--
না -খেন অর্থাৎ মৎস্যশিকার । ভারতবর্ষে মাছ নিয়ে আস্ত একটি পুরাণ রয়েছে । মৎস্যপুরাণ । মাছ বাঙালির জীবনেও মঙ্গল চিহ্ন জ্ঞাপক । মাছকে শুভ মানে উত্তরপূর্বের অধিকাংশ জাতি –জনজাতি । রাভা উত্তরপূর্বের অন্যতম জনগোষ্ঠী ।মৎস্যজীবী রাভা জনগোষ্ঠীর জীবনে মাছ খুব গুরুত্ব পূর্ণ । এতো-ই যে সাংস্কৃতিক পরম্পরায় নৃত্য –গীতে পূজা-পার্বণে ও জীবনশৈলীতে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে । প্রকৃতির নিত্য নব সাজে সৃষ্টির অফুরন্ত দানে রাভা জনজীবন সমৃদ্ধ । নতুন বর্ষা নামলে পুঁটি-মাছ সিঁদুরের ফোঁটা গায়ে ঊজানমুখী হয় । থৈ থৈ বর্ষায় খালে বিলে কিলবিলে নতুন জলের মাছ উজানস্রোতে সাঁতার কাটে । মাছেরা জোড় বাঁধে সেই সময় । ডুবু ডুবু জলে রুই – বোয়ালে গলাগলি করে মিতালি পাতে । রাভা কন্যা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দেখে প্রকৃতির ঋতু বদলের সঙ্গে কামনামেদুর প্রকৃতির সঙ্গম লিপ্সা । মাছ মারতে এসে কিশোরী লাজে রাঙ্গা হয়ে যায় । তার চোখের তারায় বিজুলি চমকায় । এই বিজুলির ছটায় চনমনা করে উঠে যুবকের মন । ভরা জ্যৈষ্ঠ রাভা জনজীবনে ডেকা – গাভুরু ( যুবক –যুবতীকে ) মিলনে প্রেরিত করে । ‘বায়খো ’ –পূজায় অংশ নিতে রাভা জনগোষ্ঠী মেতে উঠে । খোলা মন প্রসারিত করে আকাশ তলে গেয়ে উঠে , --
‘ ফাচি পিদান ফাদাং না উজায় ধুঙ্গা ।
দরায় – গাবুর মন বিজান অগান্দান চাঙা’ ।।
( নব বর্ষায় মাছে উজান ভাটি করে । সেই দেখে যুবক যুবতীর মনে প্রেমের ভাব অঙ্কুরিত হয় । )
অসমীয়াদের যেমন কৃষি (খত –খামার ) রাভাদের মৎস্য শিকার । মাছ-মারা একটি লোকউৎসব । বিহু যেমন যৌবনের মৌ-বন , মাছমারা মেয়েটি শারীরিক শক্তির যৌবনমূর্তি । মাছ মারার সময়ে যুবতীর শারীরিক বল এবং কোমরের মোচড়ের কারসাজি পরীক্ষা করা হয় । এই মৎস্য শিকার রাভা লোকজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে । এই নিয়ে কবিগণ বেঁধেছেন অনেক গান ।
‘আয়রে বাবারে মাছ মারিবা যাং ,
খেতা কাফুর লৈয়া হেনা বোহারী যাবা চাং
জাঙয় চাবা চাং” ।
-- মাছ ধরা তো বটে-ই , সেই সঙ্গে মেয়েদের ও দেখতে পাবার আনন্দ নিয়ে রাভাযুবক মাছ ধরাকেই বানিয়ে নিল উৎসবের বিষয় । চাঁদনী রাতের মোহময় কমনীয়তায় নদীর রহস্যময় শীতল জলে সপাৎ করে জালটি ফেলে রাভাযুবক তেরচা চোখে চেয়ে থাকে পারের দিকে । এখন-ই জাকৈ কোমরে বেঁধে সখিসহ হৈ হৈ করে আসবে সেই রমণী । যাকে দেখতে চাঁদের আলোয় মাছ ধরার সামাজিক উৎসব । জলজীবন মুখ্য রাভাদের । মাছ ধরা যেমন জীবিকা , তেমনি মাছকে ঘিরে স্বপ্ন বাসর রচনা কই মাছের ছটফটানির সঙ্গে রঙ্গিলী নায়িকার সামঞ্জস্য রাভাযুবকের রোমান্স চেতনাকে উজ্জীবিত করে ।
‘দল বারিনি কয় না দল কাকে রেং ,
যা চিঙো মানচা খাপাক ককে রেং ‘ ।
( -- দলবেঁধে কৈ মাছেরা মিলনেচ্ছায় ঘুরে বেড়ায় ,তদ্রূপ বায়খো পূজাতে যুবক-যুবতীর মিলনের সুযোগ যে নেয় না , সে আসলে উপেক্ষা করে ও পরে অনুতাপ করে ) ।
