জ্যোতির্ময় মুখার্জি

মায়াজম
2
ভাদু
…...আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা।

খন ছেলেবেলা, সন্ধ্যায় রাত হয়ে যাওয়া গ্রামের মেঠো বাতাসে প্রথম প্রহরের ডাক ডেকে গেল কয়েকটা শেয়াল। দেখা যায় না ওদের, তবু ওরা আছে, তবু ওরা আছে আমাদের চারপাশে, জ্বলজ্বলে দুটো চোখে…..কিছুটা লোভ, কিছুটা ভয় মেশানো হুক্কা হুয়া রবে জানিয়ে গেলো, অনেক তো হলো পড়া, এবার থামা বাছা। হয়তো আমগাছের মগডালে বসে থাকা লক্ষীপেঁচাটাও দেখে নিলো, ঢুলুঢুলু চোখে দুটো কিশোর-কিশোরী (আমি আর দিদি) গুনগুনিয়ে গুনে চলেছে নামহীন নামতা। হ‍্যারিকেনের কাঁচে শেষ চুমু খাওয়া পোকাদের অবশ্য এসব খেয়াল ছিল না, খেয়াল রাখতো না চুপিচুপি নামতা গুনতে আসা ঢোঁড় বা মেটুলি সাপেরাও। আমার কান কিন্তু খাঁড়া, পাশে শুয়ে থাকা ভুলোর (পোষ‍্য কুকুর) মতোই, কখন খোল-করতাল বাজিয়ে আসবে সে, আসবে তারা, ছুটে যাবো আমি আর ভুলো …..তারপর এপাড়া-ওপাড়া, কিছু বাতাসা, কিছু মন্ডা-জল। আর ছুঁয়ে তাকে বা জড়িয়ে, একটা মিষ্টি মিষ্টি ছোট্ট পুতুল ছানা…...ভাদু।
গ্রামতুতো সম্পর্কের সূত্র ধরে ছোটবেলা থেকেই জেনে নিয়েছিলাম বাংলার লৌকিক দেবদেবীদের, ঠিক জানা নয়, আসলে তারা তো ছিলো এবং আছে ঘরের লোক হয়েই। মাসে মাসে আসে আর যায় তারা বা দিনে দিনে রুগ্ন অপুষ্ট বাঙালির পেটে কিছু ফলমূলের বন্দোবস্ত করে, বন্দোবস্ত করে রঙহীন বাঙালির ঘরের আশেপাশে কিছু রঙবেরঙের ফুলের। আমার কাছে দেবদেবীর গুরুত্ব ঠিক এখানেই, প্রসাদী ফুল মাথায় ঠেকিয়ে, মুখে পুড়ে নেওয়া হয় যে ফলপ্রসাদ, তাতে কতটা দেবদেবীর এঁটো লেগে থাকে জানিনা কিন্তু এটা নিশ্চিত জানি ভিটামিন, প্রোটিন, মিনারেলগুলো কিলবিলিয়ে ওঠে পাকস্থলী জুড়ে। শেষ পাতে এঁটো চাঁটা, ঋতুমতী বাঙালি মেয়ে বৌ’রা যে এখনও ডোডো পাখি হয়ে যায়নি তার কৃতিত্ব কিন্তু পুরোপুরি এই বারো মাসে তোরো পার্বনের।
বাগান করা বাঙালির ধাতে নেই, ধাতে নেই এই আপ্তবাক‍্যটা স্মরণ করার যে, "An apple a day keeps the doctor away." বাঙালি ইংরেজদের কাছে অনেক কিছুই শিখেছে, কিন্তু শেখেনি বাধ্যতামূলক সৌন্দর্য ও সাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনীয় পাঠগুলি। তা না শিখুক, বাঙালি আছে বাঙালিতেই, বাঙালি থাকুক বাঙালিতেই। বাঙালির দেবদেবীরাও বাঙালির মতোই, পেটফুলো শিব গাঁজার টান মেরে চলে ভিক্ষা করতে, ওদিকে উমা চার ছেলেমেয়ে নিয়ে ব‍্যতিব‍্যস্ত, নুন আনতে পা ফুরানো সংসারে স্বামীটাও হয়েছে তেমন, মাঝে মাঝে ভুলেই যায় বাড়ি ফিরতে, গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে শ্মশানে। কতো আর সহ‍্য করা যায়! কতো আর ঝগড়া করা যায়! রেগেমেগে চলে যায় সে বাপরে বাড়ি। তবু মন কেমন কেমন করে ভোলেভালা স্বামীর লগে, এদিকে পেটমোটা শিব’ও ছুটে আসে বৌকে ফিরিয়ে নিতে, কাঁচুমাচু মুখে বলে, চল বাড়ি চল, এতো রাগ কেনো করিস বৌ? জানিসই তো আমি এট্টু এই রকমই, তা বলে রাগ করতে আছে বল? চল চল বাড়ি চল।
উমা তো দ্বিধাগ্রস্ত, কী করা যায়? যেতেও ইচ্ছা করছে কিন্তু…..
সামাল দিলো মেনকা।
জামাই বাবাজীবন কখন এলে? এসো বাবা এসো, বসো বসো।
না, আমি বসবো না, উমাকে নিয়ে যেতে এসছি, এখনই নিয়ে যাবো।
তা কি হয় বাবা? এসেই কি চলে যেতে হয়? ঘরে এসো, বসো। দূয়ার থেকে চলে গেলে যে সংসারের অমঙ্গল হবে বাবা! তোমার বিছানা করে দিচ্ছি ওই বেলগাছের মগডালে, তুমি খেয়ে দেয়ে একটু জিরিয়ে নাও বাবা।
অতঃপর, মহা ধুমধাম, নতুন জামা কাপড় পড়ে ছেলে বুড়োরা চলেছে পূজা মন্ডপে। আমরাও তখন কী ব‍্যস্ত! কী ব‍্যস্ত! খেয়ে আর ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করার সময় আছে নাকি?
বাঙালি দেবদেবীরা এমনই, তারা ঠিক বৈদিক বা হিন্দু দেবদেবী নয় মোটেই। তারা আমাদেরই মতো। তারা হাসে তারা কা‌ঁদে, তারা রাগে অভিমানে গাল ফোলায় এবং পেট। হিন্দুদের থেকে বাঙালিরা এখানেই আলাদা এবং সতন্ত্র। তাইতো নির্দ্বিধায় চাই বাঙালি বাঙালিই থাকুক এবং বাংলার দেবদেবীরাও থাকুক বাঙালি হয়েই চিরদিন।
যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়…….এই বাক‍্যটি ধরে সবটুকু হেঁটে গেলে আমরা অনায়াসেই খুঁজে নিতে পারবো দেবদেবীর উত্থান এবং অবশ্যই পতনের ইতিহাসটুকু। হ‍্যাঁ, প্রতিটি ভয়ের উৎস হতেই দেবদেবীর সৃষ্টি এবং এই ভয়ই লালিত পালিত করে দেবদেবীদের, তাদের পুষ্টি যোগায়। মানুষ যখন অসহায় প্রকৃতির কাছে বা শাসন ব‍্যবস্থায়, যখন তার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন সে ভাবে, সে ভাবতে বাধ্য হয় কেউ তো আছে, কেউ তো আছেই অলক্ষ্যে, যে শাড়ি যোগাবে নগ্ন দ্রোপদীর, ঢেকে দেবে সবটুকু লজ্জা। এভাবেই দেবতারা জায়গা করে নেয় মানুষের মনে এবং এভাবেই মানুষ ভালোবেসে ফেলে দেবতাকে। মন্দিরের দরজা খুলে ডেকে নিয়ে আসে ঘরে, আসন পাতে রান্না ঘরে, শোয়ার ঘরে এমনকি গোয়াল ঘরেও। জড়িয়ে নেয় নিজেদের তাদের সাথে, তারাও আমাদের। যেভাবে জড়িয়ে নিয়েছিল ভাদু আমাকে এবং হয়তো আমিও তাকে, আমার হারিয়ে যাওয়া ছুটুবেলায়।
ছানা পুতুলটার ইতিহাস তখন জানতাম না, জানার দরকার’ও তো ছিলো না, ভাদ্র মাসের সন্ধ্যায় আসতো সে, ঢুলুঢুলু পড়া থেকে মুক্তি দিয়ে, নাচতে নাচতে কেটে যেতো সারা সন্ধ্যাবেলা, আমার ছেলেবেলা। পরে শুনেছি তার গল্প, ঠাকুমার মুখে ঠাকুরমার ঝুলি থেকে নয়, মিঃ ডিপেন্ডেবল্ গুগলের কাছ থেকে। ঠিক মনে পড়ছে না, মনেহয় সে বলেছিল, পুরুলিয়ার কাশিপুরের পঞ্চকোটের রাজা নীলমনি সিংহদেবের কন্যা ছিলো নাকি ভাদ্রেশ্বরী। সেখান থেকেই ভদ্রেশ্বরী এবং তা থেকে আদুরে ভাদু। বাঙালি মেয়েদের ইয়া বড়ো বড়ো নাম দেওয়ার রীতি ছিলো প্রথম থেকেই। তারপর যা হয়, খাঁদি বুঁচিরা ভুলে যায় তার নাম ‘ওগো শুনছো’, মা, কাকী, জ‍্যেঠি, দাদি, ঠাকুমা ডাকে সাড়া দিতে দিতে জীবনভোর।
গল্পটা ঠিক এমনই, কুমারী ভাদুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। আজ বিয়ে, তোড়জোড় পুরোদমে, বর বরণের উপকরণ’ও রেডি, মেয়েরাও এক হাত চুড়ি পড়ে ঝনঝন হাতে শাঁখ ধরে আছে ফুঃ দেওয়ার অপেক্ষায়, এমন সময়ই উলুধ্বনি বদলে গেলো ক্রন্দন ধ্বনিতে। বর খুন হয়েছে, পথিমধ্যে ডাকাতদের হাতে। সেই শোকেই নাকি ভাদু আত্মঘাতী হয়। ঠিক জানিনা কাহিনীটা কতটুকু সত্যি বা মিথ্যে কিন্তু এইটুকু নিশ্চিত জানি ঠগির দেশে এই কাহিনী ঘর ঘরকা, লগ্নচ‍্যুতা মেয়েরাও ভবিতব্য ‘পাঁক ঘাটার’ থেকে ‘মরণ রে তুহুঁ মম শ‍্যাম সম’ ভেবে শান্তি পেতো, সালঙ্করা বেশে আয়নায় চোখ রেখে শেষ হাসিটি হেসে যেতো সে, হেসে যেতো তারা।
ভাদুর স্মৃতিকে ধরে রাখতেই নাকি নীলমণি সিংদেও ভাদু গানের প্রচলন করেন এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই ভাদু উৎসব শুরু হয়। একটি মত অনুসারে ভদ্রাবতীর জন্ম ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যু ১৭ বছর বয়সে ১৮৫৮ সালে। অদ্ভুত, জন্ম ও মৃত্যু দুটোই ভাদ্র মাসে। নাম, জন্ম ও মৃত্যুর ত্রিবেণী সংযোগে ভাদ্র মাসে ভাদু পুজা হওয়ার একটা কারণ অবশ্যই খুঁজে পাওয়া যায়।
বিয়ে করতে আসা ভদ্রাবতীর হবু স্বামীর মৃত্যু হলে ভদ্রাবতী চিতার আগুনে প্রাণ বিসর্জন করেন বলে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার পুরুলিয়া গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই তথ্যটি বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে আমার। হয়তো এটা সহমরণ বা সতিত্ব প্রচারের প্রয়াস বা হয়তো সহমরণের নামে আদতে ছিলো একটি বালিকার খুন। যাইহোক, ভাদুর এই ইতিহাসটা জানার পর ছেলেবেলার সেই মিঠে স্বাদটা ক্রমশই তিতো হয়ে গেছে আমার কাছে। যদিও, রাজপুরোহিত রাখালচন্দ্র চক্রবর্তীর ‘পঞ্চকোট ইতিহাস’-এ এই ঘটনার উল্লেখ নেই। আবার আর একটি মতানুসারে, ভাদু আসলে শস‍্যদেবী। চাষিদের শষ‍্যবন্দনার যে রেওয়াজ তাই কালক্রমে বিবর্তিত হয়ে ভাদু উৎসবের সৃষ্টি। আবার ধর্মীয় মতানুসারে ভাদ্র মাসে যে রমনী লক্ষ্মী পুজো করেন তার উপর যশোলক্ষ্মী, ভাগ‍্যলক্ষ্মী, কূললক্ষ্মী প্রসন্ন হন। এই অর্থে, ভাদু লক্ষ্মীর এক রূপ বা ভাদ্র মাসের লক্ষ্মীকে ভাদু নামে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আবার একটি সরলীকৃত মত’ও পাওয়া যায়, ভাদ্র মাসের পুজো থেকে ভাদু পুজো। আর একটি মত অনুসারে, বর্ধমানের খনি অঞ্চলে প্রচলিত ‘ভাদা গান’ থেকে ভাদু উৎসবের সৃষ্টি।
