বাংলা গানের একটি বিশিষ্ট ধারা। সংস্কৃত কীর্তন [কীর্ত্তি (বর্ণনা করা) +অন (ল্যুট), ভাববাচ্য] শব্দের একাধিক অর্থের ভিতরে বিশেষ কয়েকটি অর্থ হলো- গুণকথন, গুণগানকরণ, স্তবন। এই অর্থের সাথে বাংলা গানের কীর্তন-এর ভাবের সবিশেষ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কীর্তন-এর এই ভাব যেকোনো বিষয়ের গুণকীর্তন নয়। মূলত এর সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে হিন্দু পৌরাণিক দেবতা বিষ্ণু, বিষ্ণুর দ্বাপর যুগের প্রথম অবতার এবং দশম অবতারের অষ্টম অবতার হিসাবে নির্দেশিত শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধার সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলী। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে- কংস নামক এক অত্যাচারী রাজার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে, ব্রহ্মা সকল দেবতাদের নিয়ে সমুদ্রের ধারে বসে বিষ্ণুর আরাধনা শুরু করেন। বিষ্ণু সে আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সাদা ও কালো রঙের দুটি চুল দিয়ে বললেন যে, তিনি বসুদেবের ঔরসে দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করবেন। কৃষ্ণের প্রতীক হলো কালো চুল। তাঁর সহযোগী হলেন বলরাম, তাঁর প্রতীক হলো সাদা চুল। এই সূত্রে বসুদেবের ঔরসে দেবকীর অষ্টম গর্ভে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। পক্ষান্তরে রাধাকে কৃষ্ণের প্রণয়িনী হিসাবে দেখা হয়। পদ্মপুরাণ ও ভাগবতের মতে, গোলকধামে কৃষ্ণের বামপাশ থেকে রাধার উৎপত্তি হয়েছিল। জন্মের পর পরই ইনি কৃষ্ণের আরাধনা শুরু করেন। ইনি উৎপত্তিকালে ১৬ বৎসরের নব-যৌবনারূপে কৃষ্ণের সিংহাসনের বামপাশে অবস্থান নেন। এই সময় রাধার লোমকূপ হতে লক্ষকোটি গোপিকা ও কৃষ্ণের লোমকূপ থেকে লক্ষকোটি গোপের জন্ম হয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে- একবার বিষ্ণু রম্যবনে প্রবেশ করে রমণ ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ফলে কৃষ্ণের ডান অংশ থেকে কৃষ্ণমূর্তি ও বাম অংশ থেকে রাধা মূর্তি প্রকাশ পায়। রাধা কৃষ্ণকে কামাতুর দেখে তাঁর দিকে অগ্রসর হন। রা অর্থ লাভ এবং ধা অর্থ ধাবমান। ইনি অগ্রসর হয়ে কৃষ্ণকে লাভ করেছিলেন বলে- এঁর নাম হয়েছিল রাধা।
কীর্তন বাংলা সঙ্গীতের অন্যতম আদি ধারা। সাধারণ লোকের পক্ষে অতি সহজে ঈশ্বর সাধনার একটি উপায় হিসেবে এর উদ্ভব। গানের মাধ্যমে ধর্মচর্চার এ ধারা প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে চলে আসছে। সে ধারাবাহিকতায় বাংলার বৈষ্ণবধর্মজাত সঙ্গীতধারার বিকশিত রূপই কীর্তন। এতে সাধারণত ঈশ্বরের গুণ ও লীলা বর্ণিত হয়। বড়ু চণ্ডিদাস, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, বিদ্যাপতি প্রভৃতি কবিগন প্রচুর কীর্তন গান রচনা করেন। ১৫০০ শতকে শ্রীচৈতন্য ভক্তি সংগীতের এই ধারার প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। তার গান নারী, পুরুষ, শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এখানে উল্লেখ্য যে, রাধাকৃষ্ণের লীলার বিভিন্ন পর্যায় অবলম্বনে বিভিন্ন পালাক্রমে লীলার বিভিন্ন নৌকা বিলাস, নিমাই সন্ন্যাস, মাথুর, মান, গোষ্ঠ প্রভৃতি। পরবর্তী সময় চৈতন্যদেব(১৪৮৬-১৫৩৩) কীর্তনকে সর্বসাধারণের সঙ্গীত হিসাবে ব্যাপক প্রচার করেন।
