হোম বিশেষ নিবন্ধ তন্ময় ভট্টাচার্য তন্ময় ভট্টাচার্য personমায়াজম জুন ১৬, ২০১৮ 0 share বন্ধে মায়া লাগাইসে বাংলা গানের একটি নির্দিষ্ট ফর্ম ‘লোকসঙ্গীত’ হিসেবে পরিচিত। এবং তার বিস্তৃত ভাণ্ডার ও বৈচিত্র্য সম্পর্কে আমরা সকলেই জানি। বাক্যগঠন, শব্দব্যবহার, ক্রিয়াপদ – ইত্যাদির ফারাকই প্রমিত বাংলা থেকে আলাদা করেছে সেগুলিকে। পাশাপাশি বাংলা কবিতার দিকে নজর দিলে, আমার সীমিত পড়াশুনায় গানের তুল্য ভাণ্ডার নেই, যেগুলি আঞ্চলিক ভাষার কবিতা বলে গণ্য করা যায়। সাধারণত, গান দিয়ে যেহেতু আরও বেশি লোকের কাছে পৌঁছনো যায়, পদ বা কথা লেখার পরই সুর বসিয়ে গানের রূপ দেওয়া হয়েছে আবহমান কাল ধরে। তাহলে কি বাংলা কবিতায় আঞ্চলিক প্রভাব নেই? অবশ্যই আছে। চর্যাপদের কথা বাদই দিলাম, বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্ত পদাবলি, মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে ক্রিয়াপদ ও শব্দের ব্যবহারে আঞ্চলিকতার বৈচিত্র্য ফুটে উঠেছে প্রায়ই। ‘মৈমনসিং গীতিকা’র কথা ভুলে যাওয়া অসম্ভব। আসলে সেকালে ‘কবিতা’র আলাদা কোনও পরিচিতি ছিল না। পাঁচালি, পদাবলি – যাই লেখা হত, একটা সুরের ছাঁচে না বসালে যেন শান্তি ছিল না কারোর। ফলে সেগুলি কাব্যের বদলে গান হিসেবেই পরিচিত হয়েছে তৎকালীন সমাজে। এবং রচয়িতারাও সম্ভবত সেই চোখেই দেখতেন। কাট টু আধুনিক যুগ। মধ্যযুগের সীমা টানা হয় ভারতচন্দ্রে। তারপর ঈশ্বর গুপ্ত প্রথম আধুনিকতার ছোঁয়া আনেন বাংলা কবিতায়(যদিও তাঁর লেখাগুলি ‘কবিতা’ কিনা, সে সংশয় অনেকের মতো আমার মধ্যেও আছে)। এরপর, মধুসূদনের পথ ধরে, শেষ অবধি রবীন্দ্রনাথকে আধুনিক যুগের পুরোধা বলা হয়। পাশাপাশি, রবীন্দ্রনাথের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী যুগেও কিন্তু আঞ্চলিক ভাষায় লেখায় ভাঁটা আসেনি। কলকাতাকেন্দ্রিক যে বাংলা, তার থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেই আবর্তিত হয়েছে, হ্যাঁ, বাংলাভাষারই নানান সৃষ্টি। আমাদের মাতৃভাষা এমনই, অঞ্চলভেদে তার ভিতরের রূপ এক থাকলেও, বাইরের রূপ পাল্টে-পাল্টে যায়। সিরিয়াস সাহিত্যের ক্ষেত্রে মান্য ধরা হল কলকাতার ভাষাই। কিন্তু যাদের সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দায় নেই, তাঁরা থোড়াই পাত্তা দিলেন এসবে। নিজের অঞ্চলের ভাষাই তাঁর কাছে মাতৃভাষা। সে ভাষাতেই লিখে চললেন তাঁরা। কিছু কবিতা হয়ে রইল, বেশিরভাগই সুর জড়িয়ে বদলে গেল গানে। এভাবে চলতে লাগল, চলতেই লাগল, চলছে এখনও... এর মধ্যেই কিন্তু নিজের নির্দিষ্ট আঞ্চলিক ভাষাটিতে সিরিয়াস কবিতা লেখাও শুরু হয়ে গেছে। কবি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ – না, গান নয় আর, শুধুই কবিতা। তা সে কলকাতার এলিট মহলে পাত্তা পাক বা না-পাক। পূর্ববঙ্গে তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেরও বিভিন্ন জায়গার ভাষায় লেখা শুরু হল কবিতা। এবং তা মাধুর্যে ও মিষ্টত্বে প্রমিত বাংলার থেকে কোনও অংশে কম নয়। অবশ্যই যদি পাঠক যথার্থ সৌন্দর্য ধরতে পারেন, তবেই... এত কথা শুধু বর্তমান প্রসঙ্গে ঢোকার পাঁয়তারা। অবিভক্ত বাংলায়, কলকাতার ভাষাই মান্য বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। অন্তত সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে। এবং সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ হওয়ার পরও, ওপার বাংলার কবিতায় আঞ্চলিক প্রভাব রেয়ার। কলকাতার ভাষারই চর্বিতচর্বণ বা ‘ঢাকাইয়া রূপ’। বাংলাদেশের লেখায় যে ফারাক দেখেছি আমাদের এখানকার তুলনায়, অবশ্যই স্ট্রাকচারগত ও এই আলোচনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে, সেগুলির মধ্যে মূল হল ক্রিয়াপদ। আমাদের ‘করছে’-কে ‘করতেছে’-তে রূপ দিচ্ছেন ওঁরা। ‘চাইছে’-কে ‘চাচ্ছে’-তে এবং আরও অনেক। সবাই নয়, কেউ কেউ তাঁদের লেখায় করেন