আশুতোষ ভট্টাচার্য মহাশয় আবার ভাদুকে আদিবাসী সমাজে প্রচলিত বর্ষাকালের বা বিশেষ ভাবে ভাদ্র মাসের করম গানের হিন্দু সংস্করণ বলেছেন।
বীরভূমে আবার ভদ্রাবতীকে হেতমপুরের রাজার কন্যা হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। এখানে প্রচলিত লোককাহিনী অনুসারে, বিবাহ করতে আসা বর্ধমান রাজার পুত্র ইলামবাজারের কাছে চৌপারির শালবনে ডাকাতদলের হাতে নিহত হলে ভদ্রাবতী তার সহমরণে মৃত্যুবরণ করে। আর একটি লোককাহিনী অনুসারে, ভদ্রাবতী ভালোবেসে ফেলে অঞ্জন নামক এক নিম্নবর্ণের যুবককে, তারপর যা হয়, মৃত্যু অবশ‍্যম্ভাবী।
অর্থাৎ, ভাদুর সমস্ত কাহিনীর মূলে আছে একটিই সত‍্য…….একটি নারীর মৃত্যু।
সত্যিই তো, মৃত্যুর থেকে আর বড়ো সত্য কী আছে? তা না থাকুক, কিন্তু আর একটি সত্য এটাই যে, পঞ্চকোট রাজপরিবার থেকেই ছড়িয়ে পড়ে ভাদু গান তথা ভাদু উৎসব দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে। পঞ্চকোট রাজ দরবারে বসতো ভাদু গানের আসর। এই গান ছিল উচ্চমার্গের এবং সাহিত্য গুণ নির্ভর। গানের বোল বাঁধতেন রাজপরিবারের সদস্য ধ্রুবেশ্বর লাল, প্রকৃতীশ্বর লাল ও রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং দেও। তাঁরাই 'দরবারী ভাদু' ঘরানার সৃষ্টিকর্তা। তারপর ভাদু গান ছড়িয়ে পড়লো, মূলতঃ পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান জেলার কিছু অংশ এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচি ও হাজারিবাগ জেলায়। পরিণত হলো এইসব অঞ্চলের লৌকিক উৎসবে।
কিন্তু প্রশ্ন এটা নয় যে কেন রাজপরিবারে একটা নতুন রকমের গান গাওয়া হতো, প্রশ্ন এটাই যে কেনো রাজপরিবার থেকে ছড়িয়ে পড়লো ভাদু গান সাধারণ মানুষের মধ্যে, কেনো তারা ভাদুকে আপন করে নিলো, কেনো তারা ভাদুকে বাঁচিয়ে রাখলো এতদিন ধরে এবং কেনো রাজপরিবারে ‘সখে’র গান থেকে ভাদু হয়ে উঠলো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সুখ-দুংখের সাথী, তাদের ঘরের মেয়ে।
সাধারণ ভাবে এর একটা উত্তর হতে পারে, সহজ সরল সুরে বোনা এই গানগুলিতে একটি মেয়ের কষ্ট যন্ত্রণা এবং মৃত্যুর ইতিহাস সাধারণ মানুষের মনে প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষত মেয়েদের, তারা খুব সহজেই ভাদুর জীবনের সাথে নিজেদের রিলেট করতে পেরেছিল। তারা অনায়াসেই খুঁজে পেয়েছিল নিজেদের ভাদুর মধ্যে, তাই তারা ভাদুকে কাছে টেনে নিয়েছিল। ভাদুর সাথে ছড়িয়ে পড়া সতীত্বের বা সহমরণের সত্য বা গুজবটাও মহিলা মনে ব‍্যাপক প্রভাব ফেলেছিল এটা নিশ্চিত এবং আমি মনে করি সহমরণের এই টোটকাটা ছাড়া একটি সাধারণ মেয়ে কখনোই দেবী হিসাবে পূজিত হতে পারত না। তার করুণ পরিণতিতে সমব‍্যথী হতো, সহজ সরল গানের অভিঘাতে মন ভরতো কিন্তু কখনোই দেবী হিসেবে পূজিত হতো না। সেইসময় সহমরণে যাওয়া মেয়েরা, মেয়েদের মধ্যে দেবীর আসন লাভ করতো, সতী হিসাবে ঘরে ঘরে পূজিত হতো তারা এবং কী আশ্চর্য! এটাকে মেয়েদের একটা বিরাট প্রাপ্তি, বিরাট সৌভাগ্যের ব‍্যাপার হিসাবে দেখতো মহিলারাই এবং তারাই সহমরণে যাওয়া মেয়েদের সিঁদুর যোগাড় করে সেই সিঁদুর সিঁথিতে লাগিয়ে সতীত্বের পূণ্যের অংশীদার হতো। আমরা খেয়াল করলে দেখবো, মূলত মহিলাদের হাত ধরেই ভাদু উৎসব ছড়িয়ে পড়েছিল দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে, হয়তো সতীর ইতিহাসটাই এইক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