ভাবের বিচারে কীর্তন গান হলো- সুর-তাল সহযোগে কৃষ্ণের মধ্য দিয়ে বিষ্ণুর দশম অবতারের গুণকথন বা রাধাকৃষ্ণের পার্থিব লীলার ভিতর দিয়ে ঈশ্বর লীলা অনুধাবনের চেষ্টা। সঙ্গীতের এই বিশেষ ধারার আদি উৎস হিসাবে ধরা হয়, সংস্কৃত ভাষার কবি জয়দেবের রচিত গীতগোবিন্দম্ । এই আখ্যানকাব্যে যে পদগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোর সাথে রাগ-তালের নাম পাওয়া যায়। তবে খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ রচিত এই গ্রন্থের পদগুলোর গীতরীতি কেমন ছিল, তা জানা যায় না। এরপর একই ধারায় কীর্তনের সূচনা ঘটেছিল খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর মাধ্যমে। এর ভাষাকে মধ্যযুগীয় বাংলা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই গ্রন্থটি অনেকাংশই গীতগোবিন্দম্ দ্বারা প্রভাবিত। গীতগোবিন্দম্-এর দুটি প্রধান গায়নরূপ প্রচলিত ছিল একটি ধ্রুপদাঙ্গ, অন্যটি কীর্তনাঙ্গ। তবে গীতগোবিন্দম্ প্রধানত ধ্রুপদাঙ্গেই গীত হতো। বঙ্গদেশে গীতগোবিন্দম্ল-এর প্রভাব বিলুপ্ত হওয়ার পর শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে কীর্তনান্দোলন শুরু হয় এবং তাঁর অনুসারীরা কীর্তনাঙ্গে জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ গাইতে থাকে। ফলে গীতগোবিন্দম্-এর পদগুলি কীর্তনে পরিণত হয়। এভাবে বাংলা কীর্তন গানে গীতগোবিন্দম্-এর গভীর প্রভাব পড়ে। এরপর বা এর কাছাকাছি সময়ে বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস প্রমুখ পদকর্তারা রাধাকৃষ্ণের পার্থিব লীলাকে উপজীব্য করে পদ রচনা করেছিলেন। কিন্তু এই পদগুলো গীতগোবিন্দম্ বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর মতো কোনো অখণ্ড আখ্যান-কাব্য হিসাবে গ্রথিত হয় নি। এ সকল পদের সুর হারিয়ে গেছে।
কীর্তনের শ্রেণীবিভাগ
কীর্তন দুইপ্রকার - নামকীর্তন বা নামসংকীর্তন এবং লীলাকীর্তন বা রসকীর্তন।
নামকীর্তন বা নামসঙ্কীর্তন –
শুধু হর ও কৃষ্ণ শব্দের ক্রমাগত উচ্চারণ যখন সুর ও ছন্দে প্রকাশ করা হয়, তখন তাকে নামকীর্তন বলা হয়। অবশ্য কখনো কখনো হরে ও কৃষ্ণ উচ্চারণের পাশাপাশি বিষ্ণুর অন্যান্য অবতারদের বা কৃষ্ণের অন্যান্য নাম বা রাধা নামও উচ্চারণ করা হয়। যেমন- রাধে গোবিন্দ, হরে হরে, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে, রাম রাম হরে হরে ইত্যাদি। এই কীর্তনে মন্দিরা প্রধান বাদ্য-উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কখনো কখনো এর সাথে শ্রীখোলও ব্যবহার করা হয়। এই কীর্তন একা বা একাধিক গায়ক বসে বসে বা ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় পরিবেশন করে থাকেন। চৈতন্যদেবের সময় থেকে কীর্তনের এই ধারাটি চালু হয়েছে।
হরি বা বিষ্ণুকে সম্বোধন করে ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে/ হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে\’ এ ষোল পদবিশিষ্ট কীর্তনই নামকীর্তন। অবশ্য নামকীর্তনের এ বোল ছাড়া আরও বোল আছে। সেগুলিও নামকীর্তন হিসেবেই প্রচলিত।
লীলাকীর্তন বা রসকীর্তন –
এর অন্য নাম পদকীর্তন বা পদাবলী কীর্তন। এই কীর্তনে বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধার পার্থিব প্রেম-লীলার ভিতর দিয়ে আধ্যাত্মিক দর্শন অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়। গ্রন্থনার বিচারে লীলা কীর্তনকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ভাগ দুটো হলো- আখ্যান-কীর্তন ও ছুট কীর্তন। রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে একটি পূর্ণাঙ্গ আখ্যান-গীতি হিসাবে উপস্থাপনই হলো আখ্যানকীর্তন। অনেকে মনে করেন যে, 'আখ্যান কীর্তন' হলো- আদি কীর্তন। কারণ গীতগোবিন্দম্' -এর সূত্রে এই কীর্তনের সূচনা হয়েছিল। পক্ষান্তরে একটি স্বতন্ত্র ভাবকে প্রকাশ করার জন্য পৃথকভাবে যে কীর্তন রচনা করা হয়, তাকে 'ছুট কীর্তন'। এই কীর্তন কোনো আখ্যান-এর অংশ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে না। কিন্তু এই জাতীয় কীর্তন যে কোন আখ্যান-কীর্তনের অংশ হিসাবে চালিয়ে দেওয়া দেওয়া যেতে পারে।
রাধাকৃষ্ণ এবং গোপী-শ্রীকৃষ্ণের কাহিনী অবলম্বনে যে পালাগান তা লীলাকীর্তন। পরবর্তীকালে গৌরাঙ্গ বা শ্রীচৈতন্যের কাহিনী অবলম্বনেও লীলাকীর্তনের প্রচলন হয়। কয়েকটি প্রধান লীলাকীর্তন হলো গোষ্ঠ, মান, মাথুর, নৌকাবিলাস, নিমাই সন্ন্যাস ইত্যাদি। এগুলি পদাবলি কীর্তন নামেও পরিচিত।
জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ কীর্তন গানের আদি উৎস। এতে বিভিন্ন রাগ ও তালের উল্লেখ আছে। এর পদগুলি যে সাঙ্গীতিক কাঠামোতে রচিত, পরবর্তীকালের কীর্তনের ধারায় তারই প্রভাব পড়েছে। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকেই কীর্তন নামের এ সঙ্গীত-ধারার বিকাশ ঘটে। এ সময়ের কাছাকাছি মিথিলার কবি বিদ্যাপতিও ব্রজবুলিতে কীর্তনাঙ্গের বৈষ্ণবপদ রচনা করেন। পনেরো শতকে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে কীর্তন গানে অসামান্য বেগ সঞ্চারিত হয়। তিনি ছিলেন নামকীর্তনের প্রচারক। চৈতন্যদেব বুঝতে পেরেছিলেন যে, নারী-পুরুষ ও বয়স নির্বিশেষে সঙ্গীতের আবেদন সর্বাধিক এবং কোনো কঠিন বিষয়ের প্রতি অশিক্ষিত কিংবা স্বল্পশিক্ষিত জনগণকে আকৃষ্ট করার সহজতম উপায় হচ্ছে সঙ্গীত। তাই ঈশ্বর-সাধনার সহজতম পন্থা হিসেবে তিনি বেছে নেন কীর্তনকে। তিনি সকলকে জানান আর কোনো শাস্ত্র নয়, কেবল ‘হরে কৃষ্ণ...’ ইত্যাদি ষোল পদবিশিষ্ট কীর্তন করলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে। ঈশ্বর-সাধনার এ সহজ পথের সন্ধান পেয়ে সাধারণ লোকেরা তাঁকে অনুসরণ করে কীর্তন গাইতে শুরু করে। ফলে কীর্তন একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়। এভাবেই চৈতন্যদেব কীর্তনের মাধ্যমে তাঁর আদর্শ, অধ্যাত্মচিন্তা এবং তাঁর সাম্যের ধর্ম সারা বাংলায় প্রচার করেন। তিনিই নামকীর্তনের পরিপূর্ণ সাঙ্গীতিক রূপ দান করেন এবং এ গানকে অধ্যাত্মমার্গে উন্নীত করে বাঙালির কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন।
লীলা কীর্তনের ধারা
চৈতন্যোত্তর যুগে লীলাকীর্তন পাঁচটি ধারায় বিকশিত হয়: গড়ানহাটি, মনোহরশাহী, রেনেটি, মন্দারিণী ও ঝাড়খন্ডী। ধারাগুলি ঘরানা নামেও পরিচিত। উৎপত্তিস্থানের নামানুসারে এসব ধারার নামকরণ করা হয়। ষোল শতকে রাজশাহী জেলার অন্তর্গত গড়ানহাটি পরগনার পদকর্তা নরোত্তম দাস কর্তৃক গড়ানহাটি ধারা প্রবর্তিত হয়। ১৬০০ শতকে নরোত্তম দাস গাদানহাটি ধারাটির সূচনা করেন। তিনি ছিলেন রাজশাহী জেলার গাদানহাটি পরগনার বাসিন্দা। তিনি প্রথমে গৌরচন্দ্রিকা গেয়ে পরে কীর্তন গাওয়ার রীতি প্রবর্তন করেন। নরোত্তম দাস ধ্রুপদ সঙ্গীতে ব্যুৎপন্ন ছিলেন বলে তাঁর প্রবর্তিত গড়ানহাটি ধারাটি ছিল ধ্রুপদাঙ্গের কীর্তন। বীরভূমের মনোহরশাহী ধারার প্রবর্তক জ্ঞানদাস মনোহর। এতে খেয়াল গানের প্রভাব আছে। বর্ধমানের রেনেটি ধারার প্রবর্তক বিপ্রদাস ঘোষ। এতে টপ্পাঙ্গের প্রভাব আছে। মন্দারণ সরকার নামক জনৈক কীর্তনীয়া প্রবর্তিত ধারার নাম হয় মন্দারিণী এবং ঝাড়খন্ড অঞ্চলে উদ্ভূত ধারার নাম ঝাড়খন্ডী কীর্তন। মন্দারিণী ধারায় ঠুংরির প্রভাব লক্ষণীয়। নিম্নে সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করা হল –
গড়ানহাটি ধারা : খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে রাজশাহী জেলার গড়েরহাট বা গড়েনহাটি পরগণার পদকর্তা নরোত্তম দাস এই বিশেষ ধরনের কীর্তনের ধারা প্রবর্তন করেন। এই ধারায় মূল লীলা-কীর্তনের পূর্বে 'গৌরচন্দ্রিকা' নামক প্রারম্ভিক গান গাওয়ার রীতি প্রচলন করেন। নরোত্তম দাস ধ্রুপদ গানের প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত ছিলেন। এই কারণে তাঁর গানে ধ্রুপদের প্রভাবটা বেশি ছিল। এই ধারার কীর্তনে ধ্রুপদের মতো প্রথমে স্বরালাপ করা হয়ে থাকে। এই আলাপ শেষে নিবদ্ধ গান পরিবেশন করা হয়। ধ্রুপদের মতো এই কীর্তনে চারটি তুক রয়েছে। এগুলোকে বলা হয়- উদ্গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব ও আভোগ।