রাভা জনগোষ্ঠীর বসন্ত উৎসব ‘বায়খো’ উৎসব । পবিত্র জ্যৈষ্ঠ মাসে নব বরষার আগমনে রাভা মনে নতুন জলের মাছের মতো-ই খলবল করে উঠে । নতুন বস্ত্র , আগের দিন উপবাসে থেকে বায়খো দেবীর ( পার্বতী ) পুজোর আয়োজনে মেতে উঠে । এই অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ‘চাথা’ নৃত্য । বিহু নৃত্যের মতো নারীপুরুষের প্রেম প্রকাশের নৃত্য । অই নৃত্যের মাধ্যমে রাভাদের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার পরম্পরা রয়েছে । ‘চাথা’ গীতে কেবল যে নারীপুরুষের প্রেম মিলন বিরহের কথা আছে তা নয় । এই মৎসকেন্দ্রিক প্রচুর লোকগাথা ও প্রবচন রয়েছে । ‘রূপে কি কাম করে , গুণে হে সংসার তরে’, ‘কুরচা মাছের তিন অবস্থা মন গুমরে মারা মানুষ কম দেখিছা’; ‘সব পাখি মাছ খায় মাছরাঙ্গার নাম হয়’ , ‘মাছের তেলে মাছ ভাজা’ ইত্যাদি প্রবচন রাভা লোকজীবনে মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় ।
--‘চান্দা গেরা না গেরা চান্দা ফছাছেং
বিছিনিছে দরায় কায় কান ফছাছেং’ ।
--- অর্থাৎ চাঁদা মাছে কাটা রয়েছে , তাই খালুইতে ভরতে অনেকেই ভয় পায় । কিন্তু মচমচ তেলে ভাজলে কিংবা শুকিয়ে শুটকি করে তরকারি করলে খুব উপাদেয় হয় । তেমনি সংসারে নারীর বসতি , গার্হস্থ জীবন পাতলেই প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যাবে । চাথার গীত রাভা জীবনের বিহু গীত । কাজেই এই গীতগুলিতে স্বকীয়া পরকীয়া , -- জামাইবাবু –শ্যালিকা , দেবর – বৌদিদি ইত্যাদির মধ্যে প্রচলিত রসের কথাতেও মাছের লিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায় । মাছ কখনো দেবী , কখনো হয়ে উঠেছে যৌনতার প্রতীক ।
মাছ ধরে আসা যুবক- যুবতীর ধৈর্য পরিশ্রম , আবেগ , অনুভূতি , আচার ব্যবহার সব দেখা হয় । মাছধরাকে কেন্দ্র করে বায়খো পূজা হয় । বা য়খো পূজা রাভা জনগোষ্ঠীর জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । এই পূজা যৌবন ও জীবন সুধার পরিপূরক । মাছের যৌন জীবন, প্রেম , উর্বরতার সঙ্গে মানুষের মিল খুঁজে পায় রাভা । রাভা জীবনে প্রজনন দেবী রূপে মৎসদেবীর আরাধনা বায়কো পূজা । প্রাণীদের মধ্যে মাছদের রয়েছে সবচেয়ে প্রজনন ক্ষমতা । মাছ এদের ইস্ট সমান এবং মাছ ধরাকে পবিত্র কর্ম বলে মানা হয় । মাছ রাভাদের জীবনযাপনের আবশ্যক অঙ্গ । বিয়ে বাড়ি থেকে শ্রাদ্ধ বাড়ি সর্বত্র মাছের ব্যবহার রয়েছে ।
আদিমকাল থেকেই বৃত্তি হিসেবে মাছ জায়গা করে নিয়েছে রাভা জনজীবনে । টাটকা মাছ তো বটেই মাছ শুকিয়ে দীর্ঘদিন সংরক্ষণের কৌশল ও রপ্ত রয়েছে রাভাদের । তবে রাভাদের মধ্যে রয়েছে অনেক জনগোষ্ঠী । প্রতিটি জনগোষ্ঠী এক একটি বিশেষ প্রজাতি মংস্য খাওয়া বিরত । কারণ ওরা মনে করে ওই বিশেষ মাছটি তাদের জনগোষ্ঠীর পালক । ( যেমন দাবাং গোষ্ঠী শৌ্ল খায় না , কাস্ত্রাং কচ্ছপ , মুদ্ধি আর কামা বড়ালি মাছ খায় না ) । মাছের সঙ্গে জলপোকা , কচ্ছপ , কাঁকড়া , জলগুই , শামুক ইত্যাদি খাদ্য তালিকায় রয়েছে । রাভা সমাজের বিধি মতে শ্রাদ্ধবাসরে ( মাছুয়ানি ) মৎস্য স্পর্শ না করলে মাছ কখনো খাওয়া যাবে না । তাই শুকনা মাছ দিয়ে মাশকালাই ডাল আবশ্যক ।