কিন্তু আমার মনে হয় এটাই সব নয়, সতীর ইতিহাস এবং সহজ সরল গানের অভিঘাত ভাদুকে মানুষের মনে সহজে জায়গা করে দিলেও, এতদিন ধরে টিকে থাকা এবং লৌকিক উৎসবে পরিণত হওয়ার পিছনে আরও কিছু কারণ আছে। সেই কারণগুলি খোঁজার জন্য আমাদের অবশ্যই হেঁটে যেতে হবে তৎকালীন বাংলার আর্থসামাজিক পথ ধরে। আমাদের খুঁজে দেখতে হবে, কোনও এক অঞ্চলের মানুষের মধ্যে লোকিক উৎসব তথা লোকসংস্কৃতির উৎস এবং বিকাশের ধারাটি।
মানুষ তখন জঙ্গলে, আগুন আবিষ্কার করে ফেললেও সভ‍্যতার ‘গরম’ থেকে বহুদূরে। সারাদিন কেটে যেতো শিকারে। তারপর সূর্য ডুবলে ফিরে আসতো তাদের গুহায়। আগুন জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসতো তারা, আগুনে ঝলসে নিতো শিকার করা পশুদের। তারপর ভুরি এবং হয়তো ভুঁড়ি ভোজ। সারাদিনের ক্লান্তির শেষে এই প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে তাদের মনে আনন্দ ডেকে আনতো। তারা তখন কথা বলতে পারতো কিনা ঠিক জানিনা, কিন্তু এটা নিশ্চিত জানি শব্দ সহযোগে গান অবশ্যই গাইতো তারা। সমবেত সংগীতের তথা মুখ নিঃসৃত আওয়াজের মধ্য দিয়ে তারা উপভোগ করতো এই আনন্দ, এই প্রাপ্তি। সমস্ত লৌকিক উৎসব তথা লোকসংস্কৃতির মূলে আছে এই ঘটনাটি। বলা যেতেই পারে এটিই মানুষের আদিমতম ও প্রথম লৌকিক উৎসব। যে শিকার উৎসবের ধারা প্রায় অবিকৃত ভাবে এখনও বহন করে চলেছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা। মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব, সে ভাগ করে নেয় তার আনন্দ, তার কষ্ট পাশের মানুষদের সাথে। মানুষের এই আনন্দ এবং শোক ভাগ করে নেওয়ার প্রবৃত্তি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠানের।
অতঃপর, মানুষ সভ‍্য হলো, আই মিন্ টু সে, সভ‍্যতার মুখোশ পড়লো। পশুপালন করলো, চাষাবাদ করলো এবং গুহা-অরণ্য ছেড়ে নদীর তীরে গড়েও তুললো বসতি। কালক্রমে গড়ে উঠলো নগর সভ‍্যতা। নগর সভ‍্যতা গড়ে উঠলেও সমান্তরাল ভাবে গ্রামীণ জনপদগুলি হারিয়ে গেলো না। বরঞ্চ সেখানেই রয়ে গেল মানুষের শিকড়। মূলত গ্রাম সভ‍্যতাকে জড়িয়েই বিভিন্ন সময়ে যুগের চাহিদা মেনে সৃষ্টি হলো একের পর এক লোক উৎসবের। লোকসংস্কৃতি আদতে গ্রামীণ মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস, হতাশা-প্রাপ্তি, আচার-আচরণ, জীবন যাপন প্রণালী, বিনোদনের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা নিজস্ব কালীক ও আঞ্চলিক সংস্কৃতি। কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলের সংস্কৃতির মধ্যেই ধরা থাকে সেই অঞ্চলের মানুষের প্রকৃত পরিচয় তথা নিজস্বতা।
কোনও দেশের জাতীয় সংস্কৃতির ধারা মূলত দুটি, নগরসংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি তথা গ্রামসংস্কৃতি।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিন্তু এই ধারা কিন্তু তিনটি, নগর সংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি এবং উপজাতীয় সংস্কৃতি বা আদিবাসী সংস্কৃতি। আমাদের আলোচ‍্য ভাদু উৎসব গ্রামীণ তথা লোকসংস্কৃতির অন্তর্গত। আমরা এবার দেখে নেবো বাংলার লোকসংস্কৃতির ধারাটিকে।
অঞ্চল ভেদে লোকসংস্কৃতি দৃশ‍্যত পৃথক হলেও, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোকসংস্কৃতির মধ্যে বিষ্ময়কর মিল পাওয়া যায়। এর মূল কারণ, পৃথিবী জুড়ে গ্রামীণ মানুষের সহজ সরল অনারম্বর জীবনের চাহিদা ও প্রাপ্তির মিল। লোককলাবিদ স্টিভ্ থমসনের বিশ্বের বিভিন্ন লোককাহিনী ও পুরাণ অবলম্বনে করা মোটিফ বা ইন্ডেক্স (৬ খন্ডে) থেকে আমরা খুব সহজেই এই অভিন্নতা খুঁজে নিতে পারি। যেমন কৃষিপ্রধান বাংলার কৃষক যে এক গোছা ধান (লক্ষ্মীর ছড়া বা ছড়) ঝুলিয়ে রাখে ঘরের চালে, বিশ্বের নানা দেশের কৃষকসমাজেও দেখা যায় প্রায় একই প্রথা। কোথাও তা, ‘শস্যরাণী’, কোথাও ‘শস্যপুতুল’, কোথাও বা ‘শস্যমাতা’। মূলত, কৃষিকে কেন্দ্র করেই লোকসংস্কৃতির একটা বিশ্বজনীন রূপ পরিলক্ষিত হয়। লোকসংস্কৃতির উপাদানগুলিকে মূলত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়, বস্তুগত (material), মানসজাত (formalised), অনুষ্ঠানমূলক (functional) এবং প্রদর্শনমূলক (performing)।