মনোহরশাহী : চৈতন্যদের সমসাময়িক কালে বর্ধমান জেলার মনোহরশাহী পরগণার শ্রীখণ্ডে কীর্তনের একটি নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন জ্ঞানদাস মনোহর। এই ধারাটি 'মনোহরশাহী' নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এই ধারাকে যেসব প্রখ্যাত কীর্তনীয়ারা সমৃদ্ধ করেছিলেন, এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন– নরহরি সরকার, রঘুনন্দন আচার্য, কবি লোচন দাস, বাসুদেব ঘোষ প্রমুখ। এই কীর্তনে খেয়ালের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে এর সাথে মিশ্রিত হয়েছিল আঞ্চলিক লোকধারার সুর।
রেনেটি : খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে বর্ধমান জেলার রাণীহাটি পরগণার কীর্তনের এই ধারটি বিকশিত হয়েছিল। এই অঞ্চলের বিপ্রদাস ঘোষ কীর্তনকে টপ্পার মতো করে পরিবেশন করার রীতি প্রচলন করেন। টপ্পা অঙ্গের গায়নরীতি যাঁরা পছন্দ করতেন, তাঁদের কাছে কীর্তনের এই ধারাটি বিশেষভাবে আদৃত ছিল। এই ধারাটি রাণীহাটী ধারা হিসাবে প্রথমদিকে প্রচলিত ছিল। পরবর্তী সময় এই নামটি লোকমুখে ধারাটি 'রেনেটি' নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এই ধারাটিই কলকাতা অঞ্চলে আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
মন্দারিণী : উড়িষ্যা ও মেদিনীপুরের মন্দারণ অঞ্চলের চর্চিত কীর্তন ধারাটি 'মন্দারিণী' নামে অভিহিত হয়ে থাকে। বংশীবদন নামক প্রখ্যাত কীর্তনীয়া এই ধারাটির প্রবর্তন করেন। এই গানে ঠুংরির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
ঝাড়খণ্ডী : শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য গোকুলানন্দ ষোড়শ শতকের শেষে এই কীর্তন ধারার প্রবর্তন করেন। ঝাড়খণ্ডে এই কীর্তনের উদ্ভব হয়েছিল বলে ধারাটি ঝাড়খণ্ডী নামে অভিহিত হয়ে থাকে। ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের লোকায়ত সুরাশ্রয়ী ও বাণীশৈলী দ্বারা এই ধারা পুষ্ট হয়েছিল। চৈতন্য চরিতামৃত ও চৈতন্য ভাগবত গ্রন্থে এই কীর্তনের নাম পাওয়া যায়। কথিত আছে চৈতন্যদেব এই পথে বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন। এই ধারায় ঝাড়খণ্ড-এর লোকগানের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে এই ধারার কীর্তনের ব্যাপক চল নেই।
কীর্তনে টপ্পার প্রভাব বা ঢপ কীর্তন
কলকাতায় পরবর্তীকালে টপ্পার প্রভাবে কীর্তনের এক নতুন ধারার সৃষ্টি হয়, যা ঢপকীর্তন নামে পরিচিত। খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতকে ঢপ্কীর্তন নামে নতুন একটি ধারার সূচনা হয়। এই ধারার সূচনা হয়েছিল কলকাতায়। এই ধারার গুরু হিসাবে মান্য করা হয় রাধামোহন ঠাকুর-কে। নরোত্তম দাস কর্তৃক উদ্ভাবিত কীর্তনের এ ধারায় প্রথমে অনিবন্ধ গীতে আলাপ তথা স্বরালাপের মধ্য দিয়ে গানের শুরু হয়। আলাপের পর ধ্রুপদের গঠনভঙ্গি অনুযায়ী মূল গান অর্থাৎ নিবন্ধ গান গাওয়া হয়। নিবন্ধ গানের চারটি ধাতু উদ্গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব ও আভোগ-এর গঠনরীতি অনুযায়ী পদাবলি কীর্তনের রূপ নির্মিত হয়েছে। বৈষ্ণব পন্ডিতদের মতে কীর্তনে ৬৪ প্রকার রসের উল্লেখ আছে। সাধারণত দাঁড়িয়ে অথবা নৃত্যসহযোগে কীর্তন পরিবেশিত হয়, তবে বৈঠকি স্বভাবে কীর্তন পরিবেশনেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। কীর্তনের গঠন-প্রকৃতিতে রয়েছে কথা, আখর, দোহা, ছুট ও তুক্। এতে আখরের প্রয়োগ খুবই মধুর ও আকর্ষণীয়। কীর্তনের একটি পদ গাওয়ার পর আখর দ্বারা সঙ্গীতের মূল কথাটি ভাব ও রসে ভরিয়ে তোলা হয়। কীর্তন উচ্চাঙ্গসঙ্গীত ধারার গান। এর সুর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বিশেষ করে হিন্দুস্থানি সুরের প্রভাব থেকে মুক্ত এবং উদার ভক্তিভাবরসেপূর্ণ।
