ রক্তাক্ত হই যা আরও এগোনোকে প্রতিহত করে। স্বভাবতই সেরে ওঠার ওষুধ অনেক আগে থেকেই রেডি রাখতে হয় আমায়। কবিতা আমার কাছে সেরকমই এক ওষুধ।


কবি অমিতাভ দাস এই সময়ের এমনই একজন অন্যতম লেখক, যাঁর কলম থেকে পাওয়া মর্মস্পর্শী কবিতায় ভর করে আমি অনেক দুঃসহ সময় পার হতে পারি অবলীলায়। ২০১৮, কলকাতা পুস্তক মেলা থেকে আমার সংগৃহীত বইগুলোর মধ্যে অন্যতম "নির্বাচিত ১০০"।

নানা সময়ে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ থেকে নির্বাচিত কিছু কবিতা এবং নতুন কয়েকটি কবিতা একত্রে মলাটবন্দি হয়েছে এই সংকলনে। মোট 100 টি কবিতাই সিরিজ কবিতা হলেও প্রতিটিই এক একটি পূর্ণ কবিতা। নাম হয়ত এক। তবে প্রতিটি কবিতাই স্বয়ং সম্পূর্ণ ।

একটি স্বার্থক, কালজয়ী কবিতাকে কিছুটা ছু্ঁতে পাঠককেও বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হয়। ছুঁতে পারলে সেই পরমানন্দের সাক্ষাত পাওয়া যায়। বইটি পড়ে তেমনই এক উপলব্ধি হল। যদিও প্রত্যেকে একইরকমভাবে দেখবেন না এটাই স্বাভাবিক। 

কবি যখন বলেন "প্রথম প্রণয়কালে মানুষ গাছের মত/ সবুজ আর সতেজ। ছবি ভেঙে গেলে পর/ভালোবাসা মরুধুলো শুধু ক্যাকটাস কাঁটা/অভিমানে কাদাজল বসে থাকা একা একা" আমার মধ্যে নিমেষে দুটো আমি জন্মে যায়, প্রথমজন প্রণয়ের দিকে ঝোঁকে দ্বিতীয়জন বিরহ। 'আমি রাত্রি লিখি' নামক এই কবিতাটির শেষ লাইনে কবি লিখলেন "ঈশ্বরের চোখে ছায়া কাঁপে, তিনিও আহত হন" এ যেন এক অমোঘ উচ্চারণ, যা মর্মে প্রবেশ করা মাত্র সমস্ত ব্যথা দোসর হিসাবে পেয়ে যায় ঈশ্বরকে। ভালো লেগেছে বীজ, ভাঙন, বৃষ্টি পড়ে, মহাষ্টমী, আমি রাত্রি লিখি, নিঠুর, মাতৃকথা, মনস্তাপ, রাতের জার্নাল একে একে প্রায় প্রত্যেক কবিতাই। 


মনখারাপ হবে জেনেও আমি আবার পড়ব বইটা এমনই এক জাদু কবি ছড়িয়ে রেখেছেন বইটিতে। বইটির শেষ কবিতাটি তুলে দিচ্ছি যে কবিতাটি শুরুর প্রত্যয়কে গাঢ় করে

যদি কোনও দিন সে
--------------

সে বলেছিল: ছাদে না দাঁড়ালে
আকাশ চেনা যায় না
আরও বলেছিল, তার স্বপ্নের যে আকাশ
তা খুব নীল
একটা গাছের মত আমি আজও
দাঁড়িয়ে আছি যেন দীর্ঘ ইউক্যালিপটাস গাছ
ছুঁতে চাইছি আকাশ অথচ আকাশ
মানে শূন্য, মহাশূন্য-এই বোধটাই
নেই আমার। আমার শিকড়
ক্রমশ মাটির গভীরে চলে যাচ্ছে।
খুব গভীরে
সে বলেছিল বলে আমি আজও
দাঁড়িয়ে আছি, দাঁড়িয়ে থাকব
যদি কোনও দিন সে ফিরে আসে।
আকাশ চিনিয়ে দেয়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র