জীবনধারণের জন্য ব‍্যবহৃত বিভিন্ন বস্তু, যেমন: বাড়ি-ঘর, আসবাবপত্র, যানবাহন, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ‍্যদ্রব‍্য, ব‍্যবহৃত প্রাকৃতিক ঔষধ ইত্যাদি বস্তুগত সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত দেখা যায়, বস্তুগত সংস্কৃতিতে গ্রামগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব‍্যাদি তারা নিজেরাই উৎপাদন ও বিতরণ করে। এই দেওয়া নেওয়া কিছুদিন আগে পর্যন্ত (এবং এখনও) চলতো বিনিময় প্রথায়। স‍্যার মেটকাফ বাংলার স্ব‍য়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলিকে তাই ছোট ছোট রাষ্ট্র বলে অভিহিত করেছেন।
গ্রামীণ সংস্কৃতিতে মৌখিকভাবে সৃষ্ট ও ব‍্যপ্ত যে সাহিত্যধারা, তা মানসজাত লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। এর সাথে কিছু চিত্রকর্ম’ও (আলপনা, পটচিত্র, ঘটচিত্র, দেওয়ালচিত্র, অঙ্গচিত্র, নকশি কাঁথা-সূচীশিল্প প্রভৃতি) এই ধারার অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের লোকসাহিত্য বেশ প্রাচীন এবং অদ্ভুত সত্যি এটাই যে, বিশ্বের প্রায় সব ধারার লোকসাহিত্যের উপাদান বাংলা ভাষায় খুঁজে পাওয়া যায়। এর মূল কারণ বাঙালি আদতে একটি সংকর জাতি। নৃতত্ত্বের দিক দিয়ে দেখলে বাঙালির মধ্যে অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, নেগ্রিটো, মোঙ্গলীয় প্রভৃতি রক্তধারা প্রবাহিত। পরবর্তীকালে অ্যালপানীয়, পলিনীয়, সেমিটিক প্রভৃতি জাতির রক্তও মিশেছে। ঠিক এই কারণেই বাংলার লোকসংস্কৃতিতে বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে অনায়াসে। বাঙালি কৃষিপ্রধান জাতি হওয়ার ফলে এই মিশ্রণ কৃষক সংস্কৃতিতেই ঘটেছে বেশি। এই কারণেই বাংলার লোকসাহিত্যের মূল কাঠামোটি কৃষিকেন্দ্রীক। কৃষকের বা কৃষিজীবী মানুষের সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-হতাশার কথাই সেখানে মূল উপজীব্য। বাংলায় প্রচলিত বিভিন্ন লোককাহিনী, লোকসঙ্গীত (জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, মারফতি, বাউল, গম্ভীরা, কীর্তন, ঘাটু, ঝুমুর, বোলান, আলকাপ, লেটো, গাজন, বারমাসি, ধামালি, পটুয়া, সাপুড়ে, খেমটা, সহেলি গীত, হুদমা গীত প্রভৃতি), লোকগাথা, লোকনাট্য, ছড়া, ধাঁধা, মন্ত্র, প্রবাদ-প্রবচন, ব্রতকথা প্রভৃতি গদ্যে-পদ্যে রচিত মৌখিক ধারার সাহিত্যে কৃষকের ঘামের গন্ধ সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়া রাখাল, মাঝি-মোল্লা, ভিক্ষাজীবী ফকির-বৈরাগী, বাউল-সুফি প্রভৃতি গায়ক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিস্তৃত হয়েছে বাংলা লোকসাহিত্য বা মানসজাত লোকসংস্কৃতি।
অনুষ্ঠানমূলক এবং প্রদর্শনমূলক লোকসংস্কৃতি একে অন‍্যটির সাথে পুরোপুরি সম্পৃক্ত। কোনও অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যে সাংস্কৃতিক প্রদর্শন, যা মূলত মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য তাই প্রদর্শনমূলক লোকসংস্কৃতি। আমরা আলোচনার সুবিধার্থে, এই দুটিকে একসাথে নিয়েই আলোচনা করবো। শুধু মনে রাখবো, অনুষ্ঠানমূলক লোকসংস্কৃতিতে ধর্মীয় বা সামাজিক উপাচারটি প্রধান আর প্রদর্শনমূলক লোকসংস্কৃতিতে মানুষের চিত্তবিনোদনটি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে।