মৎস্য শিকারের সঙ্গে প্রচুর লোকবিশ্বাস ছড়িয়ে আছে । যেমন মাছ মারতে গেলে হাতে পয়সা থাকলে মাছ পাবে না । টক খেয়ে গেলে কাঁটা মাছ ( শিং কৈ ) মাছে বিঁধে । সেইজন্য কাতিবিহুতে প্রদীপ প্রজ্বলনের জন্য চালতা দিয়ে তৈরি প্রদীপ যতক্ষণ প্রস্তুত না হবে ততক্ষণ টক খাওয়া নিষেধ । হাতে আদা নিয়ে মাছ ধরতে নেমে যাও , নিজে অক্ষত থাকবে কিন্তু পাশের লোকটির নিস্তার নেই । মাছ মারার জায়গা ও তারিখ গোপন রাখতে হবে নতুবা ভুতের হাতে মার খেতে হবে । রাভা ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করে । মাছ ভুত ও মৎস্য কন্যার রূপকথা রাভাদের মুখে মুখে ফিরে ।
তবে অন্যান্য জনজাতির মতো রাভা পুজাপালিতে মাছ উৎসর্গ করে না । কারণ দেবী রূপে পূজা করে । রাভা গৃহলক্ষী রোন্তাক ( লক্ষ্মী ) রূপ বদল করে মাছ হয়ে রাভার জীবনশৈলীর অঙ্গ হয়ে উঠেছে ।
পাদটীকা =
রাভাগণ মেঘালয় , আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের একটি স্বল্প পরিচিত তপশিলি ভুক্ত উপজাতি রাভা । পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি এবং আসামের গোয়ালপাড়া এবং কামরূপ, দরং জেলায় রাভাভাষী মানুষ বাস করেন। রাভা অসমের পঞ্চম বৃহত্তম তপশিলি ভুক্ত উপজাতি। রাভা সম্প্রদায়ের মানুষেরা বৃহত্তর ইন্দো-মঙ্গলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। রাভা জনজাতির মানুষেরা রাভা ভাষাতে কথা বলেন। বড়ো, গারো, কাছারি ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর মানুষের সাথে এঁদের নৃতাত্ত্বিক যোগাযোগ রয়েছে। বলা হয় যে, রাভা সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে প্রকৃতি এবং জঙ্গলের একটি নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অতীতে তাঁরা ঝুমচাষ করতেন। লাঙ্গলের সাহায্যে কৃষি কাজ তাঁদের অজানা ছিলো। বহু শতাব্দী ধরে রাভারা চাষ-আবাদ ও তাঁত বুনেই জীবন যাপন করে আসছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ষষ্ঠ দশকে, ভারতের ইংরেজ শাসকেরা জলপাইগুড়ি, ডুয়ার্স এবং অসমের জঙ্গলগুলোকে "সংরক্ষিত বনাঞ্চল" বলে ঘোষণা করার সাথেই রাভাদের এই জীবন ধারার পরিবর্তন শুরু হল। বন থেকে বিতাড়িত হলেন রাভারা, কারণ তাঁদের ঝুমচাষ জঙ্গলের ক্ষতি করে। বনবাসী রাভারা হলেন বন-বস্তীর রক্ষক । ইউরোপীয় বন অধিকর্তাদের তথাকথিত "বিজ্ঞানসম্মত বনানিকরণ" প্রক্রিয়ায় সামিল হলেন কিছু রাভা, বাকিরা লাঙ্গল ধরলেন। বর্তমানে, রাভা সম্প্রদাযের মানুষেরা চাষাবাদ, চাকুরী, ব্যবসা ইত্যাদি বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত আছেন। তবে, এখনো বেশীরভাগ মানুষই বনকর্মী অথবা কৃষক ।
রাভারা প্রকৃতির উপাসক। রাভাদের মধ্যে প্রথাগত ভাবে মূর্তি পূজোর প্রচলন নেই। তবে বর্তমানে তাঁরা মূল ধর্ম পালনের সাথে সাথে হিন্দু ধর্মের কিছু আচার আচরণ ও পালন করেন। রাভাদের প্রধান দেবতা হলেন "ঋষি" বা "মহাকাল"। সমস্ত সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এঁর পুজো অতি আবশ্যক। এছাড়া রাভাদের আরো দুই দেবী হলেন 'রঙ্গতুক' ও 'বসেক'। এঁদের ঋষি বা মহাকালের কন্যা বলে মনে করা হয়। 'রঙ্গতুক' ও 'বসেক' হলেন পারিবারিক ধন সম্পত্তির দেবী। রাভারা মূলত মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থার অনুগামী, তাই পরিবারের জেষ্ঠা কন্যা পারিবারিক সূত্রে এই দুই দেবীর অধিকারী হন ।]বর্তমানে বহু রাভা খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
সুচিন্তিত মতামত দিন