এমন। এতে দোষ বা অন্যায়ও কিছু নেই। বরং এমনই হওয়া উচিৎ। মুখে বলা হচ্ছে একরকম, আর লেখার বেলায় সাজানো-গোছানো সনাতন ফর্ম – এ-ব্যাপারটা ভালো না লাগারই কথা। আর অন্যান্য যে ফারাক, শব্দগত, তা আমার এখনকার চিন্তার বাইরে। ধর্মগত কারণে আরবি-ফার্সি শব্দের প্রচলন বেশি ওদেশে, কথোপকথনেও তাই। কাজেই লেখার ক্ষেত্রেও সেসব ব্যাপার আসবেই। আসবে একই দেশের অঞ্চলভেদে একই শব্দের নানা রূপ। ওসব নিয়ে চিন্তিত নই আমি। আমার মতে, এই বৈচিত্র্য আখেরে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধই করছে। হাতের কাছের একটা বই থেকে ছোট্ট অংশ – ‘আমারে আমার ভালো লাগতেছে, বোন। যেনবা – কামাল করে দিয়েছি, সারা দিনমান প্রখর নারীরোদে পুড়ে শরীর কাক করে ফেলছি। যেন বহু তদবিরের পর খনন কাজের ঠিকাদারী পেয়েছি। আমরা বিচ্যুত হচ্ছি এই সত্য ফের কুঁড়ি ফলাচ্ছে। প্রতিভা সকল বাষ্পের আকারে উড়ে-ঘুরে যাচ্ছে।...’ এই কবি আমার খুব প্রিয়। অসম্ভব শক্তিশালী ও নিভৃতচারী একজন। শাহ মাইদুল ইসলাম। মাইদুলভাই শুরু করলেন ‘আমারে’ বলে, ‘আমাকে’ নয়। এখানেই ফারাক পশ্চিমবাংলার সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ প্রমুখ তাঁদের আমলে হরদম এমন ব্যবহার করতেন, কারণ তখন সেটা ট্রেন্ড ছিল। এতটা সময় পেরিয়ে এসে, এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ‘আমারে’ ব্যবহার করা – সেই ট্রেন্ডের উত্তরাধিকার নয়, এমনটাই বিশ্বাস আমার। এটা সম্পূর্ণভাবেই কবির নিজস্ব উচ্চারণ ও অনুভূতি। কবিতার খাতিরে লেখা নয়। নিজের কথার ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেহেতুই ‘লাগতেছে’ লিখেছেন তিনি, ‘লাগছে’ নয়। এবং, তিনি যেমন বলেন, তেমন ‘হচ্ছি’, ‘ফলাচ্ছে’, ‘যাচ্ছে’-ই রেখেছেন। ‘হতেছি’, ‘ফলাইতেছে’, ‘যেতেছে’ নয়। ব্যাপার হল, বাংলাদেশেরই অন্য কেউ এই ‘লাগতেছে’-কে ‘লাগতাসে’ বা ‘লাগে’ লিখতেই পারতেন, কারণ কারণ কোনো কোনো অঞ্চলে এমন রূপও প্রচলিত। এপার বাংলার কেউ কিন্তু সাহস করে ‘লাগতেছে’ লিখে ফেলতে পারতেন না সহজে। কারণ, এক – তিনি নিজে কথায় তা ব্যবহার করেন না, আর দুই – এখানে শব্দের এই রূপটি প্রচলিত নয় যেহেতু, পাঠক হোঁচট খেতে পারেন। অন্তত রবীন্দ্রঘোর থেকে বেরিয়ে আসা পাঠক। যাইহোক, এমন অজস্র উদাহরণ দিতে পারি বাংলাদেশের কবিতার, আমার পড়া প্রায় সব কবিরই, যাদের ক্রিয়াপদ-ব্যবহারে বাংলাদেশের প্রভাব। আবারও বলছি, সেটাই স্বাভাবিক এবং হওয়া উচিৎ। বাক্যের সবচেয়ে জোর তার ক্রিয়াপদে। কাজেই অন্যান্য অংশে প্রমিত চলন এলেও ক্রিয়াপদে যে আঞ্চলিকতা আসছে – তা লেখার প্রাণ ও সততারই প্রমাণ। এবং বিদ্রোহেরও। এ তো গেল শুধু ক্রিয়াপদের আঞ্চলিকতার কথা। এখন যদি পুরো কবিতাটাই আঞ্চলিক বাংলায় লেখা হয়? কলকাত্তাইয়া বাংলা যদি ছেঁটে ফেলা হয় পুরোপুরি? হ্যাঁ, এমনও লেখা হয়েছে প্রচুর। পশ্চিমবঙ্গেও, বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের লেখা নিয়েই আলোচনা চলুক আজ। বিভিন্ন সময়ে অনেক কবিই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাকে কবিতায় নিয়ে এসেছেন। পশ্চিমবঙ্গের পিনাকী ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা ‘রাতের ট্রেনে’ এখানকার একটি রেয়ার উদাহরণ, কিন্তু বাংলাদেশে এমন হামেশাই দেখতে পাওয়া যায়। কখনও আংশিক, কখনও সম্পূর্ণ। সিনিয়র কবিরা তো ছিলেনই, বর্তমানে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের অনেকেও আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখছেন। সিনিয়রদের কথা সরিয়ে রাখি আজ। নইলে, এক সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরানের গহীন ভিতর’ বইটা নিয়েই পাতার পর পাতা লিখে ফেলা যায়। বাকিরাও কম যান কই! যাইহোক, বিস্তৃতির যে আভাস পাই, তার তুলনায় বাংলাদেশের কবিতা পড়েছি খুবই কম। তবু তা পশ্চিমবঙ্গের সমকালীন অনেকের থেকেই বেশি। বাংলাদেশের