এর মধ্যে পড়ে অভিনয় ও অঙ্গক্রিয়া দ্বারা ব‍্যপ্ত লোকনাট্য, যাত্রা, নৃত্য ও খেলাধুলা ইত্যাদি। বাউল, গম্ভীরা প্রভৃতিতে নাচ, গান, অভিনয় এই ত্রিধারা যুক্ত। এছাড়া জারি নাচ, সারি নাচ, খেমটা নাচ, ঘাটু নাচ ইত্যাদি বাংলার প্রদর্শনমূলক লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। কৃষিপ্রধান বাংলার জনজীবনে জমি চষা থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের লোকাচার যুক্ত, এইসবই অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনমূলক লোকসংস্কৃতির উদাহরণ। যেমন বৃষ্টির আশায় মেঘারাণী, হুদমা দেওয়া, বেঙ বিয়া। ফসল রক্ষার জন্য ক্ষেতবন্ধন, কাকতাড়ুয়া, গাস্বি উৎসব প্রভৃতি। অতঃপর, ফসলোত্তর অনুষ্ঠান লক্ষ্মীর ছড়, নবান্ন, মাগন প্রভৃতি। তাছাড়া টুসু, ভাদু, করম, বসুধারা ইত্যাদিও এই যৌথ সংস্কৃতির উদাহরণ। এছাড়াও, হাডুডুডু, বলীখেলা, নৌকা বাইচ, বউছি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, নুনতা, চিক্কা, ডাংগুলি, ষোলোঘুঁটি, মোগল-পাঠান, এক্কাদোক্কা, বউরাণী, কড়িখেলা, ঘুঁটিখেলা, কানামছি, ঘুড়ি উড়ানো, কবুতর উড়ানো, মোরগের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই প্রভৃতি প্রদর্শনমূলক লোকসংস্কৃতির উদাহরণ।
তাহলে আমরা দেখতে পেলাম, ভাদু উৎসব আদতে বাংলার অনুষ্ঠানমূলক লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত এবং যে অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পালিত হয় বিভিন্ন প্রদর্শনমূলক লোকসংস্কৃতি তথা বিনোদন। আমরা এবার ভাদু উৎসবের মধ্যে দিয়ে সবটুকু হেঁটে গিয়ে দেখে নেবো এই উৎসবের রং ও রূপটি ঠিক কেমন এবং অবশ্যই খোঁজার চেষ্টা করবো সেই কারণটি, কেন ভাদু উৎসব রাজমহল ছেড়ে মিশে গেলো বাংলার মানুষের মধ্যে, কেন পরিণত হলো বাংলার লোক উৎসবে।
ভাদু উৎসবের রীতি অনুযায়ী, পয়লা ভাদ্র কুমারী মেয়েরা বাড়ীর কুলুঙ্গীতে ভাদু প্রতিষ্ঠা করে। একজন বর্ষীয়ান মহিলা ‘ভাদ্রেশ্বর্যৈ নমঃ’ বলে ভাদুমূর্তির দিকে
ছুঁড়ে দেয় ফুল। তারপর ভাদুর উদ্দেশ্য একসাথে গান গায়। ভাদ্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে শুরু হয় ভাদুর মুর্তি পূজা। ভাদ্র সংক্রান্তির আগের রাতে জেগে থাকে ভাদু বা কুমারী মেয়েরা অর্থাৎ পালিত হয় ভাদুর জাগরণ। এই রাতে ছোট্ট কাপড়ের বা কাগজের মন্দিরে হয় ভাদু পুজো। রাতভোর চলে ভাদু গান। ভাদ্র সংক্রান্তির সকালে দলবদ্ধভাবে মহিলারা ভাদু মূর্তির বিসর্জন দেন। যদিও, পূর্বে ভাদুর কোন মূর্ত রূপ ছিল না। একটি পাত্রে ফুল রেখে বা গোবরের ওপর ধান ছড়িয়ে ভাদুর রূপ কল্পনা করে উৎসব পালন করা হত। পরবর্তীকালে বিভিন্ন রকমের মূর্তির প্রচলন হয়েছে। মূর্তিগুলি সাধারণতঃ হংস বা ময়ূর বাহিনী বা পদ্মের ওপর উপবিষ্টা মূর্তির গায়ের রঙ হলুদ, মাথায় মুকুট, হাতে পদ্মফুল, গলায় পদ্মের মালা ও হাতের তলায় আলপনা থাকে। কখনো মূর্তির কোলে কৃষ্ণ বা রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি থাকে।
অন্যান্য অঞ্চলের পালিত উৎসব থেকে আবার বীরভূম জেলার ভাদু উৎসবের বৈশিষ্ট্য বহুলাংশে পৃথক। পয়লা ভাদ্র গ্রামের একজন ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে তাঁর কোলে মাটির তৈরী ভাদু মূর্তি দিয়ে পুরুষদের একটি দল ভাদু গান গেয়ে ও নাচ করে বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে অর্থ আদায় করেন। ভাদ্র সংক্রান্তিতে ভাদুর জাগরণ পালিত হয়। এই রাতে একটি জায়গাকে সজ্জিত করে ভাদু মূর্তি স্থাপন করা হয়। পরের দিন সকাল বেলায় মূল গায়েনকে অনুসরণে পুরুষদের দল ঢোল, হারমোনিয়াম, তবলা, কাঁসি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে ভাদু গীত গাইতে গাইতে মূর্তি বিসর্জন করেন। এই জেলায় মহিলারা গানে অংশগ্রহণ করেন না। কী অদ্ভুত! আমার গ্রামেও তো এমনই হয়, মানে হতো আর কী, সেই ছুটুবেলায়। হয়তো বীরভূম লাগোয়া গ্রাম বলেই চুঁইয়ে পড়েছিল এই পুরুষ ঘেঁষা ভাদু। সে যাইহোক, এখন আর সে নেই, এখন আর সে আসে না, এখন আর সে আসে না প্রতি ভাদ্র সন্ধ্যায়, ফিরিয়ে দিতে আমার ছেলেবেলা।
সে না আসুক, তবু মাঝে মাঝে ইউটিউবে ভাদু গানগুলো শুনে নিতে তো কোনও ক্ষতি নেই।
...ও ভাদু নামলো দ্যাশে
আষারি বর্ষার শেষে।
এই আষারি বর্ষার শেষেই একটু অবসর, চাষাবাদ থেকে একটু বিশ্রাম, তাইতো গেয়ে ওঠে গ্রামের মেয়েরা,
ভাদু পুজার দিনে,