নতুন ধারার এই কীর্তনে বৈঠকি-মেজাজে কোনো না কোনো রাগের আশ্রয়ে সুরবিন্যাস করা হতো। গানের মাঝে মাঝে কথকতার ভঙ্গিতে কিছু বাক্য ব্যবহার রীতিও ক্রমে ক্রমে এই কীর্তনের অংশে পরিণত হয়। যেমন- রাধা কহিতেছেন, কৃষ্ণ কহিলেন ইত্যাদি। এছাড়া এই কীর্তনে আঞ্চলিক পালাগানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সেকালের কীর্তনীয়রা এই কীর্তনে বাউলের সুরভঙ্গিমা অত্যন্ত কুশলতার সাথে ব্যবহার করতেন। বৈঠকি আসরে ঢপকীর্তনে অনেক সময় খোলকর্তাল, মন্দিরা, হারমোনিয়াম সহযোগে রাগভিত্তিক সম্মিলিত বাদ্য পরিবেশন হতো। কথকতার নাট্যকীয়তা, বাদ্যযন্ত্রের অনুসঙ্গ, শিল্পীদের লীলায়িত নৃত্য ইত্যাদি মিলে ঢপ্কীর্তন গ্রাম বাংলায় যাত্রাগানের মতও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এক সময়। মধুসূদন কিন্নর বা মধুকান (১২২৫-১২৭৫ বঙ্গাব্দে) নামক যশোহর জেলার জনৈক কীর্তনীয় এই কীর্তনকে জনপ্রিয় করে তোলেন। অনেকের ধারণা, ঢপ্কীর্তন নামটি মধুসূদন কানের দেওয়া। পরবর্তী সময়ে এই ধারাকে ঐতিহ্যগত একটি ধারায় পরিণত করেন রূপচাঁদ পক্ষী, লোচন দাস, দ্বারিক দাস, শ্রীরাম দাস, নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়, দাশরথী রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পান্নাবাই, পটলবাই, ছাপান্ন ছুরী কমল ঝরিয়া, ললিতা বৈষ্ণবী প্রমুখেরা। ঢপ্কীর্তনে ব্যবহৃত হত লোফা, ঝাঁপ, চঞ্চুপুট, আদ্ধা প্রভৃতি তাল।
ইংরেজ কর্তৃক কলকাতা শহরের পত্তনের পূর্ব পর্যন্ত কীর্তন গ্রামবাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে ছিল। অর্থনৈতিক কারণে গ্রামছাড়া মানুষ যখন কলকাতায় ভিড় জমাতে থাকে তখন তাদের সঙ্গে কীর্তন, পাঁচালি ইত্যাদি সঙ্গীতধারা কলকাতার নগরসমাজে প্রবেশ করে। ওই সময় কলকাতায় ঢপকীর্তন বেশ জনপ্রিয় ছিল। তবে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় সমগ্র বাংলাদেশেই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কীর্তনের শ্রোতৃজগৎ ছিল বিস্তৃত। পাকিস্তান আমলেও এদেশে গ্রামে গ্রামে কীর্তন গানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বর্তমানে এর প্রচলন সংকীর্ণ হলেও শ্রোতা আছে। আধুনিক বাংলা গানে অনেক সময় কীর্তনের মৌলিক সুর ও ভাব সংযোজনের প্রবণতাও দেখা যায়।
রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কীর্তন-অঙ্গের গানে ঢপকীর্তনের ভাব ও রীতির অনুসরণ দেখা যায়। ‘ওকে বলো সখী বলো, কেন মিছে করে ছলো’ মায়ার খেলার এই গানে মধুকানের স্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। মধুকান রাধা-কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে বহু পদ রচনা করেন এবং সেগুলি রাগ-রাগিণী সহযোগে গীত হতো।
কালীকীর্তন
কীর্তনের সুরশৈলীতে কীলী দেবীর বন্দনা করা হয়, একেই কালীকীর্তন বলা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এর অল্পবিস্তর প্রচলন আছে। কালী কীর্তন মূলত শাক্তপদাবলীর গীতিরূপ মাত্র। এতে শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবীর লীলা মাহাত্ম পায়। এই গানের জন্য দ্বিজরামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, নীলকণ্ঠ বিশেষ খ্যতি লাভ করেছিল।
কীর্তনে কলঙ্কভঞ্জন
অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর দিকে 'কলঙ্কভঞ্জন' নামে পালাকীর্তনে পৃথকভাবে একটি অধ্যায় ব্যবহৃত হতো। কৃষ্ণের সাথে প্রণয়, কলহ, মান-অভিমানের সূত্রে কলঙ্ক রটতে পারে, এই কলঙ্কমোচনের দায় গায়েন নিজেই গানে গানে মোচন করতেন। কখনো অতিরিক্ত কাহিনিও যুক্ত করতেন। কলঙ্কভঞ্জনের এই বিষয়টি অনেক সময় সেকালের কৃষ্ণবিষয়ক পালাগান বা কবি গানেও ব্যবহৃত হতো।
কীর্তন গানে নানা রাগ ও রস