দ্বিতীয় দশকের কবিদের কয়েকজনের আঞ্চলিক বাংলায় লেখা কবিতা পেলাম হাতের কাছে। হয়তো সামগ্রিকের তুলনায় এই লেখাগুলি দুর্বল নির্বাচন। আমার অপঠিত অংশে হয়তো অনেক সার্থক ও মূল্যবান কবিতা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো যখন পাওয়ার উপায় নেই হঠাৎ করে, কাছে থাকা এ-কটি কবিতাতেই উঁকি দেওয়া যাক। (১) সরলার ইতিকথা / কাজী মেহেদী হাসান তুমি কইছিলা এই পরান আমার একলা না আন্ধার রাইতের জোনাক পোকা হুনছে হইলদা পাখিও কইছে, আমি বিশ্বাস যাই ম্যালা রাইতে কুপি জ্বালাইয়া থুই, তোমার আসনের কতা, আইলানা তুমি! বাজান কয় ‘ও পোলা ঠগবাজ’; হজ্ঞলেই কয়, তুমি আইবানা খালি পরান কয়, আমি একলা না! হেইদিন চান্নি পসর, আসমানে আগুন লাগছে ঘাটপাড়ে তোমারে দেহি, বুকের মইধ্যে ষাড়ের লাহান গুঁতা দেয় চক্ষে আমার এত শরম! দুইখান পিতলের নূপুর, কইছিলা ‘পাও বাইন্ধা দিলাম’ আমি তো কবেই বুক বাইন্ধা আছি, উড়নের খায়েশ আমার নাই কইলজার টান, বুঝলা নাগর! জুলহাসের বাপে আইছিল, পুরান প্যাঁচাল হের ঘরে জুয়ান পোলা, বিয়াত্তি মাইয়া চায়, মায়ে নাতি দেইখা কব্বরে যাইবো মা মরা মাইয়া আমি, বাজান জোরাজুরি করে— হুরমতি কানপড়া দেয়, গঞ্জে দোহান আছে, ভালাই থাকবি! ক্যামনে কই—অন্তরে পাকা দালান আমিও তুলছি ঐহানে পালংক নাই, আঁচল বিছায়া শীতলপাটি বুইনা রাখছি নানা জনে নানান কতা কয়—রাইত পোয়াইলে এই পিরিত থাকবো না খালি পরান মানে না, আমি যে একলা না! রাইত বিরাইতে এহন পাগলা বাতাস আইসে দপ কইরা বাত্তি নিভে, চক্ষের পাতা এক হয় না না পাইয়া ফিরা যাও যদি— ঘাটপাড়, হিজলতলা আমারে চুম্বকের লাহান টানে উজান থাইকা কত্ত নাও আইসে, পানির লগে আচানক পিরিত আমারে হিংসা করোছ তোরা! পুরান মেলা আবার বইছে, এইবার কিন্তুক আলতা দিবা পিন্ধনের শাড়ি নাই, গতরে তোমারে জড়াইতাম— বেবাক্তে মুখ ভেংচায়—মাগীর শরম হইলো না! রাইতে আসমান জ্বলে, খালি পরান জ্বলে না নাগর আইসো তুমি, জানাই দিও—পাগলী আমার একলা না! কাজীদা’র ‘বিষাদ লিখি না তোমাকে লিখি’ বইয়ে আছে কবিতাটি। এক নারীর জবানিতে লেখা। আর সেজন্যেই হয়তো কবিতাটির সারল্য অনুভূতি জাগাত, প্রাণবন্ত হয়ে উঠত লেখাটা। আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হলেও, যেহেতু নারীর জবানিতে, কী অদ্ভুত আলোছায়া ও লণ্ঠন দুলত প্রতিটা ছত্রে। নামকরণও সার্থক, ‘সরলার ইতিকথা’। একসময় এই লেখাটা আমার খুব প্রিয় ছিল। কিন্তু অনেকটা সময় পর, আজ আবার পড়তে গিয়ে কিছু দুর্বলতাও ধরা পড়ছে আমার কাছে। যেন অতিকথন ও ন্যাকামি জড়ানো একটা লেখা। সময়োপযোগী শার্পনেস কই? একইসঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে – এই কবিতার যা বয়ান এবং বক্তব্য, তাতে শার্পনেসের দরকার নেই। জনৈকা সরলা তার মনের কথা বলছে – সে যদি এই সারল্য ছেড়ে আর্বান হওয়ার দিকে পা বাড়াত, আর যাই হোক, এভাবে পাঠকের কাছে অনিন্দিতা হয়ে উঠতে পারত না কখনোই। বলতে পারত না – ‘নানা জনে নানান কতা কয়—রাইত পোয়াইলে এই পিরিত থাকবো না / খালি পরান মানে না, আমি যে একলা না!’ খেয়াল করুন, ‘কতা’ কিন্তু, ‘কথা’ নয়। সরলার এই ঠোঁটফোলানো ভাবই লেখাটার হৃৎপিণ্ড, যার যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে ভাষানির্বাচন। সরলা তার প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ভীত। একই সঙ্গে মনে অসম্ভব বিশ্বাস – প্রিয় লোকটি তাকে ঠকাতেই পারে না, সে যে কথা দিয়েছিল! তাই এমন স্পষ্ট বলতে পারে – ‘রাইতে আসমান জ্বলে, খালি পরান জ্বলে না / নাগর আইসো তুমি, জানাই দিও – পাগলী আমার একলা না!’ কান্নামেশানো এই অসম্ভব উচ্চারণ – কবি কি সরলার বুকে হাত দিয়েছিলেন লেখার সময়? নইলে এভাবে অনুভূতি শুষে নিলেন কী করে? অথবা পেরেছেন, হয়তো তিনি কবি বলেই... এই লেখাটা এমনই, আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ, প্রমিত শব্দের সঙ্গে ফারাক – ইত্যাদি আলোচনা করতে ইচ্ছে করছে না আর। যেন সরলা আঘাত পাবে, তার আবেগ নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করি যদি। স্বপ্ন পূরণ হল কি হল না, শেষ অবধি নাগর এসেছিল কিনা – তা সরলা জীবন দিয়ে বুঝুক, আমি তার জন্য দোয়াটুকু রেখে এগিয়ে যাই পরের লেখায়... (২) ফিসফিসানি / খন্দকার নাহিদ হোসেন হাত ধইরা কইছিলা – ‘মাইয়া লোকরে মানুষ না নি কয়?’ হেরপর আর দেখা হয়নি। দেখা হয়ও না। ফিরা যাইতে যাইতে একদিন জানছি – মইরা গেছো... যেমন কইরা আর সবাই মরে... যেমন কইরা এইখানে ওইখানে যায়... খায়-ঘুমায়... যেমন কইরা ভুইল্যা যায় ভুইল্যা যায়। কেয়ারা নৌকার খিল আঁইটা এখনও চিক্কুর মারি। মানুষ আর কতটুক বদলায়? বড় হইলেই কি গাঙে ডুইবা মরে ঝাঁপ মারবার লোভ... মানুষ কি ততো বড় হয় – হয় নি মাইয়া? ভ্রম বাড়ে – এক একদিন হিলহিলাইয়া বাড়ে। আল্লাহরে, কে মাটি কোপায়... তোর কাছে হাত তুইলা চায় – বৃষ্টি দিস বৃষ্টি দিস...? কারখানার শব্দ বাইছা চলি। মুইছা রাখি হাটের রাস্তা। তবু বুকে তুই চরকা নি কাটোস? দূরে গেলে দেখি হগলেই সোহাগের চরকা কাটে – সুতায় বান্ধে মন। ক্যান একজনের লগে দেখা হইবো – আর সারাজীবন কাইন্দা মরলেও সেই দেখা মুছবো না? মানুষ মানুষের কাছে কী থুইয়া যায়? কোমল তুষের কিরা, গালি দিস তো দিস... তবু খোয়াব ডাইকা কষ্ট দিস না। খোয়াবের মানুষের রক্ত নি থাকে? হায়, কেয়ারা নৌকার খিল আঁইটা চিক্কুর মারি। তুই হাত ধইরা কস – ‘মাইয়া লোকরে মানুষ না নি কয়?’ হেরপর বয়স মইরা যায়... যেমন কইরা হগলেই মরে – যেমন কইরা এইখানে ওইখানে যায়-খায়... ঘুমায়... যেমন কইরা মন ভুইলা যায় ভুইলা যায়! ভুইলা নি যায়? নাহিদভাই-এর ‘রাক্ষস প্রণীত পাঠ’ বই থেকে নিলাম লেখাটি। এই কবির যত লেখা পড়েছি, একটা কথাই মনে হয়েছে বারবার – যা সহজ, তাকে সহজে বেঁধে রাখতে চান তিনি। এই কবিতাটিও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আর, অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, শুধু মাত্র একটা শব্দ – ‘নি’ – কী অপূর্ব নরমভাব নিয়ে আসছে, যখনই লেখা হচ্ছে তা। কবি, হয়তো সচেতনভাবেই, মোট ছ’বার ব্যবহার করেছেন শব্দটি – নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর। এবং এই প্রয়োগের সঙ্গে মিশে থাকা যে আদর এবং অসহায়তা – পাঠকের কাছে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে কবিতাটির আবেদন। ‘হয় না মেয়ে?’ – আমাদের কথ্যভাষার এই প্রশ্নটি নাহিদভাই যখন ‘হয় নি মাইয়া?’ হিসেবে লিখছেন, অথবা শেষে ‘ভুলে যায় না?’-কে ‘ভুইলা নি যায়?’, তখন যে সুর বেজে উঠছে আমার কানে, তা সাধারণভাবে বললে কখনোই আসত না। এই মায়া, এই করুণ ভাব ফুটে উঠছে শুধুমাত্র ভাষা ও শব্দের নির্দিষ্ট ব্যবহারেই। এবং তা ফুটিয়ে তোলার জন্য যেন এই ডায়লেক্টের শরণ নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ‘ভ্রম বাড়ে – এক একদিন হিলহিলাইয়া বাড়ে’ – পড়তে পড়তে ‘হিলহিলাইয়া’ শব্দটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছি আমি। হিলহিলিয়ে কী বাড়ে, আমার চটজলদি ধারণায়? লতাগাছ? যা দেওয়াল বেয়ে ছাদের ওপর উঠে ফলিয়ে তুলছে লাউ, কুমড়ো, সিম? অথবা একটা সাপ হিলহিলিয়ে উঠছে? অথচ নাহিদভাই ‘হিলহিলাইয়া’ ভ্রম বাড়ালেন। এবং ‘হিলিয়ে’-র বদলে ‘হিলাইয়া’ আমার কাছে যেন সরল ও দ্রুত চলন তুলে ধরল। শব্দের যদি কোনও ছবি থাকে, এবং তা যদি শব্দগত অর্থের থেকে আলাদা হতে পারে, তার সার্থক উদাহরণ যেন এই ‘হিলহিলিয়ে’র বদলে ‘হিলহিলাইয়া’, যা ডায়লেক্টের কারণে স্বাভাবিকভাবেই এসেছে কবিতায়। নিজের অনুভূতি দিয়ে, এই লেখাটায় শব্দের ছবি আরও খুঁজে বের করতে পারি আমি। অবশ্য একান্তভাবেই আমার মত সেগুলো। ‘মরে’র বদলে ‘মইরা’ লিখে মৃত্যুর প্রলম্বিতভাব নিয়ে আসা। ‘ভুলে’র বদলে ‘ভুইল্যা’-তে ই-কার যেন আরও দুর্বল করছে ভুলে যাওয়ার দুঃখ। ‘আল্লাহরে’ লেখায় যেন ফুটে উঠছে আকাশে মুখ তুলে চিৎকার-করতে-পারছি-না-অথচ-চাই ভঙ্গি। ‘কেঁদে’র বদলে ‘কাইন্দা’, ই-এর পা ধরে যেন ঝুলে আছে এক্ষুনি উপচে পড়বে এমন জলবিন্দু। আমি কি পাগলামি করছি? শব্দগুলোর এমন রূপ তো ভাষাকে আশ্রয় করেই এসেছে! আসলে অহরহ-পড়া কবিতায় এমন স্বাদ পাই না এবং এই ভাষা আমার ‘দ্যাশের’ বলে আগল খুলে দিয়েছি কল্পনার। রস যখন নেবই, সমালোচক হয়ে নয়, ভক্ত হয়ে। এ-ভাষা নাহিদভাইয়ের স্বতঃস্ফূর্ত। আমি লিখতে গেলে তা কৃত্রিম হয়ে যাবে, যেহেতু দৈনন্দিন অভ্যাসে নেই। ফলে ঈর্ষার চোখে তাকাতে পারি শুধু কবিতাটির দিকে। আর আমার ভিন্ন অবস্থানের জন্য এ-ভাষায় দখল না-থাকায়, অভিযোগ জানাতে পারি মৃদু। কার কাছে? নাহিদভাই-এর আরেকটি কবিতা আমি ভুলতে পারি না। শেষ বাক্যটা আনমনে উচ্চারণ করে ফেলি প্রায়ই। প্রথম পড়ার পর মনে হয়েছিল – এই লেখাটা যদি লিখতে পারতাম, আর কোনও আফশোস থাকত না জীবনে। পাঠক, আপনিও দেখুন, ‘এই টুকুন’ – শব্দটা দু-বার প্রয়োগ করার ফলে, কী সূক্ষ্ম ও নগণ্য হয়ে আসছে ‘তাহার’ কাছে ‘আমি’র অস্তিত্ব! এবং কবিতাটি আপনাকে দীর্ঘশ্বাসের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে কেমন। নীরব শ্রদ্ধা ছাড়া, কবিকে আর কিছু জানানোর নেই আমার। যদি পারতাম...! দাগ / খন্দকার নাহিদ হোসেন আমি তাহার শুকাইবার দাগ মাটির ফুটা মাটির ফুটা – এই টুকুন রক্ত নাই আওয়াজও নাই চাকু জুইড়া খুন... আমি তাহার এই টুকুন–এই টুকুন। (৩) অন্দরে অন্দরে / দুখাই রাজ চিক্কনে ডাক পারিগো অন্দরে অন্দরে আমি পুইড়া যাই তুমি বুঝি মেলা পর পর কর? ভিতরলোকে সেইদিন কইছিল তুমি সিড়ি ভাঙতে ডর পাও— কারো লগেই আর কথা কওনা কওনের কিছু ঠাওর করতেই পিন্ধনের কাপড় বিন্ধে তোমার আজলায় তুমি সেই সবুজ পক্ষীডার লাহান আর ফিরবার চাওনা এ মুড়ায়? চিক্কুর পারিগো আমি এই নিদানে চিক্কনে ডাকিগো সোনা বিহানোবেলায়। বাংলাদেশের ২৫ জন তরুণ কবির কবিতা নিয়ে একটা সংকলন সম্পাদনা করেছিলাম একসময়। তখনই এই কবিতাটা পেয়েছিলাম। আঞ্চলিক ভাষায় লেখা দুখাইদার এই কবিতা আগের দুজনের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ‘স্মার্ট’। যদিও আগের দুজনের কবিতাগুলির বিষয়বস্তুই ওই আবেগী প্রকাশ দাবি করছিল। তবু দুখাইদা কম শব্দে যে মেজাজ ফুটিয়ে তুলেছেন, তা এক বিস্ময়। অন্তত বিষয়ের ক্ষেত্রে যখন বিরহভাবটি অন্যদের সঙ্গে কমন। একজন কবি কখন আঞ্চলিক ভাষার আশ্রয় নেন? তাঁর বক্তব্যের আবেগকে মাটির কাছাকাছি এনে আরও তীব্র ও নরম করে তোলার জন্য কি? যাঁরা একাধিক লিখেছেন, বলতে পারবেন ভালো। আমার মনে হয়, দুখাইদার এই কবিতাটি সংযমের এক আশ্চর্য উদাহরণ। চাইলে বিস্তারে গিয়ে আরও কারুকাজ দেখাতে পারতেন। তিনি তা করেননি। পাঠক হিসেবে একই সঙ্গে অস্বস্তি ও ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ছে আমার ভিতর – তার কারণ কবির মুনশিয়ানা। ‘তুমি বুঝি মেলা পর পর কর?’ – এই কথাটা, হ্যাঁ, এই কথাটার ঠিক এই ভাবে প্রকাশ যে আগের দুজনের থেকে আলাদা, তা বলাই বাহুল্য। অথচ প্রশ্নে ফাঁকিবাজি নেই। বরং তোমার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হচ্ছে। কর? করলে বল। সহ্য করে নেব। তবু আলোছায়া এনো না সম্পর্কে। আগের দুজনের লেখায় এত নিমজ্জিত হয়ে ছিলাম যে, দুখাইদার লেখাটা পড়তে পড়তে বারবারই তাঁদের স্টাইল মাথায় চলে আসছে। এই চিন্তা থেকে বেরোতে পারছি না কিছুতেই। ‘তুমি সেই সবুজ পক্ষীডার লাহান / আর ফিরবার চাওনা এ মুড়ায়?’ – সটান এবং স্পষ্ট জিজ্ঞাসা। নাহিদভাই-এর ‘নি’জনিত পেলব অনুযোগের চিহ্নমাত্র নেই। দুখাইদা যেন বুক চিতিয়ে জিজ্ঞেস করছেন – চাও না? তার পরের প্যারাতেই – চিক্কুর পারিগো আমি এই নিদানে / চিক্কনে ডাকি গো সোনা বিহানোবেলায়’। কবি যেন বলতে চান – ডাকছি, কারণ তোমাকে আমার চাই। ডাকাটা প্রয়োজন। তুমি আসো বা না-আসো, আমি ডাকব। না-ডেকে থাকতে পারব না। বাকিটা তোমার বিবেচনা। ভালোবেসেও যে ঋজুতা ধরে রাখা যায়, দুখাইদার কবিতাটি বুঝিয়ে দিল। এবং আঞ্চলিক ভাষায় লিখেও, তথাকথিত ‘ন্যাকামি’র আশ্রয় না নেওয়া, আবেগকে সীমিত রেখে বক্তব্যে জোর দেওয়া – এক নতুন ভঙ্গি চেনাল আমায়। বলেছিলাম আগেই, একইসঙ্গে অস্বস্তি ও ভালোলাগা পাচ্ছি লেখাটা থেকে। অপরিচয়ের অস্বস্তি এবং নতুনত্বের ভালোলাগা। দুখাইদা এখানেই সার্থক যেন। (৪) হাংরি মুভমেন্ট / মমিন মানব (সুবিমল বসাক’কে স্মরণ করে) কামের শইল আমার ওই রহমই বেইল যায় লুলা কুত্তার মোতন ঠেক্কের ঠেক্কের ঠেক্কের আমার গোমের খিদে আমাগো দুই দলের নেতারা মুইত্তা পুরাডা দেশঐ বাসায়া দিছে আর আমি লঙ্গিডা তোলতে তোলতে শরমের চিন্তা করলাম না। গোম বাংলে দেহি চালের হুলাক দিয়ে বিষ্টি পইরা আমার হিতান বিজ্জা গেছে খেতা লঙ্গি হগলঐ বিজ্জা চুবচুব মুশুরির উপরে পাইল্লা দিয়া হেরপরেও আমি বিষ্টি ঠেকাই কাউলকা না আমার কামো যাইতে অইবো! মমিন মানবের ‘যেদিন আমরা বৃষ্টি নামাবো’ বই থেকে নিলাম। মমিনভাই পূর্বোল্লিখিত কবিদের থেকে খানিক সিনিয়র। তাঁকে গত দশকের কবি বলা যেতে পারে। তবু এই কবিতাটি নিলাম কেন? এক, বাকিদের তুলনায় কবিতার বিষয় ও প্রকাশভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। এবং দুই, কবিতাটি লেখা হয়েছে সুবিমল বসাক-কে স্মরণ করে। এই প্রসঙ্গে, সম্পূর্ণ অবান্তর একটা কথা বলে রাখি। কবিতাটা পড়তে পড়তে, কেন জানি আমার চোখে ম্যাক্সিম গোর্কি-র ‘মা’ উপন্যাসের কিছু বিক্ষিপ্ত দৃশ্য ভেসে উঠল। কেন? মমিনভাই যে অবস্থার কথা লিখেছেন, তার সঙ্গে ওই কারখানার শ্রমিকদের বসতির পরিবেশের মিল পেয়েছি? হতে পারে। বিষয় নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই। এবং এই কবিতার কোনও শব্দ নিয়ে ফ্যান্টাসি করারও অবকাশ নেই, কারণ শব্দনির্বাচনও কবি পাঠকমনে চাবুক মারতেই করেছেন। এক নিম্নমধ্যবিত্তের ছবি – যে রাষ্ট্রযন্ত্রের চক্করে পড়ে আবর্তিত হচ্ছে দিনের পর দিন – তার কথা বলে এই কবিতা। ‘লুলা কুত্তার মোতন’ কাটানো জীবন। দুই দলের নেতারা ‘মুইত্তা’ অর্থাৎ রাজনীতির কচাকচিতে সাধারণ মানুষেরও জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আত্মসমর্পণ করা ছাড়া, আর ভাগ্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। শেষ তিনটে প্যারায় যে স্যাটায়ার এনেছেন কবি, তা বুঝে নেওয়ার। আলোচনা করতে গেলে যেন কবিতাটির তীক্ষ্ণতা কমিয়ে ফেলব আমি। দরকার নেই। এই কবির অসহায়তার সঙ্গে পূর্বের তিন কবির অসহায়তার কত ফারাক! কত দৃপ্ত! এবং নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গের ছলে সমাজের এই ছবি ফুটিয়ে তোলা – আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ যে শুধু প্রেমের ভাবের সার্থক হয়ে ওঠে না, প্রহসন ও প্রতিবাদেও সমান সাবলীল, মোমিনভাই বুঝিয়ে দিলেন এই কবিতায়। মনে পড়ে গেল হেলাল হাফিজের ‘আমিও গ্রামের পোলা, চুতমারানি গাইল দিতে জানি।’ কবিতার নাম ‘হাংরি মুভমেন্ট’। সাহিত্য আন্দোলনের কথা ভুলে যাই যদি, খিদেই যে কবিতার চরিত্রটিকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, খিদে দমানোর জন্যেই যে ‘কামে যাইতে অইবো’ আবার – সে অর্থ ধরে নেওয়া যায়। অথচ, এই চিন্তার পাশাপাশি সাহিত্যের হাংরি মুভমেন্টকেও ইঙ্গিত করেছেন মমিনভাই। কবিতাটি লিখেছেন সুবিমল বসাক-কে স্মরণ করে। কেন? ১৯৭০ সালে, সুবিমল বসাকের একটি কবিতার বই বেরিয়েছিল – ‘হাবিজাবি’। তিরিশটি কবিতা, সবগুলিই বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষায়। আমার আন্দাজ, ওই ডায়লেক্টে লেখা পূর্ণাঙ্গ বাংলা কবিতার বই প্রথম ওটিই। কবিতাগুলি হাংরি আন্দোলনের সময় লিখিত। পাঠক, ইচ্ছে থাকলে বইটি সংগ্রহ করে পড়ে নিন। এই শতকেরই গোড়ার দিকে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল আবার। যদি নাও পান এখন কোথাও, অন্তত ইন্টারনেটে খুঁজলে কয়েকটি