সারা রাত উড়াব ফুর্তি হে,

কাটাব জাগরণে।

বাকী আজ রাইখনা কিছু

যা ইচ্ছা মনে,
রাখ, লোক-লজ্জা,
দাও দরজা,
মহাপুজা এইখানে

গানের বোলের দিকে খেয়াল রাখলে বোঝা যায়, মেয়েদের ঘরের চার দেওয়ালের জীবন থেকে ক্ষণিকের মুক্তির আনন্দটা। গান ও তার সাথে নাচে বদলে যায় তাদের স্বর ও শরীর ভঙ্গি’ও। একটা মুক্তির স্বাদ চুঁইয়ে পড়ে শরীর জুড়ে এবং মন জুড়েও। হয়তো এই মুক্তির স্বাদটাই ভাদুর লৌকিক উৎসবে পরিণত হওয়ার একটা মূল কারণ।
ভাদু তুমায় আনব্য মা গ

পুজব সব্বাই আজিকে

রাখব তুমায় যতন কইর‍্যে

মাণিক হঁইয়ে থাকব্যে বুকে

সোনার বাঁউটি দিব ভাদু
যায়ো না’ক কুথাকে
আমার ঘরে থাক মা গ
গড় করি মা তুমাকে

পঞ্চকোট রাজপরিবারে উচ্চ মার্গীয় দরবারী ভাদু নয়, জনপ্রিয় হয়েছে সাধারণ মানুষের সৃষ্টি বোলগুলিই। এই বোলগুলিই লৌকিক সঙ্গীত হিসাবে আজও জীবিত। ভাদু গানের বেশিরভাগটাই মৌখিক, লিখিত বোল নয়। অনেকক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক বোল সৃষ্টি হয় ভাদু গায়ক/গায়িকাদের মুখে মুখে। ভাদু গানের মূল উপজীব্য নারীদের জীবনযাপন, তাদের কথা, তাদের ছোট্ট ছোট্ট চাহিদা, প্রাপ্তির কথা, তাদের সুখ-দুঃখের কথা।
ভাদু, লে লে লে দু’আনা
তুই কিনে খাবি মিছরির দানা।
বা,
ভাদু আমার গরবিনী

ওগো আমার ভাদুমনি

মাথায় দিব সোনার মুকুট

শাড়ি দিব জামদানি.....