কীর্তণে রাগাশ্রয়ী রূপ থাকলেও রাগরূপটি প্রাধান্য পায় না। মূলত কীর্তনে রাগের ছায়া বা কাঠামো পাওয়া যায় মাত্র। ওই কাঠামোর উপর ভিত্তি করে কীর্তনের মূল ভাবকে প্রকাশ করা হয়। কিছু বিশেষ রাগের উপর কীর্তন গান নিবদ্ধ হতে দেখা যায়। এই রাগগুলো হলো- তোড়ি, কামোদ, শ্রীরাগ, পাহাড়ী, পটমঞ্জরী ইত্যাদি। কীর্তনে ভাবের কারণে বিভিন্ন ভাবে প্রায় সকল স্বরই ব্যবহৃত হয়। সেক্ষেত্রে অধিকাংশ রাগের বিচারে কীর্তনের সুর অশুদ্ধ হতে পারে, কিন্তু রসের বিচারে তার মূল্য অনন্যসাধারণ। কীর্তনগুরুরা কীর্তনে ৬৪-রসের কথা বলে থাকেন। এই রস ফুটিয়ে তোলা হয়, সুরে নিবদ্ধ কথায় বা আখরে। কীর্তনের আসরে রস সৃষ্টির জন্য অনেক সময় দোহার-এর দল সঙ্গ দেয়।
কীর্তন রাগসঙ্গীত ধারার গান হলেও এতে রাগের ব্যবহার অনেকটা শিথিল, কারণ কীর্তন তার মূল ভাব, রূপ ও রসের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে হিন্দুস্থানি রাগ-রাগিণীর কঠিন বিধি-নিষেধ থেকে সব সময় ভিন্ন পথে অগ্রসর হয়েছে। তবে কীর্তন গানের একটি বিষয় লক্ষণীয় হলো যে, তা সাধারণত সম্পূর্ণ জাতিতে অর্থাৎ সাত স্বরে গীত হয়ে থাকে। ষাড়ব এবং ঔড়ব জাতির গান তুলনামূলকভাবে কম। কীর্তনে তোড়ী, কামোদ, শ্রীরাগ, পাহাড়ী, পটমঞ্জরী প্রভৃতি রাগ-রাগিণীর ব্যবহার ছাড়াও প্রাচীন রাগ-রাগিণীর পরিচয়ও পাওয়া যায়।
কীর্তন গানে নানা তাল
কীর্তন গানে ভারতীয় প্রাচীন তালের বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। দ্রুত, মধ্য ও বিলম্বিত এ তিন লয়েই তাল বাজানো হয়। কীর্তন উদ্গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব ও আভোগ অনুসারে রচিত, অর্থাৎ আধুনিক কালের সাঙ্গীতিক পরিভাষায় স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ এই চার কলিতে নিবদ্ধ। এর তাল বিভিন্ন ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়, যেমন তাল, ফাঁক, কাল, কোশী বা কুশী ও অর্ধতালী। কীর্তনে বিভিন্ন প্রকার তাল ব্যবহূত হয়, যেমন ছোট লোফা, বড় লোফা, রূপক, যতি, তেওট, দোঠুকী, মধ্যম দশকোশী, বড় দশকোশী, দাশপেড়ে, শশীশেখর, বীর বিক্রম ইত্যাদি। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে এ গানে আনদ্ধ ও ঘন বিশেষত শ্রীখোল এবং করতালের ব্যবহারই সমধিক।
কীর্তনের অঙ্গ
কীর্তন বিচিত্রভাবে শ্রোতাদের সামনে উপস্থাপিত করা হয়। উপস্থাপন বৈশিষ্ট্য হিসাবে কীর্তনের ভাবগুলোকে অঙ্গ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। কীর্তনগুরুরা কীর্তনের অঙ্গকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। এই ভাগগুলো হলো-
১. কথা : কীর্তনের বাণীকে সাধারণভাবে কথা বলা হয়। কথা হলো লীলা-কীর্তনের ভিত্তি। এই কারণে কথা-কে অনেক সময় মূল কীর্তন বলা হয়।
২. দোঁহা : কীর্তনের এই অঙ্গে কীর্তনের বিষয়কে আবৃত্তি করা হয়। এর ভিতর দিয়ে কীর্তনে বৈচিত্র্যতা প্রকাশ পায়। এবং দীর্ঘ সময় ধরে কীর্তন পরিবেশনের সময়, শ্রোতা একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পায়।
৩. আঁখর : কীর্তনের ভাবকে সহজভাবে সুর-তাল সহযোগে ব্যাখ্যা করার একটি প্রক্রিয়া। মূলত কীর্তনিয়া এই অঙ্গে তাঁর নিজের অভিমত ব্যাখ্যা সহযোগে জানিয়ে দেন। এর ভিতর দিয়ে কীর্তনীয়া তাঁর প্রতিভার প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ লাভ করেন।
৪. তুক : কীর্তনের কাব্যগীতি অংশ হলো তুক। এই অঙ্গে অনুপ্রাসযুক্ত, ছন্দোময়, অন্ত্যমিলযুক্ত পদ পরিবেষণ করা হয়।
৫. ছুট : কীর্তনের কোনো পদকে সম্পূর্ণ পরিবেশন না করে, ছোটো ছোটো ছন্দে লীলায়িত ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়। এই অঙ্গটির মধ্য দিয়ে কীর্তনীয়ার ব্যক্তি পারঙ্গমতা বিশেষভাবে ফুটে ওঠে।
এছাড়া একটি ঐচ্ছিক অঙ্গ কোনো কোনো কীর্তনের আসরে ঝুমুর নামক একটি অঙ্গ পরিবেশন করা হয়। এক্ষেত্রে ঝুমুরের চটুল ছন্দে, নেচে নেচে কীর্তন পরিবেশন করা হয়। সাধারণত এই অঙ্গ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে কীর্তন পালা শেষ করা হয়।
কীর্তনে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র
চৌদ্দ শতকের বৈষ্ণবকাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে মুরলী বা মোহনবাঁশি ছাড়াও করতাল ও মৃদঙ্গের কথা আছে; শেষের দুটিকে কৃষ্ণের নাচের তালবাদ্য বলা হয়েছে। ষোলো শতকে চৈতন্যদেবের প্রবর্তনায় কীর্তন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যার প্রধান বাদ্যযন্ত্র ছিল খোল, করতাল ও মন্দিরা।
কীর্তনে নৃত্য মাহাত্ম্য
পৌরাণিক যুগে, বাল্মীকি প্রণীত ‘রামায়ণ’-এর পৌরাণিক চরিত্র অপ্সরাগণ নৃত্য পরিবেশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ধারণা করা হয়, রাম এবং রাবণ উভয়ই নৃত্যে পারদর্শী ছিলেন। তবে রামায়ণে ‘নাটক’ এবং ‘নৃত্য’কে পৃথক করে দেখা হতো। ব্যাসবেদ সংকলিত ‘মহাভারত’-এ উল্লেখ্য ঘৃতাচি, মেনকা, রম্ভা, স্বয়ম্প্রভা, উর্বশী এবং মিশ্রকেশী ছিলেন অপ্সরা। তাদের ছিল নর্তনশালা। উক্ত গ্রন্থে আরও আলোচিত হয়েছে গায়ক, নৃত্যশিল্পী, বাদক, স্ত্ততি, দেবদুন্দুভি, শঙ্খ, বীণা, বেণু, মৃদঙ্গ, তাল ও লয় প্রসঙ্গ।
পরে জিনসেন হরিবংশ সংকলিত ‘হরিবংশ পুরাণ’-এ (আ.স. ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ‘রাস’, ‘ছালিক্য’ ও ‘আসারিত’ প্রভৃতির কথা বলা হয়েছে। উল্লিখিত ‘রাস’ মণিপুরী নৃত্যধারার অন্যতম প্রধান ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত।
চর্যাপদের কালেই (৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ) প্রাচীন বাংলার নৃত্য, গীত ও নাট্যের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে বাঙালির নৃত্যকলার কোনো লিখিত শাস্ত্র নেই। বাংলার নৃত্য ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, নৃত্যশৈলী, বিষয়-বৈভব, পরিবেশনারীতির বিস্তৃত প্রমাণ মেলে প্রচলিত বিভিন্ন উপাখ্যান, দেবদেবীর কৃত্যে, পীর-ফকিরদের আসরকেন্দ্রিক বর্ণনা ও গীত উপস্থাপনায়।
চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে, বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ ত্রয়োদশ খন্ডে বিভক্ত সুবৃহৎ আখ্যানকাব্য। রসাশ্রয়ী ও বর্ণনামূলক কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ধামালী এবং ঝুমুর গানের প্রভাব বিদ্যমান। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নাটগীতরূপে অভিনীত হওয়ার সময় বহু স্থানে নৃত্যের অবতারণা ঘটে। কৃত্তিবাস (১৩৯৮-১৪০০) কৃত ‘রামায়ণ’ ও মালাধর বসু (১৪৩৭-১৪৮০) প্রণীত ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’-এ ‘দরবারি নৃত্য’র কথা জানা যায়। যেখানে সুনির্দিষ্টভাবে ধ্রুপদ অর্থাৎ ধুয়ার ব্যবহার হত। শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে ‘রামায়ণ নাটের’ নানা কাহিনী নৃত্যনাট্যরূপে পরিবেশনের বিবরণ রয়েছে। রামায়ণ নাট্যে আঙ্গিক, বাচিক, সাত্ত্বিক এবং আহার্য অভিনয়ের বর্ণনা ছাড়াও ‘ভদ্রনাট’ নামে এক নৃত্য বিশারদের নাম পাওয়া যায়।
জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে প্রণীত। জয়ানন্দ কীর্তনকেন্দ্রিক নৃত্যকে বলেছেন ‘সংকীর্তন নাচ’। লোচনদাশের ‘শ্রী চৈতন্যমঙ্গল’-এ ‘রুক্মিনী নৃত্য’ যা প্রকারান্তরে গোপীকা নৃত্য’র বিবরণ রয়েছে। চৈতন্যদেবের কালে ‘জলনাট্য’ বা নৃত্যের প্রচলন ছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে , উনিশ শতকে, পূর্ববঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলের পাশাপাশি ঢাকার জনপ্রিয় নাট্যগীতি ছিল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। ধনী বৈষ্ণব কীর্তনওয়ালী আনান। সম্ভ্রান্ত ধনীদের আসর জমতো বাইজি নাচে। ওই সময় ডঙ্ক কীর্তন বা বাইজির হাবভাবের সঙ্গে কীর্তন গানের প্রচলন ছিল। তৎকালীন বাংলাদেশে হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রীকৃষ্ণের জন্ম-অষ্টমীর মিছিলে এবং অনুষ্ঠানে ভক্তরা নৃত্য পরিবেশন করতো।
কীর্তনে নৃত্যের মৌলিক কোন প্রভাব সরাসরি না থাকলেও ভারতীয় নৃত্যে কীর্তন গানের প্রভাব অবশ্যই রয়েছে । বিশেষ করে মনিপুরী নৃত্য তথা রাস নৃত্যে এর গুরুত্ব অপরিসীম ।
রাস নৃত্য বা রাস নৃত্যনাট্যের কুশীলব হচ্ছেন কৃষ্ণ, রাধা ও রাধার দ্বাদশ গোপীসখী। প্রথম নর্তক কৃষ্ণ নৃত্যস্থলে প্রবেশ করে দ্রুত পায়ের কাজ করে নাচেন। হঠাৎ রাধা আসতেই তিনি নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন। এই অংশ কৃষ্ণ-অভিসার নামে অভিহিত। তারপর রাধারূপী নর্তকী নৃত্যস্থলে প্রবেশ করে কৃষ্ণকে খুঁজতে থাকেন। এই হলো রাধা-অভিসার। এরপর গোপী বৃন্দার আগমন। নৃত্য ও অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি রাধা ও কৃষ্ণের মিলনের আহ্বান জানান। রাধা ও কৃষ্ণের মিলন ঘটলে গোপীরূপী নর্তকীদের সবাই নৃত্যস্থলে প্রবেশ করেন। রাধা, কৃষ্ণ ও গোপীরা সবাই মিলে সম্মেলক রাস নৃত্য পরিবেশন করেন। এই সম্মেলক নৃত্য কুরুম্বা পেরেঙে নামে অভিহিত। রাধা ও কৃষ্ণকে মাঝখানে রেখে গোপীরা পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে বৃত্তাকারে নৃত্য করেন। দ্রুতলয়ে সমবেত কণ্ঠে গান গাওয়া হয় ও করতাল বাজানো হয়। পরে গোপীদের প্রার্থনামূলক নৃত্য। তারপর আবির খেলা। রাত শেষে কৃষ্ণের আরতি সহযোগে নৃত্য সমাপ্ত হয়। নৃত্যশিল্পীরা প্রদীপ নিয়ে নৃত্য করেন ও শ্রোতা-দর্শকেরা দীপশিখা থেকে হাত বাড়িয়ে তাপ নেন। রাস নৃত্য কুরুম্বা বা নমস্কার জানিয়ে শঙ্খ বাজিয়ে সমাপ্ত করা হয়।
কীর্তন সঙ্গীতে ভক্তের ভাব রসই প্রধান । ভক্তের ভাবের উচ্ছ্বাসের মাত্রার চূড়ান্ত রূপ হল এক কথায় কীর্তন নৃত্য । এপ্রসঙ্গে নিম্নের দুটি গ্রন্থের বক্তব্য তুলে ধরা হল –
শ্রীহরিভক্তিসুধোদয় গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে-
বহুধোত্সার্যতে হর্ষাত্ বিষ্ণুভক্তস্য নৃত্যতঃ ।
পদ্ভ্যাং ভূমোর্দিশোহক্ষিভ্যাং দোর্ভ্যাং বামঙ্গলং দিবঃ ।।
অর্থাৎ , ”ভগবদভক্ত যখন উত্ফুল্ল হয়ে নৃত্য করেন তখন তাঁর চরণ দ্বারা ধরণীর অমঙ্গল নষ্ট হয় ।”
হরি ভক্তি বিলাস ৮/১২৮ শ্লোক
আবার, শ্রীদ্বারকা মাহাত্ম্য শাস্ত্রে বলা হয়েছে-
যো নৃত্যতি প্রহৃষ্টাত্মা ভাবৈর্বহুসুভক্তিতঃ ।
স নির্দহতি পাপানি জন্মন্তরশতেষুপি ।।
অর্থাৎ , ”যিনি প্রফুল্ল মনে পরম ভক্তি সহকারে সযত্নে সমধিক নৃত্য করেন, তাঁর শত শত জন্মের পাতক ভস্মীভূত হয় ।”
উক্ত দুটি শ্লোকে কীর্তন সঙ্গীতে নৃত্যের মাহাত্ম্য সম্পর্কে সুন্দর ভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ।
উক্ত শ্লোক দুটি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে , কেবলমাত্র চিত্তের গ্লানি মুক্তির বিশুদ্ধ রূপের প্রতিফলন হল কীর্তন নৃত্যের মৌলিকতা এবং তাৎপর্য । সুতরাং এই নৃত্যে ভারতের অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যের মত কোন ব্যাকরণ নেই ।
লেখক পরিচিতি :- ৩১ অক্টোবর ১৯৭৭ সালে শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুরে জন্ম , পড়াশুনা ও বড় হয়ে ওঠা । কবিতা দিয়ে সূচনা সাহিত্য জীবন , তারপর শিশু কিশোর এবং রূপকথার গল্প দিয়ে ভারত ও ভারতের বাইরের দেশে নানা পত্র পত্রিকায় লেখা । ২০১৪ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ " প্রেম ও কিছু কথা " আত্মপ্রকাশ । ২০১৭ সালে " কাব্য প্রভাকর " এবং " কাব্য ভারতী " উপাধী লাভ । ভালোবেসে লেখা শুধু লক্ষ্য ॥
লেখক পরিচিতি :- ৩১ অক্টোবর ১৯৭৭ সালে শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুরে জন্ম , পড়াশুনা ও বড় হয়ে ওঠা । কবিতা দিয়ে সূচনা সাহিত্য জীবন , তারপর শিশু কিশোর এবং রূপকথার গল্প দিয়ে ভারত ও ভারতের বাইরের দেশে নানা পত্র পত্রিকায় লেখা । ২০১৪ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ " প্রেম ও কিছু কথা " আত্মপ্রকাশ । ২০১৭ সালে " কাব্য প্রভাকর " এবং " কাব্য ভারতী " উপাধী লাভ । ভালোবেসে লেখা শুধু লক্ষ্য ॥
সুচিন্তিত মতামত দিন