কবিতা পাবেনই। বুঝতে পারবেন, ‘হাবিজাবি’ বইটিকে কেন বাংলা কবিতার একটি মাইলস্টোন বলে আমি মনে করি, কেনই বা সুবিমল বসাক-কে স্মরণ করে এই কবিতাটি লিখেছেন মমিনভাই। (৫) আনুশা মেহরিন / রিয়াজ মাহমুদ মেহরিন, পলকা দেহ নিয়া ঝড়োবাতাসেরদিন হয়ো আর না বাহির, ঘরেতে থাকো আজ, খিচুড়ি পাকাও একপাতিল, জনৈক আবহাওয়াবিদ দুপুরে আসছেন খেতে, ক্ষুধায় তিনি কাহিল। মেহরিন, এই রাজকীয় নাম কে রাখছে তোমার? যদি জানত থাকবা এমন গরিবি হালতে, টালবা শুকনো মরিচভর্তা। কইত, আহা! কী নিষ্ঠুর রসিকতা! মাঝির বউ তুমি ভুলে যাইয়ো না, নদীর সাথে বিরোধ তাঁর উত্তাল দামোদরে যাতায়াত নয়কো মঙ্গলের। ভীষণ বিপদে এখনো সে ঢাকার জনস্রোতে, বাঁচার কসরত করে, ডুবে আর জল খায়, ডুবে ডুবে... ডুবে যায়। মোনাজাত করো বউ, বউ গো, অন্ধমানুষের মত সামনে প্রচুর খানাখন্দ। এই কবিতাটা এই আলোচনায় আনা বোধহয় পক্ষপাতিত্বই হল খানিক। কী করব! বছর দুই আগে, প্রথম যেদিন পড়েছিলাম, তখন থেকেই মুগ্ধতা। আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে এই কবিতার সংযোগ শুধু ক্রিয়াপদের ব্যবহারে। এটুকু সূত্রের জন্যেও রিয়াজ-কে ধন্যবাদ জানাই, ভাগ্যিস লিখেছিল, তাই প্রায় জোর করে হলেও আমার গদ্যে টেনে আনলাম। রিয়াজ-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার কবিতার মূল ভাষা তো প্রমিত বাংলাই, কিন্তু ক্রিয়াপদে যে আঞ্চলিকতার ব্যবহার করেছ, সেটা কি ইচ্ছে করেই? তুমি কি এটাকে আঞ্চলিক বাংলায় লেখা বলবে? উত্তর দিয়েছিল – ‘এভাবে ভেবে লিখিনি দাদা। জাস্ট ইচ্ছে হল, আর লিখলাম। তাৎক্ষণিকই।’ এই উত্তরে বোঝা যায় ওর সততা। লেখার সময় স্বাভাবিকভাবে ওর দৈনন্দিন মুখের ভাষায় ব্যবহৃত ক্রিয়াপদগুলিই রেখেছে। ‘রাঁধো’-র বদলে ‘পাকাও’ নাহয় স্থানীয় প্রভাব। কিন্তু ‘নিয়া’ ‘রাখছে’, ‘থাকবা’, ‘টালবা’, ‘কইতো’, ‘যাইয়ো না’ – এই প্রয়োগগুলো লেখার সময় রিয়াজের অবচেতনের সততাকেই বোঝায় যেন। এমন ব্যবহার অবশ্য বাংলাদেশের অনেক কবির কবিতাতেই পাওয়া যায়। নতুন কিছু নয়। আরেকটা ব্যাপারও লক্ষ্যণীয়। প্রথম বাক্যে লেখা – ‘হয়ো আর না বাহির’। ‘আর বাহির হয়ো না/হয়ো না আর বাহির’ নয় কিন্তু। ‘আর’ শব্দটার অবস্থান কথাটাকে যেন আদেশ থেকে বদলে দিল পরামর্শে। মেহরিন খুশি হল। বুঝল, যত্ন করার লোক আছে তারও। আচ্ছা, কোনও কবি যখন আঞ্চলিক বাংলায় কবিতা লেখেন, তিনি প্রথম থেকেই পরিকল্পনা করেন যে এই বিষয়টার এই রূপ দিলেই আবেদন বেশি হবে? যাঁদের প্রায় সব কবিতাই প্রমিত বাংলায়, তাঁদের দু-একটি কবিতা আঞ্চলিক ভাষায় লেখা কি আদতে মেকিং? হতে পারে। এক্সপিরিমেন্ট হলেই বা দোষ কী! হতে পারে অরিজিনিলাটির কাছে ফিরে যাওয়ার চেষ্টাও। কে বলবে? কবির মনের রহস্য মহাবিশ্বের মতোই অসীম। কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় না সহজে। তবে, রিয়াজের এই কবিতাটা আমার প্রিয় হওয়ার কারণ কিন্তু ভিন্ন। একটা বাক্য – একটাই বাক্য এর জন্য দায়ী। সেই বাক্যে আমি খুঁজে পাই ভালোবাসা, বিশ্বাস, দায়িত্ব, অসহায়তাও। ‘মোনাজাত করো বউ, বউ গো’। রিয়াজ যদি শুধু ‘মোনাজাত করো বউ’ বলে ছেড়ে দিত, হয়তো দ্বিতীয়বার পড়তাম না কবিতাটা। কিন্তু সঙ্গে ‘বউ গো’ জুড়ে দেওয়ায় যে চাপা আর্তি ফুটে উঠল লেখাটার শরীরে, পাঠক আমি তা অস্বীকার করতে পারলাম কই! আমার সামনে তাই প্রচুর খানাখন্দ। হেঁটে চলেছি অন্ধ মানুষ। বউ, বউ গো, মোনাজাত করো, যেন বাঁচিয়ে চলতে পারি। নইলে তোমার কাছে ফিরবই বা কীভাবে! (৬) এহন আমারে দেইখা / সরদার ফারুক এখন আমারে দেইখা দরোজা আইজাও আগে তো এমুন ছিলা না, কৈতর! সামনে পইড়া গ্যালে ভেচকির লগে ঠ্যাস-মারা কথা গালে ঠোনা দিয়া আর করো না আদর ফলনা দফনার লগে মিঠা মিঠা বুলি আচুক্কা ছুরির পাড় ভাজ পাই দিলের ভিতর এহন ত্যান্দর কও, আগে ভাবছিলা কিরিষ্ণ ঠাউর! কাইঠার মতো রাইতে পইড়া থাকি বিছানায় দিয়াবাতি জ্বালি, তামুকের ধোঁয়া ওড়ে আসমানে নীল তারা জ্বলে আজ যেন নিয়ম ভাঙার ভূত পেয়েছে আমায়। নইলে যে আলোচনা চলছে মূলত দ্বিতীয় দশকের কবিদের নিয়ে, সেখানে ফারুকদা-র মতো সিনিয়র কবিকে টেনে আনার অর্থ হয়! সরদার ফারুকের ‘অন্যদের তর্কে ঢুকে পড়ি’ বইয়ে আছে কবিতাটি। যেহেতু আরও অনেক সিনিয়র কবিদের বাদ দিয়েছি, ফারুকদাকেও বাদ দেওয়াই উচিৎ ছিল এই আলোচনা থেকে। হায় রে পক্ষপাতিত্ব! মাইদুলভাই-এর একটা লাইন আছে, ‘আমি মূলত আমার চোখের দিকে’। সেই দশা এখন। এই কবিতায় যখন গেঁথেই গেছে চোখ, সরিয়ে নিই কী করে! বরং ঝাঁপ দেওয়া যাক। ফারুকদার কবিতা বা তাঁর শব্দব্যবহার বিশ্লেষণের স্পর্ধা আমার নেই। প্রাসঙ্গিকতা-হেতু এ-লেখার আগমন, সেটুকুই থাকুক। আর এই কবিতাটার সম্পর্কে যদি কিছু বলিও, তা শুধু এই কবিতাটার জন্যেই নয়। সরদার ফারুকের সব কবিতার ক্ষেত্রেই বোধহয় বলা চলে তা। আমার কাছে, বর্তমান বাংলা কবিতায় সন্ন্যাসী-জাদুকর যদি কেউ থেকে থাকেন, তাঁর নাম সরদার ফারুক। অনেক ভেবেচিন্তে ব্যবহার করলাম ‘সন্ন্যাসী-জাদুকর’ কথাটা। ফারুকদা যেন ঈশ্বর, অদ্ভুত নির্লিপ্তি নিয়ে লিখে চলেন একের পর এক কবিতা। ঈশ্বরের লীলা যেমন, আন্দোলিত করে মর্ত্যের মানুষকে আর তিনি মিটিমিটি হেসে মজা দেখেন, ফারুকদাকে তেমনই মনে হয় আমার। কবিতার বিষয়বস্তু, শব্দ সাজানোর স্টাইল, বাক্যের থ্রোয়িং – সব মিলিয়ে পাঠকের মনে আলোড়ন তুলবেনই। অথচ প্রতিটা কবিতার শেষই অদ্ভুত নির্লিপ্তি দিয়ে – যেন স্বাভাবিক, কিছুই হয়নি। এমনই তো হয়, হওয়ার ছিল। আর সেইসব ‘হওয়ার ছিল’-র অভিঘাতে স্থিতি ভেঙে যায় আমার, যাবতীয় পাঠ-অভিজ্ঞতা ভেসে যায় নিমেষে। ‘তোমাকে দিলাম, তুমি ঠ্যালা সামলাও এবার’ – বলে ফারুকদা চলে যান মুখ ফিরিয়ে। পাঠকের অবস্থা ভাবেন তিনি? এই কবিতাটাও তার ব্যতিক্রম নয়। আগের প্যারাগুলোর রাগ-অভিমান পেরিয়ে এসে ফারুকদা শেষ করছেন এমন এক জায়গায়, যা বিষয়বস্তুর থেকে হয়তো শত হস্ত দূরে, কিন্তু সূক্ষ্ম সূত্রে মিলে যাচ্ছে আবহমানের সঙ্গে। ‘কাইঠার মতো রাইতে পইড়া থাকি বিছানায়/দিয়াবাতি জ্বালি, তামুকের ধোঁয়া ওড়ে’ বলে থেমে গেলেই তো হত! ‘আসমানে নীল তারা জ্বলে’ – এমন একটা না-হলেও-হত অথচ অমোঘ বিষণ্ণ দৃশ্য নিয়ে আসার জাদুকরের নামই সরদার ফারুক। মাটির ব্যাপারকে নিয়ে গেলেন আসমানে। ঈশ্বরের সংকোচন সূত্র? ‘এহন ত্যান্দর কও, আগে ভাবছিলা কিরিষ্ণ ঠাউর!’ – কিছু বলব না। পাঠক, কবিতার শরীর ছিঁড়ে নিয়ে এলাম লাইনটা। যত্ন করার দায়িত্ব আপনার... -------- বেশ খানিকটা পেরিয়ে এলাম। আমার ভাষা ‘আমাদের’ ভাষা হল। খামখেয়ালিপনা থেকে এবার ছুটি নিলেই হয়। বাংলাদেশের জল-হাওয়া-কবিতায় ঘুরতে ঘুরতে নইলে খেই হারিয়ে ফেলব এবার। তবু শান্তি হচ্ছে না। লেখার আপাত-শেষে এসেও, কী-একটা-নেই ভাব অস্বস্তি দিচ্ছে আমাকে। কী জানি নেই। আসুক। সমস্ত আলোচনার ঊর্ধ্বে, স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে আসুক। সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরানের গহীন ভিতর’-এর ছোঁয়া না পেলে, যেন এই লেখা ব্যর্থ, বৃথাই এত শব্দবিনিময়... ২৬ ক্যান তুই গিয়াছিলি?- আমি তরে জিগামু অখন চান্দের ভিতর ফের, যেইখানে জটিলতা বাড়ে, অশথ জড়ায়া থাকে নদী নিয়া জলের কিনারে, আমার গেরাম ঘিরা যেইখানে খালি পলায়ন- মানুষের, মানুষের, আর তর চক্ষের কাজল, যেইখানে মেলা দেয় একখান সুনসান নাও, যে নায়ে সোয়ার নাই, ‘কেডা যাও, কেডা বায়া যাও?’ বেকল আছাড় দিয়া ওঠে কালা যমুনার জল? কেউ নাই, কেউ তর নাই, তুই নিজেই জানস, তবু ক্যান গিয়াছিলি? ক্যান তুই দিয়াছিলি ফাল? কিসের কি বাদ্যে তর রক্ত করে উথাল পাথাল আমারে ক’ দেখি তুই? ক’না দেখি, কি চিল মানস? ল’যাই জলের ধারে দ্যাখ ছায়া আমার কি তর? মানুষে মানুষে নাই কোনো ভেদ দুঃখের ভিতর।। Tags বিশেষ নিবন্ধ Facebook Twitter Whatsapp নবীনতর পূর্বতন
সুচিন্তিত মতামত দিন