বা,
ভাদুমণি দুখ পাঁইয়েছ্যে বেথা তাকে দিও না

ভাদু বিটি বড় দুখী, তুমরা কিছু বইল্য না……

টুসু বা ঝুমুর গানের মতো এখানে কিন্তু অদ্ভুত ভাবে প্রেম বা রাজনীতির গন্ধ খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও, পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে গীত ভাদু গানে রামায়ণ- মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী, রাধা-কৃষ্ণের প্রেম মূল উপজীব্য। এছাড়া, ছড়া বা চুটকি জাতীয় ভাদু গানে সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতির সরস বর্ণনা দেখতে পাই।
ভাদু করি যে মানা
তুমি রামপুরহাটের সিনেমা যেও না
বা,
ভাদু চাই ম্যাক্সি জামা।
আমরা করি গো মানা
কলিকালের এই ঘটনা
বাপ মা করে না মানা’
আমার ভাদু কেজে পরে
রামপুরহাটে যেয়েঁ প্রেম করে
বগলকাটা বেলাউজ প’রে ঘুরে ফিরে
বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক দিক নিয়েও ভাদু গান বাঁধা হয়, যেমন,
১৮ বছরের মেয়ে ২১ বছরের ছেলে হলে
তার নীচে কেউ দিও না বিয়ে
বা,
দশম শ্রেণী পড়তেই হবে
উচ্চ মাধ্যমিকও পাশ হওয়া চাই
২৫ হাজার টাকা পাবে
১৮ বছর হওয়া চাই’,
অষ্টম শ্রেণী পড়ে গো যারা
বাই সাইকেল পাবে গো তারা
সাথে আছে সবুজ সাথী
এখন স্কুলেতে সবাই যাবে
করবে লেখাপড়া’
ভাদুগানে সহজেই উঠে আসে বর্তমান সময়ের কথা, জীবন যাপনের কথাও,
অবাক দেখে শুনে,

কেঞ্জাকুরার অশোক দত্তের দোকানে,

বড় বড় জিলিপি গুলান,

সোয়া কেজি ওজনের।

ভাদু তাদের কাছে দেবী নয় মোটেই, নয় রাজার কন্যা। ভাদু তাদের নিজেদের মেয়ে, ঘরের মেয়ে। তাইতো অনায়াসেই তারা গেয়ে ওঠে,
আমার ভাদু সোনার জাদু,

কে পাঠাইলে কোলকেতা,

সেই কোলকেতারই লুনা জলে,

ভাদু হইল শ্যামলতা .........

বা,
ভাইরে মনে মনে
আমার ভাদুর রূপ দেখে
জ্বলিস কেনে।
কী আশ্চর্য! তারা আবার ভাদুকে নিয়ে, ভাদুর রূপকে নিয়ে ঠাট্টাও করে,
দেখে শুনে এমন ভাদু
আনলি কেন সইয়েরা?
হাতটা সরু পেটটা মোটা লো
তাতে আবার গাল পোড়া।
দেবদেবী নিয়ে বাঙালির এই অনাবিল ঠাট্টাই বুঝিয়ে দেয়, বাঙালির সাথে তাদের দেবদেবীদের সম্পর্ক মূলত ভালোবাসার, ভয়ের নয়। দেবদেবীরা তাদের ঘরের লোক। ঠিক এইখানেই হিন্দুর ঈশ্বর চেতনার থেকে বাঙালির ঈশ্বর চেতনা স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে।
ঘরের মেয়ের বিদায়ে চোখ যে ভিজবে, এ তো স্বাভাবিক। তাইতো গেয়ে ওঠে,
ভাদু বিদায় দিতে
প্রাণ মোদের চাইছে না কোন মতে
তবু যে বিদায় দিতেই হয়,
যাচ্ছো ভাদু যাও গো
পিছন ফিরে চাও গো।
সাথীরা সব দাঁড়িয়ে আছে
পদধূলি দাও গো।
অতঃপর, ধুলো উড়িয়ে দেখা যাক মাঝপথে ফেলে আসা সেই প্রশ্নের, রাজপরিবারে গান কীভাবে লৌকিক সংগীত হয়ে উঠলো, কীভাবেই বা রাজপরিবার ছেড়ে ভাদু মানুষের লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠলো। ভাদু ভ্রমণের সবটুকু পথ হেঁটে এই প্রশ্নের উত্তর এখন বেশ সোজা। না, রাজপরিবারে সখের গান, উচ্চাঙ্গের ‘দরবারি ভাদু’ মোটেই সাধারণ মানুষের মধ্যে বাসা বাঁধেনি। সাধারণ মানুষের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল তাদের তৈরি গান, তাদের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার আলেখ্য। রাজপরিবারে ভাদু গান সৃষ্টি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু রাজপরিবার থেকে যখন সে পথে নামলো, বদলে ফেললো তার আদল, এই বদলে যাওয়া সাধারণ মানুষের ভাদুই মিশে গেছে বাংলার লোকসংস্কৃতির মধ্যে। এইভাবেই বেঁচে আছে ভাদু, এইভাবেই বেঁচে থাকবে, এইভাবেই বেঁচে থাকুক ভাদু, ফিরিয়ে দিতে